#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৫
নিহানের মা দ্রুত রুমের চাবি নিয়ে নিহানের হাতে দিলো। রুমে ঢুকে সবাই চমকে উঠলো। ইসরা সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। নিহানের মা গিয়ে ইসরার মাথা নিজের কোলে তুলে নিলো।
গালে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বললো, এই মেয়ে চোখ খোলো, তাকাও আমার দিকে।
নিহান সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে মায়ের হাতে দিলো। নিহানের মা ধীরে ধীরে পানির ছিটা দিতে লাগলো চোখেমুখে। নিহানের বাবা অলরেডি ডক্টরকে ইনফর্ম করে দিয়েছে। ডক্টরের বাসা কাছেই তাই আসতে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না।
নিহান মেয়েটাকে বেডে শুইয়ে দে।
মায়ের কথায় নিহান ভ্রু কুঁচকে তাকালে নিহানের মা বলে উঠে, এখন এখানে কোনো ড্রামা দেখতে চাই না আমি। তাই যেটা বলছি দ্রুত কর।
নিহান বাধ্য হয়ে ইসরাকে কোলে তোলে বেড়ে শুইয়ে দিলো। ইসরার পুরোপুরি সেন্স ফেরেনি এখনো। চোখ খোলার মতো শক্তি পাচ্ছে না। কতটা সময় ধরে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে সেটাও বলতে পারবে না। একটু পরই ডক্টর এসে চেকআপ করলো।
ভয়ের কিছু নেই। কম ঘুমানো, খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম আর দুশ্চিন্তার জন্য এমন হয়েছে। বিপি অনেক কম দেখা যাচ্ছে। এসব বিষয়ে একটু নজর রাখলেই হবে। এখন কিছু খাইয়ে আমার দেওয়া মেডিসিন গুলো খাইয়ে দেবেন।
ডক্টর মেডিসিন লিখে দিয়ে বের হয়ে গেলো ইসরার রুম থেকে, নিহানের বাবা তার সাথে গেলেন।
আমিরা মুখ ভেংচি কেটে বললো, যত্তসব ঢং আর সবার সিমপ্যাথি পাওয়ার বাহানা।
নিহানের মা গম্ভীর গলায় বললো, আমিরা অনেক রাত হয়েছে নিজের রুমে যাও।
আমিরার এখানে থাকার কোনো ইচ্ছাও নেই, তাই বলার প্রায় সাথে সাথেই বের হয়ে গেলো রুম থেকে। নিহান দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমিরার বাবা-মা একটু পর চলে গেলো। মনিরা ইসরার পায়ের কাছে বসে পায়ে তেল মালিশ করছে।
এদিকে মেইন গেইটের কাছে এসে ডক্টর দাঁড়িয়ে গিয়ে বললো, মিস্টার রেজওয়ান আমি আপনার ছেলের বিয়ের বিষয়ে সবই জানি। মেয়েটার পরিবার অন্যায় করেছে মানছি কিন্তু মেয়েটাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে আপনারা কী ঠিক করছেন ?
নিহানের বাবা বুঝতে না পেরে বললো, আপনার কথার মানে বুঝতে পারলাম না।
মেয়েটার গালে থাপ্পড়ের দাগ বসে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে। একজন মানুষ অপর একজন মানুষকে এভাবে কী করে আঘাত করতে পারে আমার জানা নেই।
ডক্টরের কথা শুনে নিহানের বাবার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো আর গম্ভীর গলায় বললো, আমি খেয়াল রাখবো এই বিষয়ে।
ডক্টর কিছু না বলে বের হয়ে গেলো। নিহানের বাবা হাতের মুষ্টি শক্ত করে ইসরার রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। ইসরার বেডের কাছে গিয়ে গালটা ভালো করে দেখে নিলো।
গম্ভীর গলায় বললো, এই মেয়ের গালে থাপ্পড়ের দাগ কেনো ?
বাবার কথায় নিহান চমকে উঠে সামনে তাকালো আর নিহানের মাও ভয়ে ভয়ে তাকালো নিহানের বাবার দিকে। উত্তর না পেয়ে তিনি হুংকার ছেড়ে একই কথা বললেন।
উত্তরে নিহান আমতা আমতা করে বললো, আমি মেরেছি।
নিহানের বলতে দেরি হলেও তার গালে সজোরে থাপ্পড় পড়তে দেরি হলো না।
মিস্টার আকরাম রেজওয়ান হুংকার ছেড়ে বললেন, এই পরিবারের ছেলে হয়ে এমন কাপুরুষের মতো কাজ কীভাবে করলে ? কোনো সাহসে তুমি এই মেয়ের গায়ে হাত তুলেছো ? প্রতারণা করেছে তার জন্য তুমি ডিভোর্স চেয়েছো আমি কিছু বলিনি। কারণ তুমি এটা চাওয়ার অধিকার রাখো। কিন্তু এই মেয়ের গায়ে হাত তোলার অধিকার তোমার নেই। সে আমাদের পরিবারে মাত্র দু-মাসের অতিথি।
নিহান গালে হাত দিয়ে বললো, কিন্তু বাবা।
আমি তোমার আর কোনো কথা শুনতে চাই না। এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাও আর একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও ভালো করে। ফিউচারে যদি আবার কখনো এমন কাজ করো সেটা তোমার জন্য খুব খারাপ হবে।
নিহান ইসরার দিকে একবার তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
নিহানের মা ইসরার দিকে তাকিয়ে বললো, ছেলেটাকে এভাবে না বললেও পারতেন। বাড়ির ঝামেলা অফিস পর্যন্ত পৌঁছালে কারোই মাথা ঠিক থাকবে না।
নিহানের বাবা কথাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললেন, মেয়েটাকে কিছু খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে দাও। মনিরাকে বলে দিও আজ রাতে যেনো এখানেই ফ্লোরে বিছানা করে শুয়ে পড়ে।
উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজের রুমে চলে গেলো নিহানের বাবা। বেলকনির ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে নিলেন। নিহান তাদের একমাত্র সন্তান, তাই সবসময় আদর ভালোবাসায় ভড়িয়ে রেখেছে। আজ ছেলের গায়ে হাত তুলে তারও খারাপ লাগছে। কিন্তু ছেলেটার আচরণ দিন দিন তার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। মানুষকে মানুষ মনে করে না যেনো সে।
ছাঁদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে নিহান। রাগে হাত-পা কাঁপছে। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার বাবার হাতে থাপ্পড় খেলো নিহান। বেশ কিছু বছর আগে একবার থাপ্পড় খেয়েছিলো আমিরার বড় ভাই মানে নিহানের চাচাতো ভাইয়ের জন্য আজ খেলো ইসরার জন্য। ইসরার উপর নিহানের রাগটা যেনো তরতর করে বেড়ে চলেছে।
৯.
সকালে ইসরার ঘুম ভাঙলো ফজরের আযান কানে আসতেই। উঠে বসতে বেশ বেগ পেতে হলো শরীর দূর্বল থাকায়। ডিমলাইটের আলোতে মনিখালাকে দেখলো ফ্লোরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আজ ইসরার ঘুম এতোটাই গভীর ছিলো মনিরা এতো শব্দে নাক ডাকা তার ঘুমে অসুবিধা করে উঠতে পারেনি। ইসরা ধীর পায়ে বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আয়নায় তাকালে গালের দিকে খেয়াল হলো। দাগটা কমে গেলেও ব্যাথাটা রয়ে গেছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হয়তো থাপ্পড় দুটো মেরেছিলো। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে রুমে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো। এতোদিন এতোটাই হতাশ হয়ে গিয়েছিলো নামাজ পড়াটাও অনেকটা হেলাফেলা করেছে। আজ মনটা হালকা করতে ইচ্ছে করছে কারণ ইসরার মনে হচ্ছে কেউ তার বুকে একটা পাহাড় সমান পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। মন হালকা করার জন্য নামাজের থেকে ভালো কোনো উপায় ইসরার জানা নেই। নামাজ শেষ হতেই মনিরাকে দেখলো উঠে গেছে আর নিজের বেড গোছাচ্ছে। সে অবশ্য প্রতিদিনই খুব সকালে উঠে নিজের কাজ শুরু করে দেয়। এই বাড়ির সবাই সকাল আটটার মধ্যে নিজেদের ব্রেকফাস্ট সেরে নেয় আর পরে নিজের অফিস টাইমে বের হয়ে যায়।
জায়নামাজ ভাজ করে ইসরা বললো, একটু বাইরে নিয়ে যাবে মনিখালা ? অনেকদিন হয়ে গেছে প্রাণ ভড়ে নিশ্বাস নিতে পারি না।
ইসরার কথায় অনেক মায়া হলো মনিরার, তাই রাজি হয়ে গেলো। ইসরার থেকে একটু সময় চেয়ে নিলো ফ্রেশ হাওয়ার জন্য। অনুমতি পেয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো সে। ইসরা বেলকনিতে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো। সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ব্যস্ত ঢাকা শহর এখনো পুরোপুরি জেগে উঠেনি তাই গাড়ির হর্ণ শোনা যাচ্ছে না তেমন। যদিও আবাসিক এলাকা হওয়ায় প্রাইভেট কার, সিএনজি আর রিকশা ছাড়া অন্য যানবাহন খুব কমই চোখে পড়ে সামনের রাস্তাটায়।
চলো গো মেয়ে।
মনিরার কথায় ইসরা চোখ সরিয়ে নিলো সামনে থেকে আর মনিরার দিকে তাকালো।
তয় যাইবা কই বলো দেখি ? বাড়ির সামনে যে বাগান আছে খুব একটা বড় না।
আশেপাশে পার্ক আছে ?
মনিরা একটু ভেবে বলে উঠলো, হ আছে তো, সকালবেলা সেইহানে মানুষের মেলা বহে যেন। সবাই কোনোদিকে না তাকাইয়া শুধু হাঁটে।
ইসরা মুচকি হাঁসলো, মনিরা যে ডায়াবেটিস রোগীদের কথা বলছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। কথা না বাড়িয়ে পাশের পার্কটার দিকে যেতে লাগলো ইসরা।
আইজ তোমারে একটু মানুষ মনে হইতাছে।
কেনো এতোদিন কী মনে হয়েছে ?
কাঠের পুতুল।
ইসরা আবারো মুচকি হাঁসলো আর বললো, আজ আমার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। তাই চাইছি আজ দিনের শুরুটা ভালো করতে, যাতে শেষটা ভালো হয়।
মনিরা হা করে তাকিয়ে বললো, তুমি ডাক্তার হইবা ?
ইসরা ছোট করে উত্তর দিলো, হুম সেটাই এখন আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
কথায় কথায় পার্কে চলে এলো। সকালে মানুষ এসব জায়গায় আসে মর্নিং ওয়াক করতে আর বিকেলে আড্ডা দিতে আসে অনেকে, আবার কেউ আসে প্রেম করতে। এখন যেহেতু সকাল তাই বসার জায়গাগুলো ফাঁকাই পরে আছে। ইসরা একটু ফাঁকা জায়গা দেখে বসলো। অনেক দিন পর মুক্ত আকাশে নিশ্বাস নিয়ে মন্দ লাগছে না ইসরার। বুকের ভারী ভাবটাও অনেকটা হালকা হয়ে গেছে।
এইটা তোমার ছেলের বউ না আকরাম ?
বন্ধু আলীর সাথে প্রতিদিন এখানেই মনিংওয়াক করে নিহানের বাবা আকরাম রেজওয়ান। আজও হাটছিলেন কিন্তু বন্ধুর কথায় পা থেমে গেলো। আলীর আঙ্গুল অনুসরণ করে তাকিয়ে ইসরাকে বসে থাকতে দেখলো মাথায় ঘোমটা দিয়ে আর পাশেই মনিরা দাঁড়িয়ে। আকরাম কী করবে বুঝতে পারছে না ? বড্ড রাগ হচ্ছে মেয়েটার উপর। এমনিতেই নিহানকে গতরাতে থাপ্পড় মারা নিয়ে উনার মুড অনেক খারাপ। এখন ইসরাকে বাইরে দেখে বেশ রেগেই গেলেন। উনি ইসরার কাছে যাওয়ার আগেই কিছু মহিলা সেখানে উপস্থিত হয়ে গেলো।
এই তুমি সেই মেয়ে না, রেজওয়ান বাড়ির নতুন বউ ?
ইসরা চুপ থাকলেও মনিরা ফট করে বলে দিলো, হ তয় কী অইছে ?
তারা নিজেদের মধ্যে বলে উঠলো, মেয়েটা সত্যি অনেক কালো। নিহান ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে ডিভোর্স দেওয়ার। এমন মেয়ে নিয়ে কী সংসার করা যায় ? এর হাতের খাবার খেতেও তো ঘেন্না লাগবে। হাজারবার হাত ধুয়ে এলেও মনে হবে ময়লা লেগে আছে। তার উপর আবার বাটপারিতেও পাকা।
ইসরা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে তাদের প্রত্যেকের মন্তব্য।
এমন মেয়ে দেখেশুনে কেউ বিয়ে করবে না, বাপ সেটা বুঝে গিয়েছিলো আর তাই এমন জালিয়াতি করার পরিকল্পনা করেছে।
তুমি বাড়ির বাইরে এসেছো কাকে বলে ? তুমি না অসুস্থ, তাহলে এই অবস্থায় বাইরে এসেছো কেনো ?
মোটা আর গম্ভীর গলা শুনে ইসরা ঘুরে তাকিয়ে নিহানের বাবাকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। আজ এটা নিয়ে আবার কী ড্রামা হবে কে জানে। ইসরা ভেবেছিলো কেউ জানার আগেই আবার বাসায় চলে যাবে কিন্তু সবটা এভাবে ঘেটে যাবে বুঝতে পারেনি। ইসরার এখন ইচ্ছে করছে দেয়ালে মাথা ঠুকে হিসাব করার। আজ কী সে দিনের শুরুটা ভালো করতে এসেছিলো নাকি অন্যদিনের থেকে আরো একটু বিষিয়ে তুলতে এসেছিলো এখানে ? দিনের শেষটা কেমন হবে সেটাই চিন্তা করছে ইসরা কারণ তার উপরই ইসরার পুরো জীবন নির্ভর করছে।
চলবে,,,,,
(শুধু এটুকুই বলবো সারাদিন অনেক ব্যস্ত ছিলাম। এখন যতটা লিখতে পেরেছি পোস্ট করলাম।)