প্রিয়ংবদা পর্ব ১০+১১

#প্রিয়ংবদা
#দশম ও একাদশ পর্ব
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

পরেরদিনটা আবারো বাঁধা পড়লো রোজকার রুটিনে। ভোরের আকাশ যখন কুসুমের ন্যায় কমলা আভায় ছেয়ে গেল, সূয্যিমামা যখন একটু একটু করে মুখ তুলে চাইলো, তখনই ঘুম ভাঙলো হৃদিতার। ভোরের শেষে কারেন্ট চলে গেছে। সে জন্যই গোটা ঘরটা নিঃস্তব্ধ, বৈদ্যুতিক পাখার আবর্তনের কড়কড় আওয়াজটা আর নেই। শেষ শ্রাবণের প্রকৃতি আগেভাগেই জানান দিচ্ছে ভাদ্রের আগমনী বার্তা,চারিদিকে কেমন ভ্যাপসা গরম, গুমোট ভাব!হৃদিতা উঠে বসে। সারা শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার।পাতলা কামিজ ঘামে ভিজে লেপ্টে গেছে গায়ে,অস্বস্তি হয়!
ভরা বর্ষাতেও নিসর্গের এমন তিতিক্ষি মেজাজে বিরক্ত হয় কিশোরী মন।
হৃদিতা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। বিছানার কুচকানো চাদর ঠিক করে বালিশগুলো রাখে জায়গামতো,নিত্যদিনের অভ্যেস। ফ্রেশ হয়ে এসে চুলে হাত দেয়। কোমড় অবধি ছড়ানো লম্বা বিনুনীটার যাচ্ছেতাই অবস্থা। শোবার বেকায়দায় চুল টুল সব বেরিয়ে এসছে অবিন্যস্ত ভাবে।হৃদিতা চিরুনি দিয়ে আচড়ায়। বিন্যস্ত হয়ে সারা পিঠময় এলিয়ে পড়ে হালকা কোঁকরানো কৃষ্ণ কুন্তল!
হৃদিতা আজ কি মনে করে যেন আর তাদের বাঁধে না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার নিরব সম্মতি জানায় আপনমনেই। মাঝখানে কেবল একটা সিঁথি কেটে সামনের চুলগুলো সাজিয়ে নেয় দুপাশে।
কলেজ ইউনিফর্ম পড়ে একেবারে ব্যাগ কাধে করেই বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। মা আজ আরো আগে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। হৃদিতা গিয়ে ডায়নিং টেবিলে বসে পড়ে।
টাপুর দেবী প্লেটে দুটো পরোটা তুলে দিয়ে ছোট বাটিতে ডাল তুলে দেন। হৃদিতা মুখে পোরে। বাবাকে দেখতে না পেয়ে মুখে থাকা খাবার চিবিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“বাবা কই মা? ”

টাপুর দেবী আলতো হেসে উত্তর দেন,
“বাজারে গেছেন। সকাল সকাল না গেলে তো টাটকা মাছ পাবে না। তাই।তুই খেয়ে নে!”

হৃদিতা মাথা নাড়ে। খাবারটুকু শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। মার উদ্দেশ্যে বলে,
“আমি আসছি মা!দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে যাও!টাটা!”

টাপুর দেবী উত্তর দেন,
“সাবধানে যাবি, আর ফিরতে দেরি করিস না। দুগ্গা দুগ্গা! ”
.
কলেজ শেষে হৃদিতা গেটের বাইরে এসে দাঁড়াতেই একটা বাদামের স্টল চোখে পড়ে। সে এগোয় সেদিকে। যেই ব্যক্তি বাদাম বিক্রি করছেন, তাকে নরম স্বরে ডেকে ওঠে,
“মামা?”
বাদাম বিক্রেতা সচকিতে তাকায়। তারপর হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,
“কিছু নিবেন আপা?কয় টাকার বাদাম নিবেন?”

হৃদিতা একটু ভেবে নিয়ে বলে,
“২০ টাকার দিন। ১০ টাকার ১০ টাকার করে আলাদা।”

বাদাম বিক্রেতা মাথা দুলিয়ে ঠোঙার ভেতরে বাদাম পুরে হৃদিতার দিকে এগিয়ে দেয়। হৃদিতা টাকা হাতেই রেখেছিল, বাদাম হাতে পেতেই টাকা মিটিয়ে দেয় সে। বাদাম বিক্রেতা সহাস্যে বলে ওঠেন,
“আবার আইসেন আপা!”

হৃদিতা মাথা নেড়ে অল্প হেসে বলে,
“আচ্ছা! ”
.
বৃদ্ধাশ্রমের ভেতর ঢুকেই বাইরে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় হৃদিতা। কাদম্বিনী দেবী প্রায় সময়ই বাইরের কোণার একটা বেঞ্চিতে বসে থাকেন। তবে আজ নেই কেন যেন! হৃদিতা ধীর পায়ে দিদার জন্য বরাদ্দ ঘরটার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খোলাই। বিনাদ্বন্দেই ভেতরে ঢোকে।কাদম্বিনী দেবী উল্টো দিকে ঘুরে কিছু একটা করছেন,হৃদিতা তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। একদম পাশটাতেই। দেখতে পায়, দিদা খুব যত্ন করে ক’টা শাড়ি বারবার দেখছে, গন্ধ শুকে আবার রেখে দিচ্ছে। হৃদিতা কৌতুহলী স্বরে প্রশ্ন ছোড়ে,
“দিদা?এসব কি? ”

কাদম্বিনী দেবী চোখ তুলে তাকান। পুরোনো স্মৃতিতে এতটাই ডুবে ছিলেন যে, বুঝতেই পারেননি মেয়েটা পাশে এসে দাঁড়ানো। তিনি হৃদিতাকে বিছানাতে বসতে বলেন। বিছানা বলা যায় না ঠিক, কাঠের চকি। ওপরটাতে শুধু একটা পাতলা তোষক আর তোষকের ওপরে আধময়লা সাদা চাদর। হৃদিতা তাতেই নিঃসঙ্কোচে বসে পড়ে। কাদম্বিনী দেবী এবারে তার সামনে একটা লাল টুকটুকে বেনারসি বের করে বলেন,
“এটা আমার বিয়ের বেনারসি দিদিভাই!সেই আগের যুগের একদম খাঁটি সুতোয় বোনা। কত ভারী দেখেছিস। শাশুড়ী মা নিজে পছন্দ করে পাঠিয়েছিলেন। ঐটুকু বয়সে এই শাড়ির ওজনেই হেলে পড়েছিলাম আমি।”

কাদম্বিনী দেবী শিশুসুলভ হাসেন। হৃদিতা মনভরে দেখে, কি সুন্দর দেখায় দিদাকে হাসলে! একদম চোখ জুড়িয়ে যায়!
কাদম্বিনী দেবী আবার একটা নীলচে কাতান বের করেন, নীল শাড়ির পাড় জুড়ে হালকা গোলাপী সুতোর বুনন,আঁকানো বাঁকানো লতা,ফুল!হৃদিতার সামনে মেলে ধরে বলেন,
“এ শাড়িটা আমার বৌভাতের। আমাদের যুগে তো আর এখনকার মতো অত ঘটা করে লোকজন ডেকে অনুষ্ঠান হতো না। সেকালে সবই ছিল ছিমছাম, পাড়ার সব গুরুজনরা এসে একসাথে বসতো। বউকে নিজের হাতে একখানা নিরামিষ,একখানা আমিষ আরেকখানা মিষ্টির পদ রাঁধতে হতো। এখনকার দিনের মতো বউ হাড়িতে গিয়ে চামচ নাড়লেই হতো না।
আমিও রেঁধেছিলাম জানিস!বড়মার দৌলতে ওটুকু বয়সেই সব রান্নাই পারতাম প্রায়। শাশুড়ী মা যখন এসে বললেন,এমন করে রাঁধার নিয়ম, তখন কোন কথা না বলেই কাজে লেগে গেলাম। সারাদিন কোমড়ে আচল গুঁজে রেঁধে বিকেলবেলা স্নান করে এই শাড়িটা পড়ে বেরিয়ে এসেই সবাইকে নিজের হাতে খাবার বেড়ে দিয়েছিলাম। ”

কাদম্বিনী দেবীর অধর পূর্বের ন্যায় প্রশস্ত। হৃদিতা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
” এত কাজ করতে হতো?”

কাদম্বিনী দেবী শাড়িটার ভাজে হাত বুলিয়ে মাথা নাড়েন। হৃদিতা আবার প্রশ্ন করে,
“কি কি রেঁধেছিলে গো?”

কাদম্বিনী দেবী শাড়ির মাঝেই চোখ রেখে বলেন,
“এঁচোড়ের তরকারি, লাউ-চিংড়ি আর পায়েস!”

হৃদিতা মাথা দোলায়। কাদম্বিনী দেবী তার আধজং ধরা ট্রাঙ্কটা থেকে আরো একখানা শাড়ি বের করেন। এটাও কাতান শাড়ি, লাল পেড়ে সাদা। হৃদিতার গায়ের ওপরে শাড়িটা লম্বালম্বি ভাবে ফেলে অভিজ্ঞ নয়নে পরখ করেন। তারপর হৃদিতার চিবুকে হাত ছুঁইয়ে বলে ওঠেন,
“এ শাড়িটা আমার ভাতকাপড়ের দিদিভাই!সারা জীবনের ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নেবার সময় এই শাড়িটাই হাতে তুলে দিয়েছিলেন তোর দাদু!
তোকে কিন্তু বড্ড মানিয়েছে। একটু পড়বি?দেখতাম!”

হৃদিতা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“এখন?কিভাবে?”

কাদম্বিনী দেবী ট্রাঙ্ক ঘেটে একটা লাল ব্লাউজ বের করে দেন।অনেক আগের বানানো, তখন উনিও হৃদিতার বয়সী। গায়ে হবার কথা। হৃদিতার উদ্দেশ্যে বলেন,
“ব্লাউজটা পড়ে আয়। আমি শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছি। ”

হৃদিতা হালকা হেসে বলে,
“আমি শাড়ি পড়তে পারি দিদা। আমি পড়ে আসি থামো!”

কাদম্বিনী দেবী সম্মতি জানান।মিনিট দশেকের মাথায় হৃদিতা বেরি বেরিয়ে আসে। খোলা চুল, কুচি করে পড়া লাল-সাদা শাড়ির আচল একদম পাট পাট করে ভাজ করা,কাঁধ গলে নেমে গেছে হাঁটুর নিচ অবধি। একদম প্রথম ভোরের সদ্য প্রস্ফুটিত শিউলি ফুলের মতোই সেই রুপ!একেবারে নজরকাড়া, হৃদয়হরা!

কাদম্বিনী দেবী একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেই ভূবনভোলানো রুপে। তারপর নিজ তাগিদেই হৃদিতার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা টেনে নিয়ে আলতো করে দাঁতে কাটেন।

হৃদিতা অবাক হয়না। তার মাও মাঝেমাঝেই এমন করে। মার ধারণা হৃদিতাকে শাড়িতে মারাত্মক সুন্দর দেখায়।এত সুন্দর দেখে যদি কারো নজর লেগে যায় সেজন্যই নজর কাটাতে এ ব্যবস্থা। তবে এসব নিছক স্বান্ত্বনা। হৃদিতাকে আর কে নজর দেবে?হৃদিতা তো কালো। তাকে দেখে সময় নষ্ট করার মতো সময় কি কারো আছে।
তবে হৃদিতা মাকে আটকায় না। এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে বলেই হয়তো তার বাহ্যিক রুপটুকু উপেক্ষা করে, মনের চোখে ধরা পড়ে সৌন্দর্য!
দিদার ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই,জানে হৃদিতা।

হৃদিতা দিদার পাশে বসে পড়ে। মাথা রাখে বাৎসল্যমন্ডিত কাঁধে। কাদম্বিনী দেবী হাসেন। মেয়েটা যে তাকে ক’দিনের তফাতেই খুব ভালোবেসে ফেলেছে তা তিনি বোঝেন।
হৃদিতা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে,
“আচ্ছা দিদা, তোমার নামটাও তো কত্ত সুন্দর বলো!কাদম্বিনী।মেঘের আরেক নাম। তবুও তুমি দাদুকে নিজের নামটা কেন বলোনি?কি সমস্যা ছিল?”

কাদম্বিনী দেবী মুচকি হেসে বলতে শুরু করেন,
“আসলে কি জানিস তো!আমার বাবা-মা সেসময় মারা যান পরপর। একদিন সন্ধ্যা বেলা হঠাৎ করে বমি করা আরম্ভ করে মা।সে বমির সাথে মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে পড়তেই কখন যেন সব ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেল। বুকের ওঠানামাটাও আর নজরে এলো না। চোখ দুটো তো আগেরই বোজা ছিল। আমি কিছুই বুঝলাম না। তব্দা মেরে তাকিয়ে রইলাম। বাবা ফিরলো ঘন্টা দুয়েক পরে। ফিরে এসে মাকে ওভাবে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। অনেক কাঁদলো। বাবার কান্না দেখে আমিও কাঁদলাম একটু। তারপরে মায়ের দাহকার্য শেষ করা হলো। মায়ের শ্রাদ্ধের ঠিক আগের দিন হঠাৎ করে বাবার ঘরে গিয়ে দেখি বাবা কেমন নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। আমি দু একবার ডাকলাম জানিস তো!সাড়া দিলনা। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম বরফের মতো ঠান্ডা। কতক্ষণ আগে আমাকে একা রেখে চলে গেছে কে জানে!বুকের ওপরটাতেই কান পেতে শুনলাম, কোন শব্দ নেই। ঐ যে ঢিপ ঢিপ শব্দটা!ওটা আর পেলাম না। বুঝলাম আমি একেবারেই একা হয়ে গেলাম।জেঠু-বড়মা থাকতো আমাদের পাশের পাড়াতে।খবর শুনে রে রে করে তেড়ে এলো। বেশ কিছুক্ষণ একনাগাড়ে প্রলাপ গুণে একটা সময় বড্ড কায়দা করে সবটা আমার কাঁধে চাঁপালো। গোটা গ্রামময় রটিয়ে দিল, আমি অপয়া,অলক্ষণে!আমার জন্যই নাকি বাবা-মা মারা গেছেন। আমিই নাকি তাদের খেয়েছি!ঐ সেদিনই শৈশবের মায়া কাটিয়ে একদম বুঝদার হয়ে গেলাম। সব বুঝতাম। সব!বয়সটা দশ হলেও জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা গুলো অনেক কিছু শিখিয়ে দিল!”

কাদম্বিনী দেবীর কন্ঠ কেঁপে উঠল। হৃদিতার চোখদুটোও কেমন ঝাপসা,দৃষ্টি অস্পষ্ট। পলক ঝাপটালেই জল গড়াবে যেন!
কাদম্বিনী দেবী আবার বলতে লাগলেন,
“কাদম্বিনী নামটা আমার বাবার দেওয়া।শরৎকালের কোন এক আশ্বিনী তিথিতে জন্ম কিনা!বাবার মুখে শোনা, যেদিন জন্ম হয়, সেদিন নাকি গোটা নীল আকাশময় থোকা থোকা সাদা তুলো উড়ছিল।নীলচে আকাশ হয়ে উঠেছিল সাদা তুলোর রাজ্য। বাবা তো ভেবেই রেখেছিল, যদি ছেলে হয় তবে নাম রাখবেন মেঘ। কিন্তু তা তো হলো না। হলো মেয়ে, আমি জন্মালাম। মা হয়তো ভেবেছিলেন বাবা অখুশি হবেন। তবে তেমনটা হলোনা। বাবা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে নাকি বলেছিলেন, ” আমার ঘরে লক্ষ্মী এসছে।আমার মা লক্ষ্মী!ওর নাম হবে কাদম্বিনী! মেঘের মতোই স্বচ্ছ, শুভ্র, পবিত্রতার কেন্দ্র হবে আমার কাদম্বিনী! আমার মেয়ে!”
আমার বাবার ঘরের আদুরে আমিটাকেই ওরা সবাই অপয়া, অলক্ষ্মী তকমা দিয়ে দিল।রাগ হলো নিজের নামটার ওপরে। বাবা-মার ওপরে। কেন একা রেখে গেল। নিয়ে যেতে পারতো!
বড়মার নিত্যদিনের ভর্ৎসনার সাথী হয়ে অপয়া নামটাই অভ্যেসে পরিণত হল।
সেজন্যই তোর দাদুকে নিজের নামটা বলতে ইচ্ছে করেনি।উনি অনেক পড়ে জেনেছিলেন। আমার মাধ্যমিকের ফর্ম পূরণ করার সময়। তার আগে কখনো জিজ্ঞাসাও করেননি, আমার নাম কি! বরাবর ‘কৃষ্ণকায়া” বলেই ডাকতেন!আমারো ভালো লাগতো সেই ডাকই। ভালোবেসে ডাকতেন বলেই হয়তো!”

কাদম্বিনী দেবীর চোখের কোণে জল জমেছে, হৃদিতা তা দেখে বললো,
“তুমি কাঁদছো কেন দিদা?আরে দেখতো, তোমার নামটা তোমার অপছন্দের তালিকাতে নাম লিখিয়েছিল বলেই না তুমি এত সুন্দর, কিউট,সুইট, ইউনিক একটা নাম পেয়েছো!কত ভালো লাগে শুনতে!”কৃষ্ণকায়া”
জানোতো, আমিও না মাঝে মাঝে কল্পনা করি, আমার বরও আমাকে দাদুর মতো ভালোবেসে “কৃষ্ণকায়া” বলে ডাকবে!ইশশ!যখন ভাবি তখন যে কি লজ্জা লাগে না!বলে বোঝানো যাবেনা!”

হৃদিতা দুহাতে লজ্জা পাবার ভঙ্গিমায় মুখ ঢাকে। কাদম্বিনী দেবী কাঁদতে নিয়েও হেসে ফেলেন ফিক করে। তারপর হৃদিতার মাথায় একটা টোকা দিয়ে বলেন,
“ফাজিল মেয়ে! তবে তোর বর তোকে “কৃষ্ণকায়া” বলে কেন ডাকবে?”কৃষ্ণকায়া” তো আমার পতিপ্রদত্ত সম্পত্তি। একান্তই আমার ব্যক্তিগত। তোকে তো সে সম্পদের ভাগ দেয়া যাবে না। তবে যে তা অনন্যতা হারাবে!”

হৃদিতা মুখ থেকে হাত সরিয়ে প্রশ্নাত্মক চাহুনি নিক্ষেপ করে কাদম্বিনী দেবীর মুখে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি সিরিয়াস দিদা?”

কাদম্বিনী দেবী মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। হৃদিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে স্বরে বলেন,
“প্রতিটা মানুষের কিছু নিজস্ব জিনিস থাকে দিদা!যা তাদের একান্তই আপন। সেসব চাইলেও ভাগ করে নেয়া যায় না।
” কৃষ্ণকায়া ” চার অক্ষরের এই সম্বোধনটাও ঠিক এমনই। আমার একান্ত ব্যক্তিগত।এর ভাগ আমি কাউকে দিতে পারিনা দিদি।
তবে তুই চিন্তা করিস না। প্রতিটা মানুষই তার ভালোবাসার মানুষটার জন্য, কোন না কোন সম্বোধন ঠিকই তুলে রাখে, নিজের মনের সুপ্ত কারাগারে। কেউ বা প্রকাশ্যে তো কেউ নিভৃতে। একান্তে কখনো প্রিয়জনের সামনে তা প্রকাশ করে তাদের চমকে দেয় সেই গোপন সম্বোধনেই। তোর জন্যও ঠিক এমনই কোন সম্বোধন আছে। যে তোকে ভালোবাসবে, সে তোর মাঝে সেই অনন্য সম্বোধনের কারণ খুঁজে পেয়েই তোকে ডাকবে, তার নিজের দেয়া নামে, ভালোবাসার অভিধায়!”

হৃদিতা ঈষৎ হেসে বলে ওঠে,
“আমাকে ভালোবেসে নতুন কোন নামে ডাকবে এমন কেউ নেই দিদা। থাকতে পারে তেমন আশাও নেই। সেসব ছাড়ো। আমি হৃদিতা!হৃদিতা হয়েই ঠিক আছি। বাবা-মায়ের হৃদ!তাদের দুজনের মিশ্রিত ভালোবাসা! আমি এতেই খুব খুশি গো!”

হৃদিতা চুপ করে যায়। চোখে মুখে খেলা করে কেমন একটা মনমরা ভাব। কাদম্বিনী দেবী তা দেখে তপ্তশ্বাস ফেলেন।
হৃদিতা নিজেকে সামলেও নেয় নিমেষেই। কিছু একটা মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে সে বলে ওঠে,
“ওহ্ হো!এই দেখ না দিদা! কলেজ গেট থেকে বাদাম নিয়েছিলাম। গল্পের তালে তোমাকে দেয়াই হয়নি।দাঁড়াও আনি!বসো একটু!”

কাদম্বিনী দেবী মাথা নাড়েন। হৃদিতা ব্যাগের প্রথম চেইনটা খুলেই বের করে আনে ঠোঙায় মোড়ানো বাদাম।কাদম্বিনী দেবীর দিকে একটা ঠোঙা এগিয়ে দিয়ে নিজেও তার পাশে বসে পড়ে বাদাম খেতে।
একটা একটা করে বাদাম বের করে দু হাতের বুড়ো আর তর্জনী আঙুলে পিষ্ট করে ভেঙে ফেলে বাইরের আবরণী। তারপরে ভেতরের লালচে ছালের দানা গুলোকে হাতের তালুকে পিষে নিলেই আলাদা হয়ে যায় লালচে অংশটুকু। তার ফুঁ দিতেই উড়ে যায় তা। আর তারপর বাদামের শেষগতি হয় মুখগহ্বর!

বাদাম খাবার মাঝপথেই কাদম্বিনী দেবী বলে ওঠেন, “জানো তো দিদিভাই, তোমার দাদু না বাদামের ভর্তা খুব পছন্দ করতো। তবে আমি ওটা ভালো মতো করতে পারতাম। কোন কোনদিন বাদাম ভাজা এত বেশি হয়ে যেত যে শিল-নোড়ায় গুড়ো হতেই চাইতো না।তো কোন কোনদিন কম ভেজে একদম ক্যাতক্যাতে করে ফেলতাম। তবে মানুষটা ওভাবেই খেয়ে নিত। প্রিয় জিনিসটা যে কখনো ঠিকমতো করে দিতে পারিনি, তারপরেও কখনো কিচ্ছুটি বলেন নি। উনি হয়তো কোন কাজেই আমার দোষ খুঁজে পেতেন না বুঝলে!আমি আজও ভাবি, ঠিক কতটা ভালোবাসলে একটা মানুষ এমন নির্দ্বিধায় সব দোষ, সব খামতি, এড়িয়ে শুধু ভালোবেসে যেতে পারেন!”

কাদম্বিনী দেবীর চোখেমুখে ভর করে একরাশ তৃপ্তি,আর সেই তৃপ্তি হৃদিতার মুখে নিয়ে আসে একগুচ্ছ মুগ্ধতা।
হৃদিতা আরেকটা বাদাম মুখে পোরে। কাদম্বিনী দেবী আবার বলতে শুরু করেন,
“জানিস তো, আমার একবার কি মনে করে শখ হলো, বাড়িতে পদ্ম ফুল লাগাবো। ওনার কাছে বলতেই উনি বললেন,
” আমাদের বাড়িতে তো পুকুর নেই!কিভাবে কি?”

কিন্তু আমিতো একরোখা। লাগাবো বলেছি তো লকগাবোই।ব্যবস্থা করে দিতে হবে।আসলে তখন আমি সন্তানসম্ভবা ছিলাম। সেজন্যই অমন আজব আজব ইচ্ছে করতো। এখন তোরা কি যেন বলিস!ঐ মুডসুইং না কি!সেটাই!
অগত্যা উনি ছুটলেন রাজমিস্ত্রী ডাকতে। ছাদের এককোণে চার পাঁচ থাক ইট দিয়ে একটা গোল গর্ত মতোন বানিয়ে দিলেন। তারপর এক থাক মতোন ইটের জায়গা, মাটি দিয়ে ভরাট করে তাতে জল দিয়েই লাগালেন পদ্ম। বর্ষা এলেই ফুটতো সেই গোলাপীরঙা শতদল।কি যে সুন্দর লাগতো দেখতে। ওদের ঘ্রাণেই গোটা ছাদ ম ম করতো।
রাত বিরাতে, মাঝে মাঝে সেই ঘ্রাণ নিতেই তোর দাদুকে ঘুম থেকে তুলে চলে যেতাম ছাদে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম। কতশত বার বৃষ্টি নেমে যেত। ভিজেই দেখতাম।
তোর দাদু ভিজতে দিত না অবশ্য। তাই প্রথমদিন বৃষ্টিতে ভিজে বসে থাকার পর, পরদিন থেকে ছাতা নিয়ে যেতেন। বৃষ্টি নামলেই আমার ওপর ছাতা ধরে নিজে ভিজে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
ঐ সময়টায় খুব জ্বালাতাম তোর দাদুকে। হুটহাট অদ্ভুত যত সব ইচ্ছে করতো, আর সেসব পূরণের জন্য সে মানুষটার কাছে ঘ্যানঘ্যান করতাম। উনি তবুও কখনো একটি বারের জন্যও বিরক্ত হতেন না। হাসিমুখেই সবটা করে যেতেন।
তবে প্রথম দু-তিন মাস পর্যন্তই ছিল এই পাগলামীর মেয়াদ। তারপরে তো আবার আগের মতো হয়ে গেলাম। শান্ত। তবে তখন আবার একটু বেশিই শান্ত হয়ে গেলাম। শরীর টরীর ভারী হয়ে গেল। নড়তে চড়তে পারতামনা বেশি। সারাদিন ঘরেই বসে থাকতাম। উনিও আর কাজ করতে দিতেন না। রান্না থেকে শুরু করে বাড়ির যাবতীয় কাজ নিজের হাতেই সামলাতেন।
সত্যি বলতে, এত ভালোবাসা যে আমার ভাগ্যে থাকতে পারে, তা কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করিনি দিদিভাই।
তবুও স্বপ্নাতীত এই ঘটনাক্রম তো আমার জীবনটারই অংশ তাইনা!
তাই এইযে একটু আগে তুই বললি, ভালোবেসে কেউ নতুন সম্বোধনে ডাকবে তেমন আশা তোর নেই!এ কথাটা মানলাম। আশা না থাকলে ব্যাপার না। আশার উর্ধ্বেও অনেক কিছু ঘটে এই চরাচরে।তবে ঐ যে বললি, কেউ ডাকবেই না, এটা ঠিক বললি না। তুই কি ভাগ্য পড়তে পারিস বল তো?না তো! তবে? আমাদের ভবিষ্যতে কি হবে, হতে চলেছে সেসব জানার সামর্থ্য কিন্তু আমাদের নেই। সৃষ্টিকর্তা দেননি। সবার শেষে তাই হয় যা সৃষ্টিকর্তা চান।
তাই আশা না রাখলেও হতাশ হবি না দিদিভাই। ভাগ্য আমাদের জন্য যা ভেবে রেখেছে তাই হবে। এর চেয়ে কিছু কম বা বেশি হবার উপায় নেই। আর বিশ্বাস কর, ভাগ্য তোর জন্য, এমনকি আমাদের সকলের জন্য যার যার জীবন অনুসারে সর্বোত্তমটাই ভেবে রেখেছেন!বুঝলি?”
হৃদিতার বাদামের ঠোঙা ততক্ষণে ফাঁকা। সেটাকেই হাতের মুঠোয় দুমড়ে মুচড়ে নিয়ে কাদম্বিনী দেবীর দিকে তাকিয়ে প্রসন্ন নয়নে চেয়ে বলে,
“বুঝেছি দিদা। ”

কাদম্বিনী দেবী খুশিমনে নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। হৃদিতা এবারে উঠে দাঁড়িয়ে কাদম্বিনী দেবীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“অনেকক্ষণ হলো এসছি গো।এবার যেতে হবে। দেরি হয়ে গেলে মা বকবে।দাঁড়াও শাড়িটা পাল্টে আসি। ”

কাদম্বিনী দেবী বাঁধা দিয়ে বললেন,
“শাড়ি বদলাতে হবে না।শাড়িটা পড়ে থাক। ওটা আমি তোকে দিলাম। দিদার তরফ থেকে সামান্য উপহার। ফিরিয়ে দিস না। কষ্ট পাব। এই যে রোজ রোজ আমাকে এত সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম আনন্দ দিয়ে হাসার সুযোগ করে দিচ্ছিস, প্রাণখুলে মনের সব কথা বলার উপায় করে দিচ্ছিস, তার জন্য দিদাও চায় তোকে একটু নিজের মতো করে সাজাতে। বাড়ি গিয়ে কপালে একটা কালো টিপ পড়িস দিদা। আর কিচ্ছু লাগবে না। রাখবি না আমার কথা?”

হৃদিতা কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে তাকায়। তবে দিদার কথা ফেলাটা অভদ্রতা দেখায়, ভেবেই আর খোলে না শাড়িটা। ছেড়ে রাখা কলেজ ড্রেস গুলো ব্যাগে পুড়ে দিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে।

বাইরে বেরিয়ে চোখ কপালে ওঠে হৃদিতার। আকাশ যে নিকষ কালো। হৃদিতার ভ্রম হয়। মনে করে ফিরতে সন্ধ্যা পার করে ফেলল কি?পরক্ষণেই হাতঘড়ির দিকে তাকায় সে। তীক্ষ্ণ চোখে দেখে ঘড়িতে সবে ৫ টা ২৩! এখনো সন্ধ্যে হতে ঢের দেরি! তবে? হঠাৎ মৃদু আকাশ ডাকার শব্দে হৃদিতার বুদ্ধি খোলে। আকাশে মেঘ করেছে। খুব জোড় বৃষ্টি পড়বে। ঐ যে ভোর থেকে অমন ভ্যাপসা আবহাওয়া, শরীর জ্বালানো উষ্ণতা। তা দুর করতেই প্রকৃতির এই পদক্ষেপ।
হৃদিতা দ্রুত পা চালায়। বৃষ্টি নামার আগেই বাড়িতে যেতে হবে।
মোড়ে পেরিয়ে যখন সেই “খাই-খাই” হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখনি, পিলে চমকে ওঠে হৃদিতার। আদৃত গাড়ি থামিয়ে উল্টো মুখ করে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে।
হৃদিতা ভাবে, আজও কেন এনার সাথেই দেখা হতে হবে! ভালো লাগে না!
হৃদিতা খুব সন্তর্পণে আদৃতের চোখে না পড়ার প্রয়াস চালায়। তবে সেই দুরন্তমনা অবুঝ কিশোরী কি আর জানে, গাড়ির লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে একনজরে একজোড়া মুগ্ধ নয়ন সেই কখন থেকে তাকেই অবলোকন করতে ব্যস্ত। দৃষ্টিতে নেই বিন্দুসম অস্থিরতা,একটুও ক্লান্তি।ভরা বর্ষায় শিউলি ফুল দেখছে যে। পলক ফেললেই যদি পালিয়ে যায় তখন!

হৃদিতা যখন পা টিপে টিপে আদৃতের পাশ দিয়ে চলে যেতে চায়, তখনই আদৃত ফোন নামিয়ে ঘুরে তাকায়। হৃদিতা হাতে নাতে চোর ধরা পড়েছে এমন ভাবে গুটিয়ে যায় একদম। আদৃত ফিচেল হেসে ভ্রু নাচিয়ে হৃদিতার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“আরে, হৃদ যে!শাড়ি পড়ে কই চললেন?”

হৃদিতা দুহাতের তালু ঘষতে থাকে। দুচোখে রাজ্যের অস্থিরতা খেলে যেতে থাকে। হঠাৎ নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ছোট করে উত্তর দেয়,
“বাড়ি!”

আদৃত বুঝতে পারার ভঙ্গিতে দুই ঠোঁট গোল করে বলে ওঠে,
“ওওওহ্!”

হৃদিতা আবার চলে যেতে নিতেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় গাল, ঠোঁট,চোখের পাতা। আস্তে আস্তে বৃষ্টির বেগ বাড়ে। আচমকা এমন হওয়ায় হৃদিতা হয়ে পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
আবার আদৃতের দিকে চোখ পড়তেই দিশেহারা হয়ে পড়ে ভীত হিয়া। গায়ের সাদা শাড়ি ততক্ষণে ভিজে একাকার। শরীরের বিশেষ বাঁকে বাঁকে লেপ্টে গিয়ে তা প্রলয়ঙ্কারী লজ্জার সৃষ্টি করতে ব্যস্ত। হৃদিতার ভয় করে। কে জানে মানুষটা কি নজরে দেখছে! আড়চোখে একবার আদৃতকে দেখে নেয়। না আদৃতের দৃষ্টি কলুসতা মুক্ত, কেবল তার সমস্ত মুখজুড়েই আবদ্ধ।
হৃদিতা স্বস্তিতে দম ছাড়ে।বুকের ভেতরে গাদা গাদা কার্বন-ডাই-অক্সাইড এতক্ষণ আটকে ছিল যেন। এবার সেসব মুক্ত।

হৃদিতা এবার সরাসরি আদৃতের চোখের দিকে তাকায়। না চেয়েও কি ভেবে যেন সাহস করে ফেলে আজ। আদৃতের দৃষ্টি তখনো অনড়। বৃষ্টির বিশাল বিশাল ফোটাও টলাতে পারেনা তাকে। হৃদিতা বৃষ্টির তোড়ে প্রায় বুজে আসা চোখেই স্পষ্ট দেখতে পায় সেই ঘোরলাগা দৃষ্টির উপচে পড়া মুগ্ধতা। হৃদিতার শরীর শিরশির করে ওঠে। গায়ে কাটা দিয়ে শিরদারা বেয়ে নেমে যায় অনুভূতির ভয়ানক শীতল স্রোত।
হৃদিতার খুব বলতে ইচ্ছে করে,
“ওভাবে দেখবেন না আদৃতবাবু!আমার ভীষণ লজ্জা করে!কেমন একটা ঘোর লাগে!অদ্ভুত অনুভূতি হয়!সেই হৃদয়কাঁপানো অনুভূতিটুকু যে বড্ড অচেনা, বড্ড অগোছালো। সবটা কেমন এলোমেলো করে দেয়!তাকাবেন না ওভাবে!”

কিন্তু বলতে পারে না। বলা হয়ে ওঠে না!
হঠাৎ দুরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ হয়। এতক্ষণে আদৃতের ঘোর কাটে,বিভোর দৃষ্টি মিলিয়ে যায়। হৃদিতা চমকে উঠে দুহাত কানে চেপে চোখ খিঁচে বন্ধ করে।
আদৃত সেদিকে তাকায়। মেয়েটা হয়তো ভয় পেয়েছে। আদৃত মেয়েটার দুবাহু স্পর্শ করে, হৃদিতা কেঁপে ওঠে সামান্য। তবে সে স্পর্শ ভীষণ পবিত্র,মার্জিত,একবিন্দুও খারাপ আভাস নেই তাতে। হৃদিতা তাই বাঁধা দেয় না। আদৃত তার বাহুজোড়া আরেকটু জোড়ে চেপে ধরে আস্বস্ত করা কন্ঠে বলে,
” ভয় কি হৃদ?আমি আছি তো!”

হৃদিতা চোখ মেলে তাকায়।কান চেপে রাখা হাত দুটো নেমে যায় আপনাআপনিই! পরক্ষণেই মনে পড়ে কেউ দেখে ফেললো না তো! হৃদিতা ঘাড় ঘুড়িয়ে চারিদিকে তাকায়। হোটেলের শাটার ভেতর থেকে ফেলা। পানের দোকানী মামাও তার দোকানের ঝাপি ফেলে দিয়েছেন বৃষ্টি শুরু হতেই। হৃদিতা শান্ত হয়।
আদৃত আবার হাসে। হাসিমাখা কন্ঠে বলে ওঠে,
“আপনার এত লজ্জা হৃদ!আপনার জন্য তবে ঠিক প্রতিদানই বরাদ্দ করেছি আমি!”
হৃদিতা বুঝতে পারেনা সে কথার মানে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয় আদৃতের হাসি হাসি মুখটার দিকে।
আদৃত হয়তো বুঝে যায়। তাই তার লজ্জা বাড়াতেই হয়তো আবার বলে বসে,
” ওভাবে কি দেখেন?আপনার চোখ যে অন্য কথা বলে হৃদ! ”

হৃদিতা চোখ সরিয়ে নেয়। দৃষ্টিসীমা আবার ধারণ করে অস্থিরতা। চোখের কালচে মণি এলোমেলো ভাবে ঘোরে এদিক সেদিক।
আদৃত এবারে আরো একটি অবিশ্বাস্য কাজ করে বসে। পকেট থেকে একটা কালো টিপের পাতা বের করে তা থেকেই একটা টিপ তুলে বসিয়ে দেয় হৃদিতার কপালে। মাঝসিঁথি করা চুলগুলো দুপাশে ঠিক মতো গুঁজে দেয়। বৃষ্টিতে ছড়িয়ে গেছিলো যে!
তারপর ভীষণ আদুরে স্বরে বলে ওঠে,
“আপনি সবসময় কালো টিপ পড়বেন হৃদ! কালো টিপে আপনাকে খুব সুন্দর মানায়,একদম রাজকুমারীর মতো!প্লিজ পড়বেন!”

#চলবে!

[আজকের পর্ব আমার মতে যথেষ্ট সোজা শব্দে লেখা হয়েছে। এর বেশি সরল করা সম্ভব না। যেসব কথা বুঝতে সমস্যা হতে পারে বলে আমার মনে হয় সেগুলোর মিনিং দিয়ে দিচ্ছি।
নোটঃ
কুন্তল অর্থ চুল, অভিধা অর্থ নাম,এঁচোড় অর্থ কাঁচা কাঠাল!

গত পর্বের না বোঝার মতো শব্দ, ময়ুখমালী অর্থ সূর্য,তমসাবৃত শর্বরী অর্থ আধার রাত! বাকি সব শব্দই বোঝার কথা।
আসলে আমার বাংলা শব্দবাছাই বোধায় খানিক কঠিন, তার জন্য দুঃখিত।তবে উপন্যাসের স্বার্থে তো একটু শব্দ কাঠিন্য প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়!

গল্পের মাঝে পড়া ভালো লাগেনি যাদের তাদের কাছেও দুঃখিত।
আর লেখিকা ইংরেজীতে ভালো না, ভয়েস,ট্রান্সফরমেশন, ন্যারেশনগুলো একটু আধটু ভালোবাসে।
ধন্যবাদ সবাইকে। হ্যাপি রিডিং!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here