#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪৮
এ বর্ণণা রুবাইয়ার মনে কী প্রভাব ফেলবে সিঁথি জানে না। সিঁথির কন্ঠ থেকে কাহিনির সার সংক্ষেপ অবলীলায় নিঃসৃত হতে লাগল।
– সেদিন নীলের কথা শুনার পর নীলকে অনেকবার কল দিয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। মাকে বলার পর মা তেমন পাত্তা দেয়নি বিষয়টা। তারা ভেবেছে আমি ছোট, অভিমানী বেশি তাই এমনটা বলছি৷ বিষয়টা তাৎক্ষণিকভাবে কেউ গর্জ করে নিয়ে উঠতে পারেনি৷ তবে আমার মন তো আগে থেকেই বলে উঠেছিল নীলের কিছু একটা হয়েছে৷ কারণ নীল কখনও আমাকে এভাবে না দেখে কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে থাকতে পারবে না। যে সন্তানকে দেখার জন্য সে অধীর আগ্রহে ছিল সে সন্তানের মুখ দেখার জন্য হলেও সে সব কাজ ফেলে আসবে৷ আমি বুঝতেই পেরেছিলাম নীল বড় কোনো বিপদে পড়েছে। আর ফোন কলে নীলের কন্ঠ শুনে বিষয়টা আরও নিশ্চিত হই। আমার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তে লাগল। তবে নিজেকে সামলেও নিয়েছিলাম। তখন তুমি একদম ছোট। তোমাকে রেখে যাওয়ার মতো কোনো উপায় ছিল না। নাহয় আমি হয়তো সে সময় নীলের কাছে ছুটে যেতাম। সেদিনের পর থেকে টানা দুদিন নীলের ফোনটা বন্ধ পাই৷ এদিকে সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নীলের খোঁজ নিতে পারেনি। কারণ তোমার শারিরীক অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। বাঁচা মরার সূতোয় বাঁধা ছিলে। বিষয়টা এমন ছিল হয়তো তুমি বাঁচবে হয়তো না। তবে তোমাকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছিল।
দুদিন নীলের কোনো খবর না পাওয়ায় পরিবারের বাকিদের টনক নড়ে। তারা তখন বিষয়টা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করে। নীলের খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, নীল তার কর্মস্থলে নেই। তখন যেন আমার মাথায় আরও বাজ পড়ে। একদিকে তুমি অন্যদিকে তোমার বাবা। সব মিলিয়ে আমি দিশেহারা হওয়ার উপক্রম। সবাই এদিকে আমাকেও সান্ত্বণা দিচ্ছে অপরদিকে নীলের হদিশ খুঁজে বের করারও চেষ্টা করছে।
অস্থিরতা নিয়ে আরও পার করলাম টানা সাতদিন। নীলের কোনো খোঁজ নেই৷ ফোন নম্বরটাও বরাবরের মতো বন্ধ। নীল কোথায় আছে কেউ জানে না। এবার তোমার দাদা আইনি সহয়তা নিতে চাইলেন। থানায় জিডি করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। তোমার দাদা জানতে পারলেন নীলকে পুলিশেই খুঁজতেছে। কারণটা ধোঁয়াশা ছিল। নীলের বিরুদ্ধে একটা মামলা দায়ের করা হয়েছে। শুধু নীল না নীল সহ নীলের দুইজন কলিগের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর একসাথে তিনজনকেই পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টা তারা পর্যবেক্ষণ করছে। সেদিন পুলিশ পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে নীলকে কোন মামলার জন্য খু্ঁজতেছে তারা জানায়নি। বরং বলল যেহেতু তিনজনই প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা তাই বিষয়টা পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে উপর মহল থেকে কাউকে বলতে নিষেধ করা হয়েছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্যই তাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তবে তারা যেহেতু পলাতক প্রাথমিকভাবে বিষয়টিতে তাদেরকেই সন্দেহ করা হচ্ছে। বাকিটা পুরোপুরি তদন্ত করে জানানো হবে। বাবা শত চেষ্টার পরও কারণটা জানতে পারলেন না।
এদিকে পুলিশ কর্মকর্তাগণ নীল আর নীলের কলিগ শোভন মজুমদার এবং রবিন মাহমুদকে হন্নে হয়ে খুঁজছে। অন্যদিকে আমি তো পাগলের মতো হাসপাতালে শুয়ে নীলের জন্য কাঁতরাতে লাগলাম। সুখের স্নিগ্ধ পরশ যেন ক্রমশেই জরাজীর্ণ হয়ে থুবরে পড়ল। চারদিকে শুধু বিষাদময় হাহাকার বইতে লাগল। কষ্টটা যেন আরও ঘিরে ধরেছিল। শুধু আমাকে না আমার পুরো পরিবারকে।
এ কষ্টের গ্লানি তখনও শেষ হয়নি। বরং আরও বেশ কিছুদিন অব্যহত ছিল। নীলের খোঁজ তখনও পাওয়া যায়নি। টানা একমাস হাসপাতালে শুধু কাঁতরিয়েছি নীলের জন্য। তোমার শরীরের অবস্থা তখন বেশ ভালো। ডাক্তার হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিল। আমরা সবাই নিজেদের গন্তব্যে আসলাম।
বলেই সিঁথি চুপ হয়ে কাঁদতে লাগল। রুবাইয়া সিঁথির চোখটা মুছে দিয়ে বলল
– মা কাঁদছো কেন এভাবে?
সিঁথি নিজেকে সামলে উত্তর দিল
– সেদিন বাসায় আসার পর নীলের শূন্যতা যেন আরও গ্রাস করতে থাকল আমাকে। চারদিকে নীলের স্মৃতি কিন্তু নীল নেই। তোমাকে কোলে নিয়েই হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছিলাম রুমে ঢুকে। বাকিরা আর কী করবে, চুপ করে শুধু আর্তনাদের সাক্ষী হয়েছিল। কারণ আমরা তো কেউ জানতাম না নীল কোন অপরাধে পলাতক। কী করেছে যে, সে লোক চক্ষুর আড়ালে গেছে। প্রশ্নটা তখন মনটাকে গ্রাস করে দিয়েছিল। সে সাথে আরেকটা প্রশ্নও মনে ঝেঁকে বসেছিল৷ যেহেতু ওকে এক মাসের উপর পাওয়া যাচ্ছিল না তাই মনের অজান্তেই মন বলে উঠেছিল নীল বেঁচে আছে তো?
কথাটা বলেই সিঁথি পুনরায় চুপ হয়ে গেল। কান্না তার চোখ দুটো যেন গ্রাস করে নিল। রুবাইয়াও এবার থমকে গেল। মনে মনে ভাবতে লাগল তাহলে কী তার বাবা সত্যিই বেঁচে নেই? আর তার মা কী এমনিতেই তার বাবাকে কল্পনা করে চিঠি লিখেছে। রুবাইয়ার বুক ধুকধুক করতে লাগল ভয়ে। ভয়টাকে কিছুটা দমিয়ে সিঁথিকে জিজ্ঞেস করল
– তাহলে কী বাবা বেঁচে নেই? চিঠিগুলো কী নিছকেই তোমার কল্পনা?
সিঁথি হাউমাউ করে কেঁদে দিল। সিঁথির কান্না দেখে যেন রুবাইয়ার আরও বিশ্বাস হতে লাগল তার বাবা মারা গেছে৷ ভয়টা বাড়তে লাগল রুবাইয়ার। রুবাইয়া তবুও নিজের ভয়টাকে পুনরায় নিবারণ করে জিজ্ঞেস করল
– মা প্লিজ কান্না করো না। বলো না কী হয়েছে এরপর।
সিঁথির কান্নার আওয়াজ মৃদু হলো। কান্নাটা থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
– মারে তোমার বাবা মারা গেলেও এতটা কষ্ট হত না। যতটা কষ্ট হয়েছিল পরবর্তী কাহিনি জানার পর।
রুবাইয়া চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠল। অবচেতন মনে চিন্তা করতে লাগল কী এমন হয়েছিল। রুবাইয়া কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই সিঁথি বলতে লাগল।
– বাসায় আসার পনেরো দিন পরও তোমার বাবার কোনো খোঁজ আমি পাইনি। সবকিছু এলোমেলো লাগছিল। সেদিন তোমার শরীরটাও তেমন ভালো না। জ্বর আসতেছিল একটু। তোমার দাদা দাদী দুজনেই ভেঙে পড়েছিল। তোমার চাচী ব্যস্ত ছিল বাসার কাজে। তামান্না ব্যস্ত ছিল তোমার দাদা দাদীর সেবাতে। সন্ধ্যার দিকে তোমার শরীররে অবস্থা খারাপ হতে লাগল। আমি দিশা না পেয়ে তোমাকে নিয়ে একাই সদর হাসপাতালে যাওয়ার জন্য ছুট লাগালাম।
যাওয়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে অনুসরণ করছে৷ আমি ব্যপারটা তেমন পাত্তা দেইনি। তোমাকে ডাক্তার দেখিয়ে আসতে আসতে আমার রাত হয়ে যায় বেশ। প্রায় রাত দশটা। তখন মফস্বলে রাত দশটা মানে অনেক সময়। বলা যায় রাতের অর্ধাংশ। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগিয়ে সিন. এন. জি স্টেশনে আসলাম। তেমন কোনো ট্রান্সপোর্ট পাচ্ছিলাম না যাওয়ার জন্য। এমন সময় মনে হলো কেউ একজন কানের কাছে এসে ফিসফিস করে কিছু বলছে৷ আমি পেছনে তাকাতেই প্রথমে ভয় পেয়ে গেলাম ডাকাত ভেবে। পরবর্তীতে চোখ গুলো লক্ষ্য করে ভেতরটা চমকে গেল। এই চোখ আমার বড্ড চেনা। কারণ এই চোখের নেশায় ডুবেছি একবার না বরং বারংবার। আমি চেঁচিয়ে উঠতে নিয়েও কণ্ঠটা স্থির করে কান্না গলায় বলে উঠলাম
– তুমি এখানে? এতদিন কোথায় ছিলে? তোমাকে পুলিশ খুঁজছে কেন? কী করেছো তুমি? এভাবে পালিয়ে আছো কেন? প্লিজ বলো হয়েছে টা কী?
অস্থির হয়ে গেলাম সাথে সাথেই। নীল আমার হাতটা ধরে টেনে একটা গাছের নীচে গেল। আমার কোল থেকে তোমাকে নিয়ে আদর করতে লাগল। কী পরম মায়া লেগেছিল তার মুখে। সে মায়াময় মুখটা এখনও চোখে ভেসে আসে।
সিঁথির কান্না আরও প্রখর হলো। রুবাইয়ার চোখও ভার হয়ে যেতে লাগল। সিঁথি কান্নাটা কোনোরকম দমিয়ে বলল, তারপর তোমার বাবা আমার হাতটা ধরে ক্ষমা চেয়ে বলল
– আমি যে কথাটা বলব এটার কোনো প্রমাণ আমি দিতে পারব না। তুমি আমায় বিশ্বাস করলে আমাকে মাফ করে দিও। সব প্রমাণ জোগাড় করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি আমি। আমার মেয়েকে তুমি দেখে রেখো। আর আমি চাই তুমি আমার মেয়ের আদর্শ ডাক্তার মা হও। হয়তো তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না। এ দেখায় হয়তো শেষ দেখা। তবে সিঁথি বিশ্বাস করো তোমায় আমি বড্ড ভালোবাসি। আমার ছিনায় তুমি থাকবে। আমার ভেতরে তুমি নামক সত্ত্বার বিলীন কখনও হবে না।
আমার কান্না যেন দলা পাঁকিয়ে আসতে লাগল। হেঁচকি তুলে কান্না করে উত্তর দিলাম
– তুমি এমন বলো না দয়াকরে। কী হয়েছে বলো আমাকে। কেনই বা তোমাকে পুলিশ খুঁজতেছে? আর কেনই বা তুমি এমন বলছো?
নীল দম নিয়ে দমটা ছাড়ল বেশ শব্দ করে৷ অতঃপর আমাকে সবটা খুলে বলতে শুরু করল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্টটা যেন সেদিনের সে ঘটনা শোনার পর আমি পেয়েছিলাম। সে ঘটনার বড় পাথরটা এখনও আমার বুকে ভার হয়ে আছে। সিঁথি চুপ হয়ে গেল। নিজের মেয়েকে বাকি কথা বলবে কী না সে বুঝতে পারছে না। বেশ দোটানায় পড়ে গেছে সে। রুবাইয়া সিঁথির নীরবতা দেখে পুনরায় জিজ্ঞেস করল
– কী হয়েছে বলো মা। প্লিজ চুপ করে থেকো না।
সিঁথি দুটানা ভেঙে জমে থাকা পাথরটাকে একটু হালকা করতে রুবাইয়াকে বলা শুরু করল।
চলবে?
কপি করা নিষেধ