হৈমন্তীকা
১৭.
রোদের কঠিন তেজ মেঘের আড়ালে মিইয়ে যাচ্ছে। কালো মেঘগুলো জোট বেঁধে প্রখর হর্তালে নামছে। উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসছে সেগুলো।
মৃদুমন্দ বাতাসে এলোমেলো ভাবে উড়ছে তুষারের চুলগুলো। কপাল কুঁচকানো। নাক ফুলিয়ে চোখে মুখে মারাত্ত্বক রাগ ফুটিয়ে রেখেছে সে। শাহাদাত আঙুল দিয়ে বারবার কপাল ঘঁষছে। হৈমন্তী হতাশ নয়নে তুষারের কার্যকলাপ দেখল কিছুক্ষণ। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ছেলেটা মাঝে মাঝে এত রেগে যায়! হৈমন্তী নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পার্কের আশেপাশে একবার নজর বুলায়। ব্যস্ত মানুষগুলো ব্যস্ত হয়ে জগিং করছে, হাঁটছে, ফোনে কথা বলছে! কেউবা বেঞ্চে বসে গল্পগুজব করছে। আর কেউ কেউ তাদেরই মতো নিশ্চিন্তে ঘাসের ওপর বসে আছে। হৈমন্তী নজর ফেরালো। স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— “আর কতক্ষণ তুষার?”
— “আমি রাগ কমাতে পারছি না, হৈমন্তীকা। অপেক্ষা করুন।”
— “আকাশ কালো হয়ে আসছে তুষার। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে।”
গম্ভীর স্বরে তার একরোখা উত্তর, “নামুক।”
হৈমন্তীর উদাসীনতা বাড়লো। সেই সঙ্গে পায়ের চিনচিনে ব্যথাটাও ক্ষীণ বেড়ে গেল যেন! সেসময় বাস থেকে টেনে আনার সময় কি যেন পায়ে বারি খেয়েছিল তার। ফলসরূপ বাম পায়ের গোড়ালি গভীর ভাবে কেটে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথাটা সহ্য করে নিলো হৈমন্তী। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে বললো,
— “পানি খেয়ে রাগ কমান তুষার। দেড়ি হচ্ছে আমার। এতক্ষণ বসে থাকতে পারব না আমি।”
তুষার বাধ্য ছেলের মতো পানিটা নিলো। ন্যায়নীতি বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি পান করলো। বললো,
— “বোতলটা আপনাকে আর ফেরত দিচ্ছি না হৈমন্তীকা। এটা আমি আমার কাছে রেখে দেব।”
বলে হাসলো তুষার। হৈমন্তী চেয়ে রইলো। শান্ত, শীতল দৃষ্টিতে। আনমনেই হাত বাড়িয়ে তুষারের এলোমেলো চুলগুলো আরও এলোমেলো করে দিলো। বিস্ময় যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল তুষারকে। মৃদু কেঁপে উঠল তার নেত্রজোড়া। হৈমন্তী হাত সরাতে নিলেই বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় তা ধরে ফেলল সে। সরল গলায় অনুরোধ করলো,
— “হাত সরাচ্ছেন কেন হৈমন্তীকা? আমার ভালো লাগছে। আবার করুন।”
হৈমন্তী শুনলো না। জোড় করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো,
— “আপনাকে বারবার বোঝানোর পরও আপনি বুঝতে চাইছেন না তুষার। আমার ওপর একটু বেশিই আশা করে আছেন। কেন এমন করছেন? কেন বুঝতে চাইছেন না আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আপনার আর আমার মাঝে কোনো ধরণের বৈবাহিক কিংবা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। আপনার বাবা, পরিবারও আমাদের কখনো মেনে নেবে না। না মেনে নেবে আমার বাবা। তবুও কেন আমাকে নিজের এতটা কাছে টেনে আনছেন? হুটহাট হাত ধরছেন, যেখানে ইচ্ছে নিয়ে যাচ্ছেন! এসব বন্ধ করুন তুষার। নিজের অধিকার খাটানো বন্ধ করুন।”
তুষার চুপচাপ শুনলো হৈমন্তীর পুরো কথা। গাম্ভীর্য নিয়ে চেয়ে রইলো তার মুখপানে। সরল গলায় আওড়ালো,
— “সম্ভব না হৈমন্তীকা। দরকার হলে আমি সারা জীবন আপনার পিছু নেবো। তীর্থের মতো অপেক্ষা করবো। তবুও আপনাকে কখনো ছাড়বো না। আপনাকে কাছে টেনে নেবো, হুটাহাট হাত ধরবো, অধিকার খাটাবো। কেননা আপনি আমার। আপনাকে ভালোবাসা অধিকারও আমার।”
অদৃশ্য কষ্টের কাঁটাযুক্ত আঘাতে ভেতরটা নিদারুণ কেঁপে কেঁপে উঠলো। নেত্রকোণে বিন্দু জলের আভাস টের পেল হৈমন্তী। সঙ্গে সঙ্গে তা নিবারণের আপ্রাণ চেষ্টা করলো। আড়চোখে একবার দেখলো তুষারকে। যতবার সে তুষারের মায়াময় চেহারাটি দেখে, কান্না যেন উপচে আসতে চায় ওর। নিয়তির ওপর বড্ড অভিমান হয়। পরপরই আফসোস হয় ভীষণ। এত বোঝানোর পরও তুষার কেন বুঝতে চায় না? এত পাগলামি কেন করে?
ভাবনার অকূলপাথারেই তুষার হঠাৎ ব্যগ্র গলায় জিজ্ঞেস করে উঠলো,
— “আপনার পায়ে কি হয়েছে হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তী নিজের পায়ের দিকে তাকালো। গোড়ালি থেকে পায়ের তালু অব্দি আধতাজা রক্তের সূক্ষ্ণ রেখা দৃশ্যমান। তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বোতলের পানিটুকু পায়ে ঢেলে দিলো তুষার। প্যান্টের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে আঘাত প্রাপ্ত স্থানে বেঁধে দিলো। আবারও প্রশ্ন করে উঠলো,
— “ব্যথা কিভাবে পেয়েছেন?”
— “বাস থেকে নামার সময় কিভাবে যেন কেটে গেছে।” হৈমন্তীর নির্বিকার উত্তর।
তুষার রুমালের ওপরই আলতো হাত বোলালো। লহু স্বরে বললো,
— “দুঃখীত হৈমন্তীকা। আমি খেয়াল করিনি।”
— “সমস্যা নেই। এতক্ষণে আপনার রাগ কমেছে নিশ্চই? এবার আমাকে যেতে দিন।”
তুষার দিরক্তি করে বললো,
— “উহু! আপনি আমার রাগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।”
অথচ তুষারের কণ্ঠস্বর একদম স্বাভাবিক, শান্ত!
_____
তুষারদের এলাকার পাশেই একটা বিল্ডিংয়ে ফ্যামিলি বাসার টুলেট লাগানো। নাওয়াজ আর আসরাফ সাহেব বাসাটা দেখে এসেছেন। বলা যায়, মোটামোটি কথাও পাকা করে এসেছেন তারা। যদিও এ বাসা থেকে নতুন বাসাটি একটু বেশিই ছোট। তবুও দিরক্তি করেন নি আসরাফ সাহেব। পরে নাহয় নতুন বাসা খুঁজবেন। কিন্তু এখন আর এক মুহুর্তও এ বাসায় থাকবেন না।
গোধুলি বেলায় তৈমুর ভবনে এসে পৌঁছায় হৈমন্তী। বাহিরে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সমাগম। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে ধরণী। হৈমন্তী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। পেছন থেকে তুষার খানিক উঁচু গলায় বললো,
— “আস্তে হাঁটুন হৈমন্তীকা। আপনার পায়ে ব্যথা।”
স্বভাবসুলভ, আস্তে হাঁটলো না হৈমন্তী। পায়ের গতি বাড়ানোর আগে আগেই হঠাৎ নাওয়াজের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, “হৈমন্তী?”
হৈমন্তী চমকালো। উপরে তাকাতেই দেখল, নাওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে প্রথম তলার সিঁড়ির কাছে। সে নেমে হৈমন্তীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। তুষারকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— “আজকে এত দেড়ি করে আসলে যে হৈমন্তী? তোমার সাথের ছেলেটা কে?”
হৈমন্তী ভীষণ অপ্রস্তুত হলো। একবার তুষারের দিকে তাকিয়ে আবারও নাওয়াহের দিকে তাকালো। মৃদু স্বরে বললো,
— “আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে।”
— “এটা কি ওই ছেলেটা?”
একটু চুপ থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠল নাওয়াজ। হৈমন্তীর অপ্রস্তুত ভাব বাড়লো। কি বলবে ভেবে পেল না। তুষার তখনো ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে আছে। বিরক্ত লাগছে তার। সরব বলে উঠল,
— “চলুন হৈমন্তীকা। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে হৈমন্তীকে নিয়ে ওপরে চলে গেল সে। নাওয়াজ আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শুধু। কিছু বলতে গিয়ে আবার থেমে গেল।
দ্বিতীয় তলায় আসতেই হৈমন্তীর হাত ছেড়ে দিল তুষার। স্বাভাবিক স্বরে বললো, “ছেলেদের থেকে দূরে থাকবেন হৈমন্তীকা। আমি আমার রাগ সামলাতে পারি না। হিংসে তো আরও না।”
হৈমন্তীকা
১৮.
সবে আটটা বেজে কুড়ি মিনিট।
উবুত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে তুষার। দরজার কড়া আঘাতে ঘুমাতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে তার। চোখমুখ কুঁচকে সে চেঁচিয়ে উঠল, “কে?”
ওপাশ থেকে হেনার কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো, “আমি।”
— “দরজা খোলা আছে। আসো।”
অনুমতি পেয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন হেনা। বিছানায় ছেলের মাথার কাছে এসে বসলেন। আলতো ভাবে চুলে হাত বুলাতেই ঘুমু ঘুমু চোখে একবার মায়ের দিকে তাকালো তুষার। পরপরই আবারও চোখ মুদে জোড়ালো গলায় বললো,
— “এত সকাল সকাল বিরক্ত করতে চলে এলে? আমার ঘুম এখনো ফুরয় নি।”
তুষারের কান মলে দিলেন হেনা। কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন,
— “ফুরাতে হবে না। ক’টা বাজে দেখেছিস? সাড়ে আটটা! এখনো তোর এত সকাল সকাল মনে হচ্ছে? বাহিরে তাকা তো একবার।”
তুষার পাত্তা দিলো না মায়ের বকাবকিতে। হেনার কোলে মাথা রাখলো,
— “আরেকটু ঘুমাবো। ডেকো না তো!”
হেনা মৃদু হাসলেন। আধঘুমন্ত তুষারের গাল টেনে বললেন,
— “এত পাজি হয়েছিস! সারাদিন শুধু ফাজলামি আর ফাজলামি। তোর বউ যে তোকে কিভাবে সামলাবে!”
— “আমার বউ তো হৈমন্তীকাই হবে মা। উনি আমাকে ঠিক সামলে নেবেন।”
বিস্তর হেসে আওড়ালো সে। হেনা চুপ হয়ে গেলেন। ক্ষীণ গম্ভীর হলো তার পুরো মুখশ্রী। সুগভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— “উঠে পর তুষার। তোর বাবা তোকে ডেকেছিলেন। অফিসের কি যেন কাজ আছে।”
— “অফিসের কাজে আমার কি কাজ?”
— “আমি কি জানি? তুই গিয়ে দেখে আয়, যা!”
তুষার অল্প বিরক্ত হলো। রোষপূর্ণ ভাবভঙ্গি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কাবার্ড থেকে টি-শার্ট নিতে গিয়ে বারান্দায় চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে গেল তার। কপালের বলিরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে এলো। বিল্ডিংয়ে সামনে বড় সড় একটা ট্রাক দাঁড় করানো। এত সকাল সকাল এই ট্রাক এখানে কেন? প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে হেনার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো তুষার,
— “গেটের সামনে এই ট্রাকটা কিসের মা?”
হেনা যেন চমকে উঠলেন। থতমত গলায় বললেন,
— “পা–পাশের বিল্ডিংয়ের হবে হয়তো।”
— “পাশের বিল্ডিংয়ের ট্রাক আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড় করানো কেন?” সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো সে।
হেনা আগের চেয়েও বেশি চমকালেন এবার। হকচকিয়ে গেলেন। নড়বড়ে গলায় উত্তর দিলেন,
— “আমি কিভাবে জানবো? আর তুই-বা এত প্রশ্ন করছিস কেন? দেড়ি হলে আবার তোর বাবা বকবে। তাড়াতাড়ি তৈরি হ, যা!”
অবাধ্যের ন্যায় তুষার তবুও কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মায়ের ভড়কে যাওয়া অভিব্যক্তির মানে কোনো ভাবেই ঠাওর করতে পারলো না। অতঃপর তোয়ালে নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল ওয়াশরুমে।
_____
সকাল থেকেই তোড়জোড় চলছে হৈমন্তীর ফ্ল্যাটে। আজকে তারা অন্য জায়গায় স্থানান্তর হবে। একে একে রুমের আসবাবপত্র সব ট্রাকের ভেতর নেওয়া হচ্ছে। হৈমন্তী আর হেমন্ত একটু অলস ভাবে কাজ করলেও আসরাফ সাহেবকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। তিনি বারবার তাদাগা দিচ্ছেন দ্রুত জিনিস নিয়ে গাড়িতে উঠতে। এই তৈমুর ভবন থেকে যত তাড়াতাড়ি বিদায় হতে পারেন, ততই তার জন্য ভালো। নয়তো কেমন গলায় কাঁটা আটকে যাওয়া অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে উনার।
বিদায় বেলায় হৈমন্তী উদাস মনে একবার বারান্দায় এলো। আলতো হাতে রেলিং ছুঁলো। স্থির দৃষ্টিতে দেখে নিলো বাগানের মধ্যিখানের বেঞ্চটা। যে বেঞ্চে প্রথম শুয়ে থাকতে দেখেছিল তুষারকে। মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো। হয়তো আর কখনো এই চিরচেনা ফ্ল্যাটের এই চিরচেনা বারান্দায় আসা হবে না তার। রাতে বারান্দায় দাঁড়ালে কারো মৃদু কথার ধাক্কায় বিরক্ত হতে হবে না। কেউ আর আসবে না বিরক্ত করতে। কেউ না!
ভাবনার মাঝেই রাবেয়ার হাঁক শোনা গেল, “হৈমন্তী? বারান্দায় বোধহয় আরও দু’টো ফুলের টব আছে। নিয়ে আয় তো! আর জলদি আয়। এখনই চলে যাবো আমরা।”
হৈমন্তী শুনলো। অতি সন্তপর্ণে অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে টব দু’টো হাতে নিতেই টের পেল, টবগুলো ভীষণ ভারি। কষ্ট হচ্ছে নিতে। বহুকষ্টে সদর দরজার কাছে এসে থামতেই কোত্থেকে নাওয়াজ চলে এলো সেখানে। কিছুক্ষণ হৈমন্তীর দিকে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বড় টবটা নিয়ে নিলো ওর হাত থেকে। তৎক্ষণাৎ বাঁধা দিয়ে হৈমন্তী বললো,
— “আমি পারব নাওয়াজ ভাইয়া। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।”
নাওয়াজ মৃদু হাসলো,
— “সমস্যা নেই। এবার চলো। আঙ্কেল বকাবকি করছেন।”
হৈমন্তী আর কিছু বললো না। সিঁড়ি বেঁয়ে নামার সময় কি দারুণ পীড়াদায়ক অনুভূতি হচ্ছিল তার। বাহিরে আসতেই বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল সে। একপলক তুষারকে দেখতে! একটুখানির জন্য!
নাওয়াজ প্রশ্ন করে উঠলো তখন,
— “কাউকে খুঁজছো হৈমন্তী? বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছো যে? হোঁচট খাবে তো!”
সঙ্গে সঙ্গে নতজানু হলো সে। মিনমিনিয়ে বললো,
— “কাউকে খুঁজছি না। এমনি, দেখছিলাম।”
কি ভেবে হাসলো নাওয়াজ। শব্দহীন ভাবে। বলে উঠল,
— “কোথাও বেশিদিন রইলে জায়গাটার প্রতি মায়া তৈরি হয়ে যায়। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। এটাই স্বাভাবিক। নতুন জায়গায় কিছুদিন থাকো। ওটাও প্রিয় হয়ে যাবে। এ জায়গার কথা আর মনে পরবে না। তাই মন খারাপ করো না।”
নাওয়াজের শান্তনায় শান্ত হতে পারলো না হৈমন্তী। অনুভূতিগুলো আগের মতোই রয়ে গেল। শেষ বারের মতো তৈমুর ভবনের দিকে তাকালো সে। তুষারের বারন্দায় হেনা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন হৈমন্তীর মুখপানে!
ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে, এখন ১২টা বেজে ৫৫মিনিট।
রুমের হালকা গোছগাছ করে রুমের অচেনা বারান্দাটিতে এসে দাঁড়ালো হৈমন্তী। ততক্ষণে আসরাফ সাহেব আর রাবেয়া ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরেছেন। হৈমন্তী ঘাড় ঘুরিয়ে একবার রুমের ভেতর তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে কেমন দমবন্ধকর অনুভূতি হলো তার। এখানে কিছুতেই ভালো লাগছে না হৈমন্তীর। সবকিছু ভীষণ অচেনা, অপ্রিয়। রুমের দেওয়াগুলোও যেন হৈমন্তীকে চিৎকার করে বলছে, ‘আমরা তোমার জন্য নই হৈমন্তী।’ ‘আমরা তোমার জন্য বড্ড অপরিচিত।’
হৈমন্তী ঘনঘন শ্বাস নিলো। মুদে আসা চোখ জোড়া নভস্থলে নিক্ষেপ করলো। হেমন্ত তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। মোবাইলে কি যেন করছিল সে। হঠাৎ উঁচু গলায় বললো,
— “আপু দেখো, দেখো, ওইটা তুষার ভাইয়া না?”
‘তুষার’ নামটা কর্ণকুহুরে প্রবেশ করতেই তড়িৎ গতিতে চোখ মেলে তাকালো হৈমন্তী। হেমন্তর ইশারাকৃত জায়গায় তাকাতেই ল্যাম্পপোস্টের আধো আলোয় তুষারের ক্ষীণ স্পষ্ট মুখ দেখতে পেল। তুষার দাঁড়িয়ে আছে, মাথা নিচু করে। হেমন্ত আবার বললো,
— “বলো না আপু। ঐটা তুষার ভাইয়া না?”
হৈমন্তীর বিশ্বাস হচ্ছে না। তবুও মানতে হবে। কেননা ওটা তুষারই। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে উত্তরে শুধু এটুকু বললো সে,
— “তুই এখানেই দাঁড়া হেমন্ত। আমি দেখে আসছি ও কেন এসেছে।”
হৈমন্তী আর দাঁড়ালো না। গায়ে ওড়না জড়িয়ে চোরা পায়ে চলে গেল বিল্ডিংয়ের বাহিরে। এ বিল্ডিংয়ে দারোয়ান নেই। তাই বেশি অসুবিধেও হলো না। ধীর পায়ে তুষারের মুখোমুখি দাঁড়ালো সে।
মুখ তুলে হঠাৎ হৈমন্তীকে নিজের সামনে দেখেও চমকালো না তুষার। কথাও বললো না। শুধু হালকা কেঁপে উঠলো তার আঁখিপল্লব। শ্বাস ফেলে হৈমন্তীই প্রথমে প্রশ্ন ছুড়লো,
— “আপনি… এখানে কি করছেন তুষার?”
তুষার জবাবহীন। বাদামী মণিজোড়া নিমেষহীন দেখছে তাকে। হৈমন্তী আবার প্রশ্ন করলো,
— “কথা বলছেন না কেন তুষার? আপনি আমার বাসার ঠিকানা কোথায় পেয়েছেন?”
জবাবে তুষার শুধু শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “আমাকে না বলে চলে এলেন কেন হৈমন্তীকা?”
যেন ঝড়ের পূর্বাভাস এই শীতল গলা। হৈমন্তী কেঁপে কেঁপে উঠলো। জবাব দিতে পারলো না। সরব নিজের বাহুতে সূক্ষ্ণ ব্যথার আভাস পেতেই অল্প চেঁচিয়ে বিড়বিড়িয়ে উঠলো, “উফফ! মশা!”
পরপরই আবারো গুটিকয়েক কামড়ের আভাস পেল পায়ে। বিরক্ত হয়ে তুষারকে জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনি শুধু শুধু এত মশার মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন কেন তুষার? চলে যান।”
তুষার দূর্বোধ্য হাসলো,
— “আমার প্রণয়ের দৃঢ়তা মশারাও জানে হৈমন্তীকা। শুধু আপনিই বুঝলেন না।”
তুষারের এরুপ কথায় প্রতিবার ভয়ংকর নীরবতায় চুপ হয়ে যায় হৈমন্তী। এবারও তাই। তবে তুষারের হাতের দিকে নজর যেতেই বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকায় সে। উন্মুক্ত ফর্সা হাতদুটি বিন্দু বিন্দু রক্তলালে শোভিত। গলায়ও আছে। বিশেষ করে থুতনির মাঝবরাবর মশার কামড়টি একটু বেশিই নজর কাড়ল তার। থমকে যাওয়া কণ্ঠে আনমনেই বলে উঠলো,
— “থুতনিতেও কামড় দিয়েছে?”
দাঁত দিয়ে নিজের নিচের অধর কামড়ে ধরল তুষার। হৈমন্তীর মতো করেই বললো, “মেয়ে মশাগুলো বড্ড বেয়াদব হৈমন্তীকা। আমার ঠোঁটে কামড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানে তো শুধু আপনার অধিকার। তাই দেই নি। রেগে গিয়ে আমার থুতনি কামড়ে চলে গেল।”
আকস্মিক এরুপ কথায় খুকখুক করে কেঁশে উঠলো হৈমন্তী। অস্বস্থিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। দূর্বল কণ্ঠকে জোড় পূর্বক কঠিন করে বললো, “চলে যান তুষার।”
ওপাশ থেকে সিক্ত উত্তর, “আপনাকে একটু দেখতে এসেছিলাম হৈনন্তীকা। মন ভরে নি। আরেকটু দেখি, চলে যাবো।”
_________________
চলবে~