ধূসর রঙের প্রজাপতি পর্ব ৪৮+৪৯+৫০

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_48

এক সাথে এতো গুলো অচেনা মুখের সামনে দাড়িয়ে আছে ঝিল। কয়েক মিনিটের দেখাতে কি চেনা হয় ?
প্রতি টি মানুষ কে এক বার কিংবা দুবার দেখেছে। কারো সাথেই কথা হয় নি। সবার মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে কার্টুন মনে হচ্ছে। কোন স্থানে ছিলো আর আজ কোন স্থানে আসতে হয়েছে। ভেতর থেকে ভয় যেন গলা টিপে ধরেছে। শুকনো ঢোক নেওয়া টা ও দুষ্কর হয়ে পরেছে। প্রতি টা সদস্য ই তাঁর থেকে বড় শুধুমাত্র ফুল রূপা আর দানেশ ছাড়া।
বার বার ফুলের দিকে তাকাচ্ছে ঝিল। এক হাতের পাঁচটি আঙুল ই মুখে পুরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। যেন গভীর মনোযোগে দেখছে সে। ঝিল বিষয় টা আরক্ত করতে পারলো না। ইহরিমা ভাইয়ের দিকে করুন চোখে তাকালেন। মেয়েটা কে সাহস দিবে যে তাঁর ও যো নেই। ইববান ঝিলের দিকে তাকালেন না। মেয়েটার মুখ দেখে ভেতর থেকে মায়া আসে। তবু ও গলে গেলে চলবে না। তাই কঠোর কন্ঠে বললেন
_ ওকে বুঝিয়ে দাও , পরিপূর্ন বউ হতে গেলে যা যা করতে হবে। আর একটা কথা এটা শিকদার বাড়ি তাই মির্জা বাড়ির মতো যা ইচ্ছে করবে বা এক মাত্র রাজকন্যা হলে চলবে না।

কথা গুলো বলেই গটগট করে চলে গেলেন ইববান। বড় মামুনির মায়া হলো তবে স্বামীর নির্দেশ আছে ঝিল কে কেউ সাহায্য করতে পারবে না। ঝিল কে গেস্ট রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ঝিল মাথা টা নিচু করে নিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলল
_বড় মামুনি আমি কি অভিনবর ঘরে থাকতে পারি ?

ভারী অবাক হলেন ওনি। ঝিলের মায়া ভরা মুখের দিকে তাকাতেই চোখ ভরে উঠলো। বিনাবাক্য ইশারা করে অভিনবর ঘর টা দেখিয়ে দিলেন। ঝিল অদ্ভুত ভাবে হাসলো। অভিনবর ঘরের দিকে ছুটে গেল। প্রতি টা স্থানে অভিনবর ছোঁয়া রয়েছে।

বাচ্চাদের মতো আচারন করছে ঝিল। ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে ফুল সেটাই দেখছিলো। এখনো মুখে আঙুল পুরে রেখেছে। এক পর্যায়ে ঝিলের চোখ যায় ফুলের দিকে। লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে
_ তুমি এখানে ?

ফুল লজ্জায় পরে যায়। মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যে ই ফুলের সাথে ভাব জমে যায় ঝিলের। ফুলের সাথে হাসি ঠাট্টা করছিলো তখনি রুমে আসেন ইহরিমা। ফুল কে ইশারায় চলে যেতে বলে ঝিলের কাছে আসেন।
মাথা নত করে রাখে ঝিল। মনের ভেতর উসখুস করতে থাকে। ইহরিমা মৃদু স্বরে বলেন
_ তোকে আমার মেয়ে হতে হবে পারবি না ?

প্রচন্ড অবাকের সহিত তাকায় ঝিল। অবিশ্বাসের চোখে বলে
_ আমি !

_ হুমম। আমার তো মেয়ে নেই পারবি না কিছু পরীক্ষা দিয়ে আমার মেয়ে হতে ?

_ আন্টি

_ আম্মু বলতে হবে।

ঝরঝরে কেঁদে উঠে ঝিল। ইহরিমার চোখে পানি চিক চিক করছে। মেয়েটাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরেন। পর পর কয়েকটা চুমু খেয়ে বললেন
_ আমরা কেউ তোকে সাহায্য করতে পারবো না। তবে দোয়া তো থাকছেই , আমার মেয়ে হতে হলে একটু পরীক্ষা যে দিতেই হবে।

_ আমি পরীক্ষা দিতে পারবো আম্মু। শুধু ভরসা রাখবেন। মামাদের সমস্ত পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হবোই।

প্রাপ্তির হাসি হাসেন ওনি। অভিনব কথা বলবে তাই ঝিল কে ফোন অন করতে বলে চলে যান।

ফোন অন করতেই কল চলে আসে। নাক টেনে ঝিল বলে
_ হ্যালো

_ কেঁদেছো তুমি ?

_ না তেমন কিছুই না। কি করছো ?

_ মশার কামড় খাচ্ছি।

_ মানে ?

_ আগে বলো মামা রা কি শর্ত দিয়েছে তোমায় ?

_ পরিপূর্ন সংসারী হতে হবে। বাড়ির অন্য বউ রা যেভাবে কাজ করে ঠিক সেভাবেই কাজ করতে হবে ।

_ হোয়াট ! তুমি পারবে তো ঝিল ? ঘর কন্যার কাজে তুমি তো একদম ই কাঁচা। ইসস

_ আমি চেষ্টা করবো অভিনব। তোমাকে পাপা রা

ঝিলের কথা শেষ করতে দিলো না অভিনব । কথার সুর পাল্টে নিয়ে বললো
_ তোমার পাপা রা আস্ত এক পাষান। গেস্ট রুম তো দূরে থাক সার্ভেন্ট রুমে ও আমার জায়গা হয় নি।
স্টোর রুমে থাকতে দিয়েছেন। যেখানে মশার চাষ করা হয়। বাট আই ক্যান ম্যানেজ।

ঝিলের মন খারাপ হয়ে গেল। স্টোর রুমে থাকতে হচ্ছে। পাপাদের এমন আচারনের কারন বুঝে নিলো ঝিল। এরা অভিনবর ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছে। বিদেশে বড় হওয়া অভিনব কি করে থাকবে ?
_ ঝিল কথা বলছো না কেন ?

_ তুমি কি করে থাকবে ?

_ উফফ তুমি আস্ত এক গাঁধা। আমি ট্রাভেলার আমার সব ধাঁচের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে।
ট্রাস্ট মি তোমার পাপাদের এমন টাইট দিবো ।
আচ্ছা যাই হোক খেয়ে নিও। দেখি তোমার প্রিয় পাপা রা আমার জন্য কোন আদরের ব্যবস্থা করেছেন। এসে থেকে যা জামাই আদর করছেন।

ঝিল ফোন রেখে দেয়। মনে তিক্ততা চলে আসলো । এমন বিদঘুটে পরীক্ষা নেওয়ার আইডিয়া কার মাথা থেকে এসেছে?
নিশ্চয়ই সেই ব্যক্তি প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছে। নিজ ভাবনায় থতমত খেয়ে যায়। প্রচুর ক্লান্ত থাকায় ডিবাইনেই ঘুমিয়ে পরে।

দুই হাতে কপাল চাপকে ধরে নেয় অভিনব। পায়ের আঙুল গুলো উঠা নামা করে মেঝে তে ছন্দের সৃষ্টি করতেই ডাক আসে ছেলেটার। এক রাশ বিরক্তি ফুটে উঠে। মশার কামড় খেয়ে শরীর যেন ফুলে উঠেছে। স্টোর রুম টাকে জঙ্গলের থেকে ও বিদঘুটে মনে হচ্ছে।
মনে মনে দু চার টে গালি দিতে লাগলো। রাফাতের কাঁধে হাত রেখে রসিকতার স্বরে বলল
_ তোমার গ্রেট বাবা কাকারা আমার কল্লা কাঁটার জন্য ডেকেছে বুঝি ?

_ খানিক টা তেমনি ভেবে নিন। হাঁসের খামারে পাঠাবে আপনাকে। তা ও হেঁটে যেতে হবে কয়েক মাইল। মির্জা পুরের শেষ মাথাতে আমাদের বিশাল খামার।

_ হেঁটে কেন ?

_ আরামের কথা ভুলে যান ভাই। আমি নিজে ও বুঝলাম না এমন শাস্তি কেন দিচ্ছে।
ঝিলের জন্য মন খারাপ হচ্ছে বেচারি জানতে পারলে কেঁদে ভাসাতো।

গা দুলিয়ে হাসে অভিনব। হাঁসের খামারে যাওয়া হয় নি কখনো। ভালো ই হবে নতুন এক এক্সপেরিয়েন্স হবে। রাফাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
_ আমার বোন টা খুব লাকি তাই না অভিনব ভাই ?

_ লাকি তো আমি , তোমার বোন আমার জীবনে আসায় আমি নতুন কে জানতে পেরেছি । রঙিন আকাশে ধূসর রঙের প্রজাপতি টা খুব মানায় বুঝেছো । তোমার বোন টা ও তেমনি, আমার মন আকাশের ধূসর রঙের প্রজাপতি।

রাফাত হাসলো। দু চোখ ভরে দেখলো অভিনব কে। ভালোবাসলে এমন ভাবে বাসো যাকে ছাড়া প্রতি টা মুহুর্ত হবে মৃত্যুসম।

*
বোনাস পার্ট

সাত দিন ধরে কাহিল অবস্থা অভিনবর। হাঁসের খামারের মতো বিশ্রী জায়গায় রোজ যাওয়া আসা করতে হচ্ছে। তা ও পায়ে হেঁটে সাথে হাঁসের ময়লা পরিষ্কার করতে হয়। গন্ধে বমি চলে আসে তাঁর । অন্য দিকে প্রথম দিন চা বানাতে গিয়ে হাত পুরিয়ে ফেলেছে ঝিল। অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে পুরো বাসা ঝারু দিতে হয়েছে। দুজনের এক জন ও এ বিষয়ে একে অপরকে অভিযোগ করে নি । হাসি মুখে সহ্য করে নিয়েছে।
হায়রে ভালোবাসা , দু পরিবার থেকেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে । প্রতিযোগিতা চলছে কে বেশি শাস্তি দিতে পারে। সারা দিন গরুর মতো খেটে রাত এগারোটায় স্বস্তি পেয়েছে অভিনব। ফোনে চার্জ নেই , দ্রুত চার্জ দিয়ে কল লাগালো।
দু বার রিং হতেই ফোন রিসিভ করলো ঝিল।
_ কেমন আছো ঝিল ?

_ ভালো তুমি ?

_ আমি ও ভালো আছি। রান্না করতে হয়েছে আজ ?

_ হ্যাঁ । ইউটিউব এর সাহায্য নিয়েছিলাম। তুমি যা যা বলেছিলে ভুলে গিয়েছি।

_ সমস্যা নেই। আমি আবার বুঝিয়ে দিবো। সহজ ভাবে সব কিছু করবে বুঝলে। আর আগুন থেকে একটু সাবধান ঝিল।

ঝিল উত্তর দিলো না। পোরা হাতের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। বেশ খানিকটা চামড়া উঠে গেছে। ঝিলের মনে ভয় জাগলো তখনি অভিনব বলল
_ ভিডিও কল দেই ভালো লাগছে না কতো দিন ধরে তোমায় দেখি না।

ঝিল নাকোচ করে দিলো। নানান বাহনা দিলে ও অভিনবর খটকা লাগলো। ঝিলের কথার মূল্য দিলো অভিনব। শ্বাস নিয়ে বলল
_ চাঁদ দেখবে ঝিল?

_ তুমি পাশে না থাকলে চাঁদ টা ও যে বিষাক্ত লাগে।

_ আমি আছি তো। এই যে ফোনের এপাশ থেকে আমরা একে অপরকে অনুভব করবো।
যদি তুমি ক্লান্ত না থাকো তো আমি তোমার মাঝেই স্বস্তি নিতে চাই ঝিল। আমি খুব ক্লান্ত।

অশ্রু ভেজা নয়নে পাপড়ি গুলো মেলে দিলো। হাতের যন্ত্রনা টা বেড়ে গেছে। কোনো মতে গাঁয়ের সাথে চেপে রেখে বলল
_ এতো ভালোবাসো কেন ? আমি তো মরেই যাবো।

_ তাহলে এক সাথে মরে যাই চলো ?

ভেজা পাপড়ি মেলে দিয়ে পিট পিট করে তাকিয়ে ঝিল হাসলো। অভিনবর বুকে মাথা রাখতে পারলে দারুন শান্তি মিলতো।
চার্জ শেষ না হওয়া অব্দি কথোপকথন চললো।
প্রেম এমনি এক অনুভূতি যার কাছে ব্যথা বলতে কিছুই নেই। সব টাই সুখ।

মাঝে কেঁটে গেছে অনেক গুলো মাস। এরি মাঝে ঘটেছে দারুন কিছু ঘটনা। একদিন সকালে বাগানে পানি দিচ্ছিলো অভিনব। জাফর নিয়মিত ব্যায়াম করেন। অসতর্কতার কারনে পা পিছলে যায়। সে দৃশ্য দেখে ঝিলের পাঁচ ভাই আর বড় দু কাকা গগন কাঁপিয়ে হাসেন।
অভিনব হাসতে চেয়ে ও হাসে নি। উল্টো জাফর কে সাহায্য করেছে। হাজার হোক শশুর তো । অন্য দিকে আগুনের তাপে হাত মুখে কালি জমে গেছে ঝিলের। প্রতি টা কাজে আজ সে দক্ষ । যার সম্পূর্ন ক্রেডিট অভিনবর। প্রতি টা কাজ কে সহজ করে দিয়েছে সে। মোট কথা দূরে থেকে ও যেন দূরে নেই। নিজ হাতে গড়ে তুলেছে ঝিল কে। ভালোবাসার ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়েছে। কয়েক মাসে চলেছে মিষ্টি প্রেম। সময় পেলেই কথোপকথন। রাতে চন্দ্রবিলাশ এমনকি তাঁরা ও গুনেছে দুজনে।
নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়েছে। ঘন্টার পর ঘন্টা পার করে দিয়ে একে অপরের নিশ্বাস শুনে। ভালোবাসা বেড়েছে বই কমে নি।
উল্টো একে অপরের কঠিন সময় গুলো তে সাপোর্ট করেছে। অভিনবর একটু বেশি ই কষ্ট হয়েছে। কারন যে সব কাজ কর্ম তাঁকে দেওয়া হয়েছে সেগুলো এক প্রকার টর্চার যা ঝিলের ক্ষেত্রে সহজ করা হয়েছে।
পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইকবাল। অভিনব কে কিছুতেই হার মানানো গেল না। কঠিন কাজ গুলো খুব সহজেই করে নিচ্ছে অভিনব।
এক দিকে যেমন বিরক্ত হচ্ছে অন্য দিকে সুখ ও লাগছে।
তাঁদের মেয়েটা কে ভালোবাসার জন্য যোগ্য এক হাত পেয়েছে।
যদি ও অভিনবর পরীক্ষা এখনো শেষ হয় নি।

জাফর আর মনিরুল কে ডেকে পাঠান ইকবাল । গভীর সমাবেশ বসান।
_ অভিনব সম্পর্কে তোমাদের কি মতামত ?

_ আমার কাছে তেমন আহামরি মন্তব্য নেই ভাই। কারন ছেলেটা দেখতে বিদেশি দের মতো হলে ও মনের দিক থেকে সৎ।
কারো প্রতি গভীর ভালোবাসা না থাকলে এতো টা টর্চার সহ্য করতে পারতো না।

_ আমি ও মনিরুলের সাথে এক মত। জাফর কিছু বলবি ?

_ আমি জানি অভিনব ছেলেটা যথেষ্ট ভালো তবে এতো সহজে আমি ছাড়ছি না। ওর বিশেষ পরীক্ষা নিবো। ঝিলের জন্য প্রান দেওয়ার মনোবল আছে নাকি সেটাই দেখার অপেক্ষা।
শিকদার পরিবার কে খবর পাঠাও বিশেষ অনুষ্ঠান হবে।

*

দু হাতে মেহেদী লাগিয়েছে ঝিল। রূপা জোড় করে পরিয়েছে। ঝিলের হাতে মেহেদীর রঙ টা বেশ ভালোই লাগছে। অভিনবর নাম টা লিখতে পারলে ভালো হতো।
কালো চুল গুলোতে কেমন জটলা বেঁধেছে। প্রায় বছর খানেক হতে চললো এ বাড়ি তে।
মির্জা বাড়ির সাথে তেমন যোগাযোগ হয় না।
ইচ্ছে করেই কথা বলে না। প্রচুর রেগে আছে যদি ও সে রাগের পাত্তা কেউ দেয় না।
পর পর তিন বার বুক ভরে শ্বাস নেয়। কতো দিন পর অভিনবর সাথে দেখা হবে। নিজের বাসায় পা রাখা হবে ভাবতেই খুশি অনুভব হচ্ছে।
_ ভাবি হয়েছে তোমার ?

_ আসছি রূপা।

দ্রুত চুল বেঁধে নেয় ঝিল। রূপার কাছে গিয়ে বলে
_ ধীরে বলো তোমার বাবা কাকারা শুনতে পেলে আমার আর তোমার ভাইয়ার গর্দান যাবে।

ঠোঁট টিপে হাসে রূপা। ফুল কে গাড়ি তে বসিয়ে এসেছে।
শাড়ি তে বেশ পরিপাটি লাগছে ঝিল কে। বউ বউ ভাব এসেছে। মুখের জৌলুস টা যেন মুহুর্তেই বেড়ে গেছে। নিচ থেকে মুজাহীদের কন্ঠস্বর ভেসে আসে। ঝিল দ্রুত হাঁটা লাগায়।

অভিনবর কাঁধে অনেক কাজ। পুরো পার্টির আয়োজন একা হাতে সামলাচ্ছে সে। লাইটিং নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে সেগুলো ই সামলাতে দফা রফা।
আশে পাশে তাকিয়ে মাহিন কে দেখতে পেল। একা সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। ইশারায় মাহিন এর সাহায্য চাইলো। অতি সর্তক হয়ে মাহিন সম্মতি জানালো। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাগানে আসতেই পেছন থেকে চিরচেনা সেই কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। বুকের ভেতর ধীম ধীম আওয়াজ হচ্ছে। অভিনবর রক্তে যেন শীতলতা নেমে গেল। আশ্চর্য হলে ও সত্য পেছন ঘোরার শক্তি টুকু পাচ্ছে না সে।
হঠাৎ করেই ঝিলের আর্তনাদ ভেসে উঠে। অভিনবর অন্তর কেঁপে উঠে। পেছন ফিরে ঝিল বলে চিৎকার করে উঠে।
ঝিলের চারপাশে আগুন জ্বলে উঠেছে। মূলত ডিজাইনের জন্য আগুনের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। বিদুৎ সংযোগ দেওয়া লাইনে ঝিলের পা লাগায় ধাউ ধাউ করে আগুন উঠে যায়। সব থেকে করুন বিষয় আগুন টা ক্রমশ এক ধাপ করে আগাচ্ছে। আর সঠিক লাইন অভিনবর জানা নেই। পাগলের মতো করে উঠে অভিনব। ঝিলের ভয় লাগছে তবে অভিনবর আচরনে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠছে। হাত দিয়ে ইশারা করছে যাতে অভিনব না আসে। তবে সে দিকে খেয়াল নেই তাঁর। আগুনের তাপে ঝিলের অবস্থা কাহিল। মাথা ঘুরিয়ে পরে যায় সে। তৎক্ষনাৎ বাচ্চাদের মতো আচারন করে ফেলে অভিনব। আগুনের মাঝেই ঝাঁপ দিয়ে যায় ঝিলের কাছে । যার কারনে গায়ে থাকা শার্টে আগুন ধরে যায়। শরীরের বেশ কিছু অংশে পুরে যায়।
শার্ট টা খুলে ফেলায় বেঁচে যায় । আশ্চর্য হলে ও সত্য সবাই তখন চলে আসে আর আগুন ও থেমে যায়।
জাফর হুমড়ি খেয়ে পরেন। ঝিলের ক্ষতি হয় নি দেখে নিশ্বাস ফেলেন। মেয়েটাকে সর্বোচ্চ কষ্ট দিলেন আজ।
চোখ দুটো ভিজে যায় অভিনব দু হাতে জড়িয়ে আছে ঝিল কে। আগুন নিভে গেছে সে দিকে খেয়াল নেই।
রোহন দ্রুত বেগে অভিনবর পাশে এসে বসে।
_ আব্বু অভিনব ভাইয়ের শরীরের বেশ কিছু অংশে চামড়া জ্বলে গেছে।

সবাই অভিনবর উন্মুক্ত পিঠের দিকে তাকায়। ফর্সা পিঠে ভয়ঙ্কর ছাপ। জাফর অনুশোচনায় ভোগেন তবে অভিনবর ভালোবাসা আজ তাঁকে মুগ্ধ করেছে। নিজের মেয়ের জন্য এর থেকে ভালো কাউ কে সত্যি ই পাবেন না ওনি। দ্রুত ডাক্তার কে ফোন লাগান।

অভিনবর মাথার কাছে বসে আছে ঝিল। সবাই কে রুম থেকে বের করে দিয়েছে সে। আজ যেন নতুন রূপ নিয়ে এসেছে মেয়েটা। প্রচন্ড তেজ আর অধিকার বোধ। অভিনবর দিকে করুন দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে। অভিনবর ঠোঁটের কোনে হাসি। ঝিলের নাক ফোলানো দেখছে সে। সাথে ঠোঁট উল্টানো টা যেন ওকে সম্মোহিত করে তুলেছে।
_ আরো রেগে থাকবে ?

_ কথা বলবে না তুমি । তোমরা সবাই বাজে , পাপার সাথে তো আমি কখনোই কথা বলবো না।
যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো ?

_ তো কি হতো ?

_ আমি মরে যেতাম।

অভিনবর বুকে মাথা গুঁজে দেয় ঝিল। কান্নার উত্তাপে গাল দুটো রঙিন হয়ে গেছে উজ্জ্বল রঙে ব্যথার ছাপ যেন রঙধনুর মতো সেজেছে।
আলগা হাতে স্পর্শ করে অভিনব। খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারে না তাই নরম হাতে জড়িয়ে ধরে।
ঝিলের চোখের পানি অভিনবর ঘাড়ে পরে পুরে যাওয়া স্থানে জ্বালা সৃষ্টি করে। তাঁতে ও যেন সুখ অনুভূত হয়। হঠাৎ করেই অভিনব এক বিশ্রি কাজ করে ফেলে। ঝিলের চোখ বেরিয়া যাওয়ার উপক্রম।
নিজেকে ছাড়িয়ে রাগি চোখে তাকায়। অভিনব অনুনয়ের স্বরে বলে
_ স্যরি। বউ কে কাছে পেলে মানুষের হুস থাকে ?

_ ছিইই তাই বলে অসুস্থ শরীরে কিস ?

দুষ্টু হাসে অভিনব। ঝিল সে হাসি উপেক্ষা করে ডয়ার থেকে মলম নিয়ে খুব যত্নে লাগিয়ে দেয়।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_49

দু পরিবারের মাঝে সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে মাস দুয়েক। নেই কোনো আড়ষ্ঠতা আর না আছে কোনো দ্বন্ধ। দুই এলাকার মানুষ যেন ধরে প্রান ফিরে পেয়েছে। খুনা খুনি না হলে ও রক্তারক্তি হয়েছে বহু বার। ভয়ে থাকতে হতো সবাই কে। মির্জা পরিবার আর শিকদার পরিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গেট টুগেদারের মাধ্যমে বিয়ের বিষয় টা ঘোষনা দিবে। তবে অভিনব বাঁধা দিয়ে বলেছে সে আর ঝিল প্রাকৃতিক সান্নিধ্যে পেতে চায়। যেহেতু সময় টা বর্ষাকাল আর গত বছরে হাওর যাওয়ার সুযোগ ছিলো না তাই তাঁরা সেখানে যাবে।
কেউ অবশ্য দ্বিমত করে নি। তবে কথা দিতে হয়েছে বিদেশ ভ্রমনের পূর্বে বিশাল গেট টুগেটার এটেন্ট করতে হবে তাঁদের । স্বাদরে গ্রহন করেছে অভিনব। ঝিল ও সম্মতি প্রকাশ করেছে।

ব্যাগ প্যাক গোছাচ্ছে অভিনব। এতোক্ষনের মৌনতা ভেঙে ঝিল পাশে এসে বললো
_ হাওর তো পরে ও যেতে পারতাম !

_ উহহুহ পরে যাওয়া যেতো না !

_ কেন ?

_ ভুলে গেলে বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওর এর আসল সৌন্দর্যের দেখা মিলে ?

_ সবাই কে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।

ব্যাগ গুছিয়ে কাবাডে রেখে অভিনব নাছোড়বান্দা সুরে বলল
_ সেটা বললে তো হবে না। সংসারী হয়ে গেছো সেটা ভালো তবে ভ্রমন ছাড়া তো যাবে না। প্রকৃতির সান্নিধ্য না পেয়ে পাঁচ কেজি ওজন বাড়িয়ে 53 তে চলে এসেছো। কোলে নিতে অসুবিধা হয় মিসেস।

_ খোঁটা দিচ্ছো ?

_ উহহুহ খোঁটা কেন দিবো ? বউ কে খোঁটা দেওয়ার সাধ্য আমার আছে ?

মুখ বাঁকিয়ে নেয় ঝিল। সত্যি পনেরো মাসে পাঁচ কেজি ওজন বেড়ে গেছে। এটা মোটে ও ভালো কথা নয়। আচ্ছা সত্যি কি অভিনবর কষ্ট হয় ?
মুখে কাঠিন্য এনে বলল
_ আমাকে কখনো কোলে নিবে না আর !

_ কেন?

_ আমি যাকে তাকে কষ্ট দিতে চাই না !

_ ওকে !

অভিনবর নিদারুন উত্তরে খেপে গেল ঝিল। মাথার ট্রাওয়াল টা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। অভিনব আড়চোখে দেখে হাসলো। ঘর থেকে বের হবে তাঁর আগেই অভিনব পথ আটকে বলল
_ কোথায় যাও ?

_ কোথাও না !

_ রাগ করেছো ?

_ নাহহ যাঁর তাঁর সাথে ঝিল রাগ করে না !

কালো কুচকুচে আঁধারে পূর্ণিমার দেখা মিলেছে। কাঁচের ভেতর দিয়ে রাতের পরিবেশ টাকে নির্মূল লাগছে। ঝিলের মোচরামোচরি উপেক্ষা করে কোলে তুলে নিলো অভিনব।
প্রচন্ড অবাকের সাথে অভিমান হলো মেয়েটার। অভিনব তাঁর ঝকঝকে হাসি দিয়ে বলল
_ প্রেম নাকি আঁধার ম্লান ?

_ কোনটাই নাহহ !

_ ওকে তোমার ইচ্ছে ।

অভিনব বেডের দিকে যেতেই খচখচ করতে লাগলো ঝিল। একটু আগে শপিং মল থেকে এসেছে প্রচন্ড ক্লান্ত সে। অভিনবর তাঁতে ধ্যান নেই। বাঁকা হেসে বলল
_ চয়েজ করার সুযোগ দিয়েছিলাম মিসেস। আপনি তা অবঙ্গা করেছেন এখন আমার চয়েজেই সন্তুষ্ট থাকুন।

_ নো অভিনব দেখো

ঝিল কে বলার সুযোগ দেয় না সে। আঁধার কে লজ্জায় ফেলতে বাধ্য করে। তাই তো পূর্ণিমার চাঁদ টা ও নুইয়ে যায় আকাশের বুকে। ভালোবাসার গহীনে ঝিল ওহ নুইয়ে যায় অভিনবর বুকে।
প্রকৃতির সাথে মানুষের বড্ড মিল।

.

সকাল সকাল দারুন এক খবরে লাফিয়ে উঠে ঝিল। ফোনের ওপাশ থেকে লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে মৌনতা। অতি লজ্জায় কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বেডের উপর হাঁটু গেড়ে বসে ঝিল। প্রচন্ড খুশি তে চোখ উজ্বল হয়ে গেছে। ততক্ষণে অভিনবর ঘুম ভেঙে গেছে। ঝিল এক পলক তাকিয়ে ফোনে মনোযোগ দেয়। আগ্রহীর স্বরে বলে
_ তারপর কি হলো ? ভাইয়া তোকে প্রপোজ করার পর তুই কি করলি ?

_ কি করবো এক্সসেপ্ট করে নিলাম।

_ বাহহ এতো কিছু হয়ে গেল আর আমি কিছু ই জানতে পারলাম না ?

_ কাল রাতে রোহন তোকে অনেক বার কল করেছে তুই ফোন তুলিছ নি।

দাঁত দিয়ে জ্বিভ কাটে ঝিল। লজ্জায় পরে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে
_ পাপা দের জানিয়েছিস তোদের কথা ?

_ আজ সকালে রোহন জানিয়েছে। আমি ও বাসায় জানিয়েছি। পজিটিভ উওর মিলেছে।

খুশি তে চিৎকার করে উঠে ঝিল। অভিনবর ভ্রু কুঁচকে যায়। ঝিল এতোটাই অন্যমনস্ক যে অভিনবর কোলে শুইয়ে পরে। একটু পর পর হাসছে সাথে অভিনবর গাঁয়ে চড় থাপ্পড়। ঝিলের কান্ডে অবাক হয় অভিনব। কথা শেষ হতেই থতমত খেয়ে যায় ঝিল।
নিজেকে ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। অভিনব এক ভ্রু নাচিয়ে হাসে , ঝিল সে হাসির মানে বুঝতে পেরে ছুট লাগায়।

*

ব্রেকফাস্টের টেবিলে মাথা নিচু করে খাচ্ছে ঝিল। অভিনবর জ্বালায় শান্তি মিলছে না। হাত দিয়ে না হয় পা দিয়ে খুঁচিয়ে যাচ্ছে। এক সময় প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠে যায় সে। অভিনব মুচকি হেসে বলে
_ আমরা আজ রাতেই রওনা হবো। রোহন আর মৌনতা ওহ আমাদের সাথে যাচ্ছে। ঝিল কে কেউ জানিয়ে নাহ।

_ কয় দিনের জন্য যাচ্ছো তোমরা ?

_তিন রাত লাগবে পাপা।

_ আচ্ছা তাহলে আমরা সবাই ওহ তো ট্যুর দিতে পারি কি বলেন বড় ভাই ?

ইববান একটু রুটি মুখে পুরে নেন। ইচ্ছে যে তাঁর ও করছে। আহা কতদিন প্রকৃতির সাথে মিতালি গড়া হয় না।
লিটন আর মুজাহীদের দিকে তাকাতেই দুজন হাসি মুখে সম্মতি জানায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে হুলস্থর লেগে যায়। সবাই বেশ খুশি হয়। অভিনবর ইচ্ছে হলো পরিবারের সাথে যাওয়ার তবে এখন তা সম্ভব নয়। পরে যাওয়া হবে বলে নিজ মন কে সান্ত্বনা দিলো।
সবাই জায়গা সিলেক্টড করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। অভিনব ল্যাপটপ হাতে খোঁজ লাগিয়ে বলল
_ তোমাদের জন্য কক্সবাজার বুকিং করলে কেমন হয় ?

সবাই সম্মতি জানায়। অভিনব কক্সবাজারের সমস্ত টিকিট কনফার্ম করে নেয়। ইববান মির্জা বাড়ি তে ও খবর পাঠান। তাঁরা ও সম্মতি জানান।

.

গালে হাত দিয়ে বসে আছে ঝিল। একটু আগে রোহনের সাথে কথা হয়েছে। রোহন জানিয়েছে ফ্যামিলি ট্যুর হচ্ছে। সবার সাথে যাওয়ার লোভ টা তাঁকে আঁকড়ে ধরেছে। মাত্র ই রুমে এসেছে অভিনব। ঝিলের ভাব ভঙ্গি বুঝতে না পেরে বলল
_ কি হয়েছে ?

_ কিছু না !

_তুমি কি ডাইনিং এর বিষয় টা নিয়ে রাগ করেছো ?

_ উহহুহ।

_ তাহলে ? সমস্যা কি ?

ঝিল উত্তর দেয় না। অভিনব ব্যস্ত হয়ে পরে। ঝিলের পাশে বসতেই ঝিল ব্যগ্র কন্ঠে বলে
_ আমি যাবো না !

_ কেন ?

_ সবাই ফ্যামিলি ট্যুর এ যাচ্ছে । আমরা ও যাই সবার সাথে ?

_ ফ্যামিলির সাথে অন্য বার যাবো এবার একটু আলাদা ঘুরি ? শাকীল , মাহের আর অমিত কে কথা দিয়েছি আমি। ওরা ও তো যাবে আমাদের সাথে।

সচকিত হয় ঝিল । একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে
_ মাহেরা আপু যাবে না তো ?

_ আরে নাহহ।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে অভিনবর বুকে মুখ গুঁজে দেয়। পর পর কয়েক টা নিশ্বাস ফেলে বলে
_ আমাকে নিয়ে সাঁতার কাটতে পারবে ?

_ অবশ্যই পারবো । মানছি 48 থেকে 53 কেজি তে চলে এসেছো বাট অভিনবর ক্ষমতা এতো টা ও ঠুনকো নয়।

মুখ বাঁকিয়ে নেয় ঝিল। হাতের সাথে অভিনবর শার্টের বোতাম গুলোর বন্ধুত্ব করে নেয়। পর পর বোতাম গুলো নিয়ে খেলছে সে। অভিনব কিছু বলে না । নির্লিপ্ত চাহনি তে ঝিলের খেলা দেখতে থাকে।

.

বাড়ির সবাই কে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায় ঝিল। দীর্ঘ এক বছরের ও বেশি সময় এই বাসাতেই বসবাস। অনেক আপন হয়ে গেছে মানুষ গুলো। রাগ অভিমান সব কিছু ছাপিয়ে গড়েছে ভালোবাসা । প্রতি টা ইট ও যেন মনে গেঁথে গেছে। অভিনব সবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে গাড়ি চলতে থাকে। সুনাম গঞ্জের হাওর দেখার জন্য মন কেমন করছে । অথচ ঝিলের মুড অফ। অভিনব এক পলক তাকিয়ে সামনের দিকে চোখ রেখে বলল
_ মন খারাপ কেন করছো ? হাওর সম্পর্কে কি কি বলেছিলাম মনে আছে ?

ঝিল মাথা ঝাঁকায়। অভিনব গাড়ির ব্রেক কষতেই ঝিল চমকে তাকায়। ব্যাক থেকে ক্যামেরা বের করে ঝিলের হাতে দিয়ে বললো
_দেখো ছবি গুলো কতো টা প্রাণোচ্ছল। মন খারাপের অবকাশ পাবে না।

ঝিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভরা পরিবার পেয়ে সব কেমন গুলিয়ে গেছে। একটু হাসি ফুটিয়ে হাওরের তীক্ষ্ম ছবি তে দৃষ্টি দেয়। সঙ্গে সঙ্গে গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। এই অপরূপ সৌন্দর্য উপেক্ষা করার শক্তি ওর নেই। অভিনব হাসে , ভ্রমন প্রেমিরা এমনি হয় প্রকৃতি পাগল।

গাড়ি এসে থামে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড এ। গাড়ি পার্ক করে দিয়ে টিকিট কনফার্ম করে নেয় অভিনব। ঝিল একদম সেটে দাঁড়িয়ে আছে। যেন অভিনবর ভেতর ঢুকে যাবে। ওর এমন আচারনে কিছু মানুষ ঘুরে ঘুরে দেখছে তাঁতে ওর কিছুই যায় আসে না। বাস ছাড়বে এগারোটায়। এখনো আধ ঘন্টা সময় আছে তাই দুটো চা নিয়ে নেয় অভিনব। ঝিল খাবে না বলে নাকোচ করে। অভিনব একটু হেসে বলে
_ আমি চা এনে দিলাম আর তুমি খাবে না ? এই যে এটা তে আমি স্পর্শ করে আছি , তা ও খাবে না ?

_ নাহ খাবো না।

_ সত্যি খাবে না ?

কথাটা এতো টাই আবেগ মাখা যে ঝিল নুইয়ে যায়। ফোঁস মেরে চায়ের কাপ টা নিয়ে নেয়। একটা বেঞ্চে উঠে বসে ফু দিয়ে চা খেতে থাকে। প্রচন্ড হাসি পেলে ও হাসে না অভিনব।
দোকান থেকে মিনারেল ওয়াটার আর কিছু ক্যান্ডি নিয়ে আসে।

এগোরাটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগে সবাই বাসে উঠে বসে। অভিনব আর ঝিল মাঝামাঝি বরাবর সিট পেয়েছে। অবশ্য এতে কোনো সমস্যা নেই আর না আছে আগের বারের মতো আড়ষ্ঠতা। শিষ বাজিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। জানালা গলিয়ে মৃদু অন্ধকার ঝিলের তুলতুলে গাল কে ছুঁইয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো যেন ঝিলের সৌন্দর্য শতগুন বাড়িয়ে ছে । ওষ্ঠাধরের মাঝে ফাঁক রেখে নির্লিপ্ত চেয়ে আছে অভিনব। মোহে মোহিত সে , হঠাৎ করে তাঁর উষ্ণ হাতের আঙুলি ছুঁইয়ে দেয় ঝিলের গালে। কেঁপে উঠে ঝিল , সাথে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নেয়।
ঝিলের ভয়ার্ত চাহনি লক্ষ্য করে তাকায় অভিনব। বিষয় টা বুঝতে পেরে হাত সরিয়ে ফেলে। ঝিলের কাঁধে মাথা রেখে নিম্মস্বরে বলে
_ রাত বাড়লে লাইট কিন্তু অফ হয়ে যাবে তখন নিজেকে গুটিয়ে নিলে খবর আছে।

_ হুমকি দিচ্ছো ?

_ আলবাত দিচ্ছি। বউ হলো ভালোবাসার মাধ্যম। যখন তখন ভালোবাসবো তাঁতে তোমার কি ?

এক গাল হাঁসে ঝিল। অভিনবর বাহু তে চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করে। ঘুমানোর জন্য লাইট অফ করে দেওয়া হয়। ঝিল লজ্জায় নুইয়ে যায়। অভিনব একটু হেসে ঝিল কে বুকে জড়িয়ে নেয়। কিছু প্রেম ময় অনুভূতি নিয়ে কেঁটে যায় অনেক টা সময়। দু জনের কেউ ই ঘুমাতে পারে না। অভিনবর শার্ট খামচে ধরে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে ঝিল। অদ্ভুত শিহরন জাগছে, অভিনব একটু নড়েচড়ে উঠে। ঝিল ভ্রু কুটি করে শুধায়
_ কি হয়েছে ?

_ ঘুম তো আসছেই না , তাই ভাবলাম কফি খাওয়া যাক ?

অবিশ্বাসের চোখে তাকাতেই অদ্ভুত হাসে অভিনব। ব্যাক প্যাক থেকে ইলেক্ট্রনিক ফ্লাক্স বের করে পানি গরম করে নেয়। তাঁতে কফি পাউডার মিক্স করে সামান্য পরিমান বাদামি চিনি দিয়ে নেয়। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ঝিল। অভিনব পাক্কা ট্রাভেলার্স । একটা ছোট ব্যাক প্যাকে এতো কিছু রাখে যা ধারনার বাইরে। হঠাৎ করেই ডোরেমনের ম্যাজিক্যাল পকেটের কথা মনে পরে গেল। যার মাঝে পুরো পৃথিবী কে লুকিয়ে রাখা। উচ্চশব্দে হেসে উঠে। অভিনবর শক্ত পোক্ত হাত ঝিলের ঠোঁট আটকে দেয়।
নিজের আচারনে অভিনব নিজে ও কেঁপে উঠে। ঘোর লাগা চোখে একটু করে এগিয়ে যায়। ঝিলের কম্পমান শরীর কে কাছে টেনে নিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে, ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_50

স্বচ্ছ কিংবা নীল রঙা পানি, দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় আর বর্ষার যৌবন—এমন অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহার দেখা যায় শুধু টাঙ্গুয়ার হাওরেই। শুধু তাই নয়, মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়-ঝরনা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, অগণিত পাখির কলতান আর করচ-হিজল বনের মায়া বিমোহিত করবে যেকাউকেই।
দেশের অন্যতম সুন্দর ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সম্ভাবনাময় জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর। আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট এটি। অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর স্বচ্ছ জলের স্বর্গরাজ্য! বর্ষা ও শীত—এই দুই মৌসুমে দুই রকমের সৌন্দর্যে অপরূপ হয়ে ওঠে এই হাওর। তবে পর্যটকদের মতে, এই হাওর তার আসল সৌন্দর্যে সাজে বর্ষাকালে। তাই তো বর্ষাকালে হাওরে আসা।
সুনামগঞ্জে পৌছাতেই কেমন কেমন অনুভব হচ্ছে। কাক ভোরের পেজা তুলোর মতো মেঘ যেন সুনামগঞ্জের প্রথম সৌন্দর্য বহন করছে। জানালায় থুতনি ঠেকিয়ে প্রান ভরে তা দেখছে ঝিল। অভিনব ঘুমে ছিলো। ভোরের দিকে একটু চোখ লেগেছিলো। গাড়ির ঝাঁকুনি তে উঠে পরে। ঝিল কে টেনে কাছে নিয়ে আসে। বিরক্ত হয় ঝিল।
_ হঠাৎ এমন করলে কেন ?

_ জানালার সাইটে বসতে দিয়েছি মাথা ঠেকানোর জন্য ? জানো এভাবে কতো দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারে।

নিজ ভুল বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে ঝিল। অস্ফুটন স্বরে বলে
_ স্যরি।

ঘড়ির কাঁটা বলে দিচ্ছে সাত টা বাজতে চলেছে। সকালের সৌন্দর্য অভিনবর মনে দাগ কেঁটে নেয়। মুখ দিয়ে উচ্চারন করে
_ মাশআল্লাহ ।

ঝিলের হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে টা উপভোগ করতে থাকে। সুনামগঞ্জের নামের মতোই জায়গার সুনাম থাকা বাহুল্য । প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য যেন উজার করে দিয়েছে সে , নিজ হাতে সাজিয়েছে সুনামগঞ্জ কে।
এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন যে সুনামগঞ্জ শহরে এসে পরে তাঁর খেয়াল হয় না। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। নন এসি বাসের ভাড়া জনপ্রতি 550 টাকা । এটা এসি বাস হলে ও এসির প্রয়োজন হয় নি। কারন আবহাওয়া শিথিল ই ছিলো। তবে সুনামগঞ্জে এসে তাপমাত্রা যেন গাঁয়ে এসে লাগলো। ঘেমে ঝিলের কপালে শিশির বিন্দুর মতো রেখা তৈরি হলো। পকেট থেকে রুমাল বের করে খুব সুন্দর করে মুছে দিলো অভিনব। একটু করে হাসলো ঝিল। লজ্জা নয় ভালোলাগা তাঁকে আকৃষ্ট করছে।

অভিনবর সাথে তালে তাল মিলিয়ে হাঁটছে ঝিল। কোথায় যাচ্ছে তা জানা নেই। তাই প্রশ্ন করলো
_ আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি ?

_ রোজ গার্ডেন হোটেলে।

_ এখানে কেন ? হাওরে যাবো না ?

_ নাস্তা করতে হবে তো ?

ঝিল কথা বাড়ালো না। কিছুক্ষনের মাঝেই রোজ গার্ডেন হোটেলে চলে আসলো। ব্যাক প্যাক রেখে ফ্রেস হয়ে নিলো। ঝিল পরোটা অর্ডার করবে বলে ঠিক করছে। তবে অভিনব বাঁধা দিয়ে বলল
_ সিলেটের ট্রাডিশনাল ফুড আখনি। আখনি নিলে কেমন হয় ?

_ আচ্ছা।

অভিনব আখনি অর্ডার করে দিলো। সাথে নিয়ে নিলো দুটো ফ্রুট জুস। আখনি টা তেহেরির মতোই দেখতে আর টেস্ট ও একি রকম। তবে এর বিশেষত্ব হলো এর সাথের এক্সট্রা ঝোল। যেটা দিয়ে আখনি মাখিয়ে খেতে বেশ সুস্বাদু । সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় আখনির মূল্য জন প্রতি 50 টাকা।
অভিনব একটু অবাক ই হলো।

খাওয়া দাওয়া কমপ্লিট করে একটু জিরিয়ে নিলো । হোটেল থেকে বেরিয়ে সবাই কে ফোন লাগালো। সবাই পৌছে গেছে। মুহুর্তেই সবাই এসে পরলো। ঝিল প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল
_ মৌন তুই !

_ সারপ্রাইজ

_ কি মৌন মৌন বলছিস ভাবি বলে সম্বোধন কর।

ঝিল ব্যঙ্গ করে বলল
_ বয়েই গেছে ভাবি বলতে। আমার বান্ধবীকে তোমার সাথে বিয়ে দিবো না।

ঝিলের কথাতে সবাই একটু হাসলে ওহ রোহন থতমত খেলো।
একে একে সবাই কুশল বিনিময় করে নিলো । মাহের জানালো মাহেরা নতুন রিলেশনে গেছে। কথা টা শোনা মাত্র ই ঝিলের মন উড়তে লাগলো। ওর কান্ডে মুখ চেপে হাসছে অভিনব। নিজের বিয়ের খবর শোনে ও এতো টা খুশি হয় না কেউ।

অভিনব আর শাকীল লেগুনা ভাড়া করে নিলো। যেহেতু ওরা দশ জন তাই একটা লেগুনা তেই হয়ে যাবে। সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর রিজার্ভ লেগুনার ভাড়া পরলো 1000 টাকা। সবাই লেগুনায় উঠে পরলো। সুনামগঞ্জ টু তাহিরপুর যাওয়ার ভিউ টা অসাধারন। গ্রাম্য সৌন্দর্য নজর কারার মতো।

চকের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক। চারপাশে গাছ পালা সহ ছোট ছোট ঘর। সব কেমন ছবির মতো। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য উপভোগ করলো।

লেগুনা এসে তাহিরপুর বাজারে থামলো। সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর আসতে মোটামোটি দুই ঘন্টা সময় লেগেছে। দু হাত মেলে দিয়ে পিঠ সচল করে নিলো ঝিল। দু ঘন্টা বসে থেকে হাত পা যেন অবশ হয়ে গেছে। অভিনব এক হাতে ঝিল কে জড়িয়ে ধরতেই তেঁতে উঠলো ঝিল। যেন আগুনের গাঁয়ে ঘি ঢালা হয়েছে। অভিনব হতবাক হয়ে গেল।
_ কি করছো কি ? সবাই আছে , সে দিকে খেয়াল আছে ?

ব্যঙ্গপূর্ন দৃষ্টি মেলে দিয়ে ঝিল কে কাছে টেনে নিলো। শাহাদাত আঙুলের সাহায্যে দিক নির্দেশনা দিয়ে অভিনব বলল
_ দেখো ওদের অবস্থা।

ঝিলের মাথা ঘুরে গেলো। এরা যে বাজারে নেমেছে মনেই হচ্ছে না। একে অপরকে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে দেখে মনে হচ্ছে পার্সোনাল বেড রুমে দাঁড়িয়ে আছে। অভিনব এক ফালি হেসে বলল
_ ডান দিকে তাকাও।

ঝিল ডান পাশে তাকিয়ে 440 ভোল্ট এর শক খেলো। রোহন আর মৌনতার অবস্থা আরো করুন। অস্ফুটন স্বরে বলল
_ ছিইইই এদের কে আমি ভরসা করতে পারছি না। যাহ তা করে বসবে।

ঝিলের কথাতে হো হো করে হেসে উঠে অভিনব। ঝিল লজ্জা পায়। সে কি একাই আনরোমান্টিক ?

.

ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় থেকে প্রায় ৩০টি ঝরনা এসে সরাসরি মিশেছে হাওরের পানিতে। সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখির কলকাকলিতে মুখর এক অপরূপ সৌন্দর্যের আধার। মাছ, পাখি এবং নানান প্রজাতির জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠাপানির এ হাওরের আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার একর।

বাজার থেকে হেঁটে তাহিরপুর ঘাটে আসলো সকলে। ঘাটে বোট রাখা আছে। সবাই বোট এ উঠলো ,একজন কর্মকর্তা সবাই কে সেফটি স্প্রে দিয়ে ডিজইনফেক্ট করে নিলো। রিফ্রেসিং এর জন্য হট ট্রাওয়াল এর ব্যবস্থা ওহ রয়েছে। সবাই একে একে ট্রাওয়াল দিয়ে চোখ মুখ মুছে নিলো। এখন খানিকটা ফ্রেস লাগছে।

ঝিল লক্ষ্য করলো বোট এর কর্নারে স্টিয়ারিং এর মতো লাগানো। অভিনব ব্যাক প্যাক গুছিয়ে রেখে ঝিলের হা হয়ে যাওয়া মুখ টা দেখলো। ডান পাশ থেকে টোকা মেরে বাম পাশে চলে গেল। এদিক ওদিক ফিরতেই প্রশস্ত হাসে অভিনব। ঝিল সে দিকে পাত্তা দেয় না। শুধু বললো
_ এই স্টিয়ারিং দিয়েই কি বোট কন্ট্রোল করা হয় ?

_ উহহু

_ তাহলে?

_ আরে এটা তো সো করার জন্য রাখা হয়েছে। ট্যুরিস্ট রা ছবি তুলতে পারবে খানিক টা সৌন্দর্য বোঝানোর জন্য।

অভিনবর সাথে পুরো বোট ঘুরে দেখলো ঝিল। বোটের ভেতর এমন সুন্দর ব্যবস্থা সত্যি ই অসাধারন। এখানে একটাই বিশাল কেবিন। যেখানে ঢালা বিছানা করা। দুটো ওয়াসরুম রয়েছে। সার্বক্ষণিক আই পি এস এর ব্যবস্থা। তবে সমস্যা হচ্ছে কেবিন টার হাইট টা ডাউন। যার কারনে ঘাড় নিচু করে রাখতে হচ্ছে অভিনবর। তা দেখে গগন কাঁপিয়ে হাসছে ঝিল। অভিনব বিরক্ত হলো। বোট কর্মকর্তার কাছে গিয়ে বলল
_ হ্যালো ! কেবিনের হাইট এতো ডাউন কেন ?

_ এটা ডাউন দেওয়ার কারন টা হচ্ছে হাওরে হাওয়া বেশি থাকে যদি কেবিন টা উঁচু করা হয় তাহলে উল্টে যাওয়ার সম্ভবনা থাকবে। তাছাড়া বোট কন্ট্রোল করতে অসুবিধা হয়ে যায়।

অভিনব আর কিছু বললো না। দুটো দিন তাঁকে ঘাড় নিচু করেই চলতে হবে। অবশ্য বোট এর বাইরের অংশ কিংবা ছাঁদেই বেশি থাকা হবে।

কেবিনের ডিজাইন টা সুন্দর। অনেক গুলো জানালা দেওয়া যার কারনে বৃষ্টি হলে বেশ রোমাঞ্চকর পরিবেশ পাওয়া যাবে।
জানালায় লাগানো সাদা পর্দা গুলো বাতাসে উড়ছে। এতেই প্রেম প্রেম অনুভূতি হচ্ছে। ঝিল কে ইশারা করলো অভিনব। মেয়েটা তীক্ষ্ম চোখে তাকালো। কাছে এসে বলল
_ সব জায়গায় রোম্যান্স নো এন্ট্রি !

_ তুমি ই একটা গাধা । সবাই ঠিক রোম্যান্স করবে ইনফেক্ট তোমার না হওয়া ভাবি কে দেখে নিও।

_ মানে !

_ রোহন অনেক এগিয়ে , তোমার মতো গাধা না।

ভেঙ্চি কাঁটে ঝিল । সবার লাজ লজ্জা না থাকতে পারে তাই বলে ওহ কেন বেহায়া হবে?
এই প্রথম মনে হচ্ছে অভিনব বিদেশে বড় হয়েছে। পুরোই ফাজিল ধাঁচের বিচ্ছু ছেলে।

চার জন কর্মকর্তা সাথে দশ জন ট্যুরিস্ট নিয়ে ওদের যাত্রা শুরু হবে। জল যাত্রায় এর আগের অভিজ্ঞতা থাকলে ও এবারের যাত্রা লোভনীয় হতে যাচ্ছে। কারন এটা হাওর। এখানে নেমে গোসল করা যাবে। বোট এর মোট কস্ট পরেছে 18,000 টাকা। তবে মেইন মিল গুলো নিজেদের প্রোভাইড করতে হয়। বোট এর প্যাকেজ এর সাথে বাবুর্চি সুবিধা রয়েছে।

অভিনব ঘড়িতে টাইম দেখে নিলো। হাঁটু গেড়ে বসে পরেছে ঝিল। একটা ওয়াটার বোতল এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছিলো। কৃতঙ্গতা প্রকাশ করলো মেয়েটা। অভিনব ঝিলের কোলে মাথা রেখে বলল
_ একটু বিলি কেঁটে দাও।

_ মাথা ব্যথা করছে ?

_ উহহু

_ তাহলে ?

_ ওদের তো বাজারে পাঠিয়েছি। তোমার লাজ লজ্জার কারনে তো পরে সেবা পাওয়া যাবে না।
তাই আগেই একটু সেবা নিয়ে নিচ্ছি। বউ বলে এতো টা ছাড় দেওয়া উচিত হবে না।

অভিনবর কথাতে ফিক করে হেসে দেয় ঝিল। মাথায় বিলি কেঁটে দিতে দিতে বললো
_ মোটে ও ছাড় দিবে না বুঝেছো । না হলে পাখি উড়াল দিবে।

_ আমার পাখি উড়াল দিবে না। কারন সে পাখি আমার থেকে ও বেশি আমাকে ভালোবাসে।

প্রশান্তির শ্বাস ফেলে ঝিল। উল্টো হয়েই অভিনবর নাকে নাক ঘষতে লাগলো। অভিনবর উষ্ণ হাত ঝিল কে কাছে টেনে নিলো। সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল। ঠিক তখনি বাইরের খটখট আওয়াজ ভেসে আসলো। ছিটকে সরে গেল ঝিল। রোহন কে দেখে প্রচন্ড অবাক হলো । একটুর জন্য বেঁচে গেছে। না হলে লজ্জায় মাথা ঠুকতে হতো।
অভিনব আফসোস এর সুরে বলল
_ মানলাম তুমি সম্পর্কে বড় হও তাই বলে প্রাইভেসি দিবে না আমাদের ?

_ কেমন প্রাইভেসি চাচ্ছেন অভিনব ভাই ?

_ প্রাক্টিক্যাল চাওয়ার তো সুযোগ নেই। একটু নক টক করে এসো। আমি ও একি মানের প্রাইভেসি দিবো।
ডোন্ট ওরি , আমার শালিকা তোমার জন্য রেডি।

হাই ফাইফ করে দুজনে। ঝিল লজ্জায় কুকুরে গেল। বড় ভাইয়ের সাথে ফ্রি হলে ও এখন লজ্জা লাগছে। ভয়ঙ্কর দুটো গালি দিলো অভিনব কে। অভিনব অবশ্য সেটা শুনতে পেল না।

.

এক গাঁদা বাজার করা শেষ। মাছ মাংস মসলা সবজি সব কিছুই কেনা হয়েছে। এখন বোট হাওর দিয়ে ওয়াচ টাওয়ারে যাবে। সেখানে গিয়ে সবাই সাওয়ার নিবে তারপর কোনো এক গাছের নিচে বোট থামিয়ে লাঞ্চ করবে। দারুন হবে বিষয় টা।
সবাই খুব এক্সাইটেড। অভিনব বরাবরের মতো ঝিল কে নিয়ে বোট এর কর্নারে চলে গেল। বোট ছাড়তেই জোরে হাওয়া বইতে লাগলো। স্নিগ্ধ হাওয়াতে পাশা পাশি বসে রইলো ঝিল আর অভিনব। হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে পা ভেজাতে লাগলো দুজনে। ঝিলের কাঁধে মাথা রেখে বলল
_ আমাদের পথ দীর্ঘ হোক !

_ আল্লাহ চাইলে অনেক টা সময় আমরা এক সাথে থাকতে পারবো। মৃত্যুর পর ও তুমি শুধুই আমার।

অভিনব হাসলো। ঝিলের বাহু টেনে কাছে টেনে নিলো। হঠাৎ করেই ঝিল চেঁচিয়ে উঠলো। কারন একটা মাছ তাঁর পায়ের উপর দিয়ে গেছে যার কারনে সুরসুরি লেগেছে তাঁর । অভিনব মাথা নিচু করতেই ঝিলের বুক ধক করে উঠলো। খামচে ধরে বলল
_ একদম না। পানি তে পরে গেলে ব্যথা পাবে।

*

#বোনাস_পার্ট

দেড় ঘন্টার মাঝেই বোট এসে থামলো ওয়াচ টাওয়ারে। সবাই হৈ হুল্লরে মেতে উঠেছে। সুন্দরবনের ওয়াচ টাওয়ার কে সন্দর বলা না গেলে ও হাওরের ওয়াচ টাওয়ার কে দুর্দান্ত সুন্দর বলতে বাধ্য হতে হয়। পানির উপর ওয়াচ টাওয়ার তাঁর চারপাশে সবুজ গাছে ঘেরা। যার অর্ধেক ডুবে আছে পানির নিচে।

সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে নেমে গেল। ঝিল একটু ভয় পাচ্ছে। কারন এটা হাওরের মধ্যি খান। পানির গভীরতা নিশ্চয়ই অনেক হবে।
দুটো রঙিন চা নিয়ে হাজির হলো অভিনব। ঝিল ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে শুধাল
_ এটা দিয়ে কি হবে ?

_ পানি তে নেমে চা খাবো। সেই ফিলিংস হবে।

_ আমার ভয় করছে।

_ আমি থাকতে ও ভয় পাও ? ছিইই ঝিল নিজের বরের উপর বিশ্বাস রাখতে পারছো না।

_ এটা কখন বললাম ?

_ আচ্ছা এতো রাগ করো না তো। আসো আমার সাথে। আমি তোমায় ধরে রাখবো।

ভদ্র মেয়ের মতো হাঁটা লাগায় ঝিল । নিজ হাতে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দেয় অভিনব। চুল গুলো রাবার ব্যান দিয়ে আটকে দেয়। কিছু টা চুল কানে গুঁজে দিয়ে এক ফালি হাসে। ঝিল এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই অভিনব ভয়ঙ্কর কাজ করে ফেলে যার প্রতিবাদের সুযোগ হয় না ঝিলের। নিজেকে ছাড়িয়ে ঠোঁট মুছে বলে
_ ছিইই এটা কি হলো ? তুমি এতো টা অসভ্য কেন বলো তো ?

_ হুসস। নিজে থেকে কিস করেছো কখনো ? সব সময় আমি ই কাছে আসি। আনরোমান্টিক মেয়ে

_ মোটে ও আমি আনরোমান্টিক না।

_ পারলে প্রুভ দিও।

কথা টা বলেই অভিনব বোটের কর্নারে চলে আসলো। সবাই নদীতে গোসল করছে। অভিনবর লোভ লাগলো তাই ঝিল কে বোটে রেখেই নদীতে ঝাঁপ দিলো।

মিনিট পাঁচেক পর ঝিল বাইরে আসলো। বুকে হাত গুঁজে রাগ কন্ট্রোলের ব্যর্থ চেষ্টা । হঠাৎ করে কিছু টা পানি এসে ওকে ভিজিয়ে দিলো। ভেবে ছিলো অভিনব তাঁকে পানি ছুড়েছো। কিছু বলার জন্য ঘুরতেই দেখলো বৃষ্টি নেমেছে। ঝিল অন্যমনস্ক ছিলো। অভিনব তাঁকে টেনে নামিয়ে নেওয়ায় ভয় পেয়ে যায়। চোখ বন্ধ করেই চেঁচিয়ে উঠে।
অভিনব আশ্বস্ত করে বললো
_ আরে চোখ খোলো। আমি তোমাকে নামিয়েছি।

ঝিল চোখ খুলে নিজে কে অভিনবর বাহুতে আবিষ্কার করে। লজ্জা পায় সে , আশে পাশে তাকিয়ে দেখে সবাই সবার মতো ব্যস্ত। বুকে দুটো কিল বসিয়ে দেয়। অভিনব কে জড়িয়ে লম্বা করে শ্বাস নেয়।

সবাই ঘন্টা খানেক গোসল করে একদম চুপচুপে হয়ে যায়। কেউ যেন পানি থেকে উঠতেই চাইছে না। একে একে চেঞ্জ করে নেয়। তারপর ই চলে আসে বোটের ছাঁদে। সেখানে বিচ সোফার ব্যবস্থার রয়েছে। কেউ কেউ সেখানে শুইয়ে রয়েছে। অভিনব ঝিল কে নিয়ে ছাঁদের কর্নারে পা দুলিয়ে বসলো।
কর্নার গুলো খুব প্রিয় ওর। আসলে এখানেই বেশি মজা পাওয়া যায়। বৃষ্টির রেখা কাটিয়ে আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে। হঠাৎ অভিনব আবিষ্কার করলো আকাশে কয়েক টা রঙিন রেখা উঠেছে। যাকে রঙধনু বলে। না চাইতে হ ওহ মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসলো
_ ওয়াও

প্রিয় মানুষের সাথে রঙধনু দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলো ছেলেটা। ঝিলের চোখ আকাশে নিবদ্ধ। তাঁর কোনো খেয়াল ই নেই। পৃথিবীর সমস্ত চিন্তা যেন মাথা থেকে উবে গেছে। নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ন্যায় সে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতি এমন এক সুখ যাহ নতুন অনুভূতির সাথে পরিচয় করায়।
প্রকৃতির সাথে থাকা মানুষ গুলো কে ড্রিপেশন কাবু করতে পারে না। সকল চিন্তার স্বস্তির জন্য আল্লাহর সৃষ্টি কে উপভোগ করতে হয়।
আল্লাহর সৃষ্টি সর্ম্পকে বর্ণনা করলে হাজারো বই হয়ে যাবে তবে বর্ননার শেষ হবে না।

.

সবাই কে লাঞ্চ সার্ভ করা হয়। একটা গাছের নিচে বোট থামানো হয়েছে। ছাঁদে ছাউনি টানিয়ে দেওয়া হলো।
হাওরের তাজা রুই মাছের সাথে গরম গরম ভাত যেন অমৃত। লাঞ্চে ছিলো ভাত, মাছ , আলুর ভর্তা , ডাল , আর লাটি মাছ ভর্তা সাথে সালাত।

লাঞ্চ করে সবাই রেস্ট নিতে বসে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রবেশ মুখেই দেখা যায় সারি সারি হিজল গাছ। মূল হাওরে পানির নিচের দিকে তাকালে দেখা মিলে হরেক রকম জলজ উদ্ভিদ ও লতাগুল্মের। হাওরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার কে দেখে দৈত্য মানব ই মনে হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ারের নিচেই সারি সারি হিজল করচের গাছ দাঁড়িয়ে আছে সারা বছর জুরে।

হাওরের উত্তর পাশে টেকেরঘাটে রয়েছে স্বচ্ছ নীল জলের শহীদ সিরাজ লেক। একপাশে মেঘালয়ের সুউচ্চ পাহাড়, আরেক পাশে ছোট ছোট সবুজ টিলা। মাঝখানে নীল জলের লেকটি অসাধারণ সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক। টেকেরঘাট থেকে মোটরসাইকেলে করে আধাঘণ্টার দূরত্বে রয়েছে বারিক্কা টিলা। যাদুকাটা নদীর তীরে এই পাহাড়টি বাংলাদেশ অংশে, এখান থেকে যাদুকাটার অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়।

হাওরের করচ হিজল গাছের মহিমা বিমোহিত করবে যে কাউকে। নিষ্পলক চাহনিতে মেতে উঠবে হৃদয়। অভিনবর বুকে মাথা গুঁজে সুবজের মহিমা দেখছে ঝিল। পানিতে ভেসে থাকা গাছ আহা কতো সুন্দর সৃষ্টি। স্বচ্ছ পানিতে খালি চোখেই দেখা যায় মাছ। রোদ্রময়ী আকাশ টা একটু একটু করে ঝকঝক করছে। ঝিলের ইচ্ছে হলো অভিনবর দেওয়া চ্যালেঞ্জ টাকে পূরন করার। হঠাৎ করেই ঝিল ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় অভিনবর ঠোঁটে। এক ফালি হাসে অভিনব। ঝিলের কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে
_ এখন পারফেক্ট কাপল লাগছে ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here