প্রিয়ংবদা পর্ব ৮

#প্রিয়ংবদা
#অষ্টম_পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

শুক্রবারের দিনটা অদ্ভুত হাসি আনন্দে পূর্ণ হয়ে গেল। ছটফটে হৃদিতা সারাদিন বাবা-মার সাথে এদিক সেদিক ছুটে ছুটে বনভোজনের এটা সেটা আয়োজন করতে করতে ভুলেই গেল, গতরাত্রীর নিদ্রাহীনতার কথা, ভুলে গেল আদৃতের প্রতি জমে থাকা, সব রাগ,অভিমান, আরো না জানে কত শত নাম না জানা অনুভুতি!
টাপুর দেবী যখন রান্নার আয়োজন করতে ব্যস্ত তখন হৃদিতা বাবার সাথে মিলে একবার বাগানের সবুজ ঘাসের ওপরে একটা বড় মাদুর বিছিয়ে দিল।বাবা মেয়েতে মিলে মাদুরের দুটো পাশ টান টান করে মাটিতে পেতে দিয়েই তার পাশে এসে রাখলো একটা অডিও অ্যাম্লিফিয়ার। বাবা-মায়ের পছন্দ মিশিয়ে তাতে রাখলো, রপালী পর্দার কিছু হৃদয়হরা গান।সাবিনা ইয়াসমিন,রুনা লায়লা, লতা মাঙ্গেশকর, আশা ভোসলে,কিশোর কুমারের মতো অসংখ্য কিংবদন্তি শিল্পীদের দেয়া কন্ঠে পরিচালিত,, অমিতাভ সাহেব,উত্তমবাবু ও সৌমিত্রবাবুর বহু চেনা, অচেনা গানের পসরা সাজলো সেখানে। তারপর বাবার পছন্দ মতো একটা গান চালিয়ে দিল। অ্যাম্লিফায়ারের ছোট্ট কালো বোতামটাতে টিপ পড়তেই কানে ভেসে এলো লতা জি ও কিশোর কুমার জির মনমোহক কন্ঠ,

আমার স্বপ্ন যে সত্যি হলো আজ
আ হা, ও হো
আমার স্বপ্ন যে সত্যি হলো আজ
কাছে এলো এতদিন দূরে ছিল যে
রঙে রঙে এ জীবন ভরে দিলো সে
আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ,
আমার স্বপ্ন যে সত্যি হলো আজ।
পাখি আর ভ্রমরের ভাষাতে,
ভরে গেছি শুধু আলো আশাতে
আজ মন জাগে যেন ভালোবাসাতে

পাখি আর ভ্রমরের ভাষাতে
ভরে গেছে শুধু আল আশাতে
কাছে ডাকো, কথা রাখো, নয় ভোলো লাজ
আমার স্বপ্ন যে সত্যি হল আজ,
আমার স্বপ্ন যে সত্যি হলো আজ।

বাবার জন্য গান চালিয়ে দিয়েই হৃদিতা ছুট লাগালো মায়ের কাছে। টাপুর দেবী তখন গোবিন্দভোগ চাল ধুঁয়ে রেখে সবেমাত্র কুলোয় মুগ ডাল নিয়ে বাছতে বসেছেন। ডালে থাকা পাথর, কুটো সব আলাদা করে রাখছেন পাশে রাখা একটা ছোট্ট স্টিলের বাটিতে। হৃদিতা গিয়ে হাটু ভাজ করে কোমড়ে দুহাত রেখে বেশ মনোযোগ দিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করলো। টাপুর দেবী মেয়ের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন,
“ওদিককার সব কাজ শেষ?”

হৃদিতা একগাল হেসে মায়ের সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়লো। তারপর জবাব দিল,
“হ্যাঁ, শেষ তো। বাবাকে গান শুনতে বসিয়ে রেখে এসছি। গান শুনছে বাবা।”

টাপুর দেবী মেয়ের দিকে চেয়ে হাসিমুখেই জবাব দিলেন,
“তা তো শুনতেই পাচ্ছি। এবারে আমাকে একটু সাহায্য কর তো হৃদ!”

হৃদিতা এবারে সপ্রতিভ কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“কি কাজ করতে হবে বলো!এক্ষুনি করে দিচ্ছি। ”

টাপুর দেবী হেসে পাশে রাখা একটা বড় বাঁশের ডালাতে রাখা আলু, বেগুন আর কটা লেবু এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“এগুলো কেটে ফেলতো। তবে, ছটফট করিস না। আস্তে ধীরে কর। সাবধান, হাত যেন না কাটে।”
হৃদিতা সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে কাজ শুরু করলো, প্রথমে গুড়ো গুড়ো আলুগুলোর ছাল ছিলেনিয়ে সেগুলোকে বটির ওপরে বসিয়ে চাক চাক করে কাটলো। তারপরে বেগুনের বোটাটা কেটে নিয়ে একে একে তিন টুকরোয় কাটলো তাদের।
তবে দু নম্বর বেগুনটা কাটতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি। বেগুনের মাঝের চাকটা কাটতে গিয়েই সেখান থেকে কিলবিলিয়ে একটা সাদাটে পোকা বেরিয়ে এলো৷ হৃদিতা এক চিৎকারে একদিকে বটি তো অন্য দিকে বেগুন ছুড়ে ফেলে পড়ি কি মরি করে উঠে দাঁড়িয়ে সরে দাঁড়ালো দু পা মতোন। টাপুর দেবী প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়ে কি হলো, কি হলো করে যখন উদ্ধার করলেন যে আসলে হয়েছেটা কি, তখন দম ফাটিয়ে হাসতে লাগলেন। মেয়ের চিৎকারের আওয়াজ শুনে ওদিকে ঋতমবাবু ছুটে চলে এসে দেখলেন মেয়ে ঠোঁট উল্টে চোখ মুখ কুচকে দাঁড়িয়ে আছে, আর স্ত্রী হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। চোখের মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা একটু নাকের ওপরে ঠেলে দিয়ে তিনি অনুসন্ধিৎসু নয়নে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে মা?চেঁচালি কেন?আমি তো ভয় পেয়ে গেছি।ভাবলাম বর্ষাকাল, বাগানে আবার সাপ টাপ এলো নাকি!”
হৃদিতা চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেই কাঁপা কন্ঠে উত্তর দিল,
“বববাবা, পোকা, বববেগুনে পপপোকা। কি রকম সাপের মতোই কিলবিল করে। ইইইইহ্, ওটা সাপের চেয়ে কোন অংশে কম না। কি ভয়ানক দেখতে!”

ঋতমবাবু মেয়ের কথাটা মস্তিষ্কে প্রবেশ মাত্র বুঝলেন না। সেকেন্ড বাদে যখন ক্ষুরধার মগজে খেলে গেল এ কথার মর্মসার, তখন বউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে তিনিও হেসে ফেললেন হু হা করে।

হৃদিতার ওল্টানো ঠোঁট আরো উল্টে গেল। ভয়ের তোড়ে চোখ গড়িয়ে জল পড়েছে গালে। সে কান্না কান্না স্বরে নালিশের সুর তুলে বললো,
“বাবা,, তুমিও?মা তো সে কখন থেকে নাগাড়ে হেসেই যাচ্ছে, হেসেই যাচ্ছে। এখন তুমিও? যাও কারো সাথে কথা নেই। আড়ি!”

ঋতমবাবু এবারে গম্ভীর মুখভঙ্গি করে হাসি থামালেন। টাপুর দেবীর দিকে একপলক গাম্ভীর্য মন্ডিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেয়ের দুবাহুতে হাত রেখে উঁচু স্বরে বললেন,
“হৃদের মা!দেখছো মামণি ভয় পায়, তাও তুমি হাসছো কেন?এ তো ভারী অন্যায় তাইনা!মেয়েটা ভয় পেয়েছে কোথায়, সামলাবে, তা না, তুমি তো হেসেই খুন। এসব আমার বাড়িতে চলবেনা। আমার মেয়েকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করা চলবে না। বোঝা গেছে?”

টাপুর দেবী মাথাটা একবার ডানে তো আরেকবার বামে হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ!বোঝা গেছে। ”

ঋতম বাবু আবার তার কন্ঠে গাম্ভীর্যের ছাপ বজায় রেখে বললেন,
“এবারে বলো, আর এমন করবে না!”

টাপুর দেবী মুখ টিপে হাসি আটকে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাতেই ঋতমবাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“এই তো মা!মা আর হাসবে না বলে দিল। আর রাগ করে না মা। বলো আড়ি ক্যান্সেল?”

হৃদিতা নাক টেনে আধভেজা গালে হাতের উল্টোপিঠ বুলিয়ে বলে,
“আচ্ছা। ক্যান্সেল!”

বাবা-মা-মেয়ে মিলে এবারটা খিলখিলিয়ে উঠল। টাপুর দেবী ততক্ষণে ডালটা বেছে ফেলেছেন। এবারে মেয়ের ফেলে রাখা বেগুন-বটি নিয়ে তিনিই বসলেন কাটতে। বেগুন কাটার পরে লেবু গুলো কেটে নিলেন, একেকটা তিন টুকরো। তারপর বাগানে রান্নার জন্য আনা মাটির উনুনটা খড়ি, চ্যালা কাঠ দিয়ে জ্বালালেন খুব ধৈর্য্য নিয়ে। তারপরে একটা বড় সড় মাপের হাড়ি তুলে দিলেন তার ওপর। হাড়ির তলা যখন উনুনের আঁচে গরম হলো, তখন তাতে তেল দিলেন। তাপের দরুণ তেলে যখন ছোট ছোট গোল্লা উঠলো, তখন বোঝা গেল তেল গরম হয়েছে। এরপর একে একে তাতে তেজপাতা, বড় এলাচ,দারুচিনি, গোটা চিরে দিয়ে সেগুলোকে হালকা ভেজে তাতে দিয়ে দিলেন বেছে ধুঁয়ে জল ঝড়িয়ে রাখা মুগডাল।তেল দেয়া হাড়ির ভেতর ছ্যাঁত করে আওয়াজ হলো। ডালটুকু হাড়িতে ভালো মতন ভেজে নিয়ে তাতে ঢেলে দিলেন ধুঁয়ে রাখা চাল। ডালে চালে খুন্তি দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে তাতে একে একে দিলেন,
“লবণ, হলুদ, সামান্য শুকনো লঙ্কার গুড়ো আর চার পাঁচটা চিরে রাখা কাঁচা মরিচ। সবকিছু দিয়ে মনমতো নেড়েচেড়ে নিয়ে মাপমতো জল ঢেলে দিয়ে ঢেকে দিলেন হাড়ির মুখ। জল ফুটে শুকিয়ে এলেই খিচুড়ি হয়ে যাবে।
চুলোর আঁচটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে তিনি কেটে রাখা আলু, বেগুন গুলো ধুঁয়ে রাখলেন। আলুতে লবণ, হলুদ ছড়িয়ে মেখে নিলেন ঠিকমতো। মাখিয়ে নিলেন আগে থেকে কেটে রাখা ইলিশ মাছও। তারপরে একটা মাঝারী আকারের বাটিতে বেসন নিয়ে, তাতে লবন,হলুদ, দিয়ে জল দিয়ে গুলে নিলেন। ঠিক মতো গুলে নেবার পরে বেগুন গুলোকে ওর মধ্যে ফেলে দিলেন পরপর।
হৃদিতা পাশে বসেই সবটা দেখছিল ভীষণ আগ্রহ নিয়ে। টাপুর দেবী তা দেখে বললেন,
” সব শিখে রাখ। বিয়ের পর কাজে লাগবে।”

হৃদিতা হালকা হেসে বললো,
“ধ্যাঁত!আমাকে আবার কে বিয়ে করবে?তুমিও না মা!শিখতে হয় নিজের জন্য শিখবো।ওসব বিয়ে টিয়ের জন্য না!”

টাপুর দেবী কথা বাড়ালেন না। দুশ্চিন্তা করে করে মেয়ের মাথায় এসব কথা তিনিই ঢুকিয়েছেন। তাই আর উত্তর দেবার মতো কিছু খুঁজেই পেলেন না। আড়ালে একটা তপ্তশ্বাস ফেলে খিচুড়ির হাড়ির ঢাকনা সরিয়ে খুন্তি দিয়ে নেড়েচেড়ে দিলেন। হয়েই এসছে প্রায়। আরেকটু!

ঋতমবাবু তখন গান শোনায় মগ্ন। হাড়ির ভেতরকার জল ফোটার টগবগ টগবগ আওয়াজটা ছাপিয়েও কর্ণকুহরে এসে বারি খাচ্ছে,

নয়ন সরসী কেন ভরেছে জলে
কত কি রয়েছে লিখা কাজলে কাজলে
বেদনার কলি তুমি দাও ভালোবেসে বঁধু
ফুল ফোটানোর ছলে আমি……!

টাপুর দেবী আর কান দিলেন না আর। খিচুড়ি হয়ে গেছে। হাড়িটাকে নামিয়ে রেখে এবারে চুলোতে বসালেন কড়াই। কড়াই যখন তেঁতে উঠলো, তখন তাতে তেল দিয়ে গরম করে নিয়েই একে একে সব নুন,হলুদ মাখানো মাছগুলো ছেড়ে দিলেন তিনি।আবার ছ্যাঁত করে উঠলো। কয়েক ফোঁটা তেল ছিটকে এসে পড়লো হাতে। টাপুর দেবী এসবে অভ্যস্থ, তাই গায়ে মাখলেন না। হৃদিতা অবাক চোখে তাও দেখল। মনে মনে উপলব্ধি করলো, মায়েদের কত কিছু সহ্য করতে হয়!আহা!এজন্যই বলে, মায়ের মতো আপন ভাবতে, স্বার্থহীন ভালোবাসতে কেউ পারেন না। এসব ভেবেই হৃদিতা আপনমনে সন্তুষ্টির হাসি হাসে। টাপুর দেবীর মাছভাজা ততক্ষণে শেষ। তিনি মাছভাজা তেলেই একে একে আলু আর বেসনে ডোবানো বেগুন গুলো ভেজে নিয়ে চুলোটা নিভোলেন। স্টিলের বড় থালাগুলো ধুঁয়ে তাতে সুন্দর করে খিচুড়ি, আলুভাজা, ইলিশ মাছ ভাজা,বেগুনি আর পাতের একপাশে একফালি করে লেবু,আর একটা কাঁচা লঙ্কা সাজিয়ে, স্বামীকে খেতে ডাকলেন। হৃদিতা কাচের গ্লাসে জল ঢেলে রাখলো। ঋতমবাবু তখন অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি ছায়াছবির
” আমি যামিনী, তুমি শশী হে, ভাতিছ গগন মাঝে”
এর লয়ে বিভোর। টাপুর দেবীর ডাকে ঘোর কাটলো। অ্যাম্লিফায়ারটা বন্ধ করে রেখে তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন চুলোর কাছটায়। টাপুর দেবী বললেন,
“নাও, নিজের খাবারের থালা আর জলের গ্লাস হাতে নাও। নিয়ে যাও মাদুরের ওপর গিয়ে বসো। আমি সব ঢেকে রেখে আসছি।হৃদ, যা তুইও যা!বাবার সাথে খেতে শুরু কর। আমি এদিকটা গুছিয়ে রেখে যাচ্ছি। ”

হৃদিতা মায়ের কথা মতোই গেল বাবার সাথে। খিচুড়ি মুখে নিতেই মুখ দিয়ে স্বস্তির ধ্বনি নিসৃত হলো,
“আহ্!কি স্বাদ, একদম অমৃত!”

ঋতমবাবুও একই কথা বলে প্রসংশা করলেন। মিনিট সাতেক বাদেই এলেন টাপুর দেবী। গরম খিচুড়ির প্রায়টাই তখনো পাতে।
বাবা-মেয়ের খাওয়ার মাঝে টাপুর দেবীর আগমণ পরিবেশ আরো জমজমাট করে তুলল যেন। তিনজনে মিলে মেতে উঠলো, হাজারো পুরোনো স্মৃতি চারণে। কিছু দুষ্টু, কিছু মিষ্টি।
হৃদিতার মন খারাপের রেশটুকু, যা গত রাত হয়ে আজ ভোর অবধি তাকে অস্থিরতার তুঙ্গে তুলে রেখেছিল তা ক্রমেই নামতে নামতে শুন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকলো।সেই মনভার করা অচেনা অজানা অনুভুতির চাদরে মোড়ানো, গতরাত্রের অসহ্য স্মৃতিটুকুকে বাবা-মায়ের থেকে পাওয়া উপহার স্বরুপ, আজকের দিনটার, দৃপ্ত রবিকিরণে জ্বালিয়ে ছাঁই করে দিয়ে একফালি শান্তির চন্দ্রময়ী হাসি ফুটলো তার ঠোঁটে।বুকভরা এক স্বস্তির শ্বাস নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে না জানি কত শত বার, ধন্যবাদ জ্ঞাপণ করলো, তার বাবা-মায়ের মতো দু-দুটো বন্ধু জীবনে উপহার দেবার জন্য!
.
সমস্ত নিশিথের জাগরণের পরে, ভোরের ঘুমটা ভাঙতে বড্ড দেরী হয়ে গেল আদৃতের। সকাল গড়িয়ে যখন বেলা হলো, বিভাবসু যখন মাথার ওপরে, সময়ের কাটা বারোর ঘরে থমকে তখনই ঘুম ভাঙলো তার। বারান্দার দরজাটা চাপানো থাকায় তা দিয়ে হালকা বাতাসে নড়ে গেছে টেনে দেয়া পর্দা। সেই সরে যাওয়া পর্দার ফাঁক গলেই অর্কপ্রভা প্রবেশে করেছে ঘরে, বিধেছে বদ্ধ চোখের পাতায়।
আদৃত চোখ কচলে উঠে বসলো। বেডসাইড টেবিলের ওপরে রাখা সিলভার চেইনের হাতঘড়িটাতে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো সে,বিরবির করে বললো,
“শিট!এত বেলা হয়ে গেছে!বুঝতেই পারিনি!”

বিছানা থেকে মেঝেতে পা নামিয়ে কপালে হাতের দু আঙুল চেপে রেখে ছোট করে “উফফফ” করে ওঠে আদৃত। এত দেরীতে ঘুম ভাঙায় মাথা ব্যাথা করছে। চটজলদি উঠে দাঁড়িয়ে কাবার্ড থেকে একটা মেরুন কালার টি-শার্ট আর একটা ব্ল্যাক ট্রাউজার বের করে বাথরুমে ঢুকে যায় সে। লম্বা একটা শওয়ার না নিলে মাথা ব্যাথা যে কিছুতেই কমবে না।
আধঘন্টা খানেক পরে বাথরুমের দরজা ঠেলে ঘরে আসে আদৃত। ভেজা চুলে তোয়ালো চালাতে চালাতেই কানে ভেসে আসে সুমধুর কন্ঠের ধ্বনি,
“আল্লাহ্ হু আকবর!”
মোড়ের মসজিদের মুয়াজ্জিন মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আযান দিচ্ছেন। আদৃত কপাল কুচকায়। মাত্র না সাড়ে বারোটা বাজে,!তো এত জলদি আজ আযান কেন… ভাবতেই মনে এলো, আজ শুক্রবার। সবাই জুম্মার নামাজ পড়বে বলেই এ সময়ে আল্লাহর আবাহন।

ভেজা তোয়ালেটা সোফার একদিকে ছুড়ে মেরে আদৃত এসে দাঁড়ালো, ড্রেসিংয়ের সামনে। হাতের আঙুল চালিয়েই ভেজা চুলগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। ঘড়িতে তখন বারো টা পয়তাল্লিশ!
মোবাইল স্ক্রল করতে করতেই কানে এসে বাধে দরজা ধাক্কানোর শব্দ, ঠক ঠুক!
আদৃত ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই বলে,

“ভেতরে এসো।”
বাড়ির একজন সার্ভেন্ট এসে দুপুরের খাবার সেন্টার টেবিলের ওপরে রেখে চলে যায়। আদৃত পেছন থেকে বলে ওঠে,
“দরজাটা চাপিয়ে রেখে যাও!”

কাজ করা হয় সেই মতোই।
আরো মিনিট দশেক ফোনস্ক্রিন স্ক্রল করেই উঠে দাঁড়ায় সে!ট্রাউজারের পকেটে ফোনটা ঢুকিয়ে রেখে খেতে বসে। ঢাকা দেয়া প্লেটটা সরিয়ে দেখে দেয় পাশে। উঠে দাঁড়িয়ে বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা জলের গ্লাসে জল ঢেলে নিয়ে আবার বসে পড়ে খেতে। খাবার দেখেই বিরক্তিতে কপাল কুচকে আসে আদৃতের। মেনু খুবই উচ্চমানের যদিও, চিকেন কসা, পোলাও, ডিমের কারি আর ভারী বুটের ডাল!
তবে আদৃতের কাছে এসব বিরক্তিকর। রোজ রোজ এসব বিয়েবাড়ির রান্না খেতে সবারই বিরক্তি আসবে। কিন্তু তার মা-বাবাকে তা বোঝাবে কে?
আদৃত দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবার মেখে মুখে নেয়। অর্ধেক খেয়েই হাত ধুঁয়ে নেয় সে। আর পারবে না।
তারপরে আবার বিছানায় বসে পড়ে।মাথা ব্যাথাটা এখনো হালকা আছে। কেমন একটা টনটন করছে। সাইডের ড্রয়ার থেকে একটা প্যারাসিটামল বের করে মুখে ভরে জল দিয়ে গিলে নেয় সে।
পুরো ভরা ওষুধের স্ট্রিপটায় মাত্র একটা ফাঁকা ঘর দেখে চোখ বুজে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের মনেই আলতো হাসি ফোটে তার ঠোঁটে। ফরসা মুখে মানানসই হাসিটুকু নিয়েই সে আবার বিরবিরিয়ে বলে ওঠে,
“আমার একটা গোটা রাত, অর্ধেকটা দিন, আর একটা প্যারাসিটামল কেড়ে নিয়ে আপনি দমবন্ধ করা কিছু অনুভূতি আর অসহ্য মাথা যন্ত্রণা উপহার দিলেন হৃদ!হিসেবটা তোলা থাকলো। কোন একদিন শুদ সমেৎ ফেরত পাবেন। আপনার নিষ্ঠুরতার বিনিময়ে একপৃথিবী ভালোবাসা,আর উপচে পড়া লজ্জা ফেরত পাবেন হৃদ। দেখে নেবেন!”

#চলবে!

[রি-চেইক করা হয়নি!ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ধন্যবাদ সবাইকে। হ্যাপি রিডিং!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here