“তুমি কেন আগে আসোনি?”
১৭.
উত্তপ্ত দুপুর। চারিদিকে হিমেল বাতাস বইছে। কিন্তু সেই বাতাস গায়ে লাগলে আরো গরম লাগছে। গরমে ঘেমেনেয়ে একেবারে গোসল করে ফেলার মতো অবস্থা হয়ে উঠছে। একটু স্বস্তি পেতে ছাদের দরজার সামনে এসে দাড়ালো মিম। সায়ানকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েও তার আতাপাতা মিলছে না।
কিছুটা ফিসফিসানি শব্দ কানে এসে বারি খেলো মিমের। কান খাড়া করে শুনার বুঝার চেষ্টা করলো কোথা হতে শব্দ আসছে। ছাদের চিলেকোঠা হতে এরকম শব্দ আসছে। একটু এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলো একজোড়া নর-নারীর ফিসফিসানির আওয়াজ। মিম চিলেকোঠার দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললো। সামনে তাকিয়ে সম্পূর্ণ স্থির হয়ে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কোনোভাবেই পারছে না সামনের দৃশ্য মানতে। মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছে।
‘যে অন্যের সংসার ভাঙে, তার সংসার আল্লাহ ভাঙে’। প্রবাদটা একেবারে বাস্তব হয়ে উঠলো মিমের চোখের সামনে। নিজের স্বামী এবং ছোট জা রিহা দুজনকে একে অপরের সাথে এতোটা ঘনিষ্ঠ দেখে এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো সে পৃথিবীতে নেই। পুরো সত্ত্বাটা বিলীন হয়ে গেছে যেনো।
ঘোর কাটতেই ছলছল চোখে তাকালো দুজনের দিকে। মিমের উপস্থিতিতেও যেনো দুজনের কিছু যায় আসেনা। এখনো সেভাবেই আছে দুজন। মিম সহ্য করতে পারলো না। তেড়ে গিয়ে দুজনকে ছাড়িয়ে নিলো। রিহার গালে চড় বসাতেই রিহাও থেমে রইলো না। সেও চড় বসিয়ে দিলো মিমের গালে। মিম হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। হামিদ মিমের বাহু চেপে ধরে শাসিয়ে বললো,
— “ডোন্ট ইউ ডেয়ার মিম..! এই দুঃসাহস নেক্সট টাইম আর করবে না।”
মিম একেবারেই হতভম্ব হয়ে গেলো। ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো হামিদের দিকে। হামিদের হাত ধরে বললো,
— “হামিদ তুমি আমাকে এই মেয়েটার জন্য শাসাচ্ছো? তুমি ভুলে গেছো আমাদের ভালোবাসার কথা? আমাদের দশ বছরের প্রেম ছিলো।”
— “ইয়েস ছিলো। কিন্তু এখন আর নেই।”
— “নেই মানে?”
— “তুমি কি করে পারলে আমার সাথে বিট্রেয় করতে?”
— “মা…মানে?”
— “তোমার সবকিছুই আমি জানি মিম। তাই আমি নিজের সুখ বেছে নিয়েছি। যেমনটা তুমি নিয়েছো।”
— “এটা অন্যায়। তুমি আমার সাথে এমন করতে পারো না। তুমি আমাকে ধোঁকা দিতে পারো না।”
— “ওহ সিরিয়াসলি? প্রথমে কে দিয়েছে ধোঁকা? তুমি দিয়েছো মিম, তুমি। আমার ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে দিয়ে সায়ানের সাথে কুকীর্তিতে মেতেছিলে। সেই তুমি আমাকে অন্যায় শেখাচ্ছো? হাসালে।”
মিম রিহাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
— “তোকে আমি আমার ছোটবোনের মতো মনে করেছিলাম। আর সেই তুই কিনা আমার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলি।”
— “তোমার কথায় বড্ড হাসি পাচ্ছে। তুমি বিশ্বাস বা ভরসা রাখার যোগ্য? কত সূক্ষ্ম খেলা খেলেছো তুমি সিনথিয়ার সাথে। সেই তুমি কিনা বিশ্বাসের কথা বলছো। হাউ ফানি।”
মিমের চিৎকার চেচামেচিতে বাড়িতে একটা গুঞ্জন পরে গেছে। সবাই উপরে উঠে এলো। রিহার স্বামী অয়ন কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রিহার দিকে। সেদিকে রিহার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আসমা জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। মিম চিৎকার করে বললো,
— “কি হয়নি সেটা বলুন। আপনার আদরের বড় ছেলে তার ছোট ভাইয়ের বউয়ের সাথে নষ্টামিতে মেতেছে। আরো কিনা দুজন মিলে আমাকে শাসাচ্ছে।”
আসমা অবাকের শীর্ষে পৌছে গেলো। সাথে অয়নও। সিনথিয়ার বাবা আরশ হামিদকে বললো,
— “হামিদ এসব কি সত্য?”
— “হ্যাঁ। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। এবং খুব শীঘ্রই বিয়ে করবো।”
— “কিসব যা-তা বলছিস? মাথা ঠিক আছে? রিহা তোর ছোট ভাইয়ের বউ। তার সাথে কিভাবে?”
— “সিমপ্ল! ডিভোর্স দিবো আমি অয়নকে। তারপর হামিদকে বিয়ে করে নেবো। তারপর…।”
বাকিটা বলার আগেই চড় পরলো রিহার গালে। রিহা চোখ তুলে অয়নের দিকে তাকালো। কিছু বলবে তার আগেই হামিদ অয়নের গায়ে হাত তুললো। একপর্যায়ে হাতাহাতি লেগে গেলো। আশেপাশের বিলিন্ড থেকে মানুষরা সবাই এদিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের মানুষের মুখে গুঞ্জন শুরু হলো। আসমা এবং আরশ মিলে দুজনকে থামাতে চেয়েও পারছে না। হামিদ জোরে লাথি দিতেই অয়ন ছিটকে পরলো। তারপর উঠে নিচে চলে গেলো। আসমা কঠিন স্বরে বললো,
— “একটা মেয়ের জন্য তুই তোর ভাইকে মারলি?”
— “শুধু তো মেরেছি। দরকার হলো আরো বড় স্টেপ নিবো।”
— “মাথা ঠিক আছে তোর? এই কালনাগিনীর জন্য নিজের ভাইয়ের সাথে শত্রুতা করছিস।”
— “আর কোনো কথা নয়।”
— “কিসের কোনো কথা নয়? তোমাদের সম্পর্ক কতদিন ধরে চলছিলো?” মিম চেচিয়ে বললো।
হামিদ মিমের গাল শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
— “কার সাথে কথা বলছিস এতো চেচিয়ে? নিচু আওয়াজে কথা বলবি সবসময়। বুঝেছিস?”
— “হামিদ তুমি আমার সাথে এমনটা করতে পারো না।” কান্নারত অবস্থায় বললো মিম।
— “আমি অনেক কিছু করতে পারি। তবে চিন্তা করো না জান তোমাকে আমি ডিভোর্স দিবো না। তুমিও থাকবে সাথে রিহাও।”
— “আমি কখনোই এটা মানবো না।”
— “তোমার মানা না মানাতে কিছু যায় আসেনা। রিহারও সম্মতি আছে এতে।”
— “আমি খুন করবো ওকে।”
মিম আশেপাশে তাকিয়ে হাতে ইট তুলে নিলো। রিহার দিকে নিক্ষেপ করার আগেই অনেকটা জোরে থাপ্পড় মারলো হামিদ। মিম মেঝেতে পরে গেছে। হামিদ রেগে তাকিয়ে আছে। রিহা বললো,
— “তোমার এই স্বভাব আর গেলো না তাইনা? এখনো আসছিলে আমাকে মারতে? শুনো আমি রিহা। সিনথিয়া নই। যাকে হাজার অপমান করলেও কিছু বলবে না এটা ভেবে ভুল করবে না। শুধু তোমার কারণে সিনথিয়া প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়েছিলো সায়ানের বাড়িতে। আর এদিকে ইনিয়ে বিনিয়ে বাবা-মায়ের কান ভারি করেছো।”
— “মানে? কিসব বলছো তুমি রিহা? খুলে বলো।” আরশ বললো।
— “এই মেয়েটার কারণেই সিনথিয়ার মিচক্যারেজ হয়েছিলো। শুধু এই মেয়েটার কারণেই। রাক্ষসী কোথাকার।”
— “মা..মানে?”
আসমার কণ্ঠস্বর কেপে উঠলো। এতোদিন সিনথিয়াকে দোষী মনে করেছিলো। কিন্তু যেদিন শুনলো অপ্সরাও চলে গেছে সেদিন থেকে কেমম যেনো সন্দেহ হতো আরশি এবং সায়ানের উপর। মনে মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি দিতো। তাদের মেয়ে নাহয় গ্যায়ো ভূত হয়ে থাকতো তাই সায়ানের সাথে ম্যাচ হতো না। কিন্তু অপ্সরাতো ওদের সোসাইটি থেকে বিলং করে। তারপরেও কেনো ম্যাচ হলো না? তাহলে ওদের মা-ছেলে দুটোর মাঝেই ঘাপলা আছে? এমন হাজারো চিন্তা ভিড় করতো আসমার মধ্যে। রিহা এবার সব বলতে শুরু করলো।
— “মা আপনি জানেন না, সায়ান যখন এবরড যাচ্ছিলো সিনথিয়া তখন তিনমাসের প্র্যাগনেন্ট ছিলো। ওই সময়টাতেই সায়ানের সাথে এই মেয়েটার ভাব হতে শুরু হয়। সিনথিয়া ওর প্র্যাগনেন্সির কথা শুধু সায়ানকেই বলেছিলো। সায়ান থেকে যখন জানতে পারলো প্র্যাগনেন্সির ব্যাপারটা তখন এই মেয়ে ফুপিকে ফোন করে কান ভার করে দিয়েছিলো। তিনি সিনথিয়াকে যা নয় তাই বলে অপমান করে। এরমধ্যে সায়ানকে হাত করে ফেলে। তারপরেই তো সায়ান ডিভোর্স দিয়েছিলো। সিনথিয়াকে যখন আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন মনে আছে এই মেয়েটা সিনথিয়াকে পানি খাইয়েছিলো? সেখানেই ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলো। তারপরেই তো ওর মিচক্যারেজ হয়ে গেলো। আর আপনারা কেউ ওর অসুস্থতা নিয়ে মাথাও ঘামালেন না।”
আসমা কাপা কাপা স্বরে বললো,
— “এসব আগে বললে না কেনো?”
— “জেনেছিই তো কিছুদিন আগে। হ্যাঁ সিনথিয়াকে নিয়ে আমি ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছি। কিন্তু আমি কখনোই চাইনি এরকম কিছু হোক ওর সাথে। শুধু এখানেই থেমে যায়নি এই মেয়ে। সায়ানদের বাড়িতে যেই ঘটনা ঘটেছিলো সায়ানের বন্ধুকে নিয়ে সেটার পেছনে কিছুটা হাত এই মেয়েটারও ছিলো। সায়ান এবং ফুপিও জড়িত ছিলো এসবের সাথে। পার্টির ঘটনা পর্যন্তই সায়ানের হাত ছিলো। বাকি সবটার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে এই মেয়েটা আর ফুপি। এরা দুজন মিলেই ছেলেটাকে ঘরে নিয়ে এসেছিলো। সেদিন পানির কল এই মেয়েটাই বন্ধ করে দিয়েছিলো যাতে সিনথিয়া উপরে আসে ভেজা শরীর নিয়ে। সব ওদের প্ল্যান মতোই হয়েছিলো। সবই হয়েছে। সায়ানকে উলটাপালটা বুঝিয়েছে। সায়ানের সাথে সিনথিয়ার সংসার ভাঙার পেছনে অর্ধেক কারণ ছিলো এই মেয়ে আর ফুপি।”
রিহা আরশের দিকে তাকিয়ে বললো,
— “বাবা আপনি জানেন না আপনার বোন কতটা ধুন্ধুর মহিলা। কতটা অত্যাচার করেছে সিনথিয়ার উপর। কখনোই শুনতে চাননি ওকে। না বুঝতে চেয়েছেন। আমরা কেউ-ই ওর মনের দিকটা বুঝতে চাইনি। সবসময় ওর বাইরের গেটাপ দেখে হাসি ঠাট্টা করেছি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কতটা মরেছে মেয়েটা আমরা কেউ সেই খবর পর্যন্ত রাখিনি। মিচক্যারেজের মতো এতো বড় একটা ঘটনা নিজের ভেতরেই চেপে রেখেছিলো। কাউকে কিচ্ছু বলেনি। জানতে পর্যন্ত দেয়নি। নিজের কষ্ট নিজের ভেতরেই চেপে রেখে দিয়েছিলো।”
আসমার মাথাটা ফাকা ফাকা লাগছিলো। আশেপাশে সব অন্ধকার হয়ে আসতেই ঢলে পরে গেলো।
______________________________
অপ্সরার ব্যাপারে সব শুনে জাভেদের বন্ধু খালিদও আগ্রহ প্রকাশ করলো। সায়ানের সাথে এখনো ডিভোর্স হয়নি অপ্সরার। ঘর থেকেই বের হতে পারছে না অপ্সরা। সায়ান হুমকি দিয়ে রেখেছে। যদি ঘর থেকে বের হয় ওকে তুলে নিয়ে যাবে। সেই ভয়েই কিছু করতে পারছে না।
দরজায় টোকা পরতেই অপ্সরা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সিনথিয়াকে দেখে মুচকি হাসলো। এই মেয়েটার সাথে কথা বললে অপ্সরার অনেক ভালো লাগে। এতোটা ভালো মনের মেয়েটার সাথেও সায়ান টিকতে পারলো না। সবকিছুর পেছনে নষ্টের মূল সায়ানের মা। ধুন্ধুর মহিলা। সবসময় উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে অপ্সরার ব্যাপারে। তাইতো আরো বিগড়ে গেছে সায়ান। লাগাম টেনে না ধরায় আজ সে মেয়েবাজ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো অপ্সরা।
সিনথিয়া অপ্সরার মেয়ে রুহিকে কোলে নিলো। কিছুক্ষণ রুহির সাথে দুষ্টামি করে অপ্সরাকে বললো,
— “আজ কিন্তু উনিও এসেছেন। সাথে উনার বন্ধু। একবার কথা বলে দেখো।”
— “আ..আমি? কি ক..কথা বলবো?”
— “সেটা কথা বলা শুরু করলেই বুঝবে।”
— “সিনথিয়া আমার কেমন যেনো লাগছে। এখনো ডিভোর্স হলোনা আর এরমধ্যেই আমি কিনা আরেকটা বিয়ের জন্য উঠে পরে লেগেছি।”
— “সায়ানের সাথে তো তোমার বিয়েটা হয়-ই নি। এরকম সম্পর্ক থেকে বাচতেই তোমাকে বিয়েটা করতে হবে। না হলে কিছুতেই শান্তি পাবে না।”
অপ্সরা চুপ করে রইলো। মেয়েটা কেঁদে উঠতেই সিনথিয়া রুহিকে অপ্সরার কোলে দিয়ে দিলো। রুহিকে আগলে ধরলো। এরমধ্যে খালিদের বাচ্চাটা ওদের রুমে চলে এলো। গুটিগুটি পায়ে হেটে এসে অপ্সরার দিকে তাকালো। অপ্সরার খুব মায়া হলো। কতটা নিষ্পাপ দেখাচ্ছে বাচ্চাটাকে। বাচ্চাটার মা নেই ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। মুখটা এতটুকুন হয়ে আছে। নিষ্প্রাণ চাহনি। একটুখানি বাচ্চার মুখেও বিষন্নতা ছেয়ে আছে। রাফি অপ্সরার আঁচল টেনে ধরে বললো,
— “মাম্মাম তোলে নাও না। তুমি আমাতে রেতে তেনো এতানে এচে গেচো? তুমি পচা। আমাতে এতটুও ভালোবাতো না।”
অপ্সরার বুকটা ধক করে উঠলো রাফির মুখে মাম্মাম ডাক শুনে। ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে অপ্সরার দিকে। সিনথিয়া মলিন হেসে রাফিকে কোলে নিলো। রাফি সিনথিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
— “আনতি মাম্মাম আমার সাতে কতা বলে না তেনো?”
— “তোমার মাম্মামও তোমার সাথে রাগ করেছে। তুমি কেনো মাম্মামকে আদর করে দাওনি বলো? তাইতো কথা বলছে না।”
— “আচ্চা আমি এতনি আদল দিচ্ছি মাম্মামতে।”
রাফি সিনথিয়ার কোল থেকে নেমে তাড়াতাড়ি করে এসে অপ্সরার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিয়ে বললো,
— “মাম্মাম আমার সাতে একন কতা বলবে। ইয়ে! ইয়ে!”
হাত তালি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে কথাগুলো বললো রাফি। রুহিকে দেখে অপ্সরার পাশে বসে পরলো। রুহির গালে হাত বুলিয়ে বললো,
— “মাম্মাম ও আমাদেল পুতুল?”
— “হুম! তোমার ছোট্ট বোন। তোমার ছোট্ট পুতুল।”
সিনথিয়াও এগিয়ে এসে পাশে বসলো। রাফিকে বললো,
— “রাফি এখন কিন্তু তোমার অনেক দায়িত্ব?”
— “তি দাতিত্ব আনতি?”
— “এখন থেকে তোমার বোনকে আগলে রাখতে হবে। কান্না করলে ওর সাথে খেলতে হবে। ওকে ঘুম পারাতে হবে। বুঝেছো?”
— “হ্যাঁ। আমি আমাল বোনতে অনেত ভালোবাচবো আনতি।”
কথাটা বলেই রুহির কপালে চুমু দিয়ে হাত গুলো ধরে বললো,
— “আমাল বোন তুমি এদদম তান্না তরবে না হু? আমি তোমাতে আমার চব তেলনা দিয়ে দিবো।”
.
বড় একটা ওড়না দিয়ে নিজেকে ভালো করে ঢেকে ড্রয়িং রুমে আসলো অপ্সরা। রুহি কোলে। রাফি অন্য হাত ধরে রেখেছে। সিনথিয়া জাভেদের দিকে এগিয়ে গেলো। দুজনকে কথা বলতে দিয়ে জাভেদ আর সিনথিয়া অপ্সরার মামা-মামির সাথে কথা বলছে ডাইনিং টেবিলে বসে। এদিক থেকে ড্রয়িংরুম দেখা যাচ্ছে।
রাফি বাবার কোলে চড়ে বসে বললো,
— “বাবাই মাম্মাম আমাদের সাতে যাবে না?”
— “হু যাবে। তবে আজ নয় বাবা। আরো অনেক পরে।”
রাফি ছলছল চোখে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেছে। অপ্সরার খারাপ লাগলো। বাচ্চাটা মায়ের ভালোবাসা পেতে একদম মারিয়া হয়ে আছে। অপ্সরা রাফিকে আদর করে দিয়ে বললো,
— “তুমি প্রতিদিন মাম্মামের কাছে চলে আসবে ঠিকাছে। তারপর তোমার বোনের সাথে খেলবে।”
— “সত্যি?”
— “হু..।”
রাফি হাসছে। হাত তালি দিচ্ছে। রুহির কপালে চুমু দিচ্ছে। অপ্সরা ওদের দেখে মুচকি হাসছে। অপ্সরার কোল থেকে রুহিকে কোলে নিলো খালিদ। তারপর বললো,
— “এরপর বলুন কি ভাবলেন বিয়ের বিষয়টা নিয়ে?”
অপ্সরা মুখটা নত করে ফেলে বললো,
— “আসলে আমি এখনো কিছু ভাবিনি। তাছাড়া আমার তো এখনো ডিভোর্স হয়নি।”
— “আপনাদের বিয়েটাই তো হয়নি। ডিভোর্সের তো প্রশ্নই উঠে না।”
— “মা..মানে?”
— “গর্ভবতী অবস্থায় বিয়ে জায়েজ হয়না। আপনি এতোদিন সায়ানের সাথে যেভাবে ছিলেন সেটাকে বিয়ে বলে না। আপনারা জেনায় লিপ্ত ছিলেন। তাছাড়া আপনি আপনার প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দতও পালন করেননি।”
— “আস..আসলে আমি বু..বুঝতে পারছি না।”
— “বাসায় কুরআনের অনুবাদ নেই?”
— “হু আছে।”
— “সময় পেলে একবার খুলে পড়বেন। আপনার প্রশ্নের উত্তর সেখানেই আছে।”
— “(—–)”
— “যেহেতু দেশের আইন অনুযায়ী আপনাদের কাবিন হয়েছে তাই আইন অনুযায়ী ডিভোর্সের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে পরে সায়ান এসে ঝামেলা করতে পারে।”
— “হু। আমি তাই ভাবছিলাম। কিন্তু…।”
— “কিন্তু কি?”
— “না মানে.. আসলে, সায়ান আমাকে হুমকি দিয়েছে ঘর থেকে বের হলে কিছু একটা করবে। তাই কোর্টে যেতে পারছি না।”
অপ্সরা কথাটা বলতেই ভিষণ লজ্জা পাচ্ছিলো। মনে মনে ভাবছে লোকটা কি ভাববে কে জানে। থুতনিটা বুকের সাথে লেগে গেছে। খালিদ বললো,
— “আপনি মত দিন এই বিয়েতে। বাকিটা আমি সামলে নিবো।”
— “আসলে আমি…।”
— “ঠিকাছে ভাবুন আপনি। আপনার মামা-মামিকে জানিয়ে দিবেন। আমি আজকেই লয়ারের সাথে কথা বলবো আপনার ব্যাপারটা নিয়ে।”
— “জ্বী আচ্ছা।”
খালিদ রুহিকে অপ্সরার কোলে দেয়ার সময় তখন একনজর তাকিয়েছিলো খালিদের দিকে। তৎক্ষনাৎ আবার নজর সরিয়ে নিয়েছে। প্রখর ছিলো সেই দৃষ্টি। আন্তর-আত্না কেঁপে উঠেছিলো অপ্সরার। খালিদরা চলে যাওয়ার পরেও একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো অপ্সরা। কোনোভাবেই ভুলতে পারছিলো না সেই প্রখর দৃষ্টির চোখজোড়া।
.
রাতে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে অপ্সরা মাত্রই শুয়েছিলো। তৎক্ষনাৎ মনে পরলো খালিদ বলেছিলো সময় পেলে কুরআনের অনুবাদটা পড়তে। অপ্সরা উঠে গেলো। ওযু করে এসে কুরআন টা নিয়ে বসলো। প্রথম থেকেই পড়া শুরু করলো। যতই পড়ছে ততই শিউরে উঠছে। আর আপসোস হচ্ছে আগে কেন এই কুরআন খুলে দেখলো না। কানাডা থাকাকালীন একদম সেখানের লাইফস্টাইলেই চলাফেরা করতো। মনেই হয়নি ও মুসলিম। শুধু নামটাই রেখেছিলো মুসলিমদের।
রাত তিনটা সময় অপ্সরা ডুকরে কেঁদে উঠলো। পুরো জীবনটাই ভুলেভরা ছিলো। কোথায় সুখে খুজে নি সে? অথচ যেখানে সব সুখ লুকিয়ে আছে সেখানে একবারও ফিরে তাকায়নি। ধরা দেয়নি রবের কাছে। কখনোই সেজদায় পড়েনি।
নফল সালাত তো দূরে থাক কোনোদিন ফরজ সালাতও ঠিকমতো পড়েনি অপ্সরা। অথচ আজ তাহাজ্জুদের সিজদায় পড়ে কাদছে। ক্ষমা চাইছে বারবার রবের কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য। আহ! এখনানেই তো সব শান্তি।
“তুমি কেন আগে আসোনি?”
১৮.
লাল বেনারসি পরে টুকটুকে বউ সেজে বিছানায় বসে আছে অপ্সরা। কোলে রুহি। পাশে রাফি বসে চোখদুটো বড় বড় করে অপ্সরাকে দেখছে। অপ্সরা রাফির গোছানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
— “কি দেখছো বাবা?”
— “মাম্মাম তোমাকে এদদম নুতুন বউ লাগছে।”
অপ্সরা আবার হাসলো। রাফি কালো একটা পাঞ্জাবি পরেছে। রুহিকেও কালো জামা পরাতে হয়েছে রাফির জন্য। রাফির এক বায়না সে যেই কালার পরেছে বোনকে সেই রঙের জামা পরতে হবে। রাফির আবদার রাখতেই রুহিকেও কালো জামা পরিয়ে দিয়েছে।
একটু পরে সিনথিয়া এবং অপ্সরার মামি রুমে প্রবেশ করলো। সিনথিয়ার ঠোঁটে মৃদু হাসি। অপ্সরার মামিও খুব খুশি। মনে হচ্ছে নিজের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে আজ। সিনথিয়া অপ্সরার পাশে বসে রসিকতা করে বললো,
— “এমা তুমি হাসছো কেনো? বউদের মুখ থাকে কাঁদো কাঁদো। আর তুমি কিনা হাসছো? কি ব্যাপার বলো তো? খালিদ ভাই কি কিছু বলেছে নাকি?”
সিনথিয়ার কথায় অপ্সরা লাজুক হেসে মাথা নিচু করে ফেললো। রাফি এখনো গোলগোল চোখে এখনো অপ্সরার দিকে চেয়ে আছে। কারণ তার মাম্মামকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। দীর্ঘ চারমাস পর আজকে তার মাম্মাম তাদের সাথে যাবে। এই কথাটা শুনার পর থেকেই রাফি খুশিতে বাবার সামনে কিছুক্ষণ লাফালাফি করেছে৷
যথাসময়ে তাদের বিয়ের সম্পন্ন হয়েছে। সবার মাঝে খুরমা বিতরণ করা হলো। অপ্সরা কালো বোরকা জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। আগে কখনো বোরকা পরেনি। আজ প্রথম পরেছে। অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে৷ নিজের কাছেই নিজেকে সম্মানিত লাগছে। আগে ছোট ছোট ড্রেস পরেছিলো তখন এমন অনুভূতি হয়নি। এই অনুভূতি একেবারে নতুন। প্রশান্তিকর অনুভুতি।
বিদায়ের সময় অপ্সরা কাদেনি। দিনটাকে খুব সুখকর মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এই সমাজের তিক্ততা থেকে মুক্তি মিলেছে খালিদের সংস্পর্শ পেয়ে। মামা-মামীকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। ওর খারাপ সময়ে যদি এই দুইজন মানুষ পাশে না থাকতো তবে সে হয়ত সায়ানের অত্যাচারে মিটে যেতো অথবা অন্যকোনো ভাবে। সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলেছে অপ্সরা। এই মেয়েটার জন্য আজ নতুন একটা জীবন শুরু করতে পেরেছে। অনেক বেশি কৃতজ্ঞ মেয়েটার প্রতি।
.
মাঝারি সাইজের একটা ফ্ল্যাটে এসে ঢুকলো অপ্সরা। রাফি হাত ধরে রেখেছে। রুহি খালিদের কোলে। খালিদের মা ভীষণ খুশি। অপ্সরাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে ছিলো। অপ্সরাও খুশি। ভদ্রমহিলাকে খুব প্রছন্ন লাগছে। কালো রঙের হিজাবে খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে। ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক। গোলগাল মুখশ্রী। ছেলের বিয়ে বলেই হালকা সাজগোছ করেছে। খালিদের বাবা এগিয়ে এসে খালিদের কোল থেকে রুহিকে নিয়ে বললো,
— “এইতো আমার দাদুভাই চলে এসেছে। এতো দেরি কেনো করেছো দাদুভাই? তোমার জন্য কত অপেক্ষা করেছি জানো?”
অপ্সরা অবাক হয়ে খালিদের বাবার দিকে তাকালো। পরনে লুঙ্গি আর সাদা হাফ হাতা গেঞ্জি। হয়ত শুয়ে ছিলেন এতোক্ষণ। সেখান থেকেই উঠে এসেছে। গালভর্তি দাড়িতে হালকা পাক ধরেছে। হাসি-খুশি একজন মানুষ। তিনি অপ্সরার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
— “এই যে মামুনি, এবার তো চলেই এসেছো। আর যেতে দিবো না তোমাকে কোথাও। আমাদের কাছেই থাকবে আমাদের মেয়ে হয়ে। যদি কখনো খালিদ অশান্তি করে তোমার সাথে সেদিনই ওকে বের করে দিবো ঘর থেকে।”
খালিদকে শাসিয়ে বললো। খালিদ বেচারার মুখটা চুপসে গেছে। খালিদের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে অপ্সরা ফিক করে হেসে দিলো। পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলিয়ে নিলো। প্রচুর হাসি পাচ্ছিলো। রাফিও দাদুর কথায় তাল মিলিয়ে বললো,
— “দাদু তুমি তিক বলেচো। আমার মাম্মামতে আমি কোতাও যেতে দিবো না।”
খালিদের মা নাজনীন বললো,
— “অনেক কথা হয়েছে। অপ্সরা তুমি যাও এই কাপড় চোপড় খুলে পাতলা থেকে কিছু পরে নাও। হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে আসো খাবার দিচ্ছি। খালিদ তুইও যা রাফিকে নিয়ে। রুহি আমাদের কাছে থাক।”
— “না আমার বনুতে আমি দিবো না। ও আমাল কাচে তাকবে।” রাফি বললো।
নাজনীন হেসে রাফিকে কোলে নিয়ে বললো,
— “তোমার বোন তো সবসময় তোমার সাথেই থাকবে তাইনা? কিন্তু এখন তুমি তো বাইরে থেকে এসেছো। তোমার হাতে-পায়ে জীবাণু। তুমি যদি এভাবে তোমার বোনকে ধরো তাহলে তো বোন অসুস্থ হয়ে যাবে।”
— “তাই? তাইলে আমি একনি হাত-মুক দুয়ে আসচি দাদি।”
— “এইতো ভালো ছেলে। যাও এবার বাবার সাথে।”
— “তিকাছে।”
অপ্সরা রাফি এবং খালিদের সাথে ওদের রুমে গেলো। মাঝারি সাইজের রুমটায় অল্প-সল্প ফার্নিচার হলেও খুব গোছালো। রুমটায় স্বস্তি দায়ক একটা পরিবেশ রয়েছে। অপ্সরা বোরকা খুলে খাটে বসলো। রাফি তার বাবার সাথে ওয়াশরুমে গেছে হাত-মুখ ধুয়ে নিতে। হাত-মুখ ধোয়া শেষ হতেই অপ্সরার কাছে এসে বললো,
— “মাম্মাম আমার মুক মুচে দাও।”
— “এইতো দিচ্ছি।”
অপ্সরা এদিক সেদিক তাকালো। এরমধ্যেই খালিদ বের হয়েছে। তাওয়াল এগিয়ে দিলো অপ্সরার দিকে। অপ্সরা সেটা নিতে গিয়েও পারলো না। খালিদ শক্ত করে ধরে রেখেছে। অপ্সরা ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকিয়েছে খালিদের দিকে। লোকটার মুখে দুষ্টু হাসি দেখেই তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিলো তাওয়ালের অংশটা। পুরো শরীর কেঁপে উঠেছে লজ্জায়। এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। খালিদ একটু গলা খাকাড়ি দিয়ে আবার বাড়িয়ে দিলো তাওয়াল। অপ্সরা মাথা নিচু করে রেখেই সেটা নিয়ে নিলো।
রাফির মুখ মুছিয়ে দেয়া শেষ হতেই ছুটে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। বোনকে ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারবে না। এদিকে অপ্সরা বেশ অস্বস্তিতে পরে গেলো। লোকটার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না লজ্জায়। এমনটা আগে কখনো হয়নি। না প্রথম স্বামীর ক্ষেত্রে হয়েছে আর না সায়ানের ক্ষেত্রে হয়েছে। আঁচলের এক অংশ আঙুলে পেচাতে পেচাতে এদিক সেদিক তাকালো। খালিদ গম্ভীর মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
— “উঠুন। অনেক ধকল গেছে আজ। ফ্রেস হয়ে নিন।”
— “জ..জ্বী।”
খালিদকে সরে যেতে দেখে অপ্সরা নিজের ব্যাগ থেকে নীল রঙের সূতির শাড়ি নিয়ে উঠে দাড়ালো। আগে কখনো শাড়ি পরতো না। পারতোও না। যেদিন সিনথিয়ার মুখ থেকে শুনেছিলো শাড়ি পরায় খুব মায়াবী লাগে সেদিন থেকেই শিখেছে শাড়ি পরা। এরপর প্রায় প্রতিদিন পরতো শাড়ি। আনমনে এসব ভেবেই মুচকি হেসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। দুই কদম গিয়েই ধাক্কা খেলো। কিন্তু পরলো না। কারো সাথে লেপ্টে গেছে। অপ্সরা মুখ তুলে তাকিয়ে আবারও লজ্জায় পরে গেলো। খালিদ রসিকতা করে বললো,
— “আমিতো এখানেই আছি। তাহলে কল্পনায় কার কথা ভেবে ব্লাশিং হচ্ছেন?”
এমন কথায় আরো লজ্জা পেলো অপ্সরা। মৃদু স্বরে বললো,
— “আমি মো..মোটেও ব্লাশিং হচ্ছিলাম না। আপ..আপনি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছেন। ছা..ছাড়ুন।”
— “ধরিই তো নি।”
খালিদের কথায় ভীষণ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেলো অপ্সরা। খালিদ মৃদু স্বরে বললো,
— “এই লাল শাড়িতে আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। নামের মতোই অপ্সরী লাগছে।”
খালিদকে পাশ কাটিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো অপ্সরা। এরকম কমপ্লিমেন্ট আগে বহু শুনেছে কিন্তু আজকের মতো অনুভূতি কখনো হয়নি। অন্যরকম ভালোলাগা মন-প্রাণ জুড়ে বয়ে গেলো যেনো। অপ্সরার এমন কান্ড দেখে খালিদ মুচকি হাসলো।
একেবারে গোসল করেই বের হলো অপ্সরা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের পানি মুছে নিচ্ছে তাওয়াল দিয়ে। আনমনেই খালিদের কথা ভাবছে আর ব্লাশিং হচ্ছে। এই মুহুর্তে খালিদ রুমে নেই। ফ্রেশ হয়েই রুম থেকে বেরিয়েছে। অপ্সরার ভাবনার মাঝেই ঘাড়ে কারো স্পর্শ পেলো। অপ্সরা শিউরে উঠলো। তড়িঘড়ি করে আয়নার দিকে তাকিয়ে চুপসে গেলো। এখন খুব বেশিই অস্বস্তি হচ্ছে। যদিও খালিদকে পছন্দ হয়েছে তবুও একটু সময় চায় অপ্সরা। এখন কি তা পাবে না? অপ্সরার মন খারাপ হলো। খালিদ কিছুটা অবাক কণ্ঠে বললো,
— “তোমার ঘাড়ে, পিঠে এসব কিসের দাগ?”
খালিদের মুখে তুমি ডাক শুনে মন খারাপ ভাব কেটে গেলো। আবারও মন ভালো হয়ে গেছে। কারণ মানুষটার ছোয়ায় কামনা ছিলো না। হালাল অধিকার, ভালোবাসা, কেয়ার এবং দায়িত্ব ছিলো। অপ্সরার এতোসব ভাবনার মাঝে খালিদ আবার বললো,
— “কি হলো চুপ করে আছো কেনো? তোমার পিঠে, ঘাড়ে এসব কিসের দাগ। দেখি এদিকে ফিরো।”
অপ্সরাকে নিজের দিকে ফিরাতেই খালিদের নজর অপ্সরার গলায়, বুকে এবং কোমড়ে পরলো। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। চোখ ছোট ছোট করে কুচকে অপ্সরার দিকে তাকিয়ে বললো,
— “এসব কিসের দাগ? দেখে তো মনে হচ্ছে কেউ মেরেছে বেধড়ক।”
— “(—-)”
— “কথা বলছো না কেনো?” কণ্ঠ কিছুটা শক্ত শোনালো। অপ্সরা মিনমিনে স্বরে বললো,
— “আস..আসলে সায়ান…।”
অপ্সরা বেশ অপ্রস্তুত। সাথে ভিষণ লজ্জা পাচ্ছে। কি ভাবছে মানুষটা কেজানে। হয়তো ভাবছে নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করলে অন্য আরেকটা মেয়ের সংসার ভেঙে সেই ভালোবাসার বুঝি এই হাল? কিন্তু অপ্সরা তো জানতো না সায়ানের সাথে সিনথিয়ার বিবাহের কথা। বিষয়টা অনেক পরে জেনেছে। অপ্সরা মাথা নিচু করে ফেললো। খালিদের সাথে নজর মিলাতে পারছে না। খালিদের ব্যস্ত এবং ব্যকুল কণ্ঠে অপ্সরার ভাবনাগুলো মিথ্যে হলো। খালিদ বললো,
— “এখনো কি ব্যাথা আছে? আর কোথায় কোথায় দাগ আছে? বলো।”
— “হালকা হালকা ব্যাথা আছে। খুব বেশি নয়।”
— “হু..! বুঝেছি আমি। এদিকে বসো। আমি দেখি কি করা যায়।”
— “আপনি ব্যস্ত হবেন না প্লিজ। এসব এমনিতেই চলে যাবে। এর আগেও বহুবার এমন মার খেয়েছি। মলম পট্টি ছাড়াই সেরে গেছে।”
অপ্সরা কথাগুলো বলে খালিদের দিকে তাকালো। খালিদের গভীর মোলায়েম চাহনি দেখে চুপসে গিয়ে মুখ নামিয়ে নিলো। খালিদ এগিয়ে এসে অপ্সরার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
— “ওয়াদা করছি আজকে থেকে তোমার গায়ে একটা টোকাও পরবে না। যদি আমি কখনো তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে তুমিই আমাকে মেরো।”
— “এমা এসব কি বলছেন? আমি কিভাবে আপনাকে..?”
— “আচ্ছা মারতে না পারলে অন্য একটা বুদ্ধি দেই কি বলো?”
অপ্সরা উৎসুক হয়ে তাকালো। খালিদ বললো,
— “মারতে তো পারবে না। সেটার বদলে খুব করে আদর করে দিও হুম..! বউয়ের আদর খুব মজা।”
অপ্সরা লজ্জা পেয়ে ছিটকে সরে গেলো। খালিদ হাসছে। গা দুলিয়েই হাসছে। লজ্জায় এবং অস্বস্তিতে অপ্সরা মিইয়ে গেলো একেবারে।
.
রাতে শোবার সময় রাফি বায়না ধরে বললো,
— “আমি মাম্মামের সাতে গুমাবো বাবাই।”
— “ঠিকাছে ঘুমাও।” খালিদ বললো।
— “সত্যি?”
— “হ্যাঁ বাবা সত্যি।”
— “ইয়ে! একন তেকে আমি মাম্মামের সাতে গুমাবো।” রাফি হাত তালি দিলো।
বিছানা ঠিক করে বাবা-মায়ের রুম থেকে রুহিকে নিয়ে এলো খালিদ। উনারা চেয়েছেন নাতি-নাতনী দুজনকে নিজেদের কাছে রাখতে। খালিদই দেয়নি। রুহিকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রাফিকে ঘুম পারাতে চাইলো। রাফি আজ বাবার কাছে ঘুমাবে না। আজকে মাম্মামের সাথে ঘুমাবে এবং মাম্মামকেই ঘুম পারাতে হবে। রাফির বায়নায় অপ্সরা হেসে দিলো। খালিদ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— “আজ থেকে বাবাই আউট হয়ে গেছে। আচ্ছা ঘুমাও তুমি মাম্মামের সাথে।”
খালিদ বালিশ নিয়ে সোফার দিকে এগিয়ে গেলে অপ্সরা বললো,
— “আপনি কোথায় যাচ্ছেন বালিশ নিয়ে?”
— “ঘুমাতে। ওখানে তোমরা তিনজনই ঘুমাও।”
— “আপনি বুঝি সোফায় ঘুমাবেন?”
খালিদ দুষ্টামি করে বললো,
— “তুমি চাইলে তোমার বাহুডোরেও ঘুমাতে পারি।”
অপ্সরা আর কিছু বললো না। চুপচাপ শুয়ে পরেছে। রাফিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো। ঘরে ড্রিম লাইট জ্বলছে। সেই আলোতে রাফির মুখের দিকে তাকালো অপ্সরা। এই মুখটায় হাজারো মায়া রয়েছে। রাফির কপালে চুমু দিলো। রাফি বললো,
— “মাম্মাম তুমি কি আবাল আমাকে চেড়ে চলে যাবে? তুমি আল যেও না মাম্মাম। তাহলে আমি কুব কাঁদবো। এর আগে যকন তুমি চলে গেচিলে আমি কুব কেঁদেচি। বাবাইও তোমাকে এনে দেয়নি। দাদিও না।”
অপ্সরার বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। রাফি যে ওর মায়ের কথা বলছে। একটুখানি বাচ্চাটা কত কষ্টই না পেলো। অপ্সরা রাফিকে আদর করে দিয়ে বললো,
— “মাম্মাম আর কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবে না। প্রতিদিন তোমাকে আদর করে বুকে নিয়ে ঘুম পারিয়ে দিবে। এবার ঘুমাও বাবা।”
— “আচ্চা মাম্মাম।”
ড্রিম লাইটের মৃদু আলোর মধ্যে দিয়ে অপ্সরা সোফার দিকে তাকালো। লোকটা গভীর ঘুমে আছে। একটুখানি সোফায় লোকটার জায়গা হয়নি। তবুও শুয়ে আছে। অপ্সরা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিলো।
____________________________
দশটার দিকে ফ্রেশ হয়ে বের হলো সিনথিয়া। আজকে একটু লেট হয়ে গেছে উঠতে। জাভেদকে দেখলো না রুমে। রুমে পানি না থাকায় রান্নাঘরে গেলো পানি খাওয়ার জন্য। পানি খেয়ে আবার রুমে এলো। বিছানা গোছানো হয়নি। এলোমেলো হয়ে পরে আছে। সিনথিয়া রুমে এসে অবাক হলো।
জাভেদ বিছানা গোছাতে শুরু করেছে। সিনথিয়া তাড়াতাড়ি জাভেদের কাছে গিয়ে বললো,
— “আরে এসব কি করছেন আপনি? আপনি কেনো করছেন এসব? সরুন আমি করে দিচ্ছি।”
— “কোথাও লিখা আছে এসব শুধু স্ত্রীরা করবে। স্বামীরা করতে পারবে না?”
— “না লিখা নেই। এবার সরুন।”
— “তুমি সরো তো। দেখছো না কাজ করছি।”
— “আপনি দিন দিন বেশ দুষ্টু হচ্ছেন।”
— “দুষ্টু হই আর যাই হই তোমারই তো।”
সিনথিয়া একটু থেমে গেলো। বুকের ভেতর ভালোলাগার ঢেউ খেলে গেলো। চোখে-মুখে প্রাপ্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে আবার বললো,
— “আচ্ছা বুজেছি। এবার সরুন।”
— “উফ! যাও তো যাও। কাজে বিরক্ত করো না।”
— “আমি বিরক্ত করছি?”
সিনথিয়ার অবাক চাহনির সাথে অবাক কণ্ঠ। জাভেদ সিনথিয়াকে জোর করে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বললো,
— “এখানেই বসে থাকো। এক পা নড়লে খবর আছে।”
— “আপনি আজকে কাজে যাবেন না?”
জাভেদ বিরক্ত হলো। সে এখন কাঁথা ভাজ করছে। বিরক্ত হয়ে বললো,
— “আর যদি কিছু বলেছো তো………।”
সিনথিয়ার কান গরম হয়ে এলো। উহ! লোকটার মুখে একটুও লাগাম নেই। কেমন ঠোঁটকাটা স্বভাবের মানুষ। মুখে যা আসে তাই ফটাফট বলে দেয়। সিনথিয়া ভুলেও আর তাকালো না জাভেদের দিকে। এদিকে জাভেদ মহা খুশি। সিনথিয়াকে জব্দ করতে পেরেছে। লজ্জা পেয়ে একদম নেতিয়ে গেছে লজ্জাবতী গাছের মতো। মনে মনে মুচকি হাসলো জাভেদ।
রান্নাঘরে কাজ করার সময় আবার এসে উদয় হলো জাভেদ। সিনথিয়ার হাত থেকে কাজগুলো টেনে নিচ্ছে। সিনথিয়া বললো,
— “কি হয়েছে আপনার? কাজে না গিয়ে এসব কেনো করছেন,?”
— “আজকে আমি রান্না করবো বুঝেছো?”
— “না বুঝিনি। সব আমাকে জ্বালানোর ফন্দি। চুপচাপ দোকানে যান।”
— “যাবো না। হিহি। এবার সরো তো।”
জাভেদ সিনথিয়াকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই সবজি কাটতে শুরু করলো। সিনথিয়া হাজার বকেও থামাতে পারলো না মানুষটাকে। এরমধ্যে রান্না চড়ালো। সিনথিয়া বললো,
— “আচ্ছা আমাকে দিন এবার। আমি রান্না করি।”
— “এই তোমাকে কি কাজের বুয়া করে এনেছি নাকি? রাণী করে এনেছি। রাণীর মতো থাকো।”
— “তাই বলে আপনি রান্না করবেন?”
— “উফ যাও তো। এতো ফরমালিটি দেখিও না। একদিন রাধলে হাত ক্ষয়ে যাবে না।”
— “আজকে যদি রান্নায় একটু উনিশ বিশ হয় আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম।”
সিনথিয়া বেশ রেগেই বললো। সিনথিয়ার রাগি মুখটা দেখে জাভেদ মুচকি হাসলো। বললো,
— “বাহ! এইতো কর্তী ভাব ফুটে উঠেছে। এই না হলে আমার বউ। যাও বউ রুমে যাও। তোমার সেবায় এই গোলাম সর্বদা হাজির।”
সিনথিয়া হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
— “আচ্ছা আজকে আপনার হঠাৎ কি হয়েছে বলুন তো? এরকম করছেন কেনো?”
এরমধ্যে রান্নাঘরে সাবিনা এলো। জাভেদকে রান্নাঘরে দেখে বললো,
— “তুই এখানে কি করছিস?”
— “দেখুন না মা। সকাল থেকেই কি শুরু করেছে। কত বললাম আমি রান্না করি। কিন্তু উনি জেদ ধরে নিজেই রান্না শুরু করেছে।” সিনথিয়া বললো।
সাবিনা একবার রান্নাবান্নার হালত দেখে মুচকি হেসে চলে গেলেন। তিনি জানেন তার ছেলে মাঝে মাঝে এমন পাগলামি করে বউ-য়ের জন্য। আগেও করেছে কিন্তু সেই মেয়েটা বুঝেনি ছেলেটার ভালোবাসা। তরকারি একবার নেড়ে ঢেকে দিয়ে জাভেদ সিনথিয়ার দিকে ফিরে বললো,
— “একটা ডিল করি কি বলো?”
— “কিসের ডিল,?” ভ্রু কুচকে বললো সিনথিয়া।
— “যদি আজ রান্না ভালো না হয় তাহলে তুমি যা চাইবে তাই পাবে। রাজি?”
— “আচ্ছা রাজি।” সিনথিয়া হেসে বললো।
— “আর যদি রান্না ভালো হয় আমি যা চাইবো তাই দিতে হবে। রাজি?”
— “হু আচ্ছা।”
— “সত্যি তো? যা চাইবো তাই কিন্তু দিতে হবে।”
জাভেদের এমন কথায় সিনথিয়া কিছুটা ভড়কে গেলো। তবুও রাজি হয়ে গেলো।
.
দুপুরে সবাই খেতে বসেছে। সাবিনা এবং অতশি খেয়ে প্রসংশা করলো। সিনথিয়া ভাবলো হয়ত শান্তনা দিচ্ছে। তাই নিজেই একবার খেয়ে দেখলো। এমা! এতো ভালো রান্না কিভাবে রাধলো এই লোকটা? সিনথিয়া একবার জাভেদের দিকে তাকালো। জাভেদ এক ভ্রু উঁচু করে শয়তানি হাসি দিলো। যার অর্থ আজ যা চাই তাই দিতে হবে। সিনথিয়া কেঁপে উঠলো। দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।
রাতের দিকে সিনথিয়া একটু টেনশনেই পরে গেলো। লোকটা কেমন যেনো অদ্ভুত আচরণ করছে। কি এমন চাইবে? এমন ভয় লাগাচ্ছে কেন? এরমধ্যেই জাভেদ উপস্থিত হলো। সিনথিয়াকে নিয়ে ছাদে গেলো।
চাঁদের আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে আছে। দূরের ওই দীঘিতে চাঁদের আলো পরায় মনে হচ্ছে যেনো আয়না ভাসছে। কাছে গিয়ে দাড়ালেই নিজেকে দেখা যাবে সেই আয়নায়। সিনিথিয়া সেদিক থেকে নজর সরিয়ে জাভেদের দিকে তাকালো। জাভেদ রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো,
— “যা চাই তাই কিন্তু দিতে হবে।”
সিনথিয়া একটু ভয় পেলো। ছাদ থেকে লাফ দিতে বলবে না তো? যেমন রহস্যময় কণ্ঠে বলছে। সিনথিয়া ভীতু চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার জাভেদের দিকে তাকালো। জাভেদ একটা কাগজ সিনথিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
— “মেঘেদের দেশে যাবে সিয়া?”
সিনথিয়া কিছু বুঝলো না। জাভেদের কথাটাই শুধু কানে বাজতে লাগলো। কিন্তু কথাটার অর্থ ধরতে পারেনি এখনো। জাভেদের মায়াময় কণ্ঠ শুনে জাভেদের দিকে তাকালো। এই লোকটা ওকে এতো ভালোবাসে কেনো? এতো কেয়ার করে কেনো? ওর মতো ময়লা রঙের একজন মানুষকে এতো সম্মান করে কেনো? কোনোকিছুই জানা নেই।
সামনের মানুষটার দিকে তাকাতেই মানুষটাকে অনেক বছরের চেনা, আপন এবং খুব কাছের মনে হলো। একেবারে হৃদয়ের কাছের। এই মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সিনথিয়া। খুব ভালোবাসে। অজান্তেই চোখের কোণ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো সিনথিয়ার। মানুষটার মায়াময় চাহনিতে নিজেকে বিলীন করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। একছুটে গিয়ে মিশে গেলো সামনের মানুষটার প্রশস্ত বক্ষে।
চলবে,,,
® ‘নুরুন নাহার’
#