#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪১
অপর পাশ থেকে বেশ নীচু গলায় জবাব আসলো।
– রিদি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। রিদির অবস্থা ভালো না। আর তার যে অবস্থা তাকে মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে অনেকদিন। যাকে তাকে দেখে চিল্লায়ে উঠা, অবিশ্বাস করা এগুলো তার সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যতদূর বুঝলাম তার মানসিক উন্নতি হওয়ার চেয়ে অবনতি হচ্ছে ক্রমে। ঢাকায় নিয়ে গেছে। ভালোবাসার মানুষ সঠিক না হলে এভাবেই ভুগতে হয়।
নীলের কথাগুলো শুনার পর থেকে কেমন জানি লাগছে। অস্বস্তি যেন বেড়ে চলেছে। একটা ভালোবাসা এভাবে একটা জীবন নষ্ট করে দিতে পারে তা জানা ছিল না। আমার খালাও আত্মহত্যা করেছিল এ ভালোবাসার জন্য। আর আজকে রিদির অবস্থাও খারাপ এ ভালোবাসার জন্য। ভালোবাসতে গিয়ে আমরা কখন ভুল করি বুঝতে পারি না। আবেগটা তখন শিথীল থাকে না। আমার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। নিজের অবস্থানের জন্য শুকরিয়া আদায় জরুরি। তা না হলে বড়ই নফরমানি করা হবে আল্লাহর সাথে। আজকে নীল সঠিক মানুষ না হলে আমারও অবস্থা হয়তো রিদির মতো হত। আমি কিছুটা চুপ থেকে গাল দিয়ে বেয়ে পড়া পানিটা মুছে নীলের দিকে তাকিয়ে বললাম
– রিদির সাথে কে এ কাজ করেছে সেটা কী তুমি জানতে পেরেছো?
– জানার চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত জানতে পারলাম না। রিদি কখনও বলতে চাইত না। হয়তো আমাদের পরিচিত কেউ। নাহয় নাম বলতে এত ভয় কেন পেত। তার উপর রিদির কোনো কাছের বন্ধুরাও জানে না রিদির সম্পর্ক কার সাথে ছিল। সব মিলিয়ে বুঝতে পারছি না কে ওকে এত কষ্ট দিয়ে মাঝ পথে ফেলে দিয়ে গেছে।
– পরিচিত কার সাথে রিদি এত অন্তরঙ্গ ছিল বুঝতেছি না। তোমার, আমার সম্পর্কের সময় রিদি সব সময় বুঝাত কীভাবে আবেগ সামলাতে হয়। বলত এত আবেগ ভালো না। অথচ নিজের বেলায় কেমন গাফেল হয়ে গেল মেয়েটা।
– অন্যকে বুঝানো সহজ তবে নিজের জীবনে প্রয়োগ করা ভীষণ কঠিন।
– তা ঠিক বলেছো। রিদির অবস্থাটা মানতে কষ্ট হচ্ছে।
– বাদ দাও সেসব চিন্তা। খাওয়া দাওয়া হয়েছে কী?
– হুম হয়েছে৷ তুমি খাবে না?
– খেতে একদম ইচ্ছা করছে না। আজকে শুয়ে পড়ব এখনই। মনটা বিশেষ ভালো না। চোখের সামনে অল্পবয়সী মেয়ের এমন পরিণাম মানতে খারাপ লাগছে। ডাক্তার হওয়ার সুবাধে এমন কত ঘটনার সাক্ষী যে হতে হয়েছে হিসাব নেই। ডাক্তারদের জীবনটায় কেমন জানি চারপাশে শুধু ভালো না থাকার গল্প শুনতে হয়।
কথাগুলো বলতে বলতে নীল খাটে হেলান দিয়ে বসল। আমি নীলের ঠিক পাশেই বসা। ওকে কিছুটা আস্তে গলায় বললাম
– তোমাদের তো দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা।
– সে তো হচ্ছেই। তবে মাঝে মাঝে ভালো লাগে না। মনে হয় এ প্রফেশনের বাইরে একটু ছুটে যেতে পারতাম তাহলে মন্দ হত না। সবার মন খারাপের গল্পের সাথী না হয়ে যদি সবার মন ভালোর গল্প শুনতে পারতাম কতই না ভালো হত। এই যে তোমাকেও সময় দিতে পারি না, সারাদিন গরুর মতো হাসপাতালে পড়ে থাকতে হয়। খাওয়ার সময়টাও মিলাতে পারি না। একসাথে যে খাব তারও উপায়। বেশির ভাগ সময় আমার কাটে হাসপাতালে। বাসায় এসেও তো শান্তি নাই, হুট করে কেউ কল করলে চলে যেতে হয় সেখানে। এ জীবনটা অনেক বিষাদ লাগে সিঁথি।
– তুমি এত হতাশ কেন হচ্ছ নীল? তুমি যে কারও মন খারাপের সাথী হতে পারছো এটাই বা কম কিসের? কারও সুখের দিনে পাশে না থাকলে দুঃখের দিনে তো থাকছো।
– তাতেই লাভ কী? সেই তো দিন শেষে শুনতে হয় ডাক্তাররা কসাই। যদিও এটা রোগীদের দোষ না কিছু কিছু ডাক্তারদের জন্যই এমনটা শুনতে হয়েছে। যাইহোক বাদ দাও মাথাটায় একটু কী হাত বুলিয়ে দিবে?
বলেই নীল তার মাথাটা আমার পেটের সাথে মিশিয়ে পায়ে রাখল। আমার পেটে তার মুখটা গুজে দিয়ে বলল
– বাবুর কী অবস্থা? বাবুর সারাদিন কী খেতে মন চেয়েছিল?
আমি বেশ দ্রূত গলায় জবাব দিলাম
– চাল। আজকে সারাদিন আমি অনেক চাল খেয়েছি। চাল খেতে ভীষণ মজা। এই দেখো উড়নার কোণে চাল বেঁধে রেখেছি। চাল খেতে এত মজা লাগে কী বলব তোমায়।
বলেই উড়নার কোণে বেঁধে রাখা চাল গুলো থেকে কিছু চাল মুখে নিয়ে চিবুতে লাগলাম। নীল আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
– চাল খেয়ো না। যদিও হরমোনের জন্য এমন হচ্ছে তবে চাল খাওয়া ঠিক না। অভ্যাস বদলাতে হবে। তোমাকে এসব বলে লাভ ও হবে না। মাকে আর মিহুকে বলতে হবে তোমাকে যেন চাল আর না দেয়।
কপালটা ভাঁজ করে নীলের দিকে তাকালাম। মুখটা ভেঙচি কেটে বললাম
– চাল আমি খাবই৷
নীল আর কোনো কথা বলল না। কারণ সে জানে আমার বিপরীতে কথা বলতে গেলেই কথার বিস্ফোরণ ঘটবে। তাই চুপ হয়ে শুধু কথা শুনছিল। মূলত বিস্ফোরণ এড়াতেই এ পন্থা অবলম্বন করেছে সে। আমি চুপচাপ বসে নীলের মাথাটায় হাত বুলাতে লাগলাম। নীল চোখ বন্ধ করে আছে।
রিদির বিষয়টা এখনও আমার মাথা থেকে নড়ছে না। যতই চেষ্টা করছি বিষয়টা এড়াতে ততই যেন বিষয়টা আমাকে আরও ঘিরে ধরছে। রিদির মুখ অবয়বটা ভেসে আসছে চোখে। তার সাথে করে যাওয়া খারাপ ব্যবহার গুলো মনে করে আরও কষ্ট লাগছে।
“সঠিক ভালোবাসা পাওয়া অনেক দুষ্কর। চেনা মানুষের ভীড়ে বসে থাকা অমানুষ গুলোকে চেনা বড় দায়। মানুষ চাই এক হয় আরেক। মানুষের চাওয়া পাওয়ার সাথে কেন সব মিলে না জানা নেই। কেনই বা মানুষ মানুষকে এত ঠকায়? কেনই বা অপর পাশের মানুষটার কথা না ভেবেই হাতটা ছেড়ে দেয়। হাতটা ধরে রাখলে কী খুব ক্ষতি হত। মাঝে মাঝে মনে হয় ক্ষতি হত না বরং অপর পাশের মানুষটা হাফ ছেড়ে বেঁচে যেত। কিন্তু কয়জনই বা অপরপাশের মানুষটাকে হাফ ছেড়ে বাঁচতে দেয়? প্রশ্নের তীর এখানে বিদ্ধ হয়। এর সমীকরণ, সারসংক্ষেপ বা সঠিক উত্তর মিলানো বড়ই দুষ্কর।”
কথা গুলো ভেবেই চোখ অশ্রুজলে ভারী হয়ে গেল। নীল ততক্ষণে ঘুম। সারাদিনের ক্লান্তি যেন সব ওর চোখে ঝেঁকে ধরেছিল, এখন সে ক্লান্তিটাও এ ঘুমের মধ্য দিয়ে বিশ্রাম করছে।
হঠাৎ দরজাটায় কেউ কড়া নাড়ল। নীলকে কোনো রকম সরিয়ে দরজাটা খুলতে চেয়েছিলাম। আমি সরানোর সাথে সাথে নীল উঠে পড়ল। আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল
– তুমি বসো আমি দেখতেছি কে।
বলেই শুয়া থেকে উঠে গিয়ে দরজাটা খুললো। লক্ষ্য করলাম বাবা এসেছে। বাবাকে দেখে নীল ভেজা বিড়ালের মতো হয়ে গেল। নীল তার বাবাকে ভীষণ ভয় সেটা বিয়ের আগে জানতাম তবে বিয়ের পর এর অনেক প্রমাণ ও পেয়েছি। নম্র গলায় নীল বাবাকে বলল
– আব্বা কী কিছু বলবেন? কোনো সমস্যা?
– সমস্যা তো বটেই। তোমাকে কিছু বলার ছিল সিঁথির ব্যাপারে। যেহেতু সিঁথির ব্যাপারে বলব তাই ওর আড়ালে বলা ঠিক হবে কী না জানি না। তাই তোমার আর সিঁথির সামনেই বলতে চাচ্ছি। বিষয়টা চরম পর্যায়ে না গেলে বলতাম না।
নীলের মুখ চুপসে আছে। সাথে আমার ভেতরও কম্পন দিচ্ছে কী বলবে বাবা এটার জন্য। আমি কী কোনো ভুল করেছি? নীরবতা বিরাজ করছে এখন। নীরবতা কাটিয়ে নীল বলে উঠল
– আব্বা বলেন কী। সিঁথি কী কিছু করেছে?
নীলের প্রতিউত্তরে বাবা যা বললেন তা শুনে আমার মাথা লজ্জায় অবনত হয়ে গেল। আমার অবস্থাটা ঠিক এমন “আল্লাহ মাটিটা ফাঁকা করো আমি হান্দাইয়া মানে ঢুকে যাই।”
চলবে?
কপি করা নিষেধ