#শুভ্র_বর্ষণ
#প্রভা_আফরিন
#পর্ব_২৫(অন্তিম পর্ব)
আধার নামা সন্ধ্যায় বিদায়ের বার্তা। দিবারাত্রির মিলনক্ষণে দুইটি পরিবারের সংযোজন- বিয়োজনের সন্ধিক্ষণ। পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে আপনজনের চোখের জলে। মিহা মামার বুকে মিশে আছে। ক্ষণে ক্ষণে কেপে উঠছে পিঠ। আনোয়ার সাহেব চোখ বন্ধ করে কাপতে থাকা হাতে আদুরে কন্যার মাথা বুকে চেপে আছেন। বন্ধ চোখের কোল ঘেঁষে মাঝে মাঝেই দু’য়েক ফোটা অশ্রুকণা খসে পড়ছে। তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করছেন আটকাতে। কিন্তু বিয়োগান্তক হৃদয়ে সকল অনুভূতি শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। মিহা ক্ষণে ক্ষণে একটাই বুলি ফোপাঁতে ফোপাঁতে আওরাচ্ছে। দুটি মা এর সংযোজনে যার ডাক।
“মামা! মামা!”
পাশে ঠোঁট কামড়ে কাদছে শোভা। মিহা মাথা তুললো। মামার সিক্ত গালে হাত হাত বুলিয়ে দিলো। আনোয়ার সাহেবের শ্বাসকষ্টের আবির্ভাব হচ্ছে বুঝতে পেরে শিরীন বেগম তাকে ধরে কিছুটা দূরে বসিয়ে দিলেন। মিহা এগিয়ে গিয়ে নিজের একমাত্র বন্ধু এবং বোনকে জড়িয়ে ধরলো। শোভা শব্দ করে কেদে ফেললো। মিহা সেই আগের মতোই নিশব্দে নিংড়ে দিচ্ছে চোখের জল। নিশান্ত এগিয়ে এসে শোভার মাথায় হাত রাখলো। আশ্বস্ত করে বললো,
“কেদোনা শোভা। বোনের সাথে সাথে এখন একটা বড় ভাইয়াও আছে তোমার। এখন থেকে তোমারও দুইটা বাড়ি। যখন ইচ্ছা এই বড় ভাইয়ার বাড়িতে গিয়ে হাজির হবে।”
মিহা আশেপাশে মাকে খুজলো। পেলো না। সুমা বেগম রুমের ভেতর আছেন। কিছুক্ষন আগেই মেয়েকে জড়িয়ে কেদে মাথা ঘুরে গেছিলো তার। এখন মেয়ের সামনে আসার শক্তি পাচ্ছেন না তিনি। স্বামীর বাধানো একটা ছবির সামনে বসে এলোমেলো হয়ে চোখের জল ফেলছেন। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছেন বারবার। মিহা অনেকবার মামীর কাছে আবদার করলো মাকে আরেকবার নিয়ে আসতে অথবা ওকে যেতে দিতে। শিরীন বেগম দিলেন না। তিনি মিহাকে দুহাতে আদর করে নিশান্তের কাছে দিয়ে দিলেন। গাড়িতে ওঠার সময় নিশান্ত এক প্রকার বাধ্য হয়েই বললো,
“আর যদি কান্না করো, তাহলে এখানেই রেখে যাবো। দরকার নেই তোমার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার। মনে হচ্ছে নিজের বউকেই জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।”
ভারাক্রান্ত মনে বিদায়ী মুহূর্তে নিশান্তের থেকে এমন একটা কথা মিহা আশা করেনি। কয়েক মুহূর্ত কান্না ভুলে হতভম্ব হয়ে নিশান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। নিশান্ত হেসে ফেললো। বললো,
“এইতো কান্না থেমেছে। খবরদার আর কাদবে না। নাহলে কিন্তু এখানেই ফেলে যাবো। আমার কথার কিন্তু নড়চড় হবে না।”
মিহা হতভম্বতা বজায় রেখেই জলদি গাড়িতে উঠে বসলো। বলা যায়না, যদি সত্যিই ফেলে টেলে যায়!
পাশ থেকে অভি ও রাফাত হাসা শুরু করলো ওদের কান্ড দেখে।
বধু বরণ পর্ব শেষে মিহার হাত ধরে বসার ঘরে নিয়ে গেলো ফাইজা ভাবী। সে বিয়েতে যায়নি। যেহেতু প্রেগন্যান্সির আর্লি স্টেজ চলছে, ফাইজার শরীর হুটহাট খারাপ করছে এবং এই সময় মিসক্যারেজ হওয়ার ঝুকি বেশি। তাই বিয়ের কোনো ধকল বা দৌড়ঝাপ ওকে করতে দেওয়া হয়নি। নিশান্তের বসার ঘরে মিহা একবার চোখ তুলে দেখলো। বেশ রুচিশীল। এটা ওর শ্বশুর বাড়ি, ভাবতেই অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। অনেক অচেনা-অজানা মুখ ওকে দেখছে। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছে। মিহাও পরিচিত হচ্ছে। ওর চোখ আশেপাশে প্রিয়তমকেই খুজছে।কিন্তু নিশান্ত আশেপাশে নেই। বাড়িতে ঢোকার পরই সে উধাও হয়ে গেছে। ফাইজা ভাবী পাশে আছে বলেই যা স্বস্তিবোধ করছে।
মিহার ফ্রেস হওয়া দরকার বুঝে রাহেলা বেগম ভীড় ঠেলে পুত্রবধূকে নিয়ে গেলো ভেতরে। ফাইজা ভাবী মিহাকে নিশান্তের ঘরে নিয়ে গেলো। বললো,
“এই হচ্ছে তোমার স্বামীর ঘর। আজ থেকে তোমারও।”
মিহা চোখ বুলিয়ে দেখলো পরিপাটি একটা রুম তবে বাসর ঘরের কোনো সাজ-সজ্জা নেই দেখে অবাকও হলো। ফাইজা ভাবী ওকে চুপ থাকতে দেখে বললো,
“কি, অবাক হচ্ছো? সাজানো নয় বলে?”
মিহা উপর নিচ মাথা ঝাকালে সে আবার বললো,
“তোমার বর সাজাতে দেয়নি। কেনো দেয়নি সেটা নাহয় তার কাছ থেকেই জানবে। তুমি ফ্রেস হয়ে নাও, আমি তোমার বরকে ধরে আনি।”
ভারী শাড়ি-গহনা এবং মেকাপ তুলে একেবারে গোসল সেড়ে একটা হালকা শাড়ি পড়ে নিলো মিহা। এতোক্ষণেও নিশান্তের খোজ এলো না। খোজ পাওয়া গেলো আরো কিছুক্ষণ পর। মিহা ভেজা চুল মেলে দিতেই দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকালো। নিশান্তের হাসি মুখে ভেতরে প্রবেশ করলো। মিহার কাছে এসে বললো,
“খুব বেশি দেরি করলাম কি!”
মিহা গাল ফুলিয়ে বললো,
“আপনি এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন?”
“আমার দ্বিতীয় বাসরটা প্রিয়তমার মন মতো করার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলাম।”
“কিন্তু আপনি ঘরটাই সাজালেন না। আপনি তো বলেছিলেন, এতো ফুল থাকবে যে তাতে নিজেকে ঢেকে ফেলতে পারবো।”
নিশান্ত উত্তরে হাসলো। কিছুক্ষণ পর সারা বাড়িতে একটাই কথা ছড়ালো, বর বউ বাড়ি থেকে উধাও।
________
আকাশে আজ চাঁদ বা তারা কিছুই দেখা যাচ্ছে না।সব ঢাকা পড়ে গেছে মেঘের আড়ালে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। প্রকৃতিতে বৃষ্টি এখনো না নামলেও একজনের চোখের বৃষ্টি থামছেই না। নিস্তব্ধতা ভেঙে ক্ষণে ক্ষণে নাক টানার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ির ডান সাইডে ঝোপের দিকটায় চেয়ারে বসে আছে শোভা। এদিকটায় মানুষের আনাগোনা নেই। বাগানের লাল নীল আলোর ছটায় চারপাশ এখনো মুখরিত। শুধু বাড়ির মানুষগুলোর মাঝে আনন্দ নেই। আছে শুধু কাজ গোছানোর ব্যস্ততা। শোভার গায়ের লেহেঙ্গাটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। ও যেখানে বসেছে তার আশেপাশে টিস্যু পেপারের ছড়াছড়ি। একটু পর পর চোখ, নাক মুছে ছুড়ে ফেলছে পায়ের কাছে।
হুট করে সেখানে রিয়াদের আবির্ভাব ঘটলো। একটা চেয়ার এনে সে শোভার পাশে যায়গা করে বসে পড়লো। শোভা চোখ তুলে রিয়াদকে একবার দেখে আবার কান্নায় মন দিলো। যেন এর চেয়ে জরুরি কাজ দু’টো নেই।
“রাত হয়েছে অনেক। বৃষ্টিও নামবে বোধহয়। এইসময় এখানে বসে আছো কেনো?”
রিয়াদের প্রশ্নে শোভা উত্তর দিলো না। চোখ উঠিয়ে একবার তাকিয়ে আবার কান্না করতে লাগলো। রিয়াদ বিরক্ত হয়ে বললো,
“হয়েছে, আর কত কাদবে? মাথা ধরে যাওয়ার কথা এতোক্ষণে। তোমার মাথা ধরেনি?”
শোভা কান্নার মাঝেই ধমকে উঠলো,
“তাতে আপনার কি শুনি? আমি যতক্ষণ ইচ্ছা কাদবো। রাতভর কাদবো। আপনি যান আপনার মনের মানুষের কাছে।”
এবার শোভার কান্না আরো এক প্রস্থ বেড়ে গেলো। মিহার শোকের সাথে যুক্ত হলো রিয়াদের কালকে বলা মনের মানুষের খোজ পাওয়ার কথা।
“আচ্ছা কাদো। কিন্তু আগে আমার কথাটা শেষ করতে দাও।”
“আমার সাথে আপনার আবার কি কথা? আপনি যান আপনার মনের মানুষের কাছে।”
শোভা আরেকটা টিস্যু বের করে নাক মুছলো। ফেললো রিয়াদের পায়ের কাছে। রিয়াদ নাক-মুখ কুচকে পা সরিয়ে বললো,
“এসব কি করছো শোভা! নোংরা জিনিস এভাবে ছড়াচ্ছো কেনো? গায়ের ওপর পড়বে তো?”
“আমি তো নোংরাই। আপনার মনের মানুষ নিশ্চয়ই খুব পরিষ্কার। যান না, তার কাছে যান। এখানে কি!”
রিয়াদের মেজাজ বিগড়ে গেলো। কালকে মনের মানুষের মন পেয়ে গেছে কথাটা বলে বড্ড ভুল হয়ে গেছে। তারপর থেকে রিয়াদকে দেখলেই এই এক ডায়লগ দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। রিয়াদ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“কি সেই তখন থেকে মনের মানুষের কাছে, মনের মানুষের কাছে যান লাগিয়েছো! মনের মানুষের থেকে দূরে আছি নাকি?”
শোভা চোখ তুলে তাকালো। কান্না থেমে গেছে কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর আবার ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না জুড়ে দিলো। বললো,
“ওওওও, তারমানে সে আপনার আশেপাশেই আছে! তাহলে এখানে কি করছেন, মনের মানুষের কাছে যান।”
“আবার! আবারো সেই একই কথা? আল্লাহ, ধৈর্য দাও আমায়।”
রিয়াদ হাত মুঠ করে চোখ বন্ধ করলো। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজের রাগ সংবরণ করলো।
পায়ের উপর নরম কিছুর অস্তিত্ব পেয়ে শোভা তাকালো। টফি শোভার পায়ের উপর এক পা তুলে দিয়ে বসেছে। ওর মুখে একটা লাল গোলাপ। রিয়াদ সেটা টফির মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে শোভার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। অনবরত মুছতে মুছতে নাক লাল হয়ে গেছে। আশ্রুসিক্ত চোখের পাপড়িগুলো ভিজে গিয়ে আরো সুন্দর লাগছে দেখতে। মাথার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে অনেকটা। এলোমেলো রূপেও কি সুন্দর লাগে মেয়েটাকে। রিয়াদের মতো এতো টিপটপ ছেলে যে কিনা অগোছালো জিনিস পছন্দই করে না, সে কিনা আস্ত এক অগোছালো মেয়েতে আটকে গেলো। তার অগোছালো রূপেই কিনা ঘায়েল হয় বারবার। রিয়াদ গলা পরিষ্কার করে সিরিয়াস হলো। অনেক হয়েছে লুকোচুরি, আর না।
“দেখো শোভা, অনেক হয়েছে লুকোচুরি। এবার আমাদের সিরিয়াস হওয়া উচিৎ।”
“তো আপনার কি মনে হয় আমি মজা করছি? তাহলে যান না, যান। মনের মা…”
“আর একবার ওই কথাটা উচ্চারণ করলে তোমার একদিন কি আমার একদিন। কথা শেষ করতে দাও আমায়। এর মাঝে একদম কথা বলবে না।”
রিয়াদের ধমকে শোভা চুপ হয়ে গেলো। রিয়াদের হাতে গোলাপ দেখে মনের মাঝে এক ধরনের কৌতুহলও হচ্ছে বটে কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলো না। রিয়াদ আবার বললো,
“তুমি ছোট নও শোভা। কারো ইঙ্গিতপূর্ণ কথা ঠিকই বুঝতে পারো তুমি। আমার সামনে ইচ্ছে করে না বোঝার ভাণ ধরছো। আমি লাস্ট কয়েকটা দিন নানান ভাবে তোমায় মনের কথা বোঝাতে চেয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই তুমি উপেক্ষা করেছো। যেহেতু কাল ইন্ডাইরেক্টলি বলেছো প্রপোজ করলে মানবে তাই আমি এবার সরাসরিই বলছি।”
রিয়াদ হাতের গোলাপটা শোভার দিকে বাড়িয়ে দিলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি উড়নচণ্ডী।”
রিয়াদ থামলো। শোভার রিয়েকশন বোঝার চেষ্টা করে আবারো বলতে লাগলো,
“তোমার এই সাপের জীবনে বেজি হয়ে আসার আহ্বান করছি। টফির পার্মানেন্ট কেয়ারটেকার হয়ে আসার আহ্বান করছি। তোমার ইংলিশ আন্টির ইন্টারন্যাশনাল ফুড এক্সপেরিমেন্ট এর পার্মানেন্ট ফুড টেস্টিং জাজ হওয়ার আহ্বান করছি। আমার অবসর খুনসুটিতে মাতিয়ে রাখার আহ্বান করছি তোমায়।”
শোভা থ বনে বসে আছে। এইরকম একটা মুহূর্তে ঠিক কি রকম রিয়েকশন দেওয়া উচিৎ সে বুঝতে পারলো না। হাতের টিস্যুর বক্স মাটিতে পড়ে গেছে প্রপোজাল শুনে। হতভম্বতা ধরে রেখে বললো,
“এটা কি ধরনের প্রেম নিবেদন?”
“আমি এতো সিনেমেটিক ভাবে রোমান্টিক কথা বলতে পারি না। আমার পক্ষে যা সম্ভব, তাই বললাম।”
শোভা ফুসে উঠলো। বললো,
“ওহহ, রোমান্টিক কথা বলতে পারি না। তাহলে প্রেম করতে চাইছেন কেনো? প্রেম করলে যে রোমান্টিক কথা বলতে হয়, তা জানেন না!”
রিয়াদ হাসলো। প্রপোজ করার মধ্যেও ঝগড়া। এই নাহলে প্রেমের সূচনা। বললো,
“তুমি নাহয় শিখিয়ে দিয়ো। তাছাড়া ভালোবাসি বলেই প্রেম করতে হবে? কিছুদিন যেতে দাও, বাড়িতে বিয়ের কথা তুলবো। অন্তত এঙ্গেজমেন্ট করে রাখবো। এই নিয়ে কারো আপত্তি হবে না বুঝলে। আনোয়ার আঙ্কেল যে আমায় তার ছোট মেয়ের হবু জামাইয়ের নজরে দেখে, সেটা তার আচরণেই বুঝি আমি।”
শোভা মাথা চেপে ধরে বললো,
“এতো এতো সিদ্ধান্ত যে নিচ্ছেন, আমার মতামত জানতে চেয়েছেন একবারও। আমি রাজি কিনা সেটা না জেনেই সব ভেবে ফেলছেন!”
“তোমার মত না জানলে কি আর তোমার বাড়িতে এসে তোমায় প্রেম নিবেদন করছি? আগেই নিশ্চিত হয়েছি তুমি আমার প্রতি উইক। ইচ্ছে করে ঘোরাচ্ছিলে বলেই তোমায় জেলাস করতে গতকাল বলেছিলাম তার মন পেয়ে গেছি। কথাটা তো সত্যি। তুমি মুখে না বললেও তোমার মন পেয়ে গেছি।”
শোভা উঠে দাড়ালো। অভিমানী কন্ঠে বললো,
“ভুল জানেন আপনি। আমার মন মোটেও দেইনি কাউকে। আপনার জন্য আমার এক্সট্রা চোখের জল ফেলতে হয়েছে। পুরো একটা দিন কষ্ট পেতে হয়েছে। মানি না আপনার প্রপোজাল।”
শোভা চলে যাওয়ার জন্য পেছন ঘুরতেই ইংলিশ আন্টির মুখোমুখি হলো। ক্ষণেই জমে গেলো সে। ইংলিশ আন্টি সব শুনে ফেললো কি না সেই আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে উঠলো সে। রিয়াদ ওর দৃষ্টি অনুসরণ মাকে দেখে তরাক করে উঠে দাড়ালো। ইংলিশ আন্টি থমথমে মুখে উভয়ের দিকে দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে এলো কয়েক কদম। শোভার সামনে দাঁড়িয়ে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“আমাকে তুমি কি বলে ডাকো?”
শোভা তোতলাতে তোতলাতে বললো,
“জ জি, ইংলিশ আ আন্টি।”
“হুম গুড। বিয়ের পর আমায় কি বলে ডাকবে জানো?”
“জি না।”
“মম। আমি চাই, আমায় মম ডাকবে রিয়াদের বউ। তাহলে আমি তোমার কে হবো?”
“কে?”
“ইংলিশ শ্বাশুড়ি। তুমি আমায় ইংলিশ মম বলে ডাকবে, মনে থাকবে?”
“থাকবে।”
“গুড। এবার যাও, দুজনে প্রেম করো। বাই।”
ইংলিশ আন্টি ঠিক যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। শোভার হুস এলো রিয়াদের অট্টহাসিতে। শোভা খেয়াল করলো ওর ভীষণ লজ্জা লাগছে। কান গরম হয়ে উঠেছে। ইংলিশ আন্টি এভাবে বোল্ড আউট করবে শোভা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেনি। রিয়াদ শোভাকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত ধরে টেনে পুনরায় চেয়ারে বসালো। নিজের চেয়ার শোভার কাছাকাছি টেনে বসে হাতের গোলাপটা ওর হাতে গুজে দিলো। হেসে বললো,
“এই নাহলে আমার মা। গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গেছি। এবার কোথায় পালাবে তুমি!”
রিয়াদ শোভার হাত চেপে ধরলো। শোভা হাতের দিকে তাকিয়ে কয়েকটা ঢোক গিললো। এতো লজ্জা কেনো লাগছে বুঝতে পারছে না। রিয়াদ ঝুকে ওর কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিলো। শোভার মাথা আরো নিচু হয়ে গেলো। রিয়াদ মুচকি হেসে বললো,
“তোমায় কাল শাড়িতে ভীষণ মিষ্টি লেগেছে শোভা।”
শোভা অভিমানী কন্ঠে বললো,
“তাহলে বলেছেন কেনো ভালো লাগেনি?”
“কারণ আমার হৃদয় হরণীকে রাগাতে আমার বেশ লাগে। তখন তাকে দেখে মনে হয় আস্তো একটা রসগোল্লা।”
শোভা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নতুন অনুভূতির সাক্ষাৎ এতো দ্রুত চলে আসবে ভাবতে পারেনি সে। হঠাৎই রিয়াদের কোলে টফি ঝাপিয়ে উঠে পড়লো। রিয়াদের কোলে বসে শোভার হাত চাটতে শুরু করলো সে৷ রিয়াদ হেসে টফির মাথায় চুমু খেলো। বললো,
“তোর জন্য একটা মিষ্টি বউ এনে দেবো ভাবছি। আমাদের প্রেমের ঘটক তুই, তোর প্রেমের ঘটকও আমি হবো।”
টফি কথাটায় যে বেজায় খুশি হয়েছে সেটা লেজ নেড়ে বুঝিয়ে দিলো। রিয়াদ হেসে আবার শোভার দিকে মনোযোগ দিলো। শোভার লজ্জা রাঙা গাল দেখে বললো,
“এবারতো একটু তাকাও রে। তুমি যে এতো লজ্জাবতী আগে জানতাম না।”
কিছু মনে পড়তেই হুট করেই শোভা মাথা তুললো। রিয়াদের হাতে নখ বসিয়ে বললো,
“এই! আপনি না রোমান্টিক কথা বলতে পারেন না! তাহলে এখন কি করছেন?”
“আহ! নখ বসিয়ে দিলো, বেজি কোথাকার! তখন তুমি আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলে না, এখন গার্লফ্রেন্ড। তাই এখন অনেক কিছুই বলতে পারি যা তখন পারতাম না।”
“আসলেই আপনি দু” মুখো সাপ, বজ্জাত। হুহ! মানি না প্রেম। আমি আবার সিঙ্গেল হয়ে গেলাম।”
“দেখি কেমন সিঙ্গেল হতে পারো। এই যে হাত ধরলাম। নো ছাড়াছাড়ি।”
_________
নিশান্ত মিহাকে ওর বাবার বাড়িতে এনেছে। মিহা পিটপিট করে নিশান্তের দিকে তাকালো।
“আপনি আমার বাড়িতে কেনো এনেছেন?”
“কারন আমাদের দ্বিতীয় বাসরটা এখানে অর্থাৎ আমার শ্বশুর বাড়িতে হচ্ছে।”
“এখানে?”
“জি ম্যাম। চলুন ভেতরে।”
নিশান্ত মিহাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই মাথার ওপর ফুল ঝরে পড়লো। মিহা অভিভূত চোখে তাকাতেই দেখলো সারা ঘরে মোমবাতির কোমল আলো বিস্তৃত। হুট করেই রাফাত এবং অভি সামনে এসে দাড়ালো। অভি বললো,
“আপনার স্বামী আমাদের খাটিয়ে মেরেছে ভাবী। পুরো বাড়িটা সাজাতে অনেক কসরত করতে হলো। আশাকরি ভাবীর পছন্দ হবে।”
মিহা মাথা নিচু করে ঠোঁট টিপে হাসলো। রাফাত নিশান্তকে চোখ টিপে বললো,
“আজকের রাতটা ভালো কাটলে আশাকরি কালকে একটা গ্র্যান্ড ট্রিট পাবো আমরা।”
নিশান্ত তাড়া দিয়ে বললো,
“হয়েছে হয়েছে, এবার বাড়ি যা। কালকে ট্রিট হিসেবে পাড়ার মোড় থেকে কলিজা সিঙারা খাওয়াবো পেট ভরে।”
অভি আর্তনাদ করে বললো,
“সিঙারা? হাতির সমান কাজ করিয়ে খরগোশের সমান খরচ করলে তো চলবে না মামা। ভাবী, আপনিই বলুন এটা ঠিক?”
মিহা হেসে বললো,
“না, একদম ঠিক না।”
নিশান্ত চোখ ছোট করে বললো,
“তুমিও! আচ্ছা সে যাক। এখন তোরা বিদায় হ। মাহযাবীন, তুমি ভেতরে যাও।”
মিহা ভেতরে এগেলো। মোমবাতি এবং গোলাপ দিয়ে বানানো পথ অনুসরণ করে এগিয়ে গেলো। পথ শেষ হলো আগে যেই রুমটা মিহা ব্যবহার করতো, সেই রুমের দরজায়। মিহা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। সেই পুরোনো ঘর। পুরোনো ভালোবাসা। মিহা দেখলো প্রথম বাসর যতটা ফুলের স্বল্পতা ছিলো এবার ঠিক তার উল্টো। ফুলে ডুবে আছে রুমটা। মিহা গোলাপের পাপড়ির ওপর হেটে রুমে ঢুকলো। চোখ পড়তেই দেখলো বিছানায় একটা প্যাকেট রাখা। তারওপর একটা ছোট্ট চিরকুট। তাতে লেখা,
“আমার ফুলের মতো সুরভিত মাহযাবীনকে ফুলের সাজে উপহার চাই। এই মিষ্টি রাতে আমার মিষ্টি আবদারটা রাখবে!”
মিহা প্যাকেটটা তুলে নিলো। নিজেকে সাজালো মেরুন রঙের পাতলা ফিনফিনে শাড়ি এবং কাচা ফুলের গহনায়। সারা ঘর সোনালী আলোয় আবৃত।নিশান্ত যখন রুমে এলো মিহা খোলা চুল পিঠ ময় ছড়িয়ে দিয়েছে। একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো নিঃশব্দে। উভয়ের ঠোঁট ভাষাহীন তবে চোখ অনুভূতিপূর্ণ। নিরবতায় উষ্ণ নিশ্বাসে কিছু মুহূর্ত কাটার পর মিহা লজ্জায় জানালার কাছে ছুটলো। পেছনে ছুটলো নিশান্ত। মিহা জানালা মেলে দিতেই বুঝলো বাহিরে বৃষ্টি নেমেছে। বাতাসের আধিপত্য জানালা ঠেলে বিস্তার করতে লাগলো রুম জুড়ে। ঠান্ডা বাতাস মোমবাতির আলোকে গ্রাস করতে শুরু করলে মিহা এবার আর জানালা বন্ধ করলো না। নিশান্ত মিহার খোলা চুল একপাশে সরিয়ে ওর কানে মুখ লাগিয়ে বললো,
“আমাদের প্রথম দেখার সঙ্গী ছিলো এই বৃষ্টি। বিয়ের দিনও বৃষ্টি ছিলো। আমাদের ভালোবাসা খোলাসা হয়েছে বৃষ্টিমুখর দিনে। আর আজ এই ভালোবাসাময় রাতেও #শুভ্র_বর্ষণ সাক্ষী হতে এসেছে। প্রকৃতির শুভ্র বর্ষণে আমি প্রথম আমার মনের শুভ্র অনুভূতির আভাস পেয়েছি। সেই অনুভূতির #শুভ্র_বর্ষণ এ ভিজে আমি তোমায় পেয়েছি। প্রতিনিয়ত তোমাতে নিজেকে হারিয়েছি। হারাতে চাই বারবার, হাজারবার।”
মিহার থুতনি বুকের সাথে গিয়ে ঠেকেছে। নিশান্ত ওর থুতনি আজলায় ভরে নিলো। ঠোঁট কামড়ে হেসে প্রথম রাতের মতো আবার বললো,
“তোমাকে কি আমি জড়িয়ে ধরতে পারি মাহযাবীন?”
মিহা নিজে থেকেই ডুবে গেলো নিশান্তের বুকের ভেতর। মিশে গেলো স্বামীর স্পন্দনের সাথে। নিশান্ত দুইহাতে ওকে আকড়ে ধরলো শক্ত করে। কপালে চুমু খেয়ে কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললো,
“হৃদয়ের দখল দিয়ে আপনজন তো হয়েই গিয়েছি। আমার সাথে তোমার ভবিষ্যতের প্রতিটা পদচারণা নতুন হোক, শুভ হোক। শুধু এভাবেই ভালোবেসে ধরে রেখো সারাজীবন।”
___________সমাপ্ত__________
(আসসালামু আলাইকুম পাঠকগণ। আমার আরো একটি