হৈমন্তীকা
৩২.
বাতাসের এলোমেলো ঝাপটায় ঘুমন্ত তুষারের ঝাঁকড়া চুলগুলো বিরতিহীন ভাবে উড়ছে। স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। নবজাত শিশুর ন্যায় আদুরে ভঙ্গিতে ঠোঁট হালকা উঁচিয়ে রেখেছে সে। হৈমন্তী দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। কোলে থাকা তুষারের মাথাটা সাবধানে নামিয়ে দিতে চাইলো সে। কিন্তু ব্যর্থ হলো। তুষার কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে পরেছে। আরেকটু নিবিড় হয়েছে হৈমন্তীর সঙ্গে। হাতের বাঁধনও আগের চেয়ে শক্ত, সূগভীর। হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাল ছেড়ে দেয়। একপাশে পরে থাকা কর্মহীন হাতটা উঠিয়ে তুষারের ঝাঁকড়া চুলের ভাঁজে নিয়ে যায়। কিছু পলক মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রয় সুদর্শন মুখপানে। হাত বাড়ায়। ঘন পাঁপড়ি গুচ্ছ ছুঁয়ে দেয় আনমনে। ভাবে, তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। যেন ভাঁজা মাছটাও উলটে খেতে পারে না। অথচ কে বলবে, এই ছেলেটাই একটু আগে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিল। মাঝরাতে কোত্থেকে বারান্দায় এসে চমকে দিয়েছিল হৈমন্তীকে। হৈমন্তী ভড়কানো গলায় প্রশ্ন করেছিল, “আপনি এত রাতে এখানে কি করছেন তুষার?”
ওপাশ থেকে তার ক্রোধে ভরা উত্তর ছিল, “আপনাকে নাকি নাওয়াজের পরিবার দেখতে এসেছিল? আংটি পরিয়েছে? দেখি! হাত বাড়ান।”
হতভম্ব হৈমন্তী আকস্মিক প্রশ্নের রেশ ধরতে পারলো না। বিমূঢ়, বিহ্বল, বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো তুষারের মুখশ্রীর দিকে। জবাব না পেয়ে রাগ যেন ক্ষীণ বাড়লো তার। নিজেই হাত টেনে নিলো। ডান হাতের অনামিকা আঙুলে সোনার আংটিটি নজরে আসতেই ধমকের সুরে বললো,
— “আংটি এখনো খুলেন নি কেন? নাকি বিয়েতে রাজী আছেন আপনি?”
হৈমন্তী থতমত গলায় বললো,
— “ম—মনে ছিল না। এক্ষুণি খুলতাম।”
তুষার প্রতুত্তর হীন এবার। একপলক হৈমন্তীর পানে চাইলো মাত্র। হৈমন্তীর বক্ষস্থল ভারি হয়ে উঠল। তুষারের চোখের সাদা অংশ লাল শিরা-উপশিরায় ভর্তি। নাক, ঠোঁট, গাল, কান কেমন ভয়ংকর রক্তিম লাল। অগোছালো চুলে অস্বাভাবিক লাগছে তাকে। আঙুল থেকে আংটিটা বের করতে করতে তুষারের গম্ভীর গলা শোনা গেল,
— “বিয়ে করেও শান্তি নেই। বউ নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। আপনাকে আমি কোথায় রেখে শান্তি পাবো হৈমন্তীকা? বুকের ভেতরটায় থাকতে পারবেন না আপনি?”
বলতে বলতে আংটিটা ছুঁড়ে মারলো বারান্দার বাহিরে। হৈমন্তী আঁতকে উঠলো। বড় বড় চোখে তাকালো। কঠর গলায় কিছু বলবে, তার পূর্বেই তাকে বারান্দার মেঝেতে বসিয়ে দিলো তুষার। নিজে শুলো হৈমন্তীর কোলে মাথা রেখে। চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
— “ঘুমাবো হৈমন্তীকা। বিরক্ত করবেন না।”
তুষারের ক্লান্ত মুখমণ্ডল দেখে হৈমন্তীর মনও সায় দিলো না কিছু বলতে। সে চেয়ে রইলো, বসে রইলো, নির্ঘুম রাত্রির নিশাচর হয়ে।
_____
নিকষকৃষ্ণ আঁধার ডিঙ্গিয়ে পূর্ব দিক থেকে জেগে উঠছে সূর্য। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে তীব্র মাত্রায়। আঁখিপল্লবে তেজি কিরণের ছোঁয়া লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল হৈমন্তীর। পিটপিট দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো সে। চোখ কচলাল। উদরে ভারি কিছুর অস্তিত্ব টের পেতেই সেদিকে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে তুষারের গভীর তন্দ্রায় লেপ্টে থাকা মুখখানি ভেসে উঠল সামনে। হৈমন্তী আনমনে মুচকি হাসলো। কপালের মসৃণ চুলগুলো আলতো করে স্পর্শ করলো। নড়েচড়ে উঠল তুষার। ঘুমে কাতর চোখ জোড়া মেলে প্রথমেই তাকালো হৈমন্তীর দিকে। ঢিমে যাওয়া স্বরে শুধালো, “শুভ সকাল হৈমন্তীকা।”
ঠোঁটের হাসিটুকু আরেকটু বাড়ালো হৈমন্তী, “শুভ সকাল।”
হৈমন্তীর উত্তর শুনে আবারও চোখ বুজে নিলো তুষার। ছোট্ট একটা হামি দিলো। বলা যায়, আবারও ঘুমানোর পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে সে। হৈমন্তী হকচকালো, ভড়কালো। রুমে উঁকি দিতেই দেখল, ঘড়িতে পাঁচটা বেজে বাইশ মিনিট।
তুষারের বুকে আলতো ধাক্কা দিলো সে। তাড়া দিয়ে বললো,
— “ঘুমাচ্ছেন কেন তুষার? উঠুন। উঠছেন না কেন?”
তুষার জবাব দিলো না। শুনলোই না যেন। হৈমন্তী আবারও বললো,
— “পাঁচটা বাজছে তুষার। একটু পর মা,বাবা জেগে যাবেন। কেন এমন করছেন? উঠুন না!”
তুষার চোখ মেলল। রোষপূর্ণ চাহনিতে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললো,
— “আমার শান্তি কি আপনার সহ্য হয় না হৈমন্তীকা?”
হৈমন্তীর চোখ ছোট ছোট হয়ে এলো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— “বাজে বকছেন কেন? উঠুন জলদি।”
একঝাঁক অনিচ্ছা নিয়ে উঠে বসলো তুষার। হৈমন্তীর ওড়না দিয়ে নিজের তৈলাক্ত মুখশ্রী মুছলো। কিছুসময় নির্নিমেষ, নিভৃতে চেয়ে রইলো হৈমন্তীর দিকে। হিম শীতল কণ্ঠে বললো,
— “আপনি দিন দিন সুন্দর হয়ে উঠছেন হৈমন্তীকা। আমার ঘুম হারাম করে দিচ্ছেন।”
এটুকু বলে আর বসলো না তুষার। তৎক্ষণাৎ উঠে বারান্দা বেয়ে নিচে নেমে গেল। হৈমন্তী রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। নিষ্পলক দেখতে লাগল কৌশলে নিচে নেমে যাওয়া তুষারকে।
_____
দিন গড়ালো। আকাশে নেমে এলো অন্ধকার। রাবেয়া রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে উঁচু গলায় হাঁক ছেড়ে উঠলেন,
— “হেমন্ত? বাপ দেখ তো কে এসেছে।”
হেমন্ত সোফায় বসে আলু ভাঁজা খাচ্ছিলো। মায়ের কথায় প্লেট-টা সোফায় রাখলো। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই গম্ভীর মুখো আসরাফ সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল। হেমন্ত দৌঁড়ে চলে গেল আবার। জুতো খুলে ভেতরে ঢুকলেন আসরাফ সাহেব। মনে মনে প্রচন্ড রাগে ফুঁসছেন তিনি। কোনোমতে ড্রইংরুমে এসে জোড়ে জোড়ে চেঁচিয়ে হৈমন্তীকে ডাকলেন।
হৈমন্তী বিছানা গুছাচ্ছিল। বাবার এহেন ডাকে ভড়কে গেল সে। ভয় পেল। দ্রুত ওড়না মাথায় টেনে ড্রইংরুমের দিকে এগোলো। ততক্ষণে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে রাবেয়াও চলে এসেছেন সেখানে। হৈমন্তী বাবার দিকে ভীতু নয়নে চেয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে বাবা?”
তিনি ক্ষিপ্ত চোখে হৈমন্তীর হাতের দিকে তাকালেন। ধমকের সুরে বললেন,
— “তোর হাতের আংটি কোথায়?”
ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল হৈমন্তীর। দৃষ্টি এলোমেলো হলো। কণ্ঠ কাঁপতে লাগলো। কি জবাব দেবে হৈমন্তী? কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোড়ালো গলায় মিথ্যে বললো সে,
— “খুলে রেখে দিয়েছি বাবা।”
— “কেন খুলে রেখেছিস? বিয়েটাকে কি ছেলেখেলা মনে হচ্ছে তোর? ইয়ারকি মনে হচ্ছে? নাওয়াজকে কি বলেছিস তুই? বিয়ে ভেঙ্গে দিতে? আর কত অসম্মান করবি আমার? একটু শান্তি দেয় আমাকে! একটু শান্তি দেয়!”
আসরাফ সাহেব থামলেন। বাবার সঙ্গে চোখে চোখ মেলানোর সাহস পেল না হৈমন্তী। স্বচ্ছ আঁখির কোটর হতে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরল মেঝেতে। থেকে থেকে শরীর কেঁপে উঠল। একটু পরেই হয়তো হিচকি সমেত কান্না উঠবে।
আসরাফ সাহেব রাবেয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। নিদারুণ কঠিন গলায় বললেন,
— “তোমার এই আত্মসম্মানহীন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেও বাঁধছে আমার। ওকে বলে দাও, ওই ছেলেকে যেন ফোন করে বলে বাসায় আসতে। এর একটা বিবিধ আমি করেই ছাড়বো। কি পেয়েছে ওই বাপ-ছেলে? আমাকে প্রতিনিয়ত ফোন করে অপমান করবে আর আমি চুপ থাকবো?”
__________________
চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা