“তুমি কেন আগে আসোনি?”
৫.
অফিসে এক মনে কাজ করছিলো সায়ান। এমন সময় দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো জেনি। সায়ান জেনির দিকে তাকালো। তারপরই হেসে দিলো। জেনি এসেই ধপ করে সায়ানের সামনের চেয়ারে বসে পরেছে। এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
— “শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করেছো? জানালে না পর্যন্ত!”
— “হ্যাঁ করেছি। এক দেখাতেই হুশ উড়ে গেছিলো তাই তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিয়েছি।”
— “কোনো মেয়েকে দেখে তোমার হুশ উড়ে গেছে তারমানে she is very hot. Right?”
— “Too much hot!”
সায়ান শেষের কথাটা অন্যরকম করে বললো। জেনি চেয়ার থেকে উঠে এসে সায়ানের সামনে দাড়ালো। সায়ানকে ধাক্কা দিতেই চেয়ারসহ কিছুটা পিছিয়ে গেলো। জেনি সায়ানের কোলে বসে পরে। গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
— “আমার থেকেও বেশি হট তোমার স্ত্রী?”
— “Yeap!”
— “Liar. I know you are lying.”
— “Shut your mouth. কতদিন পর কাছে এসেছো বলো তো?”
জেনি হেসে উঠে। সেই মুহুর্তেই সায়ান জেনির হাসি বন্ধ করে দিলো নিজের পুরুষালি আক্রমণ দ্বারা। বেশ অনেকটা সময় পর দুজন আলাদা হয়। সায়ান টাই ঢিলে করে বললো,
— “Its work time. তাই এখন কাজ করা যাক।”
— “তারপর?”
— “তারপর! হাম তুম এক কামরেমে বানদ হে।”
সায়ান চোখ মারলো। জেনি হেসে উঠে। বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে। সায়ান আবার কাজে মন দিয়েছে। জেনি হলো সায়ানের বিজনেস পার্টনার। অনেক আগে থেকেই একসাথে কাজ করতো দুজন। সেখান থেকেই ওদের অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।
.
অফিস টাইম শেষে জেনি অফিসের নিচে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির জন্য। সায়ান গাড়ি নিয়ে এসে ওর সামনে থামালো। জানালার কাচ নামিয়ে বললো,
— “Hey Jenny, Can we enjoy a special evening?”
— “তোমার বউ শুনলে মাইন্ড করবো।”
— “Oh! Come on.”
জেনি হাসতে হাসতে উঠে পরলো সায়ানের গাড়িতে। জেনি বসতেই সায়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো। সাই সাই করে পেরিয়ে গেলো অনেক দূর।
_________________________
কাজ শেষ করে রুমে আসলো সিনথিয়া। ফ্যানের গতিটা বাড়িয়ে দিয়ে ফ্যানের নিচে বসলো। গরমে একেবারে ঘেমে গেছে। ঘামে চটচটে হয়ে আছে ওর শরীর। ক্লান্ত হাতে এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে খোপা করে নিলো। এতোক্ষণ সন্ধ্যার জন্য নাস্তা বানাচ্ছিলো। আগুনের আঁচে গাল দুটো একদম লাল হয়ে গেছে।
সিনথিয়ার ইচ্ছে করছে এসিটা একটু ছাড়তে। এসির রিমোট হাত নিয়ে আবার থেমে গেলো। মনে পরে গেলো কিছু তিক্ত মুহুর্ত। কিছুদিন আগের ঘটনা। রান্নাঘরের কাজ শেষ করে সিনথিয়া ড্রয়িংরুমে বসেছিলো। ঘামে ভিজে যাওয়ায় এসিটা ছেড়ে দিলো। তখনই আরশি এসে খপ করে এসির রিমোট নিয়ে নিলো সিনথিয়া থেকে। এসি বন্ধ করে দিয়ে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
— “এসি যে ছাড়লে বিল কি তোমার বাপে এসে দিবে? নাকি নিজেরে বেঁচে বিল দিবা? বিল কত আসবে কোনো ধারণা আছে? সারাদিন তো ঘাড়ের উপর বসে বসেই খাও।”
আকষ্মিক ঘটনায় সিনথিয়া একেবারেই হতভম্ব হয়ে গেলো। আরশির এমন বাজে কথা শুনে সিনথিয়ার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। সামান্য এসি ছাড়ার কারণে এরকম একটা ওয়ার্ড ইউজ করলো? সুন্দর করে বললেই পারতো। অথবা বলতো সিনথিয়ার জন্য এসি ছাড়া নিষেধ। সিনথিয়া মিনমিনে স্বরে বললো,
— “রান্নাঘরে কাজ করার কারণে খুব গরম লাগছিলো তাই…।”
— “কি এমন ছাতার কাম করলে যে এসি ছাড়তে হবে?”
পাশ থেকে সালেহা বানু কটাক্ষ করে বললো,
— “হুনো ছেমরি এমুন একটু আধটু কাম করলে কিছু হয়না। হারাদিন তো বইয়া বইয়া-ই খাও। গর্তের ভেতরে ঢুকলে আর বাইর হইবার মন চায়না তুমার। সামান্য এতটুক কাম কইরা কিয়ের এমুন কেলান্ত হইলা তুমি? আমাগো সময় আমরা রোইদে পুইড়া কাম করছি। কই তহন তো আমাগো এসি লাগে নাই। এহন তোমাগো এসি লাগে ক্যারে?”
সিনথিয়া পুরোই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। ও সারাদিন বসে বসে খায়? কখন? কাজ করতে করতেই তো দিন-রাত পার হয়ে যায়। সামান্য একটু বিশ্রাম নিতে চাইলেও পারে না। সালাতের জন্য রুমে আসলেও পাঁচ মিনিট পরেই ডাকাডাকি শুরু করে। গোসলের জন্যেও এতোটা সময় দেয়া হয়না। তাহলে বসে বসে খায় কখন? সিনথিয়াকে চুপ দেখে সালেহা বানু মাথা নেড়ে নেড়ে বললো,
— “তোমার বাপের তো কম নাই মাইয়ার লাইগা কিছু কি দিতে পারে না নাকি? বিয়ার সুমুই তো খালি হাতেই মাইয়া পার করলো। খচর হইবো কইরা ঘরোয়া ভাবে বিয়া দিসে তোমারে। তোমার ভাইগোও তো কম নাই। বিয়ার দিন তো দেখলাম ওগো বউয়ের হাতে, গলায়, কানে সব স্বর্ণের জিনিস। তোমারে এমন ফক্কিনির লাহান পার করলো কেন? আরে একটা মাত্র জামাই তাগো একটু আধটু দিলে এমন কি হইয়া যাইবো? বিয়ার পরেও তো কিছু দিলো না। আর এহন তুমি এই বাড়িত আইয়া সব নষ্ট করতাছো।”
সিনথিয়ার মুখটা আপনা-আপনি হা হয়ে গেলো। ও এবাড়ির কোন জিনিসটা নষ্ট করেছে ওর মনে পরছে না। আর এদের এতো চাওয়া পাওয়া সেটা তো আগে কখনো বলেনি। সিনথিয়া নিচু স্বরে বললো,
— “দাদি ইসলামে যৌতুক নেয়া হারাম।”
কথাটা শেষ হতেই আরশি এবং সালেহা বানু খুব ক্ষেপে উঠলো। এমন একটা অবস্থা যেনো এখনি সিনথিয়াকে মারবে। সালেহা বানু মুখ ঝামটা মেরে বললো,
— “যৌতুক নিবো ক্যান আরশি? ওর কি কম আছে নি? মাইয়ার বাড়ির থেইক্কা খুশি হইয়া কিচু দিলে এসব যৌতুক হয়না। তোমার বাপে কিছুই তো দিলো না। খাইল্লা হাতে পার করছে তুমারে। এহন তুমি লেকচার শুনাও আমাগোরে? কয় টেকা দিছে তোমার বাপে যার কারণে দেমাগ দেখাইতাছো? হুনো আরশি যদি এহনই সায়ানের বিয়া দিবার চায় তো দেখবা মাইয়াগো লাইন পরবো। মাইয়ার বাপে সাইধা আইসা দিয়া যাইবো মাইয়া। আর বকশিস হিসাবে তো তিরিশ চল্লিশ লাখ টাকার ফার্নিচার দিবোই। তোমার বাপের লাহান তলা ছাড়া পাডাইবো না।”
সিনথিয়া বরাবরের মতোই নিরব রইলো। ও কি বলবে ভেবে পেলো না। সামান্য একটা এসি ছাড়ার কারণে এতো কথা শুনাবে জানলে কখনোই এসি ছাড়তো না। সালেহা বানু এবার বললেন,
— “হুনলাম তোমার নামে নাকি মেলা সম্পত্তি আছে? তুমি তো মাইয়া মানুষ এতো সম্পত্তি দিয়া কি করবা? তারচেয়ে ভালা হয় তোমার নামেরডি সায়ানের নামে কইরা দিলে। তইলে তোমার পুলাপানেরও হইবো। আর এমনিও সায়ানের মানেই তো তোমার সব।”
— “আমিতো জানিনা দাদি আমার নামে সম্পত্তি আছে নাকি। বাবা, ভাইরা এসব নিয়ে কখনো কথা বলেনি আমার সাথে।”
— “কয় নাই তো কি হইছে? তুমি জিগাইবা। তারপর কইবা এডি সায়ানের নামে কইরা দিতে। কইবা এডি বকশিস পাইবো সায়ান। নাইলে তুমি এই বাড়ির বান্দী হইয়াই থাকবা।”
সিনথিয়া এবার বুঝলো ব্যাপারটা। সম্পত্তির কথা তুলতেই সামান্য এসি ছাড়ার ব্যাপার নিয়ে এতো কথা শুনিয়েছে। ওদের এতোকিছুর দরকার হলে বিয়ের সময় বললো না কেন? তখন তো বলেছিলো আমরা কিছুই নিবো না। তাছাড়া ওকে বলেই বা কি লাভ? ওর হাতে তো কিছু নেই। বললে ওর বাবাকে বলুক। সিনথিয়া সিদ্ধান্ত নিলো এই ব্যাপারে ও-বাড়িতে কিছু বলবে না।
পুরোনো ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো আযানের শব্দ শুনে। বারান্দায় এগিয়ে গেলো। আযানের জবাব দেয়ার পর অনেক দুয়া করলো। রুমে এসে তাড়াতাড়ি ওযু করে সালাতে দাঁড়িয়ে গেলো। কেননা নাস্তা দিতে এক মিনিট দেরি হলে আরশি বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে।
_________________________
সায়ান খুব ফুরফুরে মেজাজে বাসায় এলো। রুমে এসে দেখলো সিনথিয়া ওর কাপড় ভাজ করে আলমারিতে রাখছে। কাজের ফাকেই সিনথিয়া চোখ তুলে তাকালো সায়ানের দিকে। সায়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলছে। সিনথিয়া একটু অবাক হলো। কারণ সায়ানকে একটু এলোমেলো লাগছে। সবসময় যেভাবে পরিপাটি হয়ে বাড়ি থেকে বের হয় ফিরে আসে ঠিক সেভাবেই। কিন্তু আজ কেমন যেনো অগোছালো লাগছে। টাই টাও গলায় নেই। শার্টের জায়গায় জায়গায় কেমন কুচকে আছে। সিনথিয়াকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সায়ান ভ্রু নাচিয়ে বললো,
— “কি দেখছো এভাবে? প্রেমে পরে গেলে নাকি আমার?”
— “আপনার কি কিছু হয়েছে? শরীর খারাপ করেছিলো বা অন্যকিছু?”
সিনথিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে সায়ান কাবার্ডে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাড়ালো। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বললো,
— “আজ হঠাৎ আমার এতো খবর নিচ্ছো কি ব্যাপার বলো তো? খুব মিস করেছো নাকি আমাকে?”
— “না মানে..আপনাকে কেমন যেনো অগোছালো লাগছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
সায়ান একটু চমকে গেলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো,
— “মাথা ব্যাথা ছিলো তাই আমার কেবিনের বেডরুমে ঘুমিয়ে পরেছিলাম।”
— “ওহ! এখন ঠিক আছেন?”
— “ইয়াহ! আম ফাইন।”
গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলে গটগট করে হেটে ওয়াশরুমে চলে গেলো। সিনথিয়া বোকার মতো চেয়ে রইলো সায়ানের যাওয়ার দিকে। সিনথিয়া বুঝলো না সায়ান হঠাৎ করেই এতো গম্ভীর হয়ে গেলো কেনো। একটু আগেও দুষ্টুমি করছিলো মুহুর্তেই কেমন বদলে গেলো। সিনথিয়া সেসব উড়িয়ে দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো।
সায়ান ওয়াশরুমের আয়নার সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন সায়ানের দুষ্টুমি আচরণের কারণে সিনথিয়ার নজর পরেনি সায়ানের বুকের দিকে। তাহলে স্পষ্ট দেখতে পেতো পরপর চারটে লাভ বাইট। সায়ান একটা বড় নিঃশ্বাস ফেললো। আরেকটুর জন্য হলে সিনথিয়া বুঝে যেতো। এমনিতেও সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে বেশ সন্দেহ করে এখন সিনথিয়া।
চলবে,,,
® ‘নুরুন নাহার’