তোমাতেই পূর্ণ আমি পর্ব -২৮

#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -২৮
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা

তিতিশাকে পড়াতে পড়াতে কখন দু ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। বই খাতা বন্ধ করে কোলে তুলে নিলাম তিতিশা কে। গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বললাম,,,

–মিস এখন তোমাকে নুডলস বানিয়ে দিব। খাবে তো বেবী?

মায়া ভরা চোখ নিয়ে অমায়িক হাসি হাসল তিতিশা। মাথা নাড়িয়ে বুঝাল খাবে। তিতিশা কে ড্রইং রুমে বসিয়ে টিভি অন করে দিয়ে চলে আসলাম কিচেন রুমে। সন্ধ্যার প্রহর পেরিয়ে গেছে সেই কখন। ঘড়িতে নয়টা বাজতে চলল। আরিয়ানা আপু ও তোহাশ ভাইয়া জরুরি কাজে বাহিরে গেছে। আর তূর্য রুমে অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পড়ালেখা + অফিসের কাজ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও কি সুন্দর সবকিছু সামলে নেই মানুষটা। ভার্সিটির টপ বয় ও হয়ে উঠে। অথচ আমি টপ তো দূরের কথা এবার বোধহয় টেনে টুনে পাশ টাই করতে হবে। কিছুই শিখা হয় নি আমার। তূর্য যদি ঘুণাক্ষরেও টের পান তাহলে দেখা যাবে সারা দিন রাত শুধু বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে হবে। টপ করা স্টুডেন্ট দের এই একটা প্রবলেম যাকে দেখবে তাকেই শুধু পড়ার উপদেশ দিবে। গতকাল রাতে ও তো টের পেলাম রাত জেগে পড়ায় মগ্ন ছিল জনাব। ঘুম হালকা হয়ে আসলেও গভীর ঘুমে ডুবে আছি এমন বাহানা ধরে ছিলাম নয়তো আমাকে ও পাশে বসিয়ে পড়াতো। ঝটপট নুডলস বানিয়ে আনতেই দেখলাম তিতিশার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে তূর্য। আমাকে দেখে ঘাড় টা এলিয়ে দিলেন সোফায়। মধুর সুরে ডেকে উঠলেন,,

–বউ,,,,,,,,

লজ্জায় স্তব্ধ হয়ে নুডলসের বাটি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে পড়লাম আমি। ছি! ছি! তিতিশার সামনে আমার মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন। তিতিশা যা পাকনি। তার উপর আমি তার মিস হয়। দিলেন তো তূর্য টা সব শেষ করে।

–কি হলো বউ? দাড়িয়ে আছো কেন? এদিকে আসো জলদি।

কি আর করার! তিতিশা কে নুডলস এর বাটি টা ধরিয়ে দিয়ে ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন তিনি। হ্যাঁচকা টানে আমাকে বসিয়ে দিলেন নিজের পাশে। প্রস্তুত না থাকায় কিছুটা হেলে পড়লাম আমি ওনার দিকে। ওনার বুকের কিছু টা অংশ খামচে ধরতেই গালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলেন তূর্য। তাড়াতাড়ি করে তিতিশার দিকে চাইতেই খেয়াল করলাম ও টিভির দিকে গভীর দৃষ্টি তাক করে রেখেছে। আমার পিঠে হাত রেখে বলে উঠলেন তূর্য,,

–তোমাকে খুব মিস করছিলাম বউ। দু ঘন্টা ধরে আমার চোখের আড়ালে তুমি । হৃদপিণ্ডে তো প্রায় রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেছে। মাথা টা ভীষণ ব্যাথা করছে। তোমার হাতের ছোঁয়া চাই। ভালোবাসার পরশ চাই। কোলে মাথা রেখে এক ঘন্টা ঘুমাতে চাই।

নিস্তেজ হয়ে চেয়ে রইলাম আমি। আবদার গুলো এতো মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ কেন? তূর্য নামক মানুষটা এমন কেন? প্রতিবার ভালোবাসাময় বাক্য ছুঁড়ে হৃদয়টা ঘায়েল করে কেন? নরম স্বরে বললাম,,

–এখানে তো তিতিশা আছে। আপনি বরং রুমে গিয়ে ঘুমোন। আপু ও তো এখনও আসে নি। ওকে একা ফেলে কি রুমে থাকতে পারি বলুন?

–তিতিশা কার্টুন দেখলে আর কিছুর খবর থাকে না। এক ঘন্টা-ই তো বউ । জাস্ট তোমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমাব। ওয়েট। তিতিশা,,,
কোনো রেসপন্স নেই তিতিশার দেখলে তো?

–না দেখি নি। মাথা ব্যাথা করছে তো?ঠিক আছে আমি টিপে দিচ্ছি।

কথাটা বলেই তূর্যর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কপালে হাত দিতেই হাতটা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলেন ওনি। লালচে বর্ণ ধারণ করল চোখ। আমার দিকে না তাকিয়েই চলে গেলেন রুমে। নিমিষেই আঁধারে ছেয়ে গেল মনটা। ওনি কি রাগ করেছেন? ওনি তো এমন কিছু আবদার করেন নি যা দেওয়া সম্ভব না। একটু কোলে মাথা রাখতেই তো চেয়েছিলেন। আমিই হয়তো একটু বেশিই করে ফেলেছি। দরজার দিকে চোখ যেতেই আরিয়ানা আপু ও তোহাশ ভাইয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। মিষ্টি হেসে সোফায় বসলেন আপু। দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলাম,,

–কাজটা ভালোভাবে কমপ্লিট হয়েছে আপু?

–হুম। তিতিশা তোকে বিরক্ত করে নি তো?

–একদমই না।


ভয়ে ভয়ে রুমে ঢুকলাম আমি। তূর্য খাটে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে মত্ত। আমার আসার শব্দ যেন তিনি পান নি এমন ভান ধরে আছেন। ল্যাপটপ থেকে একবার ও মুখ তুলে তাকান নি। দরজা টা হালকা চাপিয়ে দ্রুত পায়ে তূর্যর গা ঘেঁষে বসলাম আমি বিছানায়। আঁড়চোখে তাকিয়ে চোখ রাঙালেন তূর্য। শুকনো ঢোক গিললাম আমি। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। গায়ের ওড়নাটার এক পাশ দিয়ে ঘামটা মুছে নিলাম। কি আশ্চর্য! আমি কি তূর্য কে ভয় পাচ্ছি? হুম পাচ্ছি তো। মিন মিন করে বলে উঠলাম,,

–আআআসলে তখন তিতিশা,,

তূর্য খুব জোরে ল্যাপটপ টা রেখে চলে গেলেন বারান্দায়। এতো জোরে আওয়াজ করল যে মৃদু কেঁপে উঠলাম আমি। মনে সাহস জুগিয়ে আবারও ছুটে চললাম বারান্দায়। রেলিং এ হাত রেখে নিচে চেয়ে আছেন তূর্য। আজকের চাঁদ টা ঠিক সেদিনের মতো। সেদিন চাঁদ টা স্বাক্ষী ছিল আমাদের ভালোবাসার নতুন অধ্যায়ের সূচনার। তূর্যর কিছুটা কাছে যেতেই ঘুরে দাঁড়ালেন ওনি। অগ্নি চোখে আমার দিকে তাকাতেই ভয়ার্ত মন নিয়ে থমকে রইলাম। এক পা এক পা করে ওনি একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন। গম্ভীর কন্ঠে বলতে লাগলেন,,,

–আমার রাগ সম্পর্কে তুমি তো অবগত ছিলে তাই না? নাকি ভুলে গেছো?তোমার সাথে রাগ দেখাতে চাই না শ্রেয়া। ভালো হবে এখন আমার থেকে দূরে থাকো। আমি চাই না তোমার উপর এই মুহুর্তে আমার রাগের কোনো প্রভাব পড়ুক।

–আপনার তো মাথা ব্যাথা করছিল। রুমে এসে শুয়ে পড়ুন।

–তোমার ভাবতে হবে না।

–তূর্য প্লিজ শুনুন।

–রুমে যাও।

—তূর্য,,,,

তীব্র রাগ নিয়ে আমাকে দেয়ালের সাথে শক্ত করে চেপে ধরলেন তূর্য। রক্তিম চোখ। চোয়াল শক্ত করে বললেন,,

–কতোবার বলতে হবে তোকে?মেজাজ এমনিতে খিটখিটে হয়ে আছে তার উপর তুই এমন করছিস। এটাই তো চেয়েছিলি যেন আমি রাগ দেখাই। এটাই চেয়েছিলি না? নে এখন সহ্য কর।

কথাটা বলেই আমার গলায় সজোড়ে কামড় বসিয়ে দিলেন তূর্য। ব্যাথা অনুভূত হতেই মৃদু আওয়াজ করে কিছুটা নড়ে উঠলাম । বুকে ধাক্কা দিয়ে তূর্য কে সরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এতে যেন তিনি আরও রেগে গেলেন। দু’হাতে শক্ত করে আমার হাত দুটো আঁকড়ে ধরলেন নিজের হাতের মুঠোয় । গলায় উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই মেরুদণ্ড বরাবর স্রোত বয়ে গেল। গভীর স্পর্শ দিয়ে সরে এলেন তূর্য। গালে হাত রেখে বললেন,,,

–আ’ম সরি বউ। অফিসের কাজ ও সামনে ফাইনাল এক্সাম সব মিলিয়ে মেজাজ চওড়া ছিল। কতবার বলেছি রুমে যাও। কিন্তু তুমি শুনো নি। দিন দিন তোমার সাহস বেড়েই চলছে।
এখন তোমাকে ডাবল শাস্তি পেতে হবে।

হেঁচকি উঠে গেল আমার। তূর্যর দিকে তাকাতেই দেখি কঠোরভাবে তাকিয়ে আছেন ওনি আমার দিকে। গলায় ঝাল ঝাল অনুভব করতেই চোখ পানিতে টুইটুম্বুর হয়ে উঠল। আমাকে বাঁধন থেকে মুক্ত করে রুমে চলে গেলেন তূর্য। আমিও পিছু পিছু আসতেই আমাকে খাটে বসিয়ে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিলেন হাতে। গ্লাস টা নিয়ে ঢকঢক করে পানি টা খেয়ে শান্ত হলাম । শাস্তির কথা শুনেই আমার এ অবস্থা! না জানি আজ আবার কেমন শাস্তি দেন ওনি।

–চটজলদি পড়তে বসো।

কথাটা বলেই টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন তূর্য। মনের অবস্থা নাজুক। একটু আগেই তো এই পড়া নিয়ে ভাবছিলাম এখন এই মসিবত আমার ঘাড়েই এসে পড়ল। দীর্ঘ একটা হাসির রেখা টেনে আমতা আমতা করে বললাম,,

–একেবারে ডিনার করে না-হয় পড়তে বসব তূর্য। আর আপনার তো মাথা ব্যাথা করছিল।

–বাহানার দরকার নেই। আর এক রাত না খেলে কিছু হবে না। কিন্তু এখন আমার কথা না শুনলে এর পরিণতি খুবই ভয়ংকর হবে।

তূর্য ভয়ংকর বলেছে মানে ভয়ংকর হবেই হবে। আসলেই এক রাত না খেলে কিছু হবে না। কিন্তু তূর্যর রাগের শিকার হলে খুবই ভয়ংকর কিছু হবে। তড়িঘড়ি করে চেয়ারে বসে পড়লাম আমি। মুচকি হাসলেন তূর্য। ঠোঁট দুটো আরেকটু প্রসারিত করে বললেন,,

–গুড গার্ল।

আমাকে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে নিচে চলে গেলেন ওনি। নিশ্চয়ই খেতে গিয়েছেন।কি নিষ্ঠুর হাসবেন্ড! আমাকে পড়ায় বসিয়ে এক রাত না খেলে কিছু হবে না বলে নিজে খেতে চলে গেলেন। টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলাম আমি। লাগবে না পড়া মরা। একটুখানি ঘুমানো যাক তূর্য আসা অব্দি। কিন্তু তা আর হইল কই?পিছন থেকে গর্জে উঠলেন তূর্য। ভয়ে লাফ দিয়ে উঠলাম আমি। হৃদয়ের কম্পন ক্রমশ বাড়তে লাগল। প্লেট হাতে দাড়িয়ে ওনি। টি টেবিলের উপর খাবার গুলো রেখে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন রাগান্বিত চেহারা নিয়ে। ইশ ফর্সা চেহারা কেমন লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলেন,,

—ঘুমাচ্ছিলে কেন বউ?

–না না আমি তো ঘুমায় নি তূর্য। ওই একটু চোখ লেগে গিয়েছিল আর কি!!!( হেসে)

—যাও এখুনি চোখে মুখে পানি দিয়ে আসো।

তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে এসে চোখে মুখে পানি দিলাম। উফ বেচে গেছি। বাহিরে আসতেই তূর্য কাছে এসে বসতে বললেন। সোফায় গিয়ে ওনার পাশে বসতেই মুখের সামনে খাবার ধরলেন ওনি। একটু অভিমানী স্বরে বললাম,,

–আপনি না বলেছেন এক রাত না খেলে কিছু হবে না?

–তুমি এক রাত না খেলে কিছু হবে না কিনা জানিনা। তবে আমি এক রাত না খেলে ঘুম আসবে না। আর তুমি না খেলে আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না।– ঠোঁট হাসি ফুটিয়ে কথাটা বললেন তূর্য।

কথাটা ঘুরিয়ে পেচিয়ে বললে ও আমি ঠিকি বুঝেছি আমাকে খাওয়ানোর জন্য এতকিছু। ওনার কেয়ার ভালোবাসা গুলো মাত্রারিক্ত কেন? মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় এগুলো হারিয়ে যাবে নাতো? সুখ তো আমার কাছে বেশিদিন স্থায়ী হয় না। এখন তো সারাক্ষণ সংশয়ে থাকি। মনে হয় এই বুঝি কেউ কেঁড়ে নিচ্ছে আমাকে সুখ দেওয়া মানুষ টা কে। খাবার খেতে খেতে তূর্যর দিকে চেয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে। মানুষ টা একদম অন্যরকম। কতো কষ্ট দিয়েছি আমি তবুও আমার যত্নে একটুও ত্রুটি রাখেন না ওনি। সত্যিই ভালোবাসা কাউকে কাউকে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করে।


বিছানায় শুয়ে আছি আমি। তূর্য তোহাশ ভাইয়ার কাছে গিয়েছে অফিসের কাজ নিয়ে কথা বলতে। মনে খচখচ করছে একটা কথা। কিভাবে জানাব আমি তূর্য কে। উনিই বা কি ভাববেন?পরক্ষণেই মন বলল কিসের জড়তা? ওনি তো আমার স্বামী। রুমে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লেন তূর্য। আমাকে আবদ্ধ করে নিলেন নিজের বাহু বন্ধনে। তূর্যর বুকে মাথা রেখে নরম স্বরে বলে উঠলাম,,

–আমি মা হতে চাই তূর্য।

চমকে উঠলেন তূর্য। আমাকে বুক থেকে সরিয়ে উঠে বসলেন উনি৷ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। ওনার ভাবভঙ্গি সঠিক বুঝতে পারছি না আমি। গম্ভীর কন্ঠে ওনি বলে উঠলেন,,,

–বিয়ে হয়েছে দু’ মাস ও হয় নি শ্রেয়া। এখনই এমন কথা।

–তূর্য আমি তো শুধু,,,

–আমি তো শুধু কি শ্রেয়া? ডক্টরের কথা ভুলে গেছ? ওনি জানিয়েছেন এখন বাচ্চা নিলে তোমার মৃত্যু ঝুঁকি থাকবে। কারণ তোমার আগের বার প্রেগ্ন্যাসিতে প্রবলেম হয়েছিল। মেডিসিন গুলো নাও ঠিক ভাবে। তুমি একদম সুস্থ হলেই আমরা বেবীর কথা ভাববো।

–আমার কিছু হবে না তূর্য। আমরা চেষ্টা করে তো দেখতেই পারি।

দুই বাহুতে চেপে ধরলেন তূর্য। অসহায় চোখে তাকালাম আমি। আমার বাহু ছেড়ে দিয়ে আমাকে নিজের বুকে চেপে ধরলেন প্রচন্ড জোরে। কোমল স্বরে বলে উঠলেন,,,

–তুমি কি চাও শ্রেয়া আমি আবারও হারিয়ে ফেলি তোমাকে? আমার বাঁচার শেষ ইচ্ছে টুকু ও নষ্ট করে দিতে চাও? বেবী আমরা নিব তবে তুমি কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর। তোমার মিস ক্যারেজ হয়েছে মাত্র কয়েক মাস হয়েছে। ডক্টর তো জানিয়ে দিয়েছে এখন বেবী নিলে তোমার লাইফ রিস্ক থাকবে। আমি কিভাবে তোমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেই বলো? সবাই বেঁচে থাকতে চায়। আমিও চাই। আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে চাই তোমাকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে রেখে।

হঠাৎ মাথায় পানি অনুভব করতেই বুঝতে পারলাম তূর্য কাঁদছে। আমিও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলাম,,,

—আমি আর জেদ করব না তূর্য। কখনও না।


আজ প্রিয়ু ও আয়ুশ ভাইয়ার গায়ে হলুদ। সকাল থেকেই প্রিয়ুদের বাসায় আমি। এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আকাশ ও ছেয়ে আছে রক্তিম আভায়। বাহিরে এখনোও ডেকোরেশনের কাজ দেখতে ব্যস্ত শিহাব ভাইয়া।তূর্য আসেন নি। কারণ ওনি ছেলে পক্ষ। আয়ুশ ভাইয়াদের বাসায় গিয়েছেন ওনি। কিন্তু একটু পর পরই ফোন দিয়ে যাচ্ছেন। দু’জন দু প্রান্তে অথচ মন এক অংশ জুড়েই অবস্থান করছে। শিহাব ভাইয়া খুবই ভালো একজন মানুষ। আমাকে পান নি তবুও আমার জন্য গচ্ছিত স্নেহ একটু ও কমে নি। কোনো খারাপ ব্যবহার ও করেন নি আমার সাথে। সবসময়ের মতো হাসি খুশি আচরণ। দোয়া করি খুব শীগ্রই যেন ওনার জীবনে কেউ আসে আর পূর্ণতায় ভরিয়ে দেয় জীবনটা। রুমে এসে দেখি প্রিয়ু ম্যাডাম কানে ফোন রেখে অনবরত কথা বলেই যাচ্ছে। মনে মনে হাসি পেল আমার। আয়ুশ ভাইয়া ও এই ন্যাকা রাণীর চক্করে পড়ে একদম শেষ হয়ে গেল। দু’মাসে অনেকটাই পরিবর্তন করে দিয়েছে এই মেয়ে আয়ুশ ভাইয়া কে। কে বলেছে জীবন থেমে থাকে? আয়ুশ ভাইয়া না না করেও বাধ্য হয়েছে এই মেয়ের প্রেমে পড়তে।

–কালকেই তো বিয়ে। একটু ধৈর্য্য ধর। এখন ফোনটা রেখে সাজতে আয়। নয়তো বিয়ের কনে ছাড়াই হলুদ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটবে।

মুখ তুলে তাকাল প্রিয়ু। আয়ুশ ভাইয়ার উদ্দেশ্য বলে উঠল,,,

–আচ্ছা আয়ুশ রাখছি এখন। রাগ করবেন না প্লিজ। বিয়ে নিয়ে আমার কতো স্বপ্ন আপনি তো জানেনই। কোনোভাবেই একটা প্রোগ্রাম ও মিস করা যাবে না। সাজতে ও সময় লাগবে। আচ্ছা রাখছি রাখছি।

প্রিয়ুর কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খাওয়ার অবস্থা আমার। কি উপাধি দেওয়া যায় প্রিয়ুকে? বিয়ে পাগলি নাকি আয়ুশের পাগলি??? তীক্ষ্ণ নজরে আমার দিকে তাকাল প্রিয়ু।মুখ ফুলিয়ে বলে উঠল,,,

–হাসছিস কেন শ্রেয়া?

–বিয়ে বিয়ে করে নিঃশ্বাস নিতে ও ভুলে যাচ্ছিস হাসব নাকি কাঁদব বোন?

–তোকে বান্ধবী না শত্রু মনে হচ্ছে আমার।

–তুই যা ভাবিস তাই।

–আমি তোকে কলিজা ভাবি তাহলে তুই কি আমার কলিজা?–মুচকি হেসে বলল প্রিয়ু।

–হুম তাই।

কথাটা বলেই প্রিয়ু কে জড়িয়ে ধরলাম। কেঁদে দিল প্রিয়ু। আমারও চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা অশ্রু।

————————-
হুলুদ একটা জামদানী শাড়ি পড়লাম আমি। খোপা করে পেচিয়ে নিলাম বকুল ফুলের গাজড়া। আয়নায় নিজেকে এক নজর দেখে মেসেজ করলাম তূর্য কে–কখন আসবেন আপনি এখানে?

রিপ্লাই দেন নি। হয়তো ওইখানে কোনো কাজ নিয়ে বিজি আছেন। স্টেজে বসে আছে প্রিয়ু। আমি দাড়িয়ে রইলাম এক পাশে। এখানে খুব মানুষ। প্রিয়ুর ফুফাতো মামাতো ভাইয়ের কয়েকজন ফ্রেন্ড ও এসেছেন। একটা ছেলে কতোক্ষণব্যাপী তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দৃষ্টি স্বভাবিক নয়। কেমন যেন লালসার দৃষ্টি। ভালো ভালোই অনুষ্ঠান টা শেষ হলেই হয়। তূর্য যদি বুঝতে পারেন তাহলে মেরেই ফেলবেন ছেলেটা কে। বিয়ে বাড়ি পরবর্তীতে ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হবে। শিহাব ভাইয়া এসে জিজ্ঞেস করলেন,,

–কোনো সমস্যা শ্রেয়া? প্রিয়ু কখন থেকে তোমাকে ডাকছে শুনছো না যে?

—আসলে আমি খেয়াল করি নি ভাইয়া। এখনই যাচ্ছি আমি।

–আচ্ছা। কোনো সমস্যা হলে জানাবে আমায়।


মুচকি হেসে প্রিয়ুর কাছে চলে এলাম আমি। ফোন চেক করতেই দেখলাম তূর্য মেসেজ দিয়েছেন গেইটের কাছে যেতে। মনটা ভালো হয়ে গেল আমার। সকাল থেকে একবারও দেখি নি ওনাকে। মন টাও কেমন আনচান করছিল। তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিল মনটা ওনাকে এক নজর দেখার আশায়। গেইটের কাছে আসতেই তূর্য কে দেখতে পেলাম। কালো পাঞ্জাবি পড়েছেন ওনি। মনে পড়ে গেল নবীনবরণের কথা। সেদিন ও কালো পাঞ্জাবি পড়ে নজর কেঁড়ে নিয়েছিলেন সুদর্শন এই পুরুষ। আশেপাশে কাউকে না দেখে তূর্য কে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে। আমার মুখ টা দু’হাতে আঁকড়ে ধরলেন ওনি। সম্মোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আমার কাছাকাছি নিয়ে আসলেন নিজের মুখটা। গলা জরিয়ে ধরে আমিও চেয়ে রইলাম মুগ্ধ দৃষ্টিতে। মুচকি হেসে মুখটা ফিরিয়ে নিলেন ওনি। কি হল? আমি গলা ছেড়ে দিতে নিলে আমার চুলের পিছনে হাত দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলেন তূর্য। দু চোখের আকৃতি বড় বড় হয়ে এলো আমার। কি মজা পান ওনি সবসময় আকস্মিক আক্রমণে!!!!

—————————–
তূর্য এখনও গেইটে অবস্থান করছেন। আয়ুশ ভাইয়া নাকি আসবে। বাহ!! দু’ মাসেই প্রিয়ুর প্রেমে মাতাল প্রেমিক হয়ে উঠেছেন তিনি। বাড়ির ভিতরে এসেছি প্রিয়ুর জন্য ঠান্ডা পানি নিতে। হঠাৎ মনে হলো আমাকে কেউ ফলো করছে। পিছন ফিরে কাউকে দেখলাম না আমি। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে উল্টো ঘুরতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ছেলেটা যে বাহিরে আমার দিকে কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। ভয়ার্ত চোখে তাকালাম আমি। ছেলেটা ক্রমশ আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। বিয়ে বাড়ি গান বাজনার আওয়াজ। কারো কানে তো আমার চিতকার ও পৌঁছাবে না।ছেলেটা আরেকটু কাছে আসতেই হাত থেকে বোতল টা পড়ে প্রচন্ড শব্দ সৃষ্টি করল।

—কে আপনি? আমার দিকে এগিয়ে আসছেন কেন?

ছেলেটা কোনো উত্তর না দিয়েই আমার দিকে হাত বাড়াতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম আমি। গাল বেয়ে অঝোর ধারায় পড়তে লাগল জল। একটা চিতকার দিতেই অনুভব করলাম আমার সম্মুখে কারো উপস্থিতি নেই। সামনে তাকাতেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। ছেলেটার গলা চেপে ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে রেখেছেন তূর্য। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ছেলেটার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।চোখগুলো ও কেমন হয়ে গেছে। হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়লাম আমি। কি বলব কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো ও ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে যেন তূর্যর দু চোখ থেকে অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে। দহন হচ্ছে চারদিকে। তীব্র রাগী স্বরে বলে উঠলেন তূর্য,,,,,,

–নিজের কলিজা দেখেছিস কখনও? দেখিস নি? তোর কলিজা বের করে তোর হাতে ধরিয়ে দিব আমার কলিজায় হাত বাড়ানোর অপরাধে। আমার শুভ্রপরী আমার কলিজা। আমার কলিজায় দাগ দেওয়ার চেষ্টা তাহলে তোকে ছাড় দেই কিভাবে বল???? বল কু****বাচ্চা!

কথাগুলো বলে ছেলেটার নাক বরাবর ঘুষি বসিয়ে দিল তূর্য। বুকের কম্পন ভয় নিয়ে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারলাম না আমি। লুটিয়ে পড়লাম মেঝেতে। তূর্যর ডাক আমার কানে এলেও চোখ খোলে রাখা সম্ভব হল না আর।

চলবে,,,,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here