—আমায় মারবেন না প্লিজ।আমি কিছু দেখিনি।আমি কিছু জানি না।সত্যি বলছি আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না।দোহাই আপনার প্লিজ আমায় জানে মারবেন না।
আদিয়াত নিজের রুমে ঢুকে নতুন বউ এর মুখে এমন কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে।তোহফা চোখ- মুখ খিচে খাটের এক কোনে জড়সড় হয়ে বসে কাপছে আর এক কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার রিপিট করছে।আদিয়াত নিজের জায়গা থেকে তোহফার দিকে কদম বাড়িয়ে যেতে যেতে চিন্তিত সুরে বলল…..
—কি হয়েছে তোমার?তুমি এমন করছো কেন?কোন সমস্যা?
তোহফা,আদিয়াতকে তার দিকে আসতে দেখে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল……
—প্লিজ আমায় মারবেন না।আমি বাচতে চাই।আমি সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না।কাউকে কিছু বলবো না।
তোহফার মৃদু চিৎকারে আদিয়াতের পা থেমে গেলো।আদিয়াত থেমে গিয়ে তোহফাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল……
—রিলেক্স।এতো হাইপার হচ্ছ কেন?কি হয়েছে বলবে তো?না হলে বুঝবো কি ভাবে।
তোহফা,আদিয়াতের কথা কানে নিলো না। সে নিজের মত নিজের কথা বলেই চলেছে।তোহফার এমন ব্যবহারে আদিয়াতের রাগ লাগছে।বাড়ি ভর্তি মেহমান দেখে নিজের রাগটাকে দমিয়ে রাখার জন্য বড় বড় করে কয়েকটা নিশ্বাস নিলো।ভাগ্য ভালো রুমটা সাউন্ড প্রুভ।তা না হলে এতোক্ষনে গোলমাল বেধে যেত।আদিয়াত নিজের রাগ কিছুটা দমিয়ে মোলায়েম গলায় বলল…….
—তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?
তোহফা দু’হাতে মুখ চেপে বসে ছিলো।আদিয়াতের নরম গলার কথা শুনে তোহফা হাতের আঙুল সামান্য ফাকা করে আদিয়াতের দিকে পিটপিট করে তাকালো।তোহফার এই বাচ্চা সুলভ কাজে আদিয়াত মুচকি হাসলো।ঠোটের কোনে হাসির রেখা ঝুলিয়ে রেখে তোহফার দিকে তাকিয়ে বলল……
—আমাকে কেন এতো ভয় পাচ্ছো শুনি?আমি দেখতে কি ড্রাকুলা বা জম্বীর মত?
তোহফা আগের মতই চুপ করে বসে থেকে আঙুলের ফাকা দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে রয়েছে আদিয়াতের দিকে।ঠোটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে থাকা সামনের শ্যাম বর্নের মানুষটাকে যে কতটা সুন্দর লাগছে তা তোহফা বলে বুঝাতে পারবে না।তোহফা একি ভাবে পিটপিট করে আদিয়াত এর দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলল…….
—সকল সুন্দর চেহারার পিছনেই কি একটা পশু সুলভ মন থাকে?যাদের মনে বিন্দু মাত্রও মায়া-দয়া থাকে না।দু’রুপ নিয়ে এরা কিভাবে থাকে?
তোহফাকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আদিয়াত,তোহফাকে কিছুটা সহজ করার জন্য ঠোটের কোনের হাসিটা কিছুটা প্রসারিত করে বলল…..
—কি হল কথা বলছো না যে?
তোহফা মুহূর্তের মধ্যে মাথা খাটিয়ে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে মুখ থেকে হাত সরিয়ে কাপাকাপা গলায় বলল…..
—পানি খাবো।
আদিয়াত দু’কদম সামনে বাড়িয়ে বেড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস হাতে তুলে নিল।পাশের রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ভরে পানি ভর্তি গ্লাস তোহফার দিকে বাড়িয়ে দিতেই তোহফা ভয়ে নিজেকে আরো কিছুটা গুটিয়ে নিল।আদিয়াত,তোহফার অবস্থা দেখে সাবধানে পানির গ্লাসটা বেডের উপর রেখে আস্তে করে বলল……
—পানি খেয়ে নাও।
তোহফা কাপাকাপা হাতে পানির গ্লাস ধরতে গিয়ে হাত থেকে পানির গ্লাস বেডে পরে গেলো।তোহফা কোন রকম রিয়েক্ট না করে পলকহীন পানির গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রইল।আদিয়াত তড়িঘড়ি গ্লাসটা উঠাতেই তোহফা হাত দিয়ে পানি সরাতে লাগলো।আদিয়াত বুঝতে পারছে না তোহফা কি বেড থেকে পানি সরাচ্ছে নাকি উল্টো পানি দিয়ে বেড ভিজাচ্ছে।কেননা তোহফা পানি হাত দিয়ে নিচে না ফেলে বেডের উপরই পানি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আদিয়াত সন্দেহর চোখে তোহফার দিকে তাকিয়ে বলল…..
—কি করলে এটা?
তোহফা,আদিয়াত এর দিকে এক পলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে কাপাকাপা গলায় বলল……
—আমি ইচ্ছে করে করিনি হাত ফসকে পর গেছে।
আদিয়াত দাতে দাত চেপে বলল……
—তা তো দেখতেই পেয়েছি।
তোহফা চোর ধরা পরার মত মুখ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।আদিয়াত আর কোন কথা না বাড়িয়ে তোহফার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফ্রেস হতে চলে গেলো।আদিয়াত ওয়াসরুমে ঢুকতেই তোহফা বড় করে নিশ্বাস ফেলে খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসল।
সাথে সাথে গড়িয়ে পরল চোখ দিয়ে নোনা জল।মনে মনে নিজের ভাগ্যের উপর নিজেই তাচ্ছিল্য করতে লাগলো।
আদিয়াত লম্বা একটা সাওয়ার নিয়ে এসে দেখে তোহফা বেডের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে।আদিয়াত,তোহফা সামনে গিয়ে দাড়িয়ে তোহফার ঘুমন্ত মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।আদিয়াত আর তোহফার এরেন্জ মেরেজ হয়েছে।তোহফাকে এক দেখাতেই আদিয়াত আর তার পরিবারের সবার পছন্দ হয়েছে।তোহফার বাবা অসুস্থ বিধায় এক প্রকার ঘরোয়া ভাবেই তাদের বিয়েটা হয়েছে।ঘরোয়া ভাবে বিয়েটা হলেও আদিয়াত এর আত্মীয় স্বজন দিয়ে তাদের বাড়ি ভরা।আদিয়াতের বাবা একমাত্র ছেলের বিয়ে সাদামাটা ভাবে দিলেও নিজের কাছের আত্মীয়-স্বজন কাউকে দাওয়াত করতে ভুলেন নি।সবাই কে বিয়ের আগের দিন ফোন করে করে বাসায় উপস্থিত করিয়েছে ছেলে আর ছেলের বউকে মন প্রান দিয়ে দোয়া করার জন্য।আদিয়াত, তোহফার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রয়েছে।কতক্ষন যে আদিয়াত,তোহফার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো সেটা তার জানা নেই।তোহফাকে ঘুমের ঘরে বিরবির করে কিছু বলতে দেখে আদিয়াতের ঘোর কাটল।আদিয়াত,তোহফার কথা শোনার জন্য তোহফার দিকে ঝুকে কান পেতে দাড়াতেই শুনতে পেলো……
—আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না।তার পরেও প্লিজ আমায় মেরে না।বাবা দোহাই তোমার একটু রহম করো আর মেরো না।আমি আর সহ্য করতে পারছি না।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা খুব কষ্ট হচ্ছে।মা কোথায় তুমি আমাকে বাচাও মা আমাকে বাচাও।আমি আর পারছি না মা।মরে যাচ্ছি আমি মরে যাচ্ছি।
তোহফা বিরবির করে কথাগুলো বলছে আর ঘুমের মধ্যেই কেমন ফুপিয়ে ফুপিয়ে উঠছে।আদিয়াত,তোহফার কথা শুনে অবাক নয়নে তোহফার দিকে তাকিয়ে রইল।তোহফার সকল ব্যাবহার যেন আদিয়াতের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
________
তাহের রহমান(তোহফার বাবা)হাতে থাকা মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সোফার সাথে হেলান দিয়ে বসে সামনের বসে থাকা মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে বলল……
—দেখলে কি করে আপদ ঘাড় থেকে বিদেয় করলাম।সাপ ও মরলো না লাঠিও ভাঙলো না।
কথাটা শেষ করে হাতের রাখা মদের গ্লাসে আরাব চুমুক দিল।
তাহের রহমানের সামনে বসে থাকা মানুষটি তাকে বাহবাহ দিয়ে বলল…..
—কি আর বলবো তোমায়।আমি তো তোমার এই নিখুঁত অভিনয়ে পুরো মুগ্ধ হয়ে গেছি।
তাহের রহমান মিটমিট করে হেসে বলল……
—এতো বছর ধরে অভিনয় করতে করতে নিজেকে এখন আমার বড় অভিনেতা মতে হয়।নিজেকে নিয়ে নিজের গর্ববোধ হয়।
কথাগুলো বলে তাহের রহমান অট্টহাসিতে ফেটে পরল।সামনের বসে থাকা মানুষটাও তাহের রহমানের হাসির সাথে তাল মেলাতে লাগল।
_______
সকাল সকাল হোস্টেল থেকে গার্ড এর চোখ ফাকি দিয়ে বের হয়েছে একটি মেয়ে। উদ্দেশ্য নিজের বাড়িতে যাওয়া।তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পার হবার সময় একটা বাইক এর সাথে ধাক্কা খেয়ে মেয়েটি পরে গেলো।
—ও মা গো আমার কোমড়টা গেলো গো।এখন আমার কি হবে গো।কে কোথায় আছো গো।আমায় তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাও গো।তা না হলে আমার না হওয়া বর বিয়ের আগেই আমায় তালাক দিবে গো….।
অসাবধানতাবশত বাইকের সাথে ধাক্কা লেগে পরে যাওয়ার কারনে যুবতী একটা মেয়েকে এভাবে রাস্তায় বসে বিলাপ করে পাগলের মত কথাবার্তা বলে কান্না করতে দেখে কথা বলার ভাষা হাড়িয়ে ফেলল ফাহাদ।ফ্যাল ফ্যান নয়নে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল সে।মেয়েটি নিজের মত বিলাপ করেই চলেছে।মেয়েটির চোখ সামনে বাইকের উপর বসে থাকা ফাহাদ এর দিকে পরতেই দেখে ফাহাদ তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে।মেয়েটি নিজের বিলাপ করা বন্ধ করে উঠে দাড়িয়ে ফাহাদ কে এক রাম ধমক দিয়ে বলল…….
—ঐ মিঞা এমনে হা কইরা চাইয়া রইছেন কেন? জীবনে মাইয়া মানুষ দেখেন নাই।বাইক চালানোর সময় চোখ থাকে কই?চোখ কি আসমানে উঠাইয়া রাখছেন নাকি?অবশ্য দেখবেন কেমনে চোখের মধ্যে কানা মানুষের মত এমন চমশা(চশমা) লাগাইলে তো বেবাক ফকফকাই দেখবেন।মানুষ জন তো তখন আর চোখে পরবো না।বাইক চালানোর সময় কি মনে করেন নিজেরে?চালায় বাইক ভাবটা লয় মনে হয় ঊড়োজাহাজ চালাইতাছে।
মেয়েটিকে এক নাগালে বকবক করে কথা বলতে দেখে ফাহাদ অবাক হয়ে ভাবলো……
—এক বারে এতো কথা কিভাবে বলছে মেয়েটা?এটা মানুষ না কথা বলার মেশিন?
মেয়েটা যে ভিষন ভাবে ক্ষেপে আছে সেটা ফাহাদ এর বুঝতে ভুল হল না।ফাহাদ এতোক্ষন ভেবেছে মেয়েটাকে সাহায্য করবে সরি-টরি বলবে।কিন্তু তার কথা শুনে ফাহাদ তার মত পাল্টিয়ে মেয়েটাকে আরেকটুকু ক্ষেপানোর জন্য মুচকি হেসে আশেপাশে তাকিয়ে একটু নরম গলায় বলল……
—আপনার সাথে আপনার বাড়ির লোক কেউ নেই?না মানে আশেপাশে যে কাউকে দেখছি না।
মেয়েটি কপালে ভাজ ফেলে ফাহাদ এর দিকে তাকিয়ে বলল…..
—না নেই?কেন?বাড়ির লোক দিয়ে কি করবেন?
ফাহাদ অবাক হওয়ার ভান করে বলল…..
—ও মাই আল্লাহ্।আপনার মত একটা পাগলকে আপনার বাড়ির লোক একা রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে?কেমন ফ্যামিলি আপনার?আপনার মত পাগলকে তারা যদি বাড়িতে আটকে না রাখতে পারে তাহলে মেন্টেল হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় না কেন?বুঝিনা দেশ এতো মেন্টেল হাসপাতাল থাকতে কেন যে এরা পাগলদের বাড়িতে বসিয়ে রাখে।নিজেরা তো অত্যচার সহ্য করবেই সাথে অন্যকেও অত্যচারের স্বীকার বানাবে।(আফসোসের সুরে)
ফাহাদ কথাগুলো বলার মাঝেই খেয়াল করছিলো মেয়েটি তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাড়িয়ে রয়েছে।ফাহাদ নিজের লক্ষ পূরণের কাজে সক্ষম হয়ে মনে মনে শয়তানী হাসি দিয়ে নিজের কথা শেষ করে মেয়েটাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পাশ কাটিয়ে বাইক নিয়ে চলে গেলো।পিছন থেকে মেয়েটার গলা ফাটানো চিৎকার চেচামেচির কথা কানে আসতেই ফাহাদ মিটমিট করে হাসতে লাগল।
#চলবে,
#তোর_হতে_চাই
#Ariyana_Nur
#Part_01
(ভূলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না।ধন্যবাদ)