#রংধনুর_রঙ_কালো
১৫.
অন্বয়ের একদম পাশাপাশি আলাদা একটা রুম ভাড়া করা হয়েছে অরিনের জন্য। অন্বয়-অরিন এখন সারাদিন একসাথেই থাকে। অরিনের মন ভালো করার জন্য অন্বয় তাকে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যায়। শুধু রাতেরবেলা তারা আলাদা হয়। ওইটুকু সময় অরিনের জন্য সবচেয়ে বিষাক্ত। ইলহানের স্মৃতিগুলো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তাকে। ইলহানের বিশ্বাসঘাতকতার কথা মনে হলে পৃথিবী তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। এর থেকে যদি ইলহান মরে যেতো, তাও অরিনের কষ্ট কম হতো। তখন সে অন্তত ইলহানের কল্পনাগুলো আঁকড়ে ধরে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু এখন তো সেই সুযোগটাও নেই। ইলহানের কথা মনে পড়লে ঘৃণা ছাড়া অন্যকোনো অনুভূতি আসে না। সেই ঘৃণাময় অনুভূতিটাও অসম্ভব যন্ত্রণাদায়ক! কাউকে প্রচন্ড ভালোবাসলে যেমন তার কথা মনে না করে থাকা যায় না। উঠতে,বসতে, খেতে, চলতে শুধু তার কথাই মনে পড়ে। তেমনি কাউকে ঘৃণা করলেও ব্যাপারটা একই ঘটে। পার্থক্য শুধু, ভালোবাসার মানুষটির কথা মনে হলে বুকে অদ্ভুত প্রশান্তি আসে। আর ঘৃণিত ব্যক্তিটির কথা মনে হলে কষ্টে বুক জ্বলে যায়। এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয় সর্বক্ষণ। এমন ঘটনা তখনি ঘটে যখন কেউ তাকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে, যাকে সে অতীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল। অরিন মাঝে মাঝে রাতেরবেলা অন্বয়কে করিডোরে ডেকে গল্প করে কাটায়। কারণ রাতে তার ঘুম আসে না। অন্বয়ের সাথে গল্প করলে সময়টা ভালো যায়। কখনও কখনও গল্প করতে গিয়ে ভোর হয়ে যায়। অরিন তখন দুঃখিত গলায় বলে,” স্যরি, আমার জন্য আপনার রাতের ঘুমটা নষ্ট হলো।”
অন্বয় তখন বলে,” সমস্যা নেই। আমি রাতে এমনিতেও ঘুমাই না। ভাগ্যিস আপনি গল্প করতে ডেকেছেন। নাহলে আমার সময়টাও খুব বোরিং কাটতো।”
অরিন তখন মুচকি হাসে। কারণ সে বুঝতে পারে, অন্বয়ের কথাগুলো মিথ্যে। তার চোখে তখন ঘুমের পাহাড় জমে থাকে। ক্রমাগত হাই তুলতে তুলতে সে অরিনের গল্প শোনে। অরিন এটাও জানে, ঘুমের থেকেও অন্বয় অরিনের সঙ্গ পেতে বেশি পছন্দ করে। এই মানুষটি না থাকলে অরিন তার জীবনের এতোবড় ধাক্কা কখনোই সামলে উঠতে পারতো না। অন্বয়ের এপার্টমেন্টে অরিন এক সপ্তাহ ধরে আছে। এর মধ্যে একবারও ইলহানের সাথে যোগাযোগ হয়নি। অরিন নতুন মোবাইল কিনেছে। কিন্তু ইলহান তাকে একবারও ফোন করেনি। এমন না যে সে ইলহানের ফোনের অপেক্ষায় ছিল। আসলে অরিন শুধু অবাক হয়েছে। একটা মানুষ কত ভয়ানকভাবে অভিনয় করতে পারে। কথায় কথায় যার স্বভাব ছিল পাঁয়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া সে এখন অবধি একটা খোঁজ পর্যন্ত নিচ্ছে না। অরিন ভেবেছিল ইলহানকে ডিভোর্স পেপার পাঠাবে। কিন্তু এটা করতে গেলে তাকে প্রথমে ইলহানের সাথে যোগাযোগ করতে হবে৷ অরিন এই কাজ ভুলেও করবে না। বরং ইলহান যদি কখনও তার সাথে নিজ থেকে যোগাযোগ করতে আসে তখনি কেবল অরিন তাকে ডিভোর্সের কথা বলবে। অরিন বাংলাদেশে ফেরার তাগিদ অনুভব করছে না। অস্ট্রেলিয়ায় ঘুরে বেড়াতে তার ভালোই লাগছে। সে আরও কিছুদিন অস্ট্রেলিয়া থাকবে।নিজের মতো সময় কাটাবে। শপিং করবে, ঘুরা-ফেরা করবে, ইচ্ছে মতো খাওয়া-দাওয়া করবে। আর যদি কখনও ইলহানের সাথে দেখা হয়ে যায়, সাথে সাথে জুতো ছুঁড়ে মারবে৷ মারবেই।
অরিন ইদানীং নিয়মিত নেশাদ্রব্য পান করে। অন্বয় তাকে কড়াভাবে ড্রিংক করতে নিষেধ করেছে। তার নিষেধাজ্ঞার কিছু কারণ আছে। অরিন ড্রিংক করলে পুরোপুরি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। তার আচরণ হয় বাচ্চাদের মতো। দুইদিন আগেও সে বারে গিয়ে ফরসা দেখতে একটা লম্বা ছেলেকে ইলহান মনে করে চড় দিয়েছে। শুধু তাই না, চুল, নাক-মুখ খামচে একবারে যা-তা অবস্থা। বাংলা ভাষায় এমনসব গালি-গালাজ করেছে, ওই ছেলেটি যদি বাংলা বুঝতো তাহলে শুধু গালা-গালি শুনেই অজ্ঞান হয়ে যেতো। অন্বয় অনেক কষ্টে তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। তাছাড়া ড্রিংকিং তো শরীরের জন্যও ক্ষতিকারক। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে সেই অভ্যাস আর ছাড়ানো যায় না। অরিন আজ-কাল কিছুতেই পাত্তা দেয় না৷ সে দিন দিন অনেক বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। তার মেজাজ বেশিরভাগ সময় খিটখিটে হয়ে থাকে। বাংলাদেশ থেকে কেউ ফোন করলে অরিন কখনও ধরে না। তার কারো সাথে যোগাযোগের ইচ্ছে নেই। সে এখন চূড়ান্ত বেপরোয়া, চূড়ান্ত স্বাধীন! এভাবে সারাজীবন কাটাতে পারলে মন্দ হতো না। একদিন সকালে অন্বয় দেখলো খবরের কাগজে একটা বিশেষ খবর ছাপানো হয়েছে। অন্বয় সেই খবরের কাগজ আর দুই মগ কফি নিয়ে অরিনের ঘরে এলো। জিজ্ঞেস করলো,” কেমন আছেন মিসেস অরিন?”
অরিন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। চোখে-মুখে তেলতেলে ভাব। এই অবস্থায় অরিনকে দেখে অন্বয়ের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে মুখ ধোঁয়ার আগ পর্যন্ত অরিনের চেহারায় যে ভাবটা থাকে তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি। অন্বয়ের তাই বিশ্বাস। অরিন আলতো হাসি দিয়ে বললো,” ভালো আছি। আপনি আজকে সকাল-সকাল আমার ঘরে?”
” আপনাকে একটা জিনিস দেখাবো। তার আগে জানা উচিৎ আপনার মন ভালো আছে নাকি? যদি মন ভালো হয় তাহলে নিউজটা দিবো না। যখন মনখারাপ থাকবে তখন দিবো।”
অরিন ভ্রু কুচকে বললো,” তাহলে নিশ্চয়ই এটা কোনো গুড নিউজ। আপনি চাইছেন গুড নিউজটা শুনে আমার খারাপ মন ভালো হয়ে যাক৷ তাই না?”
” উহুম। এটা নিঃসন্দেহে ব্যাড নিউজ। আমি চাইছি মনখারাপের সময় আরও মনখারাপের খবর দিয়ে আপনাকে একেবারে কাঁদিয়ে ফেলতে।”
অরিন আরও ভ্রু কুচকে বললো,” কেনো?”
” জানি না কেনো। আমার আপনার কান্না দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কাঁদলে আপনাকে কিউট লাগে।”
” আপনি কি আমাকে টুশকি মারতে এসেছেন?”
” টুশকি না। প্রশংসা করলাম।”
” আচ্ছা, আমার মনখারাপ। এখন বলুন তো নিউজটা কি?”
অন্বয় খবরের কাগজ অরিনের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,” আগে কফিটা খাবেন। তারপর চার নাম্বার পেইজটা পড়বেন। আগেই কিন্তু পড়বেন না। তাহলে আপনার কফি খাওয়া মাটি হয়ে যাবে। আজকের কফিটা অনেক ভালো হয়েছে।”
অরিন কফি খেলো না। উদগ্রীব হয়ে খবরের কাগজের চার নাম্বার পেইজ বের করে নিউজটা পড়লো। তারপর তিন-চার মিনিট একদম নীরবে কাটলো। অরিন একটু পর খবরের কাগজ রেখে বিছানা থেকে নেমে গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অন্বয় দ্রুত উঠে তার পেছন পেছন গেল। অরিন করিডোরে এসে দাঁড়িয়েছে। আশেপাশে হালকা বাতাস। অরিনের লম্বা চুলগুলো মাতাল ভাবে উড়ছে। অন্বয়ের ইচ্ছে করলো ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখলো। অরিনের সামনে থাকলে সে যথেষ্ট এলোমেলো হয়ে পড়ে। নিজেকে খুব নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অরিন হঠাৎ বললো,
” আমার একটুও মনখারাপ হয়নি অন্বয়সাহেব। চলুন আজকে আপনাকে নিয়ে লংড্রাইভে যাবো। আপনার গাড়ি আমি ড্রাইভ করবো। রাজি?”
” আপনি ড্রাইভিং জানেন?”
” মোটামুটি জানি। কেউ শিখিয়েছিল একসময়। যাতে তার অনুপস্থিতিতেও আমার চলতে অসুবিধা না হয়।ভয় নেই, আপনাকে এক্সিডেন্ট করাবো না। আমি আবার ড্রাইভিং-এ এতোটাও খারাপ না।”
অরিন কথা বলতে বলতে তৈরী হওয়ার জন্য রুমে চলে গেল। অন্বয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে বুঝতে পেরেছে সেই কেউটা হলো ইলহান। অরিন আজ-কাল ইলহানের নাম মুখে নেয় না। একটু আগে অন্বয় তাকে যে নিউজটা দেখিয়েছে সেটা ছিল মডেল সোফিয়া রিভেরার বিয়ের নিউজ। আর তার উড বি হচ্ছে ইলহান মাহদী। অরিন যে এতো সহজভাবে বিষয়টা গ্রহণ করবে অন্বয় ভাবতেও পারেনি। আচ্ছা, তিনি কি এখন রুমে গিয়ে কাঁদছেন? মনে তো হয় না। এই কয়েকদিনে মিসেস অরিন যথেষ্ট স্ট্রং হয়ে গেছেন। এখন আর ছোট-খাটো কারণেই কেঁদে ফেলেন না। কিন্তু এখানেই ভয়। মানুষের কান্না থেমে যাওয়া মানেই কষ্ট কমে যাওয়া নয়। বরং না কাঁদলে কষ্টগুলো জমতে থাকে। জমতে জমতে একদিন তা মহাপ্রলয়ের রূপ ধারণ করে। তারপর হয় মহা বিস্ফোরণ। তার চেয়ে তো এটাই ভালো, কেঁদে-কেটে কষ্টগুলো একদম ঝেড়ে ফেলা। অন্বয় চায় অরিন কাঁদুক। প্রাণ খুলে কাঁদুক।
চলবে
– Sidratul Muntaz