#মায়াবিনী_মানবী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৩
নারীর ষষ্ঠেন্দ্রীয় নাকি তুমুল প্রখর হয়। তবে সব নারীর বেলায় কি এমন হয়?হয়তো বা হয়।জুইঁর ষষ্ঠেন্দ্রীয়ও আজ কিছু একটা ঠাহর করতে পারছে।কোন ছেলে কখনো এমনি এমনি প্রেম করবে বলবে না। এমনি এমনি একটা মেয়েকে ফোন কিনে দিয়ে বলবে না তার সাথে কথা বলতে হবে।আবার এমনি এমনি ই শাড়ি চুড়ি গিফ্ট করবে না।
তখন আলআবির রুমে আলআবির শেষ কথার পরেই হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজে আলআবি জুইঁ কে একটা কথা ও বলতে না দিয়ে ফোনটা জুইঁর হাতে গুঁজে দেয় আর বলে…
–এটা নিয়ে আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।কথা বলতে হলে শুধু আমার সাথে ই কথা বলবে আর প্রেম করতে ইচ্ছে হলে সেটাও আমার সাথে ই করবে।
আলআবি তার কথা শেষ করে ই দ্রুতপায়ে বেলকনিতে চলে গেল।আলআবির প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে ই লিপি রুমে প্রবেশ করে। লিপি কে দেখে জুইঁ ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি টেনে আনে। লিপি জুইঁ কে আলআবির রুমে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল…
–জুইঁ একলা একলা কি করো এইহানে।
জুইঁ লিপির প্রশ্নে কিছু টা ঘাবড়ে গেল।আলআবির সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়েছে এটা এবাড়ির সবাই ই জানে।তবে জুইঁ যে কখনো আলআবির রুমের দিকে পা বাড়ায় না সেটাও সকলে জানে।
জুইঁ চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বেনজিকে দেখে বলে উঠলো…
–আসলে চলে যাব তো কিছুক্ষণ পরেই তাই বেনজিকে একটু আদর করে যেতে এসেছি।
লিপির সামনেই বেনজির গায়ে জুইঁ হাত বুলাতে লাগল। এতক্ষণে বেনজিও উঠে গিয়েছে।লিপি জুইঁ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো…
–তোমারে রেডি হইতে কইছে খালায়।তোমার রুমে গিয়া তো তোমারে পাই নাই এদিক দিয়া যাওনের সময়ই তোমারে চোখে পড়ল।এহন তাইলে যাও যাইয়া রেডি হও।
জুইঁ কিছু একটা ভেবে লিপিকে বলল…
–আচ্ছা আপনার কাছে কি কালো রঙের ব্লাউজ হবে?
লিপি দ্রুত মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল…
–হ!হ! আছে তো কি করবা?
জুইঁ লাজুক এক হাসি দিয়ে বলল…
–শাড়ি পড়ব।একটু পড়িয়ে দিবেন?
–আইচ্ছা আইচ্ছা দিমুনি। (লিপি)
এরপর ই দুজন আলআবির রুম থেকে বাইরে বেড়িয়ে আসে। ওপাশে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা আলআবির তৃপ্ত হাসির সে আর সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ সাক্ষী রইল না।
বর্তমানে শুভ্র বর্ণের সেই শাড়ি পড়ে কালো বর্ণের হিজাব পড়তে ব্যস্ত এক রমনী।চোখে তার ঠাঁই পেয়েছে চিকন কাজল রেখা।এছাড়া মুখমন্ডলে নেই কোন সাজসজ্জার সরঞ্জামের ছোঁয়া। এই রমনীই যে জুইঁ তা বোঝা বড় দায়।কারণ এই শাড়ি নাকি ক্ষনিকের মধ্যেই কিশোরী থেকে যুবতীতে পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা বহন করে বেড়ায়।তেমনি জুইঁ কেও এই শাড়ি পরিণত করেছে আজ এক যুবতী রমনীতে।
ঘড়ির কাঁটা বলে দিচ্ছে সময় এখন রাত ৯টা বেজে ৩০ মিনিট। ড্রইংরুমে মিসেস পারভীন, সিরাজ সাহেব আর তাদের ছেলে আলআবি অপেক্ষায় আছে জুইঁর।অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চুড়ি পরিহিত হাতে শাড়ির কুঁচি ধরে সন্তপর্ণে নেমে আসে জুইঁ।এই রমনীকে দেখেই আলআবি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে…
–মাশাল্লাহ!তোতাপাখি আল্লাহ তোমাকে সর্বদাই এমন ভাবে রাখুক।
নিচে নামতেই মিসেস পারভীন জুইঁ আর লিপি একধাপ প্রসংশা করলেন।সকলে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে জুইঁর ঠিক পিছনেই আলআবি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি তে ব্যাগপত্র ওঠানো হচ্ছে।
হুট করে জুইঁ টের পায় আলআবি জুইঁর কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগের চেন খুলে কিছু করছে।জুইঁ পিছনে ফিরতেই আলআবি ফিসফিসে আওয়াজে বলে উঠলো…
–চিন্তা করো না কিছু চুরি করছি না।বাড়ি গিয়ে দেখে নিও।আর না দেখলেও চলবে তিনদিন পরতো আমি নিজেই যাচ্ছি যশোর।
জুইঁ পিছনে আলআবির দিকে কিছু টা ঝুঁকে আলআবির ফিসফিসে কন্ঠের ন্যায় ই বলল…
–আবার কি দিয়েছেন। এমনিই টেনশনে বারবার গলা শুকিয়ে আসছে।বাবা যদি একবার জানতে পারে আমার কাছে ফোন আছে তাহলে সেদিনই বাড়ি থেকে বের করে দিবে।
আলআবি দুষ্টুমি ভরাট করা কন্ঠে বলে উঠলো…
–তাহলে তো ভালই।আমার রুমে গিয়ে বসবাস শুরু করে দিও।আগে থেকেই প্র্যাকটিজ হয়ে যাবে।
জুইঁ আলআবির এ কথার সত্যি ই কোন মানে খুঁজে পেল না।মিসেস পারভীন এর ডাক পরলো তখন।জুইঁ আলআবির পানে চেয়ে স্নিগ্ধতা মাখা এক হাসি ছড়িয়ে দিয়ে আলআবি কে বলল…
–আসি।ভালো থাকবেন। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।
আলআবি সকলের অগোচরে জুইঁর হাত শক্ত করে ধরে বলল…
–সাবধানে যাবে।প্রতিদিন কিন্তু আমার সাথে কথা বলবে।
আলআবি আর কিছু বলল না।জুইঁর হাতটা ছাড়তে মোটেও ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে না তার
#মায়াবিনী_মানবীকে ছাড়তে।জুইঁ নিজের হাত টা কিছু টা জোর করে ই ছাড়িয়ে নিল আলআবির থেকে।
নিজেকে জুইঁর এ মুহূর্তে নিশাচর প্রানী বলে অ্যাখায়িত করতে ইচ্ছে করছে। রাতের হাইওয়ে দিয়ে তাদের গাড়ি টা দ্রুতবেগে ছুটে চলছে। গাড়ি তে রয়েছে মোট চারজন মানুষ। জুইঁ, মিসেস পারভীন, সিরাজ সাহেব আর ড্রাইভার।জুইঁর পাশে মিসেস পারভীন বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন।সামনের সিটে বসা সিরাজ সাহেব এরও একি অবস্থা। জুইঁ হাতে হাত ঘড়ির অভাবে সময় দেখতে পারছে না।মধ্য বয়সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো…
–আঙ্কেল কয়টা বাজে বলতে পারবেন?
গাড়ি চালাতে চালাতে উনি বললেন…
–এই রাত একটার কাছাকাছি হবে।
দুজনের কথায় সিরাজ সাহেব এর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো।তিনি আড়মোড় ভেঙে ড্রাইভার আশরাফুল কে বললেন…
–আশরাফ গাড়ি টা সামনের কোন চায়ের দোকানের সামনে রেখো একটু। তুমি অনেক সময় ড্রাইভ করেছ।একটু চা খেলে ভালো হবে।
আশরাফুল সিরাজ সাহেব এর কথা মতো প্রায় দশ থেকে পনেরো মিনিট পরে একটা ছোট খাটো চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করলো।মিসেস পারভীনেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছে।মিসেস পারভীন জুইঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন…
–জুইঁ নেমে একটু হাটাহাটি কর।চা ও খেতে পারিস।
জুইঁ দ্রুত বলে উঠলো…
–না না। এখন নামবো না।তোমরা যাও।এভাবেই ভালো লাগছে।
মিসেস পারভীন এর সঙ্গে জুইঁ আর গাড়ি থেকে নামেনি।জুইঁ বাদে বাকি তিনজন গাড়ির পাশের চায়ের দোচালা দোকান টায় বসে পড়েছে। জুইঁ আগ্রহ কে দমিয়ে রাখতে না পেরে দ্রুত ব্যাগের চেন খুলে আলআবি কি দিয়েছে তা খুঁজত লাগে।ব্যাগ খুঁজে ছোট একটা ব্যাগ আর টেপরেকর্ডার পেল।ব্যাগটা থেকে একটা সিমকার্ড বেরিয়ে এলো।আলআবির সিমকার্ড দেয়ার উদ্দেশ্য ঠিক বুঝতে পেরে আনমনে হেঁসে উঠলো। হাতের টেপরেকর্ডার টা অন করতেই ওপাশ থেকে আলআবির সুদৃঢ় কন্ঠের আভাস পেল। জুইঁ গভীর মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলো।
“এই রেকর্ড টা আমার মায়াবিনীর জন্য। আশা করি আমার কাঙ্ক্ষিত মানুষ টাই কথা গুলো শুনছে। আজ তোমাকে আমার মায়াবিনীর গল্প শুনাবো। আমার মায়াবিনীর সঙ্গে দেখা হয়েছে আজ থেকে আরও দশদিন আগে।দশ দিনেই যে কারো মায়ায় জড়ানো যায় তা হয়তো আমার মায়াবিনী আমার জীবনে না আসলে বুঝতে ই পারতাম না। তোমাকে একটা সিক্রেট বলি শোন-যেদিন আমি জীবনে প্রথম ড্রিংক করেছিলাম সেদিন ই তোমার সঙ্গে আমার দেখা। আরেকটা সিক্রেট কি জানো?আমি সেদিন মাতাল হলেও পরেরদিন ঠিকই আমার সব কিছু মনে পরে যায়।সকালে টেবিলে নাস্তা করার সময় বুঝতে পারি আমার বাসায় একটা #মায়াবিনী_মানবী এসেছে। তার একটু একটু করে খাবার মুখে দেয়া দেখে মনে হয়েছিল ওই নরম হাতে একদিন আমিও খাবার খাবো।সেদিন তার জন্য আমার জীবনের পুরো দু’বছর এর রুটিন এক নিমিষেই পাল্টে যায়।আমার কাজে আমি নিজেও অবাক ছিলাম।আমার মায়াবিনীকে খুব সহজেই বোকা বানানো যায়।বেনজিকে দেখে যখন ভয়ে শিটিয়ে যেত তখন ভয়ার্ত চেহারার মায়াবিনীকে দেখে প্রতিবারই বিমোহিত হতাম।সেদিন ছাঁদে যখন মায়াবিনীকে বলি আমার চোখে চোখ রাখতে তখন বোকা মেয়েটা মুহূর্তে ই হ্যাঁ বলে দেয়।তখন তার চোখে তাকিয়ে ভয়ংকর এক কান্ড বাঁধিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করেছিল। মনে হয়েছিল ওই চোখজোড়ায় নিজের অধর দুটো খুব জোড়ে চেপে ধরি।আমার মায়াবিনী প্রতিবারই যখন কফির মগে চুমুক ফেলত ততবারই মনে হতো একদিন কফির মগের জায়গায় আমার অধর থাকবে।একদিন ওই একই মগে দুজনের চুমুক থাকবে।ধীরে ধীরে #মায়াবিনী_মানবীর মায়া আমাকে তীব্র থেকে তীব্র ভাবে গ্রাস করে ফেলল।মায়াবিনীকে এখনো সামনা সামনি অনেক কথা বলা বাকি।এখনো তার বাড়ি গিয়ে তাকে পাওয়ার প্রস্তাব দেয়া বাকি।তাকে বধুরূপে দেখা এখনো বাকি।এখনো বাসর ঘরে তাকে অপেক্ষা করানো বাকি।এখনো তার সাথে দু’রাকাআত নামাজ পড়া বাকি।রাতভর একই রুমে আবদ্ধ থেকে তার কোলে মাথা রেখে ছোট ছোট পুঁচকোদের গল্প করবো তার সাথে। প্রতিভোরবেলা উঠে তার লজ্জায় রাঙা মুখ টা কে দেখা এখনো বাকি। এখনো তার ভিজে চুলের পানির ঝাপটায় ঘুম ভাঙ্গা বাকি।ইনশাআল্লাহ একদিন এইসব ইচ্ছে ই পূরণ হবে।শুধু জানতে চাই মায়াবিনী করবে কি পূরণ আমার এই বাকি থাকা ইচ্ছে গুলো?”
আসছি তিন দিন পর।তোমাকে পবিত্র রূপে আমার করে নিতে। ভালো থেকো।”
রেকর্ড টা এখানেই শেষ হয়।জুইঁর চোখে পানি ছলছল করছে।রেকর্ডার টা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বুকে।অনবরত বলতে লাগলো…
–করব।আপনার প্রত্যেকটা ইচ্ছে পূরণ করব। অবশ্যই করব।
হঠাৎ বিকট এক শব্দ এসে জুইঁকে অসহনীয় যন্ত্রণার মুখোমুখি ফেলল।বুকে তার মৃত্যুসম ব্যাথার অনুভূতি অনুভব হলো।
পরের দিন সকালে,
চলবে………….
[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক।গল্পের সকল প্রকার চরিত্র, উক্তি কাল্পনিক।অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]