#রংধনুর_রঙ_কালো
৫.
অরিন বেডরুমের ফ্লোরে ‘দ’ আকারে বসে কাঁদছিল। ইলহান বারান্দা থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
” তোমার কি হয়েছে অরিন? প্লিজ আমাকে সত্যি কথাটা বলো। কেনো এমন ব্যবহার করছো? নাকি তুমি আমাকে সহ্যই করতে পারছো না? আমার থেকে মুক্তি চাও তুমি?”
অরিন মাথা তুলে প্রশ্ন করলো,
” মুক্তি চাইলেই কি দিবে?”
ইলহানের কপালের ভাজ মিশে গেল। সে স্তব্ধ চেহারায় বললো,
” একবার চেয়েই দেখো।”
অরিন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। বাঁকা হেসে বললো,” আমাকে তো মুক্তি দিবেই। এখন কি আর আমার প্রয়োজন আছে? ভীনদেশের এই শহরে কত সুন্দরী রমণী তোমার মনোরঞ্জনের অপেক্ষা করছে। তাদের মাঝে আমি তো কয়লার মতো নিকৃষ্ট।”
” এইসব কি ধরণের কথা? তুমি নিজেকে কয়লার সাথে তুলনা করছো? কিন্তু আমার কাছে তুমি ব্ল্যাক কুইন। তুমিই সেরা। হাজারটা সুন্দরী রমণী আসলেও তোমার জায়গা নিতে পারবে না।”
” আমার সেরা হতে চাই না। আমি একমাত্র হতে চাই।”
” আমার কাছে তুমি একমাত্রই।”
” আমাকে কি তোমার দুধের শিশু মনে হয়? আমি কি নির্বোধ? কিছু বুঝি না ভেবেছো? এইখানে তুমি কি করো, কিভাবে থাকো সব আমার বোঝা হয়ে গেছে। ওই বাড়িটা যে তোমার নিজের বাড়ি সেটা আমি ভালো করেই জানি। আর জানি বলেই এসেছি। ধরা পড়ার ভয়ে এতোবড় নাটক তুমি না করলেও পারতে।”
” মানে তুমি বলতে চাইছো ওই বাড়িটা আমার বাড়ি? ক্লিফোর্ডদের আমি ভাড়া করে এনেছি তোমার সাথে মিথ্যে বলার জন্য? ”
” অবশ্যই! ধরা পড়ে গিয়ে নিজের পিঠ বাঁচাতে তুমি এই কাজ করেছো। নাহলে আগে তো কখনও বলোনি।”
” এই বিশ্বাস আমার উপর? তোমার কথা অনুযায়ী তো এখন মনে হচ্ছে তুমি যোয়ীকেও আমার গার্লফ্রেন্ড ভেবেছো।”
” হ্যাঁ ভাবছি। বরং আমি নিশ্চিত।”
” ছিঃ অরিন! শী ইজ লাইক মাই লিটল সিস্টার।তোমার মন এতো নোংরা!”
অরিন উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলো,” আমার মন নোংরা? নাকি তোমার চরিত্র নোংরা? তুমি নিজে একটা নোংরা! তোমার মতো বিশ্বাসঘাতক, প্রতারকের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। নর্দমার কীটের চেয়েও জঘন্য তুমি। আমি তোমাকে খুন করে ফেলবো ইলহান। সত্যি, সত্যি খুন করে ফেলবো।”
ইলহান দু’হাতে অরিনের বাহু আঁকড়ে ধরে স্থির কণ্ঠে বললো,
” অরিন প্লিজ, কাম ডাউন! আমি তোমাকে প্রমাণ দিতে পারি যে ওইটা ক্লিফোর্ডের বাড়ি। আর যোয়ীর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। যোয়ী আর ক্লিফোর্ড কাপল। ওদের সম্পর্ক চারবছরের। বিশ্বাস না হলে এখনি আমি ওদের ফোন করছি। তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো।”
অরিন শক্ত করে একটা চড় দিল ইলহানকে। স্বাদ মিটলো না বলে অন্য গালেও আরেকটা দিল। এতো মার খেয়েও ইলহানের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। ফরসা গাল দু’টো লাল হলো শুধু। নাকের ডগায় গোলাপী আভা সৃষ্টি হলো৷ সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরিনের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললো,
” আমাকে মেরে যদি তুমি শান্তি পাও তাহলে মারো। যত খুশি মারো! কিন্তু দয়া করে ভুল বুঝো না। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করলে আমি সেটা সহ্য করতে পারবো না। এতো ভয়ানক শাস্তি আমাকে দিও না অরিন।”
অরিন ইলহানের সামনে থেকে সরে গেল। দৃষ্টিনন্দন ছোট্ট টি-টেবিল থেকে ইলহানের সেলফোনটা দেখতে পেয়ে সাথে সাথেই হাতে তুলে নিল। সেলফোনের লক খুলতে গিয়ে ব্যর্থ হলো পাসওয়ার্ডের জন্য। অরিন ইলহানের দিকে চেয়ে কঠিন গলায় বললো,
” পাসওয়ার্ড বলো।”
” পাসওয়ার্ড হচ্ছে মাই ব্ল্যাক কুইন।”
অরিন ইলহানের কথামতো পাসওয়ার্ড লিখতেই লক খুলে গেল। ওয়ালপেপারে অরিনের ছবি সেট করা।অরিন এসব দেখে তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো,
” আমি আসার পর এগুলো করেছো তাই না?”
ইলহান মাথা নিচু করে বললো,” তুমি যেটা খুশি ভাবতে পারো। আমি বললে তো আর বিশ্বাস করবে না।”
অরিন গ্যালারিতে ঢুকলো। ইলহানের অনেক ছবি। বেশিরভাগ ছবিই সাদা চামড়ার সুন্দরী মেয়েদের সাথে। অরিন ভ্রু নাচিয়ে বললো,
” বাহ, খুব সুন্দর! এরা সবাই নিশ্চয়ই তোমার গার্লফ্রেন্ডস। তাই না?”
” গার্লফ্রেন্ডস কেনো হবে?এরা সবাই তো আমার বউ। তোমার জন্য যেমন আলাদা এপার্টমেন্ট নিয়েছি, এদের প্রত্যেকের জন্যেও নিয়েছি। এখন বলো তো, কার সাথে কয়দিন করে থাকা উচিৎ?”
” তুমি কি আমার সাথে ফাজলামি করছো?”
” ফাজলামি তুমিই শুরু করেছো৷ তাছাড়া সত্যি বললে তো বিশ্বাস করবে না। তাই মিথ্যেটাই বলি।”
” সত্যিটা কি শুনি?”
অরিন বিছানায় বসলো সত্যি জানতে। ইলহান উঠে এসে অরিনের পাশে বসে বললো,” এগুলো আমাদের ক্লাব মেম্বার। ভার্সিটির সব ফ্রেন্ডরা মিলে এই ক্লাবটা মেইনটেইন করি। প্রত্যেক সপ্তাহে আমরা এখানে দেখা করি। ভ্যাকেশনে ট্যুরে যাই। আরও অনেক মজা করি। এটা আমাদের একটা ইঞ্জয়মেন্ট মিডিয়াম।”
” মজা করার জন্য এইভাবে ছবি তোলা কি খুব জরুরী?”
” তোমার কাছে এটা বিরাট কিছু হতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে গালে কিস করা, জড়িয়ে ধরা এসব তো ফরমালিটির মধ্যে পড়ে। কিন্তু তুমি না চাইলে আমি এসব ফরমালিটিও আর করবো না।”
” আগে কখনও আমাকে তোমাদের ক্লাবের ব্যাপারে বলোনি কেনো?”
” বললে কি হতো? তুমি তো সন্দেহই করতে। যেমন এখন করছো।”
” তাহলে সন্দেহ ভেঙে দাও। আমাকে নিয়ে চলো তোমার ক্লাবে। আমি সবকিছু নিজের চোখে দেখতে চাই। দেখি এটা তোমার কেমন ক্লাব!”
” তুমি চাইলে কালকেই নিয়ে যাবো।”
” ঠিকাছে। তাহলে আজরাতে এই ফোনটা আমার কাছে থাকবে।”
” এজ ইউর উইশ। আমার ফোন লাগবে না। কিন্তু তোমাকে লাগবে।”
” খবরদার! আবার লাথি খাবে কিন্তু।ওই জায়গায়।”
ইলহান হেসে দিল। অরিন অবাক হয়ে বললো,
” তোমার হাসি পাচ্ছে কেনো? অদ্ভুত!”
” তুমি এই জায়গায় লাথি দেওয়া কোথ থেকে শিখেছো অরিন?”
” জানি না।”
অরিন বিছানার এক প্রান্তে গিয়ে শুয়ে পড়লো। মনে মনে তারও হাসি পেল। ইলহান পাশে শুয়ে বললো,” তোমাকে পাওয়ার জন্য কি করতে হবে বলো?”
” তোমার কিছু করার দরকার নেই। আমার মন থেকে সন্দেহ দূর হলে আমি নিজেই আসবো।”
” প্রমিস?”
অরিন জবাব দিল না। সে মনে-প্রাণে চায় তার সমস্ত সন্দেহ দূর হয়ে যাক। ইলহানকে পুনরায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে তারও খুব ইচ্ছে হয়।
পরদিন যখন অরিন ইলহানের সাথে ক্লাবে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিল ঠিক তখনই মোবাইল হাতে নিতেই অন্বয়ের ম্যাসেজ দেখতে পেল।
” জরুরী ভিত্তিতে আপনার সাথে দেখা করতে চাইছি অরিন। আজকের মধ্যে দেখা হলে আরও বেশি ভালো হয়। আপনার কি সময় হবে?”
অরিন উত্তরে বললো,” কখন দেখা করতে চান?”
” এখন দেখা করলেই সবচেয়ে ভালো হয়।”
” এখন সম্ভব না। আমি ব্যস্ত আছি।”
এই কথা বলেই অরিন ফোন সাইলেন্ট করে দিল। অন্বয় তারপর অনেকবার ফোন দিল। কিন্তু অরিন ধরতে পারেনি ইলহান পাশে ছিল বলে। ক্লাবটা দেখতে অনেকটা রেস্টুরেন্টের মতো। রুফটপে সুন্দর সুন্দর টেবিল। খোলা আকাশের নিচে বসে আড্ডা দেওয়া যায়। এখানকার আকাশটা আজকে কমলা রঙের। রুফটপের দেয়াল সাদা। সামনই বিশাল বিচ। ছেলে-মেয়েদের সুইমিং কস্টিউম পরা অবস্থায় বিচে নামতে দেখে অরিনের লজ্জায় শরীর শিহরিত হলো। রুফটপে দাঁড়িয়ে এইসব যখন সে দেখছিল তখন তার কাছে মনে হলো এটা কোনো হলিউড সিনেমার দৃশ্য। প্রত্যেকটা মানুষ ধবধবে ফরসা। তাদের কাপড়ের পরিমাণ খুবই অল্প। অরিনের তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করছিল নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে মেয়েদের পরিয়ে দিতে। ইলহানের প্রায় সব ফ্রেন্ডের সাথে অরিন পরিচিত হলো। তারা সবাই খুব আন্তরিক। অরিনের সাথে কেউ কেউ বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করলো। তাদের চেষ্টা দেখে অরিনের ভালো লাগলো। সবথেকে যেটা ভালো লাগলো, বেশিরভাগ মানুষ অরিনের গায়ের রঙের প্রশংসা করছে। তারা এতো কালো মানুষ আগে কখনও দেখেনি। কালো রঙেও যে মানুষকে এতো সুন্দর দেখায় তাদের ধারণাতেই ছিল না। অরিন ধরে নিল এসব তাকে খুশি করার চেষ্টা। সবশেষে সোফিয়া নামের একটা মেয়ের সাথে অরিনের দেখা হলো। মেয়েটাকে দেখে অরিন কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক শুধু তাকিয়েই রইল। ঘন কালো কোকড়া চুলের ফরসা চামড়ার অসম্ভব সুন্দর একটি মেয়ে। ঠোঁটে তার বেগুনি রঙের লিপস্টিক। শরীরে হাতকাটা বেগুনি টপ। টপের উপর পাতলা, ফিনফিনে সাদা কোটি। দেখতে একদম বার্বী ডল লাগছে। মানুষ এতো সুন্দর কিভাবে হয়? অরিন মনে মনে ‘মাশাল্লাহ’ উচ্চারণ করলো। কিন্তু অন্যদিকে সোফিয়াকে দেখে ইলহানের হৃদযন্ত্র কাজ করা থামিয়ে দিল। সে ভাবেনি এই সময় সোফিয়াও ক্লাবে থাকবে। কারণ ঠিক এই সময় তার স্টুডিওতে ফটোশ্যুট থাকে। এজন্যই ইলহান অরিনকে এখন নিয়ে এসেছিল। যাতে সোফিয়ার সাথে দেখা না হয়। অথচ দেখা হয়েই গেল। সোফিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে সে বিশেষভাবে অরিনের সাথে দেখা করতেই এখানে এসেছে। ইলহানের মাথা গরম হয়ে গেল। সোফিয়া জানলো কিভাবে অরিন যে এখানে এসেছে? কে খবর দিল তাকে? ইম্মি?হতে পারে। ইম্মি তো সোফিয়ার বেস্টফ্রেন্ড। ইলহান ডানে-বামে নজর দিলেও ইম্মির মাধ্যমে সোফিয়ার কাছে সেই খবর পৌঁছে যায়। শিট! ইলহান ইম্মির কথাটা কিভাবে ভুলে গেল? নিজের বোকামির জন্য দেয়ালে কপাল ঠুঁকতে ইচ্ছে হলো। সোফিয়া আসার পর থেকে ইলহান সর্বদা অরিনের পেছন পেছন ঘুরতে লাগলো। কারণ সে নিশ্চিত, অরিনকে একা পেলেই সোফিয়া কথা বলতে চলে আসবে। আর নিশ্চয়ই সে এমনকিছু সত্যি বলবে যাতে ইলহানের সাথে অরিনের সম্পর্ক খারাপ হয়। সোফিয়া অরিনের সামনেই ইলহানের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিল। ইলহান থতমত খেয়ে অরিনের দিকে তাকালো। আর অরিনের যেনো ভেতর থেকে সবকিছু জ্বলে গেল। সোফিয়া আঁড়চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে তাকে আরও জ্বালানোর উদ্দেশ্যে ইলহানকে বললো,
” বেইবি, তুমি যে আজকে ক্লাবে আসবে আমাকে বলোনি কেনো? কতদিন আমরা একসাথে সুইমিং করি না। আজকে হবে?”
অরিনের ঠাটিয়ে চড় মারতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু আশেপাশের মানুষদের দেখে সে কিছু করলো না। কারণ প্রত্যেকেই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে। এইখানে অরিন সিন ক্রিয়েট করতে গেলে মানুষ যদি তাকে আনকালচারড ভাবে? ইলহান পরিস্থিতি ঠান্ডা রাখতে বললো,
” সোফিয়া, দেখো আমার ওয়াইফ অরিন তাবাসসুম। আর অরিন, ও আমাদের ক্লাব মেম্বার সোফিয়া রিভেরা।”
অরিন মৃদু হেসে ‘হাই’ বললো। কিন্তু সোফিয়া সেদিকে পাত্তাও দিল না। পুনরায় ইলহানের গলার পেছনে হাত বেঁধে বললো,
” তোমার ওয়াইফকে দেখার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। আমি তো তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।”
অরিন রাগে টিকতে না পেরে সেখান থেকে সরে গেল। ইলহান ধমক দিল,” হোয়াটস রং উইদ ইউ সোফি? তুমি কি চাচ্ছো? অরিনের সাথে আমার ঝামেলা হোক?”
সোফিয়া জবাব না দিয়ে মুচকি হেসে জুসের গ্লাসে চুমুক দিল। ইলহান অরিনের পেছন পেছন গেল। ওকে বুঝানোর চেষ্টা করলো যে সোফিয়া সবার সাথেই এমন করে। সে একটু অন্যরকম। অরিন যেনো তার আচরণে কিছু মনে না করে। অরিন ইলহানের সামনে আচ্ছা, আচ্ছা করলেও মনে মনে ঠিকই সন্দেহ পুষে রাখলো। হঠাৎ সোফিয়া অরিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার ভাণ করে তার গায়ে জুস ঢেলে দিল। তারপর ঢং করে বললো,” স্যরি।”
ইলহান ইশারায় সোফিয়াকে থ্রেট করলো। আরেকবার এমনকিছু করলে তার খবর আছে। অরিন সোফিয়াকে কিছুই বললো না। জ্যাকেটের নোংরা দাগ পরিষ্কার করতে ওয়াশরুমে চলে গেল। তখন সোফিয়াও অরিনের সাথে ওয়াশরুমে ঢুকলো। এটাই এতোক্ষণ চাইছিল সে। ইলহানের থেকে অরিনকে আলাদা করতে। লেডিস ওয়াশরুমে ইলহান নিশ্চয়ই আসতে পারবে না। অরিন জ্যাকেট খুলে বেসিনে দাগ পরিষ্কার করতে লাগলো। সোফিয়া ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
” হাই, আমি সোফিয়া রিভেরা।”
অরিনও সোফিয়ার ভাষায় জবাব দিল,” আমি অরিন তাবাসসুম। ”
” তুমি যতই প্রিটি হও, তোমার গায়ের রংটা অত্যন্ত বাজে।”
অরিন ভদ্রভাবে বললো,” ধন্যবাদ। কিন্তু আমি এই গায়ের রঙ ইচ্ছে করে তৈরী করিনি। এটা গড গিফটেড।”
” গড গিফটেড? গিফট তো সেটা, যেটা আমাদের জন্য মঙ্গলময়। কিন্তু তোমার কালো রঙ তো অমঙ্গলের। এটা গডের গিফট না। গডের অভিশাপ।”
অরিন শক্ত চোখে তাকিয়ে চলে যাচ্ছিল। সোফিয়া পেছন থেকে ডেকে বললো,
” তুমি কি জানো ইলহান তোমাকে কেনো বিয়ে করেছে?”
অরিন থেমে দাঁড়ালো। কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” মানে? কি বলতে চাও?”
সোফিয়া কাছে এসে অরিনের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বললো,” তার আগে একটা কথা বলি। তুমি হয়তো এই ক্লাবের মূল উদ্দেশ্যটা জানো না। এটা মূলত আমাদের বিনোদনের একটা মাধ্যম। কিন্তু এখানে কেমন বিনোদন হয় সেটা কি তুমি জানো? এইখানে প্রত্যেক সপ্তাহে মেয়েদের নিয়ে একটা স্পেশাল কন্টেস্ট হয়। কন্টেস্টে যে ফার্স্ট হবে সে এখানকার সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলেটির সাথে ডেটিং এর চান্স পাবে। আর সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটিকে তুমি খুব ভালো করে চেনো। আমার কি নাম বলতে হবে?”
অরিন যখন বুঝলো সোফিয়া কার কথা ইঙ্গিত করছে তখনি বুক পাজরে সুক্ষ্ম টান অনুভব করলো। দুই চোখ ফুড়ে বেরিয়ে এলো জল। সোফিয়া অরিনের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
” এই ক্লাবের এইটটি পারসেন্ট ফিমেল মেম্বার শুধুমাত্র ইলহানের জন্য এখানে জয়েন করেছে। যে তুরি বাজালেও একশোটা সুন্দরী হামলে পড়ে সেখানে তোমার মতো কালো, নোংরা দেখতে একটা টিপিক্যাল বেংগালি মেয়েকে ইলহান কেনো বিয়ে করলো? তোমার কি জানতে ইচ্ছে হয় না অরিন?”
অরিন অন্যদিকে ফিরে চোখ মুছলো। ইলহান সম্বন্ধে সে যেটুকু ধারণা করেছিল ইলহান তার চেয়েও বাজে। অনেক, অনেক বাজে! আর এই সোফিয়া মেয়েটা তার চেয়েও বাজে। অরিন চলে যেতে চাইল। সোফিয়া শক্ত করে ওর হাত টেনে ধরে বললো,
” পুরো কথা না শুনে কোথায় যাচ্ছো? তোমাকে শুনতেই হবে। ইলহান তোমাকে শুধুমাত্র চ্যালেঞ্জে জেতার জন্য বিয়ে করেছে। তাছাড়া বেংলাডেশে তার বুড়ো মা-বাবাকে দেখে রাখার জন্য একটা বুয়া প্রয়োজন ছিল। তুমি হলে সেই বুয়া। ইলহানের বাবা-মায়ের বিনা পয়সার পারমানেন্ট সার্ভেন্ট। বুঝেছো তোমার অবস্থানটা কোথায়?”
অপমানে অরিন দাঁত খিচে ধরলো। চোখ মুখ বুজে বললো,
” আমি যেমনই হই অন্তত তোমাদের চেয়ে ভালো। তোমার মতো বিচ না আমি।”
” হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বিচ? কাকে তুমি বিচ বললে?”
” বিবাহিত পুরুষের সাথে যারা প্রেম করার জন্য লাফায় তারা বিচ ছাড়া আর কি?”
সোফিয়া সর্বশক্তি দিয়ে অরিনের গালে চড় মারলো। অরিন লুটিয়ে পড়লো ফ্লোরে। সোফিয়া অরিনের চুল খামচে ধরে ওকে তুলতে তুলতে বললো,” তুই নিজেকে কি মনে করিস? ইলহানের কাছে তুই ওয়ান টাইম গার্ল। মন ভরে গেলেই ও তোকে ছুঁড়ে ফেলবে। তোর মতো মেয়ের সাথে ও সারাজীবন সংসার করবে ভেবেছিস? তুই কোনদিক দিয়ে ওর যোগ্য? ওর পাশে দাঁড়ালে তোকে ডাস্টবিনের মতো লাগে, ডাস্টবিন চিনিস?”
সোফিয়া কথা শেষ করে অরিনকে জোরে ধাক্কা মারলো। দেয়ালের সাথে বারি খেয়ে অরিন চোখেমুখে অন্ধকার দেখলো। এই অবস্থাতেই কপালে হাত রেখে কোনোমতে ওয়াশরুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো। ইলহান রক্তাক্ত অবস্থায় অরিনকে দেখে চমকে উঠলো। বিচলিত গলায় প্রশ্ন করলো,” এই অবস্থা কিভাবে হলো অরিন? কে করেছে?”
অরিন আধো আধো স্বরে উচ্চারণ করলো,” সোফি, সোফিয়া।”
তারপরই ইলহানের বুকে লুটিয়ে পড়লো সে। সোফিয়া চিৎকার দিয়ে বললো,” মিথ্যে কথা। শী ইজ আ লায়ার। আমি কিচ্ছু করিনি। ও নিজেই প্রথমে আমাকে আক্রমণ করেছিল। আমি শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছি।”
ইলহান হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” ছি সোফিয়া। আই হেইট ইউ। আই যাস্ট হেইট ইউ।”
আহত অরিনকে কোলে নিয়ে ইলহান গাড়িতে উঠে গেল। সোফিয়া চিৎকার করে বলতে লাগলো,” ট্রাস্ট মি ইলহান। আমি কিচ্ছু করিনি। প্লিজ আমার কথা বিশ্বাস করো!”
সবাই অবাক হয়ে ঘটনা দেখলো। নিস্তব্ধতা ছেঁয়ে গেল চারদিকে। শুধু সোফিয়ার কান্নার তীক্ষ্ণ গর্জন শোনা যাচ্ছে।
চলবে
-Sidratul Muntaz