প্রাণস্পন্দন পর্ব ৩২+৩৩

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

এক ঝাঁক মরা কাক দেখার মতো অভিজ্ঞতা হলো আয়েন্দ্রির। মাঠভরা ছেলেমেয়ের সামনে অভব্য ভাষায় কথা শোনাল শ্রেয়া। অমসৃন কন্ঠে শাসিয়ে তাকে মনের ক্ষোভ নিঃসৃত করল। আয়েন্দ্রির ভেজা আঁখিপল্লব নিগূঢ়ভাবে ওঠানামা করছে। তার অগোচরেই টুপটুপ করে পড়ছে শীতল জল। শ্রেয়ার বজ্র কন্ঠ—

“এতই যখন ওর গলায় ঝুলতে ইচ্ছে হলো তাহলে মাঝখানে আমাকে কেন টানলে? লজ্জা করছে না তোমার?”

আয়েন্দ্রি অশ্রুসজল চোখে চেয়ে আছে। তার কথা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে তার স্বরনালীতে। ভেজা গলায় বলল—

“আমার কথা শোনো শ্রেয়া।”

“কী শুনব? কেন শুনব? তুমি আসলেই একটা…।”

অজানা কেউ মুখ চেপে ধরে শ্রেয়ার। লাল দুই চোখে পানি জমেছে তার। ঘার ফিরিয়ে মানুষটাকে দেখে হকচকিয়ে যায় শ্রেয়া। নিষ্প্রাণ!

নিষ্প্রাণ আরেক হাত দিয়ে আয়েন্দ্রির হাত চেপে ধরে। সরল দৃষ্টিতে চেয়ে বলল—

“কান্না বন্ধ কর্।”

জোর করে কান্না বন্ধ করার দরুন স্বরনালী থেমে থেমে কম্পিত হচ্ছে আয়েন্দ্রির। শ্রেয়ার মুখ থেকে হাত সরায় নিষ্প্রাণ। দুর্বোধ্য গলায় বলল—

“তোমার আমার মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি যার জন্য ধ্রুবতারার দিকে আঙুল উঠাবে তুমি। মাইন্ড ইট।”

শ্রেয়া রাগে ফেটে পড়ে বলল—

“তাহলে কী ছিল ওইসব?”

নিষ্প্রাণ অকপট হাসল। রহস্যচ্ছলে বলল—

“ইটস আ প্র্যাঙ্ক! চল্ ধ্রুবতারা।”

রাগে গজরাতে থাকে শ্রেয়া। চোখ দিয়ে অগ্নিনালা বেরোচ্ছে। ঝনঝন করছে তার কলেবর।
,
,
,
শহিদমিনারের সিঁড়িতে বসে আছে আয়েন্দ্রি। কোনোরকম ভাবাবেগ ছাড়াই আয়েন্দ্রির দিকে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির নিটোল নেত্রযুগল দিয়ে শ্লথ ধারায় স্বচ্ছ, শীতল, নোনতা জলের নহর গড়াচ্ছে। নিষ্প্রাণ চোরা হাসল। মেয়েটা এত কাঁদে কেন? তার নয়নতারা কখনো কাঁদতো না!
নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। অপ্রত্যাশিত কাজ করল। দুই হাতে আয়েন্দ্রির চোখের জল মুছে দিলো। আঁজলাতে মুখ টা নিয়ে ঘুরিয়ে তার দিকে ফেরালো। ডাসা ডাসা, চঞ্চল দুই চোখে নিষ্প্রভ। নিষ্প্রাণ মোলায়েম গলায় বলল—

“কাঁদিস না। ভালো লাগছে না আমার।”

আয়েন্দ্রি আলগোছে নিষ্প্রাণের হাত সরায়। চিন্তিত মুখটা নিচু করে। অপরাধবোধ ঘিরে ধরে তাকে। নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকে। ওড়নার কোণা নিয়ে আঙুলে পেচাতে থাকে। নিষ্প্রাণের অনাড়ম্বর দৃষ্টি। আয়েন্দ্রি অনুতপ্ত গলায় বলল—

“সরি।”

নিষ্প্রাণ টিমটিমে গলায় বলল—

“এখন সরি বলছিস কেন? কে বলেছিল তোকে পাকনামি করতে?”

আয়েন্দ্রি ঠোঁট ফুলিয়ে নিষ্প্রাণের দিকে তাকায়। গাঢ় দৃষ্টি। অপ্রকট অনুভূতি। সপ্রতিভ বাসনা। নিষ্প্রাণ আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসে আয়েন্দ্রির। আয়েন্দ্রির লজ্জা হয় না। ভালো লাগে তার। নিষ্প্রান তার হালকা ভর আয়েন্দ্রির কাঁদের দিকে হেলিয়ে দেয়। রহস্য হাসে!

চিত্রভানু আজ লজ্জিত। লুকোতে চায় নীলাভ কাদম্বিনীর আড়ালে। লুকোচুরি হাসি তার। আচমকা দাপিয়ে উঠে, পূনরায় নুইয়ে যায়। প্রভঞ্জনে নেই তপ্ততা। মৃদু শীতলতায় কাতর সে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে সে সর্বাঙ্গের রোম!

নিষ্প্রাণ চাপা সুরে কানের কাছে বলল—

“বিয়ের পর এসব কান্না টান্না চলবে না। যা কান্নাকাটি করার বিয়ের আগেই করে নে।”

আয়েন্দ্রি চোখের পাতা সংকোচন করে। ব্যস্ত হয়ে বলল—

“কেন?”

“কান্নাকাটি ভালো লাগে না আমার। তাই।”

বিগলিত হাসে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের চশমার গ্লাসে নিজের মুখটা দেখতে পায়। কাঁচ ভেদ করে ওই দুই ভরাট চোখে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রি। গভীর, শান্ত দুই চোখ। এক নিমিষেই কুহেলিকায় আচ্ছন্ন করে আয়েন্দ্রিকে! আয়েন্দ্রির ধ্যাণ ভাঙে কুসুমের সরস গলায়—

“কীরে কবুতরের জোড়া! জায়গা তো আরো আছে। এমন সেঁটে বসে আছিস কেন?”

আয়েন্দ্রি লজ্জামিশ্রিত হাসে। সীমান্তের কার্বন কপি এসেছে। যেন সীমান্তের অপূর্ণতা পূরণ করতে কুসুমের এই নতুন রূপ!

জবাব দিলো নিষ্প্রাণ।

“কেন? হিংসে হয় তোর?”

কুসুম তরল মেজাজ দেখিয়ে বলল—

“হিংসে হবে কেন? বিয়ের আগেই লটর-পটর করা এই তোগো প্রেমিক যুগলের কাম!”

“লটর-পটর আবার কী?”

কুসুম হার মেনে বলল—

“জানি নাতো। কাল যখন সীমান্তের সাথে কথা বললাম, ও বলল তোদের দুই জনের মধ্যে না-কি লটর-পটর চলে! তাই বললাম।”

ছোট্ট করে হাসে নিষ্প্রাণ। উঠে দাঁড়ায় সে। স্বাভাবিক গলায় বলল—

“আমি গেলাম। যাবি না কোথাও।”

নিষ্প্রাণ যেতেই ঝুপ করে আয়েন্দ্রির পাশে বসে কুসুম। চাপা উত্তেজনা নিয়ে বলল—

“এই ফেসে গেছে নিষ্প্রাণ তাহলে?”

আয়েন্দ্রি ব্রীড়িত! অবনত শিয়রে অস্পষ্ট সুরে বলল—

“হুম।”

কুসুম এক আকাশ উচ্ছলতা নিয়ে তীরের বেগে প্রশ্ন ছুড়ে—

“আঙ্কল মেনে নিয়েছে সব?”

“প্রাণ কথা বলেছে বাবার সাথে। তেমন কিছু বলেনি। তবে মেনে নেবে মনে হচ্ছে।”

উল্লাসিত গলায় হৈ হৈ করে ওঠে কুসুম।

“ইশ! কবে হবে তোদের বিয়ে? নিষ্প্রাণ হাঁদারামটাকে বরবেশে দেখার অনেক শখ আমার!
এই, আগে বলতো ওই গুঁমড়ো মুখো চিতল মাছটাকে তুই পটালি কী করে?
আরে চশমা পড়তো মনে হয় যেন মানুষ না চোখে পড়ে ওর! তুই ভেবে দেখেছিস! দেড় বছর একই ডিপার্টমেন্টে থেকেও ও তোকে কখনো দেখেইনি। ভাবা যায়!”

কুসুমের কথায় অলক্ষিত হাসে আয়েন্দ্রি।
,
,
,
আয়েন্দ্রির মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিপাত নিষ্প্রাণের। উঁহু! মুখ নয়। আয়েন্দ্রির ঠোঁট। তার ওই গোলাপের পাঁপড়ির মতো নরম ওষ্ঠাধর প্রতিক্ষণে ঘায়েল করে নিষ্প্রাণকে! আর ওই লাল তিল!
উফ! যেন এখনই নিষ্প্রাণের সর্বস্ব গ্রাস করে নেবে!

সুপের কিছু অংশ লেগে আছে আয়েন্দ্রির ঠোঁটে। টিশু দিয়ে তা মুছে নেয় আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের সুক্ষ্ম দৃষ্টির কারণ জানার জন্য প্রশ্ন করে—

“কী দেখছিস এভাবে?”

নিষ্প্রাণ শীতল গলায় বলল—

“তোর ঠোঁট।”

বৃহৎ ঢোক গিলে আয়েন্দ্রি। আশেপাশে সন্ধিৎসু চোখে তাকায়। বড় নিঃশ্বাস ফেলে অপ্রতিভ গলায় বলল—

“বাজে কথা বলিস কেন তুই?”

“সত্য বলেছি। তোর ঠোঁট যে আমাকে পিপাসার্ত করে। এই তৃষ্ণা আমি কী করে মিটাই?”

আয়েন্দ্রি ব্যস্তসমস্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে। নিষ্প্রাণের হাত ধরে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসে। পিচডালা সড়ক পথের ফুটপাত দিয়ে নির্বিঘ্নে হাঁটছে দুজন। দৈবাৎ বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“রিকশা নে।”

“কেন?”

“আমি বলেছি তাই।”

দ্বিরূক্তি করল না নিষ্প্রাণ। রিকশায় পাশাপাশি বসতেই নিষ্প্রাণের এক হাত জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় আয়েন্দ্রি। উত্তরোত্তর তার হৃদপ্রকোষ্টে উত্তাল, অসহ, দুর্বার ঢেউ খেলে যাচ্ছে। নিষ্প্রাণের হৃদস্পন্দন অনুরণিত করছে আয়েন্দ্রির দেহযষ্টি। তিরতির করে কাঁপছে তার ঠোঁট। আয়েন্দ্রি ভীত হয়! শঙ্কিত হয়!
এমনতো আগে কখনো হয়নি। নিষ্প্রাণ অতি মাত্রায় স্বাভাবিক। চলন্ত রিকশার সাথে মৃদু প্রভঞ্জন যেন তার উদ্দাম ফিরে পেয়েছে। নিষ্প্রাণের ঘন চুল উলুথুলু। হাতে চাপ লাগতেই আয়েন্দ্রির দিকে তাকায়। পেলব গলায় বলল—

“কী হয়েছে?”

আয়েন্দ্রি আড়চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো। কিছু হয়নি বুঝিয়েছে সে। গূঢ় হাসে নিষ্প্রাণ। মাথাটা হেলিয়ে আয়েন্দ্রির মাথার সাথে ঠেস দেয়। আদুরে গলায় বলল—

“বিয়েটা হতে দে। তার আগে আমায় কলঙ্কিত করিস না!”

আয়েন্দ্রি লজ্জায় সিদিয়ে যায়। বদ্ধ অনুভূতিতে তার মরমর প্রাণ। যার স্পন্দন বয়ে বেড়াচ্ছে এই প্রাণহীন মানুষটা।
#প্রাণস্পন্দন
#বোনাস_পর্ব
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সারাদিনের ক্লান্ত,শ্রান্ত কিন্তু প্রফুল্ল মন নিয়ে বাসায় ফেরে আয়েন্দ্রি। অবসাদগ্রস্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতে পারলেই যেন সর্বসুখ প্রাপ্তি হবে।

সিঁদর মেঘে আচ্ছন্ন আকাশ। শীতল বহ্নিসখ। একটু পরেই মসজিদ হতে ভেসে আসবে মধুর গুঞ্জনে মাগরিবের আযান!

আয়েন্দ্রি ঘরে ঢুকেই চকিত হয়! একজন ভদ্রলোক বসে আছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। দীর্ঘ কাঁধ। গাম্ভীর্যপূর্ণ আনন। আয়েন্দ্রি পূর্ণ নজর দিয়েও চিনতে পারল না ভদ্রলোককে। আলফাজ সাহেব দৃঢ় চোখে তাকালেন আয়েন্দ্রির দিকে। আয়েন্দ্রি তার দৃষ্টি অবনত করে নিজের কক্ষের দিকে গেল।

ঘামতে শুরু করে আয়েন্দ্রি। ঢিবঢিব করছে তার বুক। বিচলিত মস্তিষ্ক। উচাটন চিন্ত ভাবনা। দরজার আড়ালে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি। ভদ্রলোকের নম্র গলার স্বর শুনতে পায় সে।

“আমি তাহলে আজ উঠি জনাব। ছেলেপক্ষকে বিয়ের তারিখ ঠিক করার কথা বলব।”

আলফাজ সাহেব দ্বিরূক্তি করলেন। বললেন—

“তারা তো আমার মেয়েকে দেখেনি?”

ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন—

“ছেলে আপনার মেয়েকে দেখেছে। আর ছবি তো আমি তার মামা-মামিকে দেখিয়েছি। তাদের কোনো আপত্তি নেই।”

আলফাজ সাহেব স্বগৌরবে বললেন—

“তা হয় না। আমি তো আর ছেলেকে দেখিনি। তাকে আমি সরাসরি দেখতে চাই। আপনি তাদের শুক্রবার আসতে বলুন। আয়েন্দ্রিকেও না হয় আরেকবার পরখ করে নিল!”

ভদ্রলোক অমায়িক হেসে বললেন—

“জি জনাব, উত্তম প্রস্তাব। আমি তাদেরকে আপনার প্রস্তাব জানাব। আজ তাহলে আসি। আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। সাবধানে যাবেন।”

“জি, শুকরিয়া।”

ভদ্রলোক যেতেই আয়েন্দ্রি নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। সজলনেত্রে চেয়ে বিদুর গলায় বলল—

“এসব কী বলছো বাবা? প্রাণতো তোমাকে কথা দিয়েছে।”

আলফাজ সাহেব কঠিন গলায় বললেন—

“আমি কথা দেইনি। ওই ছেলের ওপর আমার ভরসা নেই। ছবিটা টেবিলে রাখা আছে। দেখে নিয়ো। ভালো ছেলে। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। তোমাকে পছন্দ করে নিজ থেকে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বাবা-মা নেই এইজন্য নিজে আসেনি।সবকিছুরই একটা নিয়ম আছে। লোক মারফত খবর পাঠিয়েছে। বিয়ের পরও তোমাকে পড়াবে। তা নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। নিজেকে প্রস্তুত করো।”

আয়েন্দ্রি ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল—

“বাবা, তুমি প্রাণকে ধোঁকা দিতে পারো না। তুমি ওকে কথা দিয়েছ।”

“এমন কোনো কথা আমি ওকে দেইনি আয়ু। ছেলেপক্ষ দুদিন পর তোমাকে দেখতে আসবে। তৈরি থেকো।”

“বাবা! বাবা!”

আলফাজ সাহেব দৃঢ়চিত্তে হেঁটে গেলেন। একরাশ ক্ষোভ নিয়ে নিজের কক্ষে গিয়ে বিছানায় বসল আয়েন্দ্রি। ঝমঝমিয়ে কাঁদছে সে। ঝুমা নরম পায়ে এসে আয়েন্দ্রির পাশে বসলেন। আয়েন্দ্রি খপ করে মায়ের হাত ধরে বলল—

“মা, তুমি বাবাকে বুঝাও না। বাবা কেন এমন করছে? প্রাণ বলেছে ও সব সামলে নেবে। ওকে একটু সময় দাও তোমরা।”

ঝুমা ভারাক্রান্ত গলায় বললেন—

“ছেলেটাকে আমারও পছন্দ। কিন্তু তোর বাবাতো কারো কথা শুনছে না। আর দেখতেই তো আসবে। দেখলে তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না।”

“যদি বিয়ে হয়ে যায়?”

ঝুমা চুপ রইলেন। এই প্রশ্নের জবাব তিনি দিতে পারলেন না। আয়েন্দ্রি কম্পিত গলায় বলল—

“বলো না মা, যদি বিয়ে হয়ে যায়?

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ঝুমা। চাপা কষ্ট নিয়ে বললেন—

“তাহলে ভাগ্যকে মেনে নিতে হবে।”

আয়েন্দ্রি থম মেরে রইল। যদি এই কথা নিষ্প্রাণ জানে, তাহলে কী করবে সে? প্রাণ কী তার স্পন্দনকে তার থেকে আলাদা হতে দেবে?
,
,
,
“ধ্রুবতারাকে মারলেই কী সব সমাধান হয়ে যাবে?”

নিষ্প্রাণের করা প্রশ্নে ভাবান্তরহীন নয়নতারা। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে একটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে সে পায়চারি করছে। নিষ্প্রাণ ভাবিত নয়নে চেয়ে আছে তার করা প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায়।
নয়নতারা কোমল গলায় বলল—

“যদি মেরে ফেলিস তাহলে ও তোর আকাশেই থাকবে। অন্যের আকাশে যাবে না।”

“কিন্তু আমি যে ওকে ভালোবাসি!”

“ভালো তো আমিও সবাইকে বেসেছি। কই তুই ছাড়া তো কেউ আমার ভালোবাসার মূল্য দিলো না।”

নিষ্প্রাণ নিস্পৃহ গলায় বলল—

“ওকে আমি মারতে পারব না।”

নয়নতারা সেই মোমবাতি হাতে একদম নিষ্প্রাণের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিশোরী নয়নতারা থেকে যুবা নিষ্প্রাণ বেশ লম্বা। মৃত্যুর পরে তো মানুষের বয়স বাড়ে না!
নয়নতারা আবেশিত গলায় বলল—

“যদি সত্যিই ওর বিয়ে হয়ে যায়! কী করবি তুই?”

নিষ্প্রাণ সাবলীল গলায় প্রত্যুত্তর করে।

“যা করে এসেছি। মৃত্যু !”

অট্টহাসিতে অন্ধকার ঘরে আলোড়ন তুলে নয়নতারা। চোখের সামনে নিজের খুনিকে দেখে পৃথিবীর কেউ এত পুলকিত হয় না যতটা নয়নতারা হয়! মৃত্যু তার শরীরের মুক্তি দিলেও আত্মার মুক্তি দেয়নি।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

দুই পাশের হাই বেঞ্চের মাঝে লো বেঞ্চ। তার উপরেই হাত, পা মুড়িয়ে রোদনে আচ্ছন্ন আয়েন্দ্রি। ঘণ্টা ধরে চলা নিরবধি ক্রন্দনে গলা জমে এসেছে তার। পাতলা ঠোঁট দুটো ফুলে উঠেছে। কালো মনির সফেদে ভাসমান চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কুসুম চিন্তিতচিত্তে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রির রোদনভরা আননে।
অনায়তন গলায় বলল—

“কেঁদে কী হবে বল্?”

ভ্যা ভ্যা করে চোখের শ্লথ ধারা স্ফীত ধারায় রূপ নেয়। ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায় কুসুম। কান্নার তোড়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আয়েন্দ্রির। হেঁচকি তুলে বলল—

“বাবা এমন কেন করছে?”

কুসুম স্বভাবসুলভ আচরণ করে বলল—

“তা আমি কী করে বলব বল্! আঙ্কলের মাথায় কোন ভূত চেপেছে কে জানে!”

শূন্য ক্লাস রুমে আয়েন্দ্রি আর কুসুম ছাড়া কেউ নেই। ক্লাসের দরজায় আচমকা করাঘাত পড়ে। চকিতে ফিরে তাকায় দুজন। নিষ্প্রাণকে দেখেই ঝমঝমিয়ে ফের বর্ষণ শুরু হয় আয়েন্দ্রির নেত্রযুগলে। কুসুম ওঠে আসে বেঞ্চ থেকে। নিষ্প্রাণের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ গলায় বলল—

“তোরা কথা বল্। আমি বাইরে যাচ্ছি।”

নিষ্প্রাণ ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকায়। আয়েন্দ্রির মাথায় যেন বাজ পড়ল! হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে ঝপাৎ করে জড়িয়ে ধরল নিষ্প্রাণকে। চমকিত হয় নিষ্প্রাণ। কাঁপা কাঁপা হাতটা আয়েন্দ্রির পিঠে উপর রাখতেও সংকোচ হচ্ছে তার। সে সোজা দাঁড়িয়ে রইল। মখমলে গলায় বলল—

“কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?”

আয়েন্দ্রি হালকা করে মাথাটা আলগা করে নিষ্প্রাণের বুক থেকে। ঠোঁট ভেঙে বাচ্চা বাচ্চা কন্ঠে বলল—

“বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে প্রাণ।”

এক শীতল ধারা বয়ে গেল নিষ্প্রাণের শিড়দাঁড়া বেয়ে। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল—

“তো?”

আয়েন্দ্রি চমকে গিয়ে কান্না থামায়। নিষ্প্রাণ থেকে সরে এসে অনুরক্তির গলায় বলল—

“তো! বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দেবে প্রাণ!”

নিষ্প্রাণ বিগলিত হাসে। আয়েন্দ্রিকে বেঞ্চের উপর বসায়। হাঁটু ভাঁজ করে তার সামনে বসে। কৌতূকমাখা গলায় বলল—

“বিয়ে দেবে তার জন্য কাঁদছিস না- কি অন্য কারো সাথে বিয়ে দেবে তাই কাঁদছিস?”

নিষ্প্রাণের বুকে চট করে এক ঘুষি বসায় আয়েন্দ্রি। গা দুলিয়ে হেসে ওঠে নিষ্প্রাণ। নৈঃশব্দে নির্নিমিখ চেয়ে থাকে আয়েন্দ্রির ভেজা মুখটার দিকে। দুই হাত দিয়ে প্রখাঢ় মায়ায় মুখটা মুছে দেয়। আয়েন্দ্রি শান্ত হয়। ধাতস্থ হয় সে। মনে আশ্বাস জাগে। সাহস সঞ্চারিত হয়। আয়েন্দ্রির দুই হাত নিজের প্রশস্ত পাঞ্জায় লুফে নেয় নিষ্প্রাণ। আলতো করে চুমু খায় তাতে। মিষ্টি করে হেসে বলল—

“চিন্তা করিস না। আমি স্যারের সাথে কথা বলব।”

“যদি বাবা না মানে?”

“মানতে হবে।”

“যদি সত্যিই বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়?”

ফিক করে হেসে ফেলে নিষ্প্রাণ। ফিচেল গলায় বলল—

“তাহলে বিয়ে হবে। কিন্তু বাসর আমার সাথেই হবে।”

নাক- মুখ কুঁচকে নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের ঝাঁকড়া চুল থেকে এক দলা খাঁমচে ধরে টান মারে। হেসে ওঠে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির হাতের কবজিতে কাটা দাগ। সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে নিষ্প্রাণ—

“হাত কাটল কী করে?”

“গ্লাস ভেঙে গেছে।”

সেই কাটা দাগে আলগোছে অধর ছোঁয়ায় নিষ্প্রাণ। অতলান্ত মায়ায় চেয়ে নরম গলায় বলল—

“ক্লাস করিসনি কেন?”

আয়েন্দ্রি সোজাসাপ্টা উত্তর দেয়।

“ইচ্ছে করছিল না।”

“লাভ কী বল্? শুধু শুধু ক্লাস মিস দিলে পড়ার ক্ষতি হবে। তোকে আর চিন্তা করতে হবে না। আমি কথা বলব স্যারের সাথে।”

“তুই বাবাকে রাজি করাতে পারবি তো?”

নিষ্প্রাণ সাবলীল গলায় বলল—

“চেষ্টা করব।
আজ প্রাবিশের বার্থ ডে মনে আছে তোর?”

আয়েন্দ্রি মিনমিনে গলায় বলল—

“হুম।”

নিষ্প্রাণ উৎসুক গলায় বলল—

“স্যার তোকে আসতে দেবে? এতগুলো ছেলের মধ্যে? সীমান্তও আসবে। আর আমিও থাকব।”

আয়েন্দ্রি ভারাক্রান্ত চোখে চাইলো। নিষ্প্রাণ সরস গলায় বলল—

” আরাজকে নিয়ে আসিস সাথে। তাহলে নিশ্চয়ই স্যার মানা করবে না?”

আয়েন্দ্রির চিত্ত দুলে ওঠে। এই একটা মানুষ যার কাছে তার সমস্ত সমস্যার সমাধান আছে।

“চল্। ক্লাস শেষ। তোকে বাসায় পৌঁছে দেই।”

আয়েন্দ্রি ওঠে দাঁড়ায়। নির্মল হাসে। হট করেই নিষ্প্রাণের ব্যাগ টেনে ধরে বলল—

“তোর এই ব্যাগের মধ্যে কী আছে রে? সারাক্ষণ কাঁধে নিয়ে ঘুরিস!”

নিষ্প্রাণ স্নেহার্দ্র গলায় বলল—

“এখন না। বিয়ের পর দেখাব। এখন চল।”

মুখ বিকৃত করে আয়েন্দ্রি। এই ব্যাগটা এক মিনিটের জন্যও কাছ ছাড়া করে না নিষ্প্রাণ!

ক্লাসরুম থেকে বের হতেই নিষ্প্রাণের ধারালো চোখ জোড়া বদ্ধ হয় সারকের দিকে। নিজের ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছিল সে। নিষ্প্রাণের শ্বাস ভারী হয়। আয়েন্দ্রি চেয়ে আছে মাঠের দিকে। নিষ্প্রাণের পাশ ঘেঁষে চলে যায় সারক। সারক খানিকটা পেছনে যেতেই নিজের মাত্রাতিরিক্ত রাগের বহিঃপ্রকাশ করে নিষ্প্রাণ। অতি সন্তর্পনে বাম হাত উঠিয়ে পেছন থেকে আয়েন্দ্রির কোমর আঁকড়ে ধরে। হতভম্ব হয়ে যায় আয়েন্দ্রি। চকিতে নিষ্প্রাণের মুখের দিকে তাকায়। নিষ্প্রাণ অরব, নিশ্চল, শান্ত। সারকের পূর্ণ নজর পড়ল সেই অপ্রিয় দৃশ্যে। ভার্সিটি ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ। তাই শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ নিচে নেমেছে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরাও ব্যস্ত বাড়ি ফেরাতে। করিডোর ফাঁকা। পুরো ভবনে দুটো সিঁড়ি একটা উত্তরে অন্যটা দক্ষিণে। সময় ও সুবিধা অনুযায়ী যার যেইটা পছন্দ সে সেইটা ব্যবহার করে। সারক দক্ষিণ দিকের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। নিষ্প্রাণ তার হাত সরিয়ে আনে। ছেলেটার অদ্ভুত কান্ডে আয়েন্দ্রি যারপরনাই বিস্মিত হয়!

চলবে,,,
চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here