শুভ্র বর্ষণ পর্ব ১২

#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_১২

আনোয়ার সাহেব বাজার থেকে ফিরেছেন। তবে ওনার হাত খালি। বাজারের ব্যাগ দুইটা রিয়াদের হাতে। বাজার থেকে ফেরার সময় আজ লতিফ সাথে ছিলো না। লতিফ ছেলেটা আনোয়ার সাহেবের ফুট ফরমায়েশ খাটে। সে না থাকায় আনোয়ার সাহেব একাই বাজারে গিয়েছিলেন। বয়সের ভাড়ে কিংবা নানান অসুখ বিসুখের জন্য আজকাল শরীরটা কেমন অবসাদ গ্রস্থ হয়ে পড়ে। আজও তেমনটাই হয়েছিলো।

বাজারটা বাড়ি থেকে দশ মিনিটের পথ। বেশিরভাগ সময় লতিফ সাথে থাকে বলে আনোয়ার সাহেব হেটেই আসেন। আজ একা একাও তাই হেটেই ফিরছিলেন। ভারী বাজারের ব্যাগ দুটো বয়ে আনার সময় বুঝলেন কত বড় ভুল করেছেন। হাটের দিন বিধায় মাঝ রাস্তায় রিক্সা নেই। যাও পাওয়া যাচ্ছে সবই যাত্রীসহ।

কি এক মুসিবত হাজির করলেন বোকামো করে। আনোয়ার সাহেবের বেশ কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো হাত দুটো অবশ হয়ে রাস্তায় খুলে পড়বে। গায়ের জোড়ের ‘গ’ টুকুও নেই যেন। অথচ যৌবনকালে তার শক্তি ছিলো প্রশংসনীয়। আরো কিছুদূর যেতেই রিয়াদের দেখা পেলেন তিনি।

রিয়াদ মায়ের দেওয়া বাজারের লিস্ট নিয়ে হাটের দিকেই যাচ্ছিলো। আনোয়ার সাহেবের মুখ দেখেই সে অবস্থা বুঝে গিয়েছিলো। দৌড়ে এসে তার থেকে ব্যাগ নিয়ে নেয়। আনোয়ার সাহেব বাধা দিতে চাইলো। তবে রিয়াদ না শোনায় তিনিও আর কিছু বললেন না। বাজারের ব্যাগে একটায় আছে কাচা সবজি আর অন্যটায় মাছ। সাথে একটা দেশী মুরগী এনেছে।
শোভার দেশী মুরগি খুব প্রিয়। অন্যদিকে মিহা মুরগি তেমন পছন্দই করে না। শোভা যখন মুরগির হাড় পর্যন্ত চিবিয়ে খায় মিহা বোকা চোখে তাকিয়ে থেকে বলে,
“কি এমন স্বাদ এই মুরগিতে! হাড়ও বাদ দিবিনা!”

শোভা গর্ব করে বলে,
“স্বাদ বুঝলে তো নিজেই আমার মতো খেয়ে ফেলতে। এইজন্যই তুমি চিকন বুঝলে। আমার থেকে বয়সে দুইবছর বড় হয়েও ওজনে চার কিলোগ্রাম কম তোমার।”
আনোয়ার সাহেব মেয়েদের খুনসুটিতে হেসে ওঠেন।

আনোয়ার সাহেব বাড়ি ঢুকেই শোভাকে ডাকলেন। শোভা এসে বাবার সাথে রিয়াদকে দেখে অবাক হলো। তবে মুখে সেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো না। রিয়াদকে না দেখার ভাব করে এগিয়ে এসে বাবাকে এক গ্লাস পানি দিলো। আনোয়ার সাহেব পানি খেয়ে রিয়াদকে বসতে বললো। যদিও রিয়াদকে বাজারে যেতে হবে কিন্তু আনোয়ার সাহেবের অনুরোধে বসতে হলো। মিহা এসে বললো,

“আরে রিয়াদ ভাই যে, কেমন আছেন?”

“এইতো আলহামদুলিল্লাহ। তোমার খবর কি?”

“ভালো। আপনি বসুন আমি আসছি। যাবেন না কিন্তু।”

রিয়াদ একটু মুচকি হাসলো। শোভা তখন তেলেবেগুনে জ্বলছে। বাবার কি দরকার ছিলো উনাকে ডেকে বসাতে! এহহ! আবার দাত বের করে হাসা হচ্ছে। রিয়াদের হাসিমুখ শোভা দেখেনি। বা কবে দেখেছে মনে করতে পারবে না। আর শোভার প্রতি তো রাগ এবং উপেক্ষা ছাড়া আর কোনো মুখভঙ্গি দেখায়নি সে। গোমড়া মুখো আবার হাসতেও জানে! আপু নিশ্চয়ই এখন রিয়াদের জন্য হালকা খাবারের ব্যবস্থা করতে গিয়েছে।
অন্যদিকে রিয়াদ যেন শোভাকে দেখেও দেখেনি এমন একটা ভাব করে আনোয়ার সাহেবের কথা শুনছে। যা শোভাকে আরো বেশি খেপিয়ে তুলছে।

শিরীন বেগম ছোট মাছ দেখেই রাগ হয়ে গেলেন। বারবার মানা করেন ছোট মাছ আনলে যেন সকালে আনে। এখন এই বিকেলে ধৈর্য ধরে এগুলো কেটে ধুয়ে ফ্রিজে রাখা কি চারটি খানি কথা! স্বামীর ওপর রাগ হলেও রিয়াদের উপস্থিতিতে সেটা চেপে গেলেন। মাছের ব্যাগটা নিজে নিয়ে শোভাকে বাজারের ব্যাগটা ভেতরে নিতে বললো। শোভা ব্যাগ উঁচু করতে গিয়ে বুঝলো বেশ ভারী এটা। ওর মুখ দেখে রিয়াদের ঠোঁটের কোণে একটু তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। যেটা শোভাকে ভেতরে ভেতরে আরো অপমানিত ও বিব্রত করলো। এই লোকটার সামনেই কেনো মান সম্মান কাচের মতো ঝনঝন করে ভাঙে! কোনোমতে ব্যাগটা নিয়ে এঁকেবেঁকে রান্না ঘরে রেখেই রুমে ছুট দিলো। রিয়াদের সামনে আর পড়া যাবে না।

মিহা রিয়াদের জন্য কিছু হালকা খাবার ও ফল কেটে আনলো। সাথে আনোয়ার সাহেবের জন্য চা এনে দিলো। রিয়াদ খাবে না খাবে না করেও এক টুকরো আপেল মুখে দিলো। আনোয়ার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,

“মাস্টার্স তো শেষ করলে এবার কি করবে ভেবেছো কিছু?”

“আমি অনার্স থেকেই বাবার ব্যবসা টুকটাক দেখতাম। এবার বাবা বলছিলেন তার ব্যবসার দায়িত্ব নেই যেন। তবে আমার ইচ্ছে আলাদা চাকরি করবো। ইন্টারভিউ দিয়েছি কয়েক যায়গায়। হয়ে গেলে জয়েন করবো।”

“বাহ, নিজে কিছু করতে চাইছো শুনে ভালো লাগলো।”

__________

অনন্ত আসার পর থেকে নিশান্তের সাথে মিহার কথা বলা কমে গিয়েছে। কথা বলার ইচ্ছে দুজনের না কমলেও সময়ের হেরফের হওয়ায় কথা বেশি হচ্ছে না। নিশান্ত অফিস শেষে বাড়ি এসে ভাই এবং পরিবারকে সময় দেওয়ার পর মিহার সাথে যখন কথা বলছে ক্লান্তিতে দু-চোখ তখন ঘুম খোজে। কয়েকবার কানে ফোন রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। মিহা যখন কয়েকবার ডেকেও সাড়া পায় না তখন চুপ থেকে নিশান্তের ঘুমের গাঢ় নিশ্বাসের শব্দ শুনতে চেষ্টা করে। তারপর এক তপ্ত নিশ্বাস ফেলে ফোন কেটে দেয়।

বাকিরাত টুকু কাটে তীব্র অভিমানে। নিশান্ত এখানে এসে যেই বালিসে ঘুমায় সেটা গালে চেপে ধরে রাখে। কখনো সেটার গন্ধ নেয়। বালিসটায় নিশান্তের গায়ের গন্ধ আছে। যেটা ওকে মনে করায় মানুষটা ওর কতটা জুড়ে বসবাস করছে। এই বালিসের কভার সে ধোয় না, যতক্ষন না নিশান্ত আবার এসে এটাতে মাথা রাখছে। এতো মিস কেনো করে ওকে! ইচ্ছে করে লোকটাকে চোখের সামনে বসিয়ে রেখে সারাদিন দেখেই যাক। কোথাও যেতে না দিক।
তবে মিহা বোঝে নিশান্তের দিকটা। সে কতটা ব্যস্ত মানুষ তা জানে। তবুও একটা সুক্ষ্ম অভিমান মনের কোণে উঁকি দেয়। অবশ্য পরদিন সকালেই নিশান্ত ফোন দিয়ে কয়েকবার সরি টরি বলে আদুরে আলাপে ওর মন ভালো করে দেয়।

আজ নিশান্ত আসবে বলেছিলো। দুজনে একসাথে বাহিরে খেতে যাওয়ার কথা ছিলো। মিহা যখন রেডি হতে শুরু করে তখনই নিশান্ত ফোন দিয়ে জানায় আজ বিকেলে সময় দিতে পারবে না। জরুরি কাজ আছে একটা। মিহা কোনো উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেয়। তীব্র অভিমান হচ্ছে। এতো ব্যস্ত কেনো থাকতে হয়? একটু সময় কি বের করা যায় না? মিহা শাড়ি পড়ে সবে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। নিশান্ত আসতে পারবে না শুনে সেভাবেই রুম থেকে বের হয়ে বাগানে গিয়ে সবুজ ঘাসে বসে পড়লো।

কাদতে ইচ্ছে করছে ভীষন। এতোদিনের বুঝদার মেয়েটার আজ বড্ড অবুজ হতে মন চাইছে। নিশান্তের ব্যাস্ততা বুঝেও চোখ ভিজিয়ে, গাল ভাসিয়ে কাদতে ইচ্ছে করছে। প্রেমে পড়লে বুঝি এমনই অবুজ হয় মানুষ! হবে নাই বা কেনো? দুজনের দেখা সাক্ষাৎ কমে গিয়ে মিহার মনে এক আস্ত মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে। নিশান্তের হয়েছে কি!

মিহার মন খারাপ দেখে আকাশেরও বুঝি মন খারাপ হলো। মেঘলা আকাশটা কিছুক্ষনের মধ্যেই কালো রঙে ঢেকে গেলো। ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ বাড়তে লাগলো।বাড়ির কেউই বোধহয় জানে না মিহা বাগানে। বিকেলের সময়টা সবাই একটু বিশ্রামে থাকে। তাই কেউ ডাকতেও এলো না। মিহা একই ভাবে বসে রইলো। ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ নিশান্তের দেওয়া বেলীফুলের চাড়া গুলোতে। গাছগুলো বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে। মিহা আঙুল বাড়িয়ে একটা পাতা স্পর্শ করলো। টুপ করে একফোটা জল বেরিয়ে এলো ওর শান্ত দীঘি থেকে। বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম করে। মিহা ভিজে গেলো। তবুও উঠলো না। আজ ওর মন কিশোরী হয়ে উঠেছে। আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।

বৃষ্টির ফলে আজকে সন্ধ্যাটা বোধহয় একটু জলদিই এলো। চারিদিক আলো শূন্য হয়ে গেলেও বৃষ্টি রয়ে গেলো। রয়ে গেলো মিহাও। বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। গুড়িগুড়ি পড়ছে এখন। ঠান্ডা লাগছে ভীষণ। লাগুক, মনের ভেতর যে একজনকে না দেখে পুড়ছে তার থেকে বেশি নয় বাহিরের ঠান্ডা। ঠান্ডা লেগে জ্বর চলে আসুক। তবে যদি সেই আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি ছুটে আসে।

আধার তখনও পুরোপুরি আলোকে গ্রাস করেনি। ছাই বর্ণময় পরিবেশ। এমন সময় মিহাদের বাড়ির সামনে একটা সিএনজি এসে থামলো। মিহা সিএনজির আওয়াজে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। কেউ একজন মাথার ওপর ব্যাগ ধরে বৃষ্টি আড়ালের চেষ্টা করে সিএনজি থেকে নামলো। নিশান্ত! মিহা তড়িৎ গতিতে বসা থেকে উঠলো। নিশান্ত এসেছে তাহলে। আগে কেনো বললো না আসবে! মিহা কেদে ফেললো ঝরঝর করে।

নিশান্ত কয়েক কদম হাটতেই মিহাকে দেখতে পেলো। বিস্ময়ে ওর পা থেমে গেলো। ধুসর সন্ধ্যায় শাড়ি পরিহিতা মাহযাবীন। কলাপাতা রঙের শাড়িটা ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। ভেজা খোলা চুল থেকে পানি গড়াচ্ছে টুপটাপ। চোখের কাজল লেপ্টে অনেকটাই ছড়িয়ে গেছে। মাহযাবীন কাদছে! এই অবস্থা কেনো মেয়েটার? ভাবনাটা মাথায় আসতেই দ্রুত বাগানের দিকে পা চালালো নিশান্ত। তবে জোরে কয়েক কদম এগোতেই ঘটে গেলো ঘটনাটা। মিহার কান্না থেমে গেলো। বিস্ময়ে মুখে হাত চলে গেলো। নিশান্ত পা পিছলে পড়েছে। যেন তেন ভাবে পড়া নয়, একেবারে মুখ থুবড়ে পড়া।

নিশান্ত যখন মাথা তুললো ওর মুখেও কাদা লেগে গিয়েছে। সারা গায়ে কাদায় মাখামাখি। মিহা ফিক করে হেসে ফেললো। ভুলেই গেলো একটু আগের কান্না। তবে যায়গা থেকে নড়লো না। নড়ার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। নিশান্ত কোনো মতে উঠে কোমড় ধরে হেটে মিহার সামনে এলো। দুজন যখন মুখোমুখি হঠাৎই মিহার হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। মুখের ভাব বদলে গেলো। সেখানে ধরা দিলো বিস্ময়। নিশান্ত উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো,

” এই অবস্থা কেনো? কি হয়েছে তোমার? অসময়ে এভাবে ভিজে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? উত্তর দাও।”

মিহা কিছু বলতে পারলো না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে নিশান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কাদামাখা মুখে এ কাকে দেখছে সে! নিশান্তই তবে সেই ব্যক্তি!

নিশান্ত মিহার হাত ঝাকিয়ে বললো,
“কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেনো? কি হয়েছে তোমার?”

মিহা স্তম্ভিত গলায় আস্তে করে বললো,
“আপনিই সেই!”

কথাটা শুনে নিশান্ত ভ্রু কুঞ্চিত করলো। পরমুহূর্তে ওর উদ্বিগ্ন ভরা মুখে একটা হাসির ঝলক ফুটে উঠলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here