#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭
মেসেজটা ওপেন করতেই যেন বুকের ভেতর তুমুল আবেগের বর্ষণ উঠা নামা করে থুপ করে থেমে গেল।
“পাবানার একটা টিকেট কেটে রাখব। আজকে এসে দিয়ে যাব তোমায়। তোমাকে উত্তর খুঁজতে সেখানেই যেতে হবে। তোমার মাথায় যে তারটা একটু ঢিলা হয়ে গেছে সেটা অচিরেই ছুটে যাবে। ছুটার আগে চিকিৎসা দরকার। আমি তোমার প্রেমিক হয়ে এ বড় দায়িত্ব টা নিজের কাঁধে নিলাম। তোমার বাবা,মা কে বুঝানোর দায়িত্ব আমার। ওকে সিঁথি রাণী।”
মেসেজটা পড়ে স্তব্ধ অসাড় হয়ে বসে রইলাম। মনে হচ্ছিল আমি কোনো পাথরের মূর্তি। এরকম একটা উত্তর আশা করিনি। মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গেল। কল দিলাম ওকে। কলটা ধরতেই আমার রাগের বহমান নদী ঢেউয়ের মতো উল্টে গিয়ে সে জায়গা দখল করে নিয়েছে আবেগের নদী। রাগ যেন নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে তার মধুমিশ্রিত সুরের ছন্দাসিক্ত কন্ঠে। রাগটাকে দমিয়ে নিয়ে নীরব গলায় বললাম
– কী করো?
উহুম উহুম। শব্দ গুলো কানে আসতেই যেন মনে হলো কোনো সুরশলাকার তার টেনে তা ছেড়ে দিয়েছে আর সেটার প্রতিধ্বনি এখনও আমার কানে বাজছে। আমি পুনরায় বলে উঠলাম
– এমন করছো কেন? কী হয়েছে? আর কী করো?
– আমি যা করি এটা বললে তো রেগে যাবে তাই বলব না।
কথাটা শুনতেই মনে হলো সে কী কোনো মেয়ের সাথে নাকি। বেসামামাল কর্কশ গলায় বলে উঠলাম
– কোন মেয়ের সাথে আছো বলো। এত চারিত্রিক সমস্যা তোমার। তোমাকে কত ভালো ভেবেছিলাম আমি আর সে তুমি কী না…..
– স্বাদে কী আর তোমায় পাগল বলি, মেয়ে? সিগারেট খাচ্ছিলাম তাই এ কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম না। সবসময় এক স্টেপ আগে বুঝো। তোমার বাবা, মাকে জানানো উচিত যে তোমার কিছু সমস্যা রয়েছে।
এ তো দেখি রিতীমতো ব্লেকমেইল করা শুরু করেছে। আমিও কী ভয় পাবার পাত্রী নাকি। যুদ্ধের ময়দানে যখন নেমেছি তখন এত সহজে হাল ছাড়লে তো হবে না। দাদীর মুখে এক অপরূপ রমণী চন্দ্রাবতীর কথা শুনেছিলাম, যে ছিল এক সুসজ্জিত রাজ্যের রাণী। পুরো রাজ্যের দায় ছিল তার হাতে। সে নিজের ভালোবাসা পাবার জন্য ধন দৌলতে ভরপুর রাজ্য ত্যাগ করে বনবাসে গিয়েছিল। এক যুগ পর নিজের ভালোবাসার মানুষকে সে আপন করে পেয়েছিল। এ যুগে হয়তো ভালোবাসার জন্য বনবাসে যাওয়া সম্ভব না তবে তাকে আপন করে পাবার জন্য কিছু বুদ্ধির সমাবেশ ঘটিয়ে তা দিয়ে আন্দোলন অভ্যহত রাখতে হবে। তাই আমি বেশ চটপটে গলায় বললাম
– তুমি কী আমাকে ব্লেকমেইল করছো এসব বলে? আমাকে কী তোমার বোকা মনে হয়? জীবনে কত আকাম করেছি। মা,বাবা টের পায় নি। আর আসছো আজকে এসব বলে আমাকে বিপদে ফেলতে। কোনো লাভ নেই। এসব বললে উল্টা তোমাকে আমি নাকানি চুবানি খাওয়াব। বলব তুমি আমার পিছু লেগেছিলে। কী যে মিথ্যা বলব তুমি হিসাব করেও পাবে না।
নীল একদম চুপ। ওপাশ থেকে শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শুনা যাচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলল
– আলহামদুলিল্লাহ।
কথাটা ওপাশ থেকে উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে আমি চমকে উঠলাম। আমি এতকাল জেনে এসেছি মানুষ খুশির সংবাদ পেলে অথবা কোনো ভালো কাজ করলে আলহামদুলিল্লাহ বলে। এর বাইরে কোনো অঘটন ঘটলে ইন্না-লিল্লাহ বা আসতাগফিরুল্লাহ বলে। ছোট বেলা থেকে এ বিষয়টা অনুসরণও করে এসেছি । কিন্তু আমি তো তার ব্যপারে কোনো ভালো কিছু বলে নি তাহলে সে আলহামদুলিল্লাহ কেন বলল। যদিও সৃষ্টিকর্তাকে সর্ব অবস্থায় স্মরণ করে শুকরিয়া আদায় করা যায়। তবে এ শুকরিয়া আদায়ের পেছনে যে কোনো কূট বুদ্ধির আস্তরণ জমে রয়েছে সেটা আমার বুঝতে বাকি নেই। তবে সে আস্তরণের গভীরের রহস্যটা আমার কাছে অজানা। চুপ হয়ে রইলাম। রহস্য উদঘাটনের কৌশল খুঁজতে লাগলাম। মিনেট এক এভাবেই চুপ হয়ে আছি দুজন। এ চুপ থাকার নিস্তবতা যেন দুজনের দূরত্ব না বাড়িয়ে আরও কাছে আসার প্রয়াস জুগাচ্ছে। দুজন চুপ থাকলেও দুজনের মন যেন দুজনের সাথে কথা বলছে। বুকের ভেতরে চাপা অনেক কথায় যেন মনে মনে বলছি। মনের কম্পনগুলো একে অপরে যেন শুনতে পারছি। এটাকে কী আমি আবেগ বলব নাকি এটাকে বলব গড়ে উঠা কোনো স্বপ্নের বিচরণ। যে স্বপ্নে একে অপরের এত সন্নিকটে থাকা সত্ত্বেও মন উজার করে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না। এ সম্পর্কের শারিরীক দূরত্ব থাকলেও মানসিক দূরত্ব নেই বললেই চলে। এ নিস্তব পরিবেশ বেশিক্ষণ স্থায়ী রইল না। রোমান্টিক এ চিন্তা ভাবনার অবসান ঘটিয়ে ওপাশ থেকে নীলের কন্ঠ ভেসে আসলো।
– কী ব্যাপার চুপ কেন? আলহামদুলিল্লাহ কেন বলেছি জিজ্ঞেস করবে না?
মৃদু কাঁপা গলায় বললাম
– কেন?
হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে কানে আসতেই, বলে উঠল
– তোমার কথাগুলো রেকর্ড করে রাখলাম। এটাও শুনাব তোমার বাবাকে। কীভাবে বাবা, মাকে ফাঁকি দিয়ে আকাম,কুকাম করো সেটা তাদের জানা উচিত। তাদের মেয়ে সম্পর্কে তাদের অবগত হওয়া উচিত।
রোমান্টিক পরিবেশটায় মনে হলো বড় ধরণের একটা বাজ পড়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কিছু কিছু মানুষকে দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটা উল্টে খেতে পারে না কিন্তু আক্ষরিক অর্থে তারা মাছ ভাজা উল্টে তো খায় তার উপর কাটা সহ খেতেও সক্ষম হয়। নীল ও সে ধাচের বুঝতে বাকি রইল না। একদিকে রাগ অন্যদিকে বাবাকে বলে দেওয়ার ভয়। সবমিলিয়ে এখন আমি পুনরায় চুপ। আমার চোখে সে করুণ দৃশ্য ভাসছে। নীল আর আমার বাবা পাশাপাশি বসে আছে। বাবা আমাকে ডেকে রেকর্ডিং টা শুনাল তারপর একটা লম্বা ঝাঁটা নিয়ে.…….। বাকিটা আর কল্পনাও করতে চাই না। নিজের ক্রাশের সামনে এত বড় অপমান কী আমি মানতে পারব? কপাল মানুষের পুড়া হয় এত পুড়া হয় জানতাম না তো। অভিমান জমেছে অনেক। বলার মতো কোনো কথা পাচ্ছি না। ওপাশ থেকে নিস্তবতার সুর বেজে আসছে। আমি চুপ থেকে ফোনটা কেটে দিলাম। মনের ভেতরে থাকা আবেগটাকে দমিয়ে চুপ হয়ে এক কোণে বসে রইলাম। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মা এখনও ঘুমুচ্ছে। বাবা আসবে সকাল ৮ টায় আমার খালাত বোনকে সাথে নিয়ে আর নাস্তা নিয়ে। ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে সে সাথে রাগেও। আচ্ছা নীলের প্রতি এত অভিমান কেন আমার জমছে! এ অভিমানের শেষ কোথায়? কেনই বা তাকে আমি এত জ্বালাচ্ছি। কেনই বা তার প্রতি এত পাগলামি আসছে। ফোনটা বেজে উঠল। নীল কল করেছে। কলটা পাওয়ার সাথে সাথে আমার ভেতরে চাপা অভিমান ক্রমশেই মলিন হয়ে গেল। অভিমান বাড়া – কামা বা উঠা – নামার এ বিষয়টাকে কী বলে জানিনা। অভিমানের খাতা এখন ফিকে। আমি কলটা ধরেই হ্যালো বললাম। নীল তার লোভনীয় কন্ঠসুরে বলল
– রাগ করলে নাকি? আমি মজা করছিলাম। তুমি আমার প্রেমিকা তোমার সাথে মজা করব না তো অন্য কারও সাথে করব।
– তুমি এমন মজা কখনও করবে না। আমার ভয় হয়।
– বাবাকে বুঝি ভীষণ ভয় পাও?
– হুম একটু
– যদি কখনও তোমার বাবা আমাকে ছেড়ে দিতে বলে তুমি ছেড়ে চলে যাবে?
– তুমি যদি বলতে বাবা তোমাকে ভালোবাসতে নিষেধ করলে ভালো না বেসে থাকতে পারব কী না। তাহলে উত্তর আসত, পারব না। কিন্তু পরিস্থিতি যদি কখনও দুজনকে আলাদা করে দেয় তাহলে হয়তো এ পথ আলাদা হয়েও যেতে পারে। তবে ভালোবাসার জায়গাটায় হাহাকার মরুভূমির মতো খা খা করতে পারে।
মনের অজান্তেই কথাটা বলেই নিজেই কেঁপে উঠলাম। সত্যিই কী পরিস্থিতির বেড়াজালে আটকে পড়ে আমি তাকে ছেড়ে দিতে পারব নাকি এটা শুধু বাস্তবিক একটা বাণী আওরাচ্ছিলাম। আমার কন্ঠ স্তবির হয়ে গেল৷ মাঝে মাঝে কিছু কথা এমন পরিস্থিতিতে দাঁড় করায় যার উত্তর আমারা চাইলেও মিলাতে পারি না। আমার নীরবতা ভেঙে নীল বলে উঠল
– কী ব্যাপার চুপ কেন? তোমাকে যতটা বাচ্চা মনে করেছিলাম ততটা তুমি না। যথেষ্ঠ বাস্তবাদীও বটে। আন্টির কী অবস্থা?
– মা ভালো আছে। এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। তুমি কী আজকে আসবে মাকে দেখতে?
– আসব তবে সন্ধ্যার পর। সারাদিন ডিউটি থাকবে। রোগীর প্রেসার থাকবে। দিনের বেলা সম্ভব না। যাইহোক থাকো। আর সাবধানে থেকো। সময় করে নাস্তা করে নিও। আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। পরে কথা হবে। সাতটা বেজে গেছে অলরেডি।
– হুম…
বলেই কল কাটলাম। হুম শব্দটা এমন একটা শব্দ যেখানে লুকিয়ে থাকে হাজার গল্প,অভিমান,ভলোবাসার অভিব্যক্তি। মানুষ যখন এগুলো সুন্দর করে উপস্থাপন করে প্রকাশ করতে পারে না তখন হুম লিখে নিজের ভেতরে থাকা হাজার কথার অভিব্যক্তি প্রকাশের দায় ঠেঁকায়।
কলটা কেটে চুপ হয়ে আছি। এর মধ্যে মা একটু চোখ খুলল। মায়ের কাছে গিয়ে হাতটা ধরে মায়ের কপালে চুমু টেনে বললাম
– কেমন লাগছে এখন?
মা হালকা গলায় বলল
– খুব পানি খেতে মন চাচ্ছে।
কথাটা শুনে চোখের কোণ থেকে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল। মায়ের এ চাওয়াটা আমি পূর্ণ করতে পারব না। কারণ মাকে এ মুহুর্তে মুখে এক ফোটা পানিও দেওয়া যাবে না। চোখের পানিটাকে আড়াল করে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে বললাম
– মা এখনতো পানি খাওয়া যাবে না। ডাক্তার বললেই পানি দিব। তুমি একটু ধৈর্য ধরো। শরীর ভালো লাগছে তো?
– আগের চেয়ে একটু ভলো রে। তোর বাবা কোথায়। মানুষটা আমাকে দেখতেই আসলো না।
মায়ের মুখে চাপা অভিমান। ভালোবাসার সম্পর্কের এ এক বহিঃপ্রকাশ। কোনো কিছু হলেই এক রাশ অভিমান ঝেঁকে বসে। মা তো জানেও না বাবা মাকে একবার না, বহুবার দেখেছে।মায়ের পাশে বসে কেঁদেছে। হয়তো মা ভুলে গেছে। আমি মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম
– রাণী সাহেবা, রাজা সাহেব আপনাকে অনেকবার দেখে গেছেন। রাতে থাকার কষ্ট হবে তাই বাসায় গিয়েছেন। সকাল বেলা নাস্তা নিয়ে হাসপাতালে আসবে। আপনার জ্ঞান ছিল না যখন, তখন আপনাকে দেখেছে। এত অভিমান চাপানোর কিছু হয়নি। আপনি বিশ্রাম করুন।
মায়ের মুখে প্রস্ফুটিত হাসি। ভালোবাসা হয়তো এমনিই। আজকাল সবকিছুতেই আমি অন্যরকম অধ্যায় খুঁজে পাই। প্রেমে পড়লে কী এমন হয় নাকি সময়ের পরিক্রমায় এমন হয় জানা নেই।
কেবিনের দরজাটায় নক আসলো। মায়ের পাশ থেকে উঠে দরজাটা খুলে দেখলাম বাবা এসেছে। তার ঠিক পাশে একজন রমণী দাঁড়িয়ে আছেন। আর সে রমণী হলো আমার খালাত বোন রিদি। তাকে দেখার পর আমার চোখ কপালে উঠল।
(কপি করা নিষেধ)






