প্রেমসাগরের_উত্তাল_ঢেউ পর্ব ১

নিজের প্রাক্তন হবু স্বামির বিয়ের কার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচী। কালো রঙের হার্ডবোর্ডের উপরে সোনালী রঙের কালী দিয়ে বড় বড় করে লিখা,
“Wedding Invitation”
সব কিছুই ঠিক আছে কার্ডে। শুধু কনের নামের জায়গাটা ছাড়া। সে কার্ডটা বুক ভরা কষ্ট নিয়ে খুলল। কনের নামের জায়গায় লিখা “আরোহি আফনান”। যেটা প্রাচীর নিজের চাচাতো বোন। সেখানে একবার হাত বুলিয়ে এক ফোটা চোখের জল ফেলল প্রাচী৷
অপরদিকে আরোহি খুশি মনে কার্ডটা বাসায় দিয়ে চলে গেলো। তার মনে লাড্ডু ফুটছে। কতোদিন পর প্রাচীকে সে হারাতে পারলো। আর এমন ভাবে হারিয়েছে যে এই কষ্ট ভোলা প্রাচীর জন্য অনেক কঠিন। গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে আরোহি প্রাচীর বাসা ত্যাগ করলো।

____________________

প্রাচী ড্রয়িংরুমে বসে আছে। সাথে আছে মিসেস লারা(প্রাচীর মা), মিস্টার ইজাজ(প্রাচীর বাবা) আর প্রহর(প্রাচীর বড় বোন)।
কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই বোবা বনে গিয়েছে। বিশেষ করে মিস্টার ইজাজ মেয়ের দিকে তাকাতে পারছেন না।
সবাইকে চুপ থাকতে দেখে প্রহর বলল,

” মা? বাবা? তোমরা কি কিছুই বলবে না?”

প্রহরের কথার কোনো উত্তর কারো কাছ থেকে আসে না। প্রহর আবারও বলে,

“শুনে রাখো,আরোহিদের সাথে কোনো রকম সম্পর্ক আমরা রাখতে পারবো না। অন্তত আমি না! আমার বোনটাকে দেখেছো? কি হাল হয়েছে ওর?”

প্রহরের কথা শেষ হতেই প্রাচী বলে,

“ছাড় আপুনি। জানিস তো সম্পর্ক ছিন্ন করা পাপ। তাছাড়া আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি। আর মনকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।”

প্রহর তখন বলে,

~”হুম কতো সামলেছিস নিজেকে তা জানি। কিছুক্ষণ আগে যে চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ঘুরছিলি? তখন কোথায় ছিল তোর নিয়ন্ত্রিত মন?”

প্রাচীর কাছে এর কোনো উত্তর নেই। আসলেই সে নিজেকে সামলে উঠতে পারে নি। প্রহরকে থামাতে সে মিথ্যা বলেছে। কিন্তু বোন যে তাকে সেই ছোট্ট থেকে কোলে পিঠে মানুষ করেছে। তার সবকিছুই বোনের জানা। তার কাছ থেকে কিছুই লুকাতে পারে না। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।

প্রাচীর এইমুহূর্তে প্রচুর কান্না পাচ্ছে। তাই সে ড্রয়িংরুম থেকে দৌড়ে শিড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে আসে। দরজাটা কোনো রকমে আটকিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। মনের সব কষ্ট নোনা জল হয়ে নয়ন বেয়ে গড়িয়ে পরছে। কিন্তু কষ্ট কিছুতেই কমাতে পারছে না। তার শুধু সেই বিভিষীকাময় দিনটার কথাই মনে পরছে যেদিন আয়ুস তার সাথে বেইমানি করে ভুল বুঝে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছিল। প্রচুর ভালোবাসতো প্রাচী। আর তার বদলে পেয়েছে অপমান, ঘৃণা, আর একবুক কষ্ট।
কান্না করতে করতে একসময় তার চোখের পানিও শেষ হয়ে যায়। দ্রুত ওয়াসরুমে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে আসে। বেশি কান্না করার কারনে চোখ লাল রঙ ধারন করেছে।
ওয়াসরুম থেকে বাইরে এসে মুখ মুছছিল তখনই দরজায় কড়া নারে প্রহর।
বাইরে থেকে সে বলে,

“প্রাচী দরজা খোল।”

প্রাচী টাওয়ালটা সোফায় রেখে দরজা খুলে দেয়। প্রহর ভিতরে চলে আসে। প্রাচী নিজের চোখ নামিয়ে রাখছে যাতে করে লাল আভাটা দেখতে না পায়। প্রহর ভ্রু কুচকে বলে,

“তুই এমন চোখ নামিয়ে রাখছিস কেন?”

প্রাচী ভাঙা কণ্ঠে বলে,
“এমনি আপুনি। তেমন কোনো কারন নেই।”

প্রহর বুঝতে পারে প্রাচী কান্না করছিল। সে প্রাচীকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“শোন আমি তোর বোন। আর জানিস? মায়ের পরে সবথেকে কাছের হয় বোন। তুই আমার কাছ থেকে নিজের কান্না লুকিয়ে রাখতে পারিস নি কোনোদিন। আর পারবিও না। আমি জানি তুই অনেক কষ্টে আছিস। আর এই কষ্ট যে পায় সেই বোঝে। কিন্তু সবসময় তো আর টাইম খারাপ যায় না! আঁধারের পরেই আলো আসে। তেমন করে এভাবে পরে থাকলে তো হবে না! তোকে ভালো থাকা শিখতে হবে।”

প্রাচী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। প্রহরকে জরিয়ে ধরে কান্না করে দিল।

“আপুনি আমি যে পারছি না। কিছুতেই আয়ুসকে ভুলতে পারছি না আমি। বার বার শুধু ওর দেয়া অপবাদগুলো মনে আসে। বিশ্বাস করো নিজের প্রতি রাগ হয়। শেষে কিনা এমন একজনকে ভালোবাসলাম যে আরেকজনের কথা শুনে আমাকে অপবাদ দেয়! যখন নিজের বোকামির কথা মনে আসে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করে!”

প্রহর প্রাচীর শেষ কথাটা শুনে বেজায় রাগ হলো। প্রাচীকে নিজের বুক থেকে তুলে চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল,

“আমার হাতে মার খাবি যদি আরেকবার নিজের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করিস। তুই একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এসব কি বলিস হুম? আর যেন না শুনি।”

প্রাচী নিচু কণ্ঠে বলে,

“আচ্ছা সরি! আর বলবো না।”

প্রহর~”হুম। আচ্ছা শোন আমাকে আজ নিতে আসবে তোর ভাইয়া।”

প্রাচী~”সে কি? আজই চলে যাবে?”

প্রহর দাঁড়িয়ে পরে। টেবিল থেকে টিস্যু এনে প্রাচীর হাতে দিয়ে বলে,

“হুম। আজকেই যেতে হবে। আর এই নে টিস্যু। চোখ মুছে নে।”

প্রাচী টিস্যুটা নিয়ে নিজের চোখ মুছে নিল। তখনই মিসেস লারা দরজায় নক করে বলল,

“আসবো?”

প্রাচী তাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

“মা। আসো।”

মিসেস লারা ভিতরে আসেন। প্রাচীকে বলেন,

“মা প্রাচী,আমাদের জন্য আজ তোর এই অবস্থা! ভুল মানুষকে বেছেছিলাম তোর জন্য। আমরা সত্যি বুঝতে পারি নি যে এমন কিছু হবে!”

প্রহর বলে,

“মা তোমরা কি ওদের কথা বাদ দিতে পারছো না? আমি সেই সকালে এসেছি। এই দুপুর হয়ে গেল। এখনো তোমাদের টপিক বদলায় নি? যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। বরং কিছু মানুষের আসল চেহারা দেখতে পেলাম। এখন এটা বাদ দাও।”

মিসেস লারা কিছু বলার আগে সেখানে ইজাজ গিয়ে উপস্থিত হন। তিনি চুপচাপ প্রাচীর হাত ধরে নিচে নিয়ে আসেন। প্রাচী সহ সবাই অবাক। প্রাচী কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে যে কি হয়েছে। কিন্তু ইজাজ কোনো উত্তর দেন নি। নিচে আসতেই প্রাচী দেখলো খাবার টেবিলে সব সাজানো। মিস্টার ইজাজ এতসময় গম্ভীর থাকলেও এখন হেসে বললেন,

“দেখ তো মা, খাবার গুলো কেমন হয়েছে?”

প্রাচী বেশ অবাক হলো। এই কিছুক্ষণ আগেই তো কিছুই ছিল না! এখন কিভাবে আসলো? প্রাচী মিস্টার ইজাজকে জিজ্ঞেস করে,

“বাবা? এসব কখন করলে?”

মিস্টার ইজাজ হাসি বজায় রেখে বললেন,

“শহরে একটা নতুন রেস্টুরেন্ট বানানো হয়েছে। সেখান থেকেই আনিয়েছি। এখন চল খেতে হবে তো।”

ইতিমধ্যে মিসেস লারা আর প্রহর চলে এসেছে। তারাও জানতো না এসব। তাই অবাক হয়েছে। সবাই মিলে খাওয়া শুরু করলো। মিস্টার ইজাজ প্রহরকে বললেন,

“কিরে প্রহর? ফারহান(প্রহরের স্বামি) কি আজই আসবে?”
প্রহর~”হুম বাবা আজকেই আসবে। সন্ধ্যার পরেই আসবে মনে হয়। আমাকে সেটাই বলেছে।”

মিসেস লারা~”আজই কি চলে যাবি? কয়েকটা দিন থাক!”

প্রাচী~”আমিও সেটাই বলছি! থাকলে কি এমন হয়?”

প্রহর~”সেটা তোমার জামাইকে জিজ্ঞেস করো!”

মিস্টার ইজাজ~”ওকে আর কি জিজ্ঞেস করবো? আমাকে এতো ভয় পায়!”

সবাই হেসে দিল। আসলে ফারহান মিস্টার ইজাজকে একটু ভয় পায়। সে খুবই রাগী মানুষ। তবে বেশ মিশুক। ফারহান ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। প্রহরকে বেশ কেয়ার করে। তাদের বিয়ে হয়েছে বেশি দিন না। এই এক বছর পার হলো।

_____________________
বিকালে,,,,,,,

মিসেস লারা ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন প্রহরকে নিয়ে। বিভিন্ন কথা বলছিলেন তারা। হঠাৎ কলিংবেক বেজে উঠলো। মিসেস লারা ওঠার আগেই রাইমা(সার্ভেন্ট) গিয়ে দরজা খুলে দিল।
দুজন মানুষ ভিতরে ঢুকলো। মিসেস লারা তাদের দেখে পুরো অবাক। প্রহর রাগ কন্ট্রোল করে চুপ করে আছে। মিসেস লারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রাচী সেখানে আসলো। সে ওই দুজনকে খেয়াল করে নি। মিসেস লারাকে প্রাচী বলল,

“মা আমার ফোনটা পাচ্ছি না। কোথায় বলতে পারো?”

এই কথা বলার পরেই তার চোখ পরে ওই দুজনের উপর। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,,,,,,

#প্রেমসাগরের_উত্তাল_ঢেউ
লেখিকা-লাবিবা নুসরত
||পর্ব-১||
(আসসালামু আলাইকুম। গল্পের প্রথম পর্ব পরেই কেউ থিম সাজিয়ে নিবেন না প্লিজ। সামনে আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন। হ্যাপি রিডিং।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here