প্রপর্ণ পর্ব ২১

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(২১)
#কুরআতুল_আয়েন

–“দিলেন তো আমার ফোনটার বারোটা বাজিয়ে।আরে আপা হিল পরে যদি হাঁটতেই না পারেন তো পড়েন কেন?”

জয়নব রাগে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে আছে।এমনেই রাগে তার মাথা অনেকটা চড়ে আছে।কাল থেকে বুরাগকে ফোন দিচ্ছে,বুরাগের কোনো রেসপন্স না পেয়ে সোজা অফিসে চলে এসেছে।এসেই বিপত্তি বাজলো,তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে সে নিজেই উল্টো গিয়ে পড়লো সামনে থাকা ব্যক্তিটির উপর।যার ফলে,ব্যক্তিটির হাতে থাকা ফোনটা টুপুত করে সাদা ফ্লোরটায় পড়ে যায়।

রায়ান মুখে একরাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে ফ্লোর থেকে ফোনটা তোলে নিলো।তখন জয়নব রায়ানের সাথেই ধাক্কা খেয়েছিলো।ফোনটা হাতে নিয়ে রায়ান আঁতকে উঠলো।ফোনের কাঁচটায় অনেক ফাটল ধরেছে।অবশ্য অনেকটা উপর থেকেই পড়ে গিয়েছিলো।উপুড় হয়ে পড়ে থাকায় ফোনের পিছন সাইড দেখতে পাচ্ছিলো।তবে রায়ান এইটা ঘুনাক্ষরেও ভাবে নি তার এতো শখের ফোনের তেরোটা বেজে যাবে।তখন না মজা করে বারোটা বলেছিলো এখন ফোনের করুণ অবস্থা দেখে রায়ান তেরোটা না বলে পারছে না।মুখটাকে কাঁদো কাঁদো করে বললো,

–“কি করলেন এইটা আপা!আমার ফোনের বারোটা না আপনি তেরোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।এক পয়েন্ট না দিয়ে পারলাম না।”

জয়নবের বিরক্তি ধরে গিয়েছে।পারছেও না রায়ানের সামনে থেকে সরে আসতে।কিছুটা ক্যাটক্যাট গলায় বললো,

–“কিসের আপা বলছেন আপনি আমাকে?আমাকে আপনার কোনদিক দিয়ে আপা মনে হয়?আপনিই তো দেখেশুনে চলতে পারেন না।হাঁটার সময় ফোনে চোখ দিয়ে রাখলে এইসবেই হবে।আর দোষ দিচ্ছেন আমাকে।আমার কথা গুলো ভালো করে কানে ঢুকিয়ে শুনে নিন।দোষ আমার না আপনার। ”

রায়ান মুখ হা করে জয়নবের কথা গুলো গিললো।পাশের ডেস্ক থেকে পানির বোতল টা নিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে একটা বড়সড় ঢেঁকুর তুললো।মুখটাকে বিস্তৃত করে বললো,

–“কানে না পেটে ঢুকিয়ে নিয়েছি।এতোক্ষণ গিলে খেলাম আপনার কথাগুলো।পরে দেখি গলায় ট্রাফিক জ্যামের মতো আটকে আছে।ট্রাফিক পুলিশের মতো কাজ করলো হাতে থাকা এই পানির বোতল টা।একদম জ্যাম ছুটিয়ে দিয়েছে।ইসস!একটা ভুল করে ফেলেছি আপনার কথা গুলো কানে ঢুকানোর এই উচিত ছিলো।তাহলে,কানে ময়লা হিসেবে অনেকদিন জমা থেকে যেতো।কিন্তু,এখন একটু পরেই মল হিসেবে কমোডে চলে যাবে।”

জয়নব আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো রায়ানের দিকে।নিজেই নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।রাগান্বিত গলায় চেঁচিয়ে বললো,

–“ফাজিল,বদ,ইতর কোথাকার।নিজে দোষ করে আবার পটর পটর করছে।”

জয়নব রায়ানকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গটগট করে চলে আসতে লাগলো।রায়ান ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো জয়নবের যাওয়ার পানে।কিছুক্ষণ পর ফোনটাকে উলোটপালোট করে দেখে সামনে হাঁটা ধরলো।গন্তব্য বুরাগের কেবিন।হাঁটছে আর গুনগুন করে গান গাইছে,
আমি ইতর,তুমি আমার সোনা বাঁদর।আমি বদ দুজনে মিলে একসাথে বসে খাবো মদ!লা লা লালালা লা..
যাক,আপার জন্য সুন্দর একটা গান শিখতে পেরেছি।আরো কয়েকটা লিরিক্স মিলিয়ে বাসর রাতে বউকে গেয়ে শুনাবো।
—-
আজাদ রহমান পেপারে মুখ গুজে বসে আছেন।আজকে অফিসে যাননি।গতকাল রাতেই উনি আর উনার ছোট ভাই আলামিন বাসায় এসেছেন ব্যবসার কাজ সেরে।তাই আজকে বুরাগ একাই অফিস গিয়েছে।অফিসের অনেক কাজ জমা হয়ে আছে তার উপর আবার মিটিংও আছে।

আফিয়া আজাদ রহমানের সামনে বসে আছেন।আফিয়ার মুখে মুচকি হাসির রেখা বিদ্যমান।বেলীর মা হওয়ার খবরটা শুনেই আজাদ রহমান সোফায় বসে পেপারে মুখ গুজে বসে রয়েছেন।আজাদ রহমান মনে মনে অনেকটা রাগ করেছেন বুরাগের উপর।উনি ভেবে পাচ্ছেন না কীভাবে জয়নবকে এই বাসার বউ করে আনবেন।তার উপর আবার বুরাগ বাবা হবে।পেপার সামনে ধরে থাকলেও উনি পেপারে মনোযোগ দিচ্ছেন না।মনে মনে শুধু এটাই ভাবছেন,ব্যবসার ক্ষতি আমি কিছুতেই হতে দিবো না।

আফিয়া জানেন,উনার স্বামী পেপারে চোখ রাখলেও মন উনার অন্যদিকে।কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকেও যখন আজাদ রহমানের পাত্তা পেলেন না তখন আফিয়া নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন।শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।দুপুরের খাবার তৈরি করতে হবে সবার জন্য।

বেলী আয়নার সামনে দাঁড়ালো।উল্টে পাল্টে নিজেকে দেখছে।একবার পেটে হাত রাখে তো আরেকবার কোমড়ে হাত রাখে।হাসি,খুশি দৌড়ে বেলীর কাছে এসে থামলো।দু’জনের দৌড় থেকে বেলী আয়না থেকে সরে আসলো কিছুটা ভড়কে গিয়ে বললো,

–“তোদের কিছু হয়েছে?এইভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন?”

হাসি,খুশি সটান করে বিছানায় বসে পড়লো।খুশি নিজের চুল টাকে ঘাড় থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো,

–“কে আগে দৌড়ে তোমার রুমে আসতে পারে তাই দেখছিলাম।কিন্তু,মাঝপথে এসে হাসি আমার জামা ধরে টান দেওয়ায় দু’জনে একসাথে তোমার রুমে ঢুকে পড়ি।না হলে আমিই ফার্স্ট হতাম।”

বেলী খুশির কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো।হাসি,খুশিকে এইভাবে দেখে অনেকটাই ভালো লাগছে তার।শিউলির মারা যাওয়ার পর কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে হাসি,খুশি।হুট করেই শিউলির কথা মনে পড়ে গেলো বেলীর।মুখটা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।সেই সাথে চোখে পানির টুইটুম্বুর।বেলী হাসি,খুশির থেকে চোখের পানি আড়াল করতে বারান্দায় চলে গেলো।বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিলে হাত দুটোর ভর ছেড়ে দিয়ে নিষ্পলক চেয়ে আছে আকাশের দিকে।দুপুরের আকাশ রৌদ্রে ঝলমলিয়ে উঠেছে।বেলীর তাকানোটাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।তাও,তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে।তারা খোঁজার চেষ্টা করছে।পরমুহূর্তেই বেলী বিরবির করে বলতে লাগল,কি বোকা তুই বেলী!দুপুরের আকাশে কি তারা দেখা যায় নাকি!তারা তো রাতের আকাশে দেখা যায়।রাতের কালো আকাশটায় নিজেদেরকে ছোট কূপবাতির মতো প্রকাশ করে তোলে।বেলীর গলা ছেড়ে কান্না করতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু,হাসি আর খুশির সামনে কান্না করে তাদের আনন্দ টাকে মাটি করতে চায় না।ঠোঁট কামড়ে কান্নাটাকে দমানোর চেষ্টা করছে।যার ফলস্বরূপ চোখের কার্ণিশ বেয়ে পানি গাল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
—-
রায়ান বুরাগের কেবিনে ঢুকে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।কেবিনে কেউ নেই।ওয়াশরুমে পানির আওয়াজ পেয়ে রায়ান বুঝে নিয়ে বুরাগ ওয়াশরুমে আছে।তাই সে নিঃশব্দে চেয়ারে বসে পড়লো।ফোনের করুণ অবস্থা মনে পড়তেই ফোন না নিয়ে টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট টা ঘুরাতে লাগলো।পেপার ওয়েট টার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।টেবিলের সামনে অর্ধেক খাওয়া কফিটা নিয়ে খেতে শুরু করলো।রায়ান ভেবে নিয়েছে এইটা বুরাগ খেয়েছে।বুরাগের এঁটো খাবার রায়ান নিঃসন্দেহে খেয়ে ফেলে।এইটা তার কলেজ লাইফ থেকে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।কফিটা ঠান্ডা হওয়ায় আরো তেতো লাগছে।তাও,সবটা খেয়ে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে মাথা এলিয়ে বসে রইলো।

মিনিট বিশেক পর বুরাগ বেরিয়ে আসলো।মাথার সামনের চুল গুলো ভিজে যাওয়ায় শার্টের বুকের দিকটাও ভিজে আছে।আকাশি রঙের শার্ট টা বুকে লেপ্টে আছে।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে রায়ানকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে কিছুই বলে নি।নিজের চেয়ারে বসে টিসু নিয়ে মুখ মুছতে লাগলো।টিসু নেওয়ার খঁচখঁচ শব্দ টা পেয়ে রায়ান চোখ খুলে বুরাগের দিকে তাকালো।বুরাগকে দেখে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে তাকিয়ে রইলো।

বুরাগ আড়চোখে রায়ানকে দেখছে আর একটা পর একটা টিসু ব্যবহার করে ঝুঁড়িতে ফেলছে।মাথাটা এমনেই গরম হয়ে আছে বুরাগের।এমনেই অফিসে একটার পর একটা মিটিং তারউপর এতোক্ষণ ধরে জয়নবের প্যাঁচপ্যাঁচানি।জয়নবের হাত থেকে বাঁচার জন্যই ওয়াশরুমে এতোক্ষণ সময় ব্যয় করে বসে ছিলো।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রায়ানকে দেখে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।আবার যদি জয়নব আসে তাহলে রায়ানের সাথে কথা বলার নাম দিয়ে জয়নবকে বের করে দিতে পারবে।

রায়ান দাঁত কেলিয়ে বললো,

–“তোর তরফ থেকে একটার পর একটা সুখবর পেয়ে আমি মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলছি।আমার মুখ থেকে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।যদি গান হিসেবে বলতে চাই তাহলে হবে,বুরাগের এক একটা সুখবর আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।”

পাশে থাকা পানির গ্লাস টা বুরাগ এক চুমুকেই সাবাড় করে দিলো।চুল গুলোকে পরিপাটি করতে করতে বললো,

–“জানতাম এইটাও তোর কানে যাবে।তোকে এইখানে আসতে দেখে তখনই বুঝে নিয়েছি।মা তোকে এইটা না বলে শান্তি পাবে না তাও আমি জানি।”

–“বুঝতে হবে এটাই আমার আন্টি।তুমি না বললেও তোমরা এক একটা খবর আমার কাছে আসে।যাক,অবশেষে চাচ্চু হবো।বাবা হই আর না হই চাচ্চু হবো এটাতেই অনেক খুশি।”

বুরাগ কিছু বলে না শুধু চুপ করে বসে আছে।রায়ান কিছুটা চিন্তিত সুরে বললো,

–“ভাবির বোনকে কে মেরে ফেলেছে তা কি জানতে পেরেছিস?”

–“কালপ্রিট কে তা তো আমরা জানি।এখন শুধু তাকে ধরার পালা।আশা করি পেয়ে যাবে পুলিশ।এইকাজে কোনো গাফিলতি দিতে না করেছি আমি।”

রায়ান কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ায়।শিউলির বিধস্ত মুখটা পেপারে ছাপানো হয়েছিলো।সেখান থেকেই রায়ান দেখেছিলো শিউলিকে।আর,তার আগেই বুরাগের মুখে শুনেছিলো এই নিউজ টা।শিউলিকে জীবন্ত অবস্থায় সামনাসামনি না দেখেও রায়ান শিউলির আঁচড়ের মুখটা দেখে বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেছিলো।বারবার শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিলো,একটাবার যদি শিউলির সাথে দেখা হতো তাহলে খুব আগলে রাখার চেষ্টা করতাম।কেন এই কথাটা বারবার মনে হয়েছিলো তা রায়ানেরও অজানা।

জয়নব ফোন টিপতে টিপতে পুনরায় বুরাগের কেবিনে ঢুকলো।বুরাগ জয়নব কে আবারও দেখে চোখ,মুখ কুঁচকে ফেলেছে।রায়ান পাশে তাকিয়ে জয়নব কে দেখে বড়সড় একটা টাসকি টুসকি খেলো।পরক্ষণেই ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,

–“আরে আপা যে!কি সৌভাগ্য আমার।”

জয়নব ফোন থেকে চোখ তোলে রায়ানের দিকে তাকিয়ে রাগে কিড়মিড় করতে লাগলো।রায়ানকে পাত্তা না দিয়ে পাশের চেয়ার টা টেনে নিয়ে বসে পড়লো।রায়ানকে এইখানে দেখে জয়নবের একদম ভালো লাগছে না।ভেবেছিলো একটু বুরাগের সাথে সময় কাটাবে।আগে,তো বুরাগ তাড়া দিয়ে উঠে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছিলো।তার কিছুক্ষণ পরেই একটা ফোন আসায় সেও উঠে বাহিরে চলে গিয়েছিলো।আর,ফোনকল শেষ করে এখন বুরাগের কেবিনে রায়ানকে দেখে অনেকটাই চটে আছে।
বুরাগ কাউকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।জয়নব ফোনটা হাত থেকে রেখে দিয়ে কফির মগ টা হাতে নিলো।মগ খালি দেখেই কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো।সে তো অর্ধেক খেয়ে গিয়েছিলো আর বাকি অর্ধেক গেলো কোথায় তাই ভেবে পাচ্ছে না।কফি ফেলে দেওয়ার মতো কোনো স্কোপ নেই এইখানে।
এপাশ ওপাশ তাকিয়ে জয়নব বুরাগকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“বুরাগ আমার বাকি কফিটা কোথায়?”

বুরাগ চোখ তোলে জয়নবের দিকে তাকিয়ে বললো,

–“মানে?”

–“আরে!আমি অর্ধেক খেয়ে গিয়েছিলাম বাকি অর্ধেক তো মগেই ছিলো।কিন্তু এখন দেখছি নেই।”

রায়ান জয়নবের কথা কর্ণপাত করেই সটান করে উঠে দাঁড়ালো।বমি আসার ভান করে দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।বুরাগ আর জয়নব কার্টুনের মতো তাকিয়ে রইলো রায়ানের দিকে।

কিছুক্ষণ পর রায়ান এলোমেলো হয়ে বের হয়ে আসলো।টি-শার্টের উপরে চেক শার্ট টা পানিতে ভিজে রয়েছে।এসির সামনে দাঁড়িয়ে বুরাগকে ক্লান্ত গলায় বললো,

–“এসির সবটা পাওয়ার দে তো ভাই।”

বুরাগ ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো,

–“দেওয়া আছে।”

রায়ান এসির বাতাসের সামনে হাত দুটো মেলে দাঁড়িয়ে আছে।যাতে,তাড়াতাড়ি করে ভিজা অংশ গুলো শুকিয়ে যায়।বুরাগ মিটিমিটি হাসছে।রায়ানের কান্ডকারখানা দেখেই বুঝে নিয়েছে আসল কাহিনির মূলভাব।বুরাগ তো রায়ানের ওই স্বভাবের সাথে পরিচিত।

জয়নব একবার রায়ানের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার বুরাগের হাসির দিকে তাকাচ্ছে।বুরাগের হাসি দেখে জয়নবের যায় যায় অবস্থা।মনে হয় এই প্রথম বুরাগকে হাসতে দেখেছে।বুরাগকে আবারও হাসতে দেখে জয়নব বললো,

–“তুমি হাসছো কেন বুরাগ?”

বুরাগ হাসি মুখেই জবাব দিলো,

–“কিছু না এমনেই।তোমার না জানাই ব্যাটার।”

জয়নব বুরাগের উত্তর পেয়ে কিছুতেই খুশি হতে পারলো না।ধপাধপ্ পা’য়ে রায়ানের সামনে এগিয়ে গেলো।বুকে হাত গুজে বললো,

–“আপনি এইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?এইটা কোনো সার্কাসের জায়গা না আর না এইখানে কোনো সার্কাস হচ্ছে।”

জয়নবের কথা শুনে রায়ান বুকে থুতু দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।জয়নবের কথার প্রতিত্ত্যুরে রায়ান কিছুটা রস মিশিয়ে বললো,

–“আপা আপনার কথা বলার ধরণ যেমন তেতো ঠিক একইভাবে কফিটাও তেতো ছিলো।তেতো কেন বুঝতে পেরেছি,আপনার বাহারি রকমের লিপস্টিক লাগানোর ঠোঁটের ছোঁয়া ছিলো তো তাই।এতোক্ষণ সময় ব্যয় করে বমি করার প্রচেষ্টা চালালাম কিন্তু বমি আসলো না।পরে নিজেই নিজের মাথায় গাট্টি মেরে বললাম,আরে এই তেতো কফিটা তোর ইউরিনের সাথে হলুদ বর্ণ হয়ে বের হয়ে যাবে।একটু তফাৎ হবে আর কি,কালো থেকে হলুদ রঙ ধারণ করবে।”

–“তার মানে কফিটা আপনি খেয়েছেন।আর খেয়ে কিসব লেইম কথাবার্তা বলছেন।অসহ্যকর মানুষ আপনি।আজকের দিনটাই খারাপ আমার।”

জয়নব ফোন নিয়ে দ্রুত গতিতে কেবিন থেকে বের হয়ে আসলো।রায়ান এখনো সোফায় বসে আছে।বুরাগ আর না পেরে শব্দ করে হেসে উঠলো।
—-
বেলী বাচ্চাদের মতো বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে।চারপাশে সব বই পড়ে রয়েছে।বুরাগ ছাদ থেকে নেমে সোজা রুমে ঢুকে পড়লো।ছাদে গিয়েছিলো সিগারেট খাওয়ার জন্য।বেলী এখন কোনো কিছুর গন্ধই নিতে পারছে না।আজকে অনেকবারই বমি করেছে।তাই বুরাগ ছাদে গিয়ে নিজের মতো সিগারেট টেনে এসেছে।তাও আবার কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করে।একটা চকলেট আর সেন্টার ফ্রেশ খেয়ে রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরেছিলো।

বেলীকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে বুরাগ দরজার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।বেলীর দিকে একমনে চেয়ে আছে।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে বেলীকে।বেলী শাড়ি বাদ দিয়ে একটা লম্বা সিল্কের ফ্রক পড়ে আছে।বেলীকে বেশ ছোট ছোট লাগছে।বুরাগ বেলীকে দেখছে আর মনে মনে আওড়াচ্ছে,
মেয়েটাকে এতো ছোট ছোট লাগছে কেন?মনেই হচ্ছে না মেয়েটা মা হবে।

বেলী কলম কামড়াচ্ছে আর একটার পর একটা বই উল্টে পাল্টে দেখছে।পড়ার প্রতি আর কোনো অবহেলা করতে চাইছে না সে।বুরাগ ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে শব্দহীন ভাবে হেঁটে আসলো বেলীর কাছে।বেলীর পিছনে এসে বসে বেলীকে জড়িয়ে ধরলো।বেলী বুরাগের ছোঁয়া,উপস্থিতি বুঝতে পারলেও তার মন এখন পড়ায় মনোনিবেশ করে আছে।বুরাগ বেলীর কাঁধে থুঁতনীটা রেখে দিয়ে তাকিয়ে আছে বেলীর মুখের দিকে।বেলীর গালে চোখ পড়তেই বুরাগ নিজেকে আর সামলাতে না পেরে গালে কামড় বসিয়ে দিলো।কামড় টা একটু জোরেই দিয়েছে বুরাগ।কামড়ের তেজ মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলতেই বেলী বুরাগের থেকে ছিটকে সরে আসলো।গালে হাত বুলাচ্ছে আর দাঁতে দাঁত চেপে বলছে,

–“রাক্ষস একটা!আমার গাল কি খাওয়ার জিনিস নাকি।আপনাকে আর বিশ্বাস নেই।আমার পড়ার মুড টাই নষ্ট করে দিয়েছেন।এখন,আমাকে হাসি,খুশির রুমে গিয়ে পড়তে হবে।আর মা’কে বলে আলাদা একটা রুম নিয়ে নিবো।আপনার সাথে থাকলে আবার না জানি কখন কামড় দিয়ে বসেন।আপনার থেকে সেইফ থাকতে হবে আমাকে,সেই সাথে আমার বাচ্চাকেও।”

বেলী কথাগুলো বলে মুখ ভেঙচি মেরে চলে গেলো।বুরাগ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো বেলীর যাওয়ার দিকে।বুরাগ কতোক্ষণ নিজেকে বকে নিয়েছে।আবার মনে মনে ভাবতে লাগলো,একটা কামড়ের জন্যই রুম ছাড়া হয়ে গেলো!আগে তো কতো কামড়িয়েছি,কই তখন তো এমন করে নি।কিছু কি হয়েছে বেলী।ধুর!বেলীকে ছাড়া আমি থাকবো কি করে।এখন গেলে জীবনেও আসবে না যে রূপ দেখিয়েছে।ঘুমানোর পর না হয় চুপচাপ নিয়ে আসবো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here