#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_নায়া_মনি
#পর্ব১৩
নিস্তব্ধ মধ্য রাত এখন।অন্ধকার রুমে চাঁদের আলো নিভো নিভো করছে।ডান পাশে উন্মুক্ত গায়ে আরামে ঘুমিয়ে আছে স্পর্শ। বাম পাশেই বাচ্চাদের মতো স্পর্শের মুখ ফিরে ঘুমিয়ে আছে জেরিন।গায়ে পাতলা ঘুমানোর জামা।নিস্তব্ধ পরিবেশে আকাশে দেখা গেলো ঘন কালো মেঘ।মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে।দু-একবার মেঘের গর্জন হতেই ঘুম থেকে চমকে উঠে জেরিন।আতকে চেপে ধরে স্পর্শের হাত।ঘুমন্ত স্পর্শ কপাল কুঁচকে চোখ মেলার চেষ্টা করে।ভিতু জেরিনের মুখ দেখে স্পর্শ কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বলে,
—-“কী হয়েছে জেরি?আপনি ঠিক আছেন তো?”
জেরিনের হুশ হতেই হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে বসে।ঢোগ গিলে খোলা জানালা ঈশারা করে নিচুস্বরে বলে,
—-“মনে হচ্ছে ঝড় উঠেছে।আমি জানালা দিয়ে আসছি।”
—-“কিন্তু আপনি…”
স্পর্শের কথা না শুনেই জেরিন ভিত পায়ে উঠে দাঁড়ায়।প্রচুর বাতাসে জেরিনের গাল ছুঁয়ে থাকা চুল গুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। দক্ষিণের দুটো জানালা লাগাতে উদ্বেগ নিতেই বেশ জোরেই মেঘের শব্দ হলো।ভয়ে চাপা চিৎকার করে দুহাতে কান চেপে ধরে জেরিন।স্পর্শ দ্রুত পায়ে জেরিনের পিছনে এগিয়ে আসে।কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পিছন থেকে জোড়িয়ে ধরে স্পর্শ। উদাম বুকে শরীর স্পর্শ হতেই সব ভয় সরে যেয়ে থম মেরে গেলো জেরিন।বরফের মতো শিতল হয়ে গেছে জেরিন।বুকের ভিতর ডিপডিপ শব্দ শুরু হয় দুজনের।মৃদু অস্থিরতা ঘিরে ধরে দুজন কে।স্পর্শ অপ্রস্তুত জেরিনের কোমর আলতো ছুঁয়ে দিতেই কেপে উঠে সে।স্পর্শ শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
—-“ঠিক আছেন আপনি?”
স্পর্শের কথায় মৃদু কেপে উঠে জেরিন।স্পর্শের বুক থেকে মুখ তুলে চোখ নামিয়ে নিচুস্বরে বলে,
—-“আমি, আমি ঠিক আছি। ”
খোলা জানালা বেদ করে এক ঝাক বৃষ্টির পানি ভিজিয়ে দিলো দুজন কে।এসিতে জেরিনের কাশি দেখে স্পর্শ গায়ের জামা খুলে জানালা মেলে দিয়ে ছিল।এখন বৃষ্টির পানিতে সেই উন্মুক্ত বুক ভিজে একাকার।দ্রুত স্পর্শ কে ছেড়ে জানালা বন্ধ করে দিলো জেরিন।কিন্তু এর মাঝে সে আধভেজা হয়ে গেছে।
.
.
.
.
সকাল সকাল ভেজা চুলে জেরিনকে কফির মগ হাতে রান্না ঘরে দেখে সন্দিহান চোখে তাকালো নাজমুন বেগম।গায়ের জামাটা বদলে গেছে দেখে বেশ উশখুশ করতে লাগে।নিশ্চুপ হয়ে দুটো কফির মগ হাতে নিজের রুমের দিকে পা দিতেই সেলিনা কে দিয়ে প্রশ্ন করালেন নাজমুন বেগম,
—-“জেরিন কফি কার জন্য?”
জেরিন রুমের দরজায় থেমে বলে,
—-“স্পর্শের জন্য মামি।রাতে গায়ে পানি দেওয়াতে একটু ঠান্ডা ভাব হচ্ছে। তাই কফি দিচ্ছি উনাকে।”
সেলিনা হাল্ক কেশে বলেন,
—-“আর অন্য কফির মগ?”
জেরিন আগের মতোই বলে,
—-“আমার জন্য মামি।”
জেরিন আর কথা বলল না।সচেতন পায়ে রুমে প্রবেশ করে।সেলিনা কিছুটা ব্যস্ত হয়ে বলেন,
—-“নাজমুন, ওদের মাঝে তো সব সম্পর্ক হয়ে গেছে।স্পর্শের চলা ফেরা আর জেরিনের ভাবে তো মনে হচ্ছে, দুদিন পর বলবে তুই নানি হচ্ছিস।”
নাজমুন বেগম চোখ রাঙিয়ে বলেন,
—-“বললেই হলো নাকি?বাচ্চাতো হাসানেরই হবে।”
—-“তুমি বললেই কি হাসানকে বাবা করতে পারবে?এতো বড় পরিবারে জেরিন বউ হওয়ার পরও মা হিসেবে তোমার সন্দেহ। হাসানের মতো নিচু মানুষিকতাই ঠিক আছে তোমার জন্য।”
জসীম সাহেবের এমন কঠিন কথায় বেশ ধাতুস্থ হলেন নাজমুন বেগম।সেলিনা দ্রুত কাজে হাত লাগিয়ে কেটে পরে।দরজায় বেল হতেই নাজমুন বেগম কেমন খুশি খুশি হয়ে ছুট লাগান।জসীম হাসেব সন্দিহান কন্ঠে বলেন,
—-“এই সকাল সকাল কে এলো? ”
নীল রঙা পাঞ্জাবি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসান। নাজমুন বেগম হাসি দিয়েই বলেন,
—-“আসো বাবা, কেমন আছো?”
হাসান সালাম দিয়েই দাত বেড় করে হেসে বলে,
—-“আপনি আসতে বলেছেন তাই ভালোই আছি।”
নাজমুন বেগম আদর করে হাসান কে ভিতরে আনলো।জসীম সাহেব সকাল সকাল এই লোককে দেখেই বিরক্ত হলেন।হাসান সালাম দিতেই জসীম সাহেব বিরশ মুখে উত্তর দিলেন সালামের।
স্পর্শ বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে আছে।মাত্র সাদ কে কল করে জানিয়েছে আজ অফিসে সে আসবে না।জেরিন কফির মগ সামনে ধরে মৃদু গলায় বলে,
—-“কফি!”
স্পর্শ হেসে কফির মগ হাতে তুলে বলে,
—-“ধন্যবাদ মিস, সরি মিসেস মেহরাব।”
জেরিন চোখ নামিয়ে নিচুস্বরে বলে,
—-“রাতে আমার জন্য গায়ে পানি দিতে হলো আপনার।”
স্পর্শ কফির মগে চুমুক দিয়ে তৃপ্তি জানিয়ে বলে,
—-“কফিটা আপনি বানিয়েছেন তাই না?একদম আমার মায়ের মতো হয়েছে।”
জেরিন ঠোঁট কামড়ে হাসার চেষ্টা করে স্পর্শের বরাবর পা ভাজ করে বসে।কফির মগে আলতো চুমুক দিয়ে বলে,
—-“মাঝে মাঝে মাথা ধরলে কফি বানাই।আসলে কয়েক বছর ধরে যত্ন, ভালবাসা পাইনি।”
স্পর্শ ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় বলে,
—-“সারা জীবন ভালবাসার মতো যদি একটা পরিবার পেতে একটু খারাপ থাকেন সেটা মন্দ না।জানেন,আমার মা অনেক মডেল টাইপ কিন্তু একদম সরল মনের।আমার ভাইয়া এতো বন্ধু প্রিয় না দেখলে বুঝবেন না।”
জেরিন বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে,
—-“সবাই খুব ভালো তাই না?অবশ্য আপনার মতো ছেলে নিশ্চয় অনেক সম্মানিত এবং সৎ মানুষের সন্তান।”
দুজনের কথার মাঝে বসার ঘর থেকে হাসা-হাসির শব্দ হচ্ছে।নাজমুন বেগনের কন্ঠের সাথে অপর কন্ঠে আলতো কানে লাগতেই কেপে উঠে জেরিন।ভয়ে স্পর্শের হাত ঘামচে ধরে।স্পর্শ বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
—-“কী হয়েছে? ”
জেরিন ভিতু চাহনিতে কাপা কাপা গলায় বলে,
—-“সেই লোকটা, সেই লোকটা। ”
জেরিনের কথার মানে কিছুই বুঝলো না স্পর্শ। মিনিট দু-এক হতেই কাজের মেয়ে বাইরে থেকে বলে,
—-“আফা মনি হাসান ভাই আসছে।”
এই কথাটা শুনেই স্পর্শের কপালে ভাজ পরে যায়।জেরিনকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-“পাগলি আমি তো সাথেই আছি।স্পর্শ মেহরাবের সামনে কেউ আপনাকে ছুঁয়ে ও দেখবে না।”
__________________________
মুখোমুখি বসে আছে স্পর্শ এবং হাসান।বার কয়েক স্পর্শ কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বিষম খেলো হাসান।স্পর্শের পাশেই গুটি মেরে শক্ত করে স্পর্শের হাত ধরে বসে আছে জেরিন।নাজমুন বেগম হরেক রকম নাস্তায় বসিয়ে রেখেছে হাসান কে।দৃশ্যটা দেখে স্পর্শ মুখ চেপে হাসলো।লতিফ সাহেব বেশ রয়েসয়ে বল্বন,
—-“হাসান কেমন আছো , কী অবস্থা?”
হাসান জেরিনের দিকে ক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে বলে,
—-“এই আছি এক রকম।আপনাদের মেয়ে ভালো রাখলো কই!”
জেরিন স্পর্শের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।নাজমুন বেগম ঠেস মেরে বলেন,
—-“কারো মনে কষ্ট দিয়ে কি ভালো থাকা যায়? তুমি চিন্তা করো না বাবা।ধৈর্যের ফল তুমি পাবে। ”
স্পর্শ নিঃশব্দে হেসে শান্ত গলায় বলে,
—-“ম্যাডাম,একটা কথা ঠিক বলেছেন।ধৈর্য ধরলে ফল পাবে।জেরিন যেভাবে আমাকে পেয়েছে।”
হাসান রাগে গম্ভীর চোখে তাকায়।লতিফ সাহেব কিছু বলতে যেয়েও পারলেন না।জেরিন ফ্যালফ্যাল চোখে স্পর্শের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলে,
—-“সত্যি কী তাই?”
স্পর্শ আলতো কন্ঠে বলে,
—-“আমার মতো কাজ পাগল ছেলে যেমন মেয়ে চাই ছিল সেই মেয়ে জেরিন।ভাবতেই অবাক লাগে আমি এই মেয়েটার জীবনে সব থেকে গুরুত্ব পূর্ণ। ”
নাজমুন বেগম কিছুটা শক্ত গলায় বলে,
—-“নিজে নিজে বিয়ে করলেই সংসার হয় না।হাসান এখনো জেরিনের স্বামী।শুধু তুলে দেওয়াই বাকি এখন।”
জেরিন ভিত চোখে স্পর্শের দিকে তাকায়।জসীম সাহেব সবার কথা শুনে বলেন,
—-“আমি জেরিনের বাবা এবং সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে আমার।আমি সেদিন বলেছি হাসান, জেরিন পালিয়ে গেছে এই বিষয় কথা হবে না আমার।তোমাদের ব্যবস্থা আমি আগেই করেছি।তবুও জেরিন কে বউ হিসেবে চাইলে সম্পূর্ণ নাজমুনের আর তোমার কাহিনী। ”
স্পর্শ জেরিনের বাম হাত নিজের হাতের ভিতর নিয়ে হেসে বলে,
—-“বাবা সব বলেই দিয়েছে। আশা করছি আমাদের সংসার শুরু হতে কেউ আটকাবে না।”
#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব১৪
ভাব মারতে এসে স্পর্শের কথায় যে এতো অপমান হবে আশা করেনি হাসান। নাজমুন বেগম কথার আগা মাথা খুজতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।লতিফ সাহেবের স্ত্রী প্রসঙ্গ পাল্টে জেরিন কে বলেন,
—-“স্পর্শ তো এখনো নাস্তা খায়নি। ছেলেটা কে একটু নাস্তা দেওয়া উচিত।”
জেরিন সম্মতি জানিয়ে বলে,
—-“হ্যা, আমি নাস্তা দিচ্ছি এখনি।”
জেরিন উঠে দাঁড়ায়।দু পা সামনে দিতেই স্পর্শ পিছু ডেকে হাসার চেষ্টা করে বলে,
—-“ওগো শুনছো? কফিতে না কাজ হয়নি। যদি কড়া করে চা দিতে, খুব ভালো হতো।মা ও মাথা ধরলে দিতো। ”
জেরিন প্রথমে বিস্মিত এবং পরে শিহরিত হলো।’ওগো শুনছো’ শব্দটা কানে প্রতিধ্বনি হতে লাগে।গাল জুড়ে লাল আভা ভর করে। এখানে আরো মানুষ বসে আছে তা জেনো কয়েকে সেকেন্ডের জন্য ভুলেই গেছে জেরিন।লজ্জা ভরা মুখে বলে,
—-“এখনি আনছি, আপনি বসুন এখানে।”
নাজমুন বেগম পাল্লা দিয়ে বলেন,
—-“হাসানের জন্য ভালো করে দুধ চা নিয়ে এসো।”
কথাটা জেরিনের কানে আদৌ কী গেছে, জানা নেই।জেরিন দ্রুত পায়ে রান্না ঘরে চলে গেলো।মিনিট পাচ হতেই কড়া করে রং চা হাতে এগিয়ে আসে জেরিন।চায়ের কাপ চোখের সামনে ধরতেই স্পর্শ মৃদু হেসে বলে,
—-“ধন্যবাদ! ”
—-“একি তুমি হাসানের জন্য চা আনলে না?তোমাকে আমি কেনো পাঠিয়েছি হ্যা?”
নাজমুন বেগমের শক্ত গলা শুনে চমকে উঠে জেরিন।ভিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-“আমি শুনতে পাইনি।”
সেলিনা মৃদু হেসে বলে,
—-“যার জন্য আনা প্রয়োজন তার জন্য তোএনেছে।”
নাজমুন বেগম মুখ কালো করে নিলেন।হাসান বেশ জেদি চোখে জেরিনের দিকে তাকালো।জেরিনের সেদিকে বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।স্পর্শ চায়ে চুমুক দিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলে,
—-“আমি যতদূর জানি জেরিন রং চা খুব ভালো বানায়।সত্যি বলতে প্রয়োজনে উপকার করার সব কিছুই সে পারে।”
জেসমিন বসার ঘরের কাছে এসে হাসান কে দেখে বেশ অবাক হলো।বিস্মিত চাহনি নিয়েই সে সোফায় এসে বসে।জেরিনের পাশে বসে হাসানের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।জসীম সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
—-“জসীম ভাই আপনার শরীর এখন কেমন?কাল রাতের বুকে ব্যথা কমেছে?”
জসীম সাহেব কিছু বলার উদ্বেগ নিতেই স্পর্শ কিছুটা সিরিয়াস মুখে বলে,
—-“বাবা কাল আপনার বুকে ব্যথা হয়েছিল আমাকে বলেন নি কেনো?”
জসীম সাহেব হাসার চেষ্টা করে বলেন,
—-“তেমন কিছু না শুধু একটু বুকে ব্যথা।”
হাসান ফোড়ন কেটে ভাব মেরে বলে,
—-“মনে হয় অনেক বড় ডাক্তার যে তোমাকে বলবে।উনার বুকে ব্যথা হলে ওষুধ আছে,আমি আছি, আমরা আছি।”
স্পর্শ জসীম সাহেবের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলেন।জসীম সাহেব কিছুটা শক্ত গলায় বলেন,
—-“ওষুধ আছে আর আমরা আছি এটাই ঠিক আছে।এই আমি আছি বা আমরা আছির মাঝে তোমাকে না রাখলেই আমি খুশি হবো।”
স্পর্শ হাসার চেষ্টা করে বলে,
—-“মাঝ রাতে জেরিন বলেছে, আপনার হার্টে সমস্যা আছে।এই বয়সে ভালো ডাক্তার খুবই প্রয়োজন।”
লতিফ সাহেব এই বিষয় সম্মতি জানিয়ে বলেন,
—-“সব বিষয় তর্ক বা দোষ খুঁজলে হয় না।জসীম তোমার ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত।”
জেরিন নিচুস্বরে বলে,
—-“আব্বু ডাক্তার দেখানো দরকার। ”
নাজমুন বেগম বেশ শক্ত ভাবে বলেন,
—-“ডাক্তার দেখিয়ে লাভ কী?তোমার জন্য কী ভালো থাকতে পারে?মানুষটা চিন্তায় শেষ হয়ে গেছে।”
জেরিন বেশ লজ্জিত এবং অপরাধী চোখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।স্পর্শ সম্পূর্ণ চা খেতে পারলো না।চায়ের কাপ টি টেবিলে রেখে ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে।জেরিনের বুক ভারি হয়ে আসে।মাথা নিচু করে আস্তে করে উঠে রুমে চলে গেলো জেরিন।স্পর্শ সবার দিকে একবার তাকিয়ে গম্ভীর মুখে রুমে চলে গেলো।জেসমিন মৃদু প্রতিবাদ করে বলেন,
—-“নাজু তোর এই কাজটা ঠিক হয়েছে?নতুন জামাইয়ের সামনে এভাবে না বললে হতো না?মেয়েটার সাথে স্পর্শ ও উঠে গেলো।”
হাসান নাজমুন বেগমকে উস্কে বলে,
—-“আম্মি তো ঠিকই বলেছে।উনি কী কম অপমানিত হয়েছে জেরিনের জন্য?বিন্দু মাত্র ভদ্রতা নেই। নিশ্চয়ই রাস্তার কোনো ছেলেকে ধরে আনছে।তা নাহলে কোন পাগলে এমন মেয়ে নিবে?”
কথা এবার সেলিনার কাছেও কাটার মতন বিধলো।গরম গলায় বলেন,
—-“তোমার কাছে পাগল হতে পারে কিন্তু স্পর্শের কাছে অনেক দামি।তুমি এখানে বসে নাজমুন কে সম্মতি দিচ্ছো। আর ওদিকে স্পর্শ জেরিনের কষ্টের মাপ বুঝে গম্ভীর মুখে ওর সাথে রুমে গেছে।তুমি ওর পরিবারের সামনে পাগল আর অভদ্র বলতে পারলে বাইরের মানুষের কাছেও বলতে পারো।”
হাসান দাতে দাত চেপে বলে,
—-“সত্যি কথা বললেই খারাপ না?ওরে ভালো বললেই আমি ভালো নাকি?”
জসীম সাহেব ধমকের সুরে বলেন,
—-“অনেক হয়েছে আর না।তোমাকে নাজমুন আসতে বলেছে আমরা না।ওর সাথে বসে যা বলার বলে খেয়ে বিদায় হও।”
কথাটা বলেই জসীম সাহেব উঠে রুমে চলে গেলেন।হাসান অপমানে নাজমুন বেগম কে কিছু বলবে তার আগেই নাজমুন বেগম ও উঠে গেলেন।
.
.
.
.
জানালার পাশে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।ঘড়িতে সবে দশটা বাজে।দক্ষিণের জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে এক দল বাতাস এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে।বাড়ির সামনের পিচঢালা চকচকে বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া ফুল ঝরে আছে।চোখের দৃষ্টি স্তির সেখানেই জেরিনের।বুকে মৃদু যন্ত্রণা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।গম্ভীর মুখে ঠিক জেরিনের পাশেই এসে দাঁড়াল স্পর্শ। জেরিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও রাস্তায় ঝরে থাকা ফুলের দিকে চাইলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর মুখে বলে,
—-“দুঃখিত আমার জন্য আপনাকে কথা শুনতে হলো।”
স্পর্শের কন্ঠ পেয়ে কিছুটা চমকে পাশে তাকালো।কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে আগের মতো রাস্তায় চোখ রেখে থমথমে গলায় বলে,
—-“আমি দুঃখিত। আপনাকে এভাবে এখানে আসতে বলা উচিত হয়নি আমার।একটা অচেনা মেয়ের জন্য অপমানিত হচ্ছেন।আমি ভুলে যাই আমার মতো মেয়ের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।আমার এদিকেও আশ্রয় নেই আর ওদিকেও নেই।যা আছে সবই কঠিন শব্দ আর অবহেলা।”
স্পর্শের বুকে জেনো খুব তীরের মতো বিধলো প্রতিটা কথা।চোখ বড় করে মৃদু অস্থির গলায় বলে,
—-“কী বলছেন আপনি?আপনি কী সত্যি অচেনা মেয়ে?স্পর্শ মেহরাব অচেনা মেয়ের জন্য এভাবে অন্যের বাড়ি এসে থাকবে এটা ভাবাও কল্পনার বাইরে।সে যদি থাকে তাহলে শুধুই তার সব চেয়ে জেনা মানুষটার জন্য।”
জেরিন এবার ফ্যালফ্যাল চোখে স্পর্শের দিকে তাকালো।মিনিটেই বুক ভারি হয়ে এলো।ধরা গলায় বলে,
—-“আমিও বাচতে চাই কিন্তু আমাকে দিচ্ছে না কেও।আমি সত্যি আব্বুকে চিন্তায় রেখেছি।মাঝে মাঝে মনে হয় আমি না থাকলে সবাই ভালো থাকবে।কোনো ঝামেলাই থাকবে না।মরে গেলে তো আমাকে ভুলেই যাবে সবাই।”
স্পর্শ স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে জেরিনের গালে দুহাত রেখে বলে,
—-“আপনাকে বলে ছিলাম এমন কথা বলবেন না আর।আপনার জীবন যে এখন অন্য কারো সাথে জড়িত।আমি যতদিন আছি নিজেকে দুর্বল ভাবলে চলবে না।সত্যি হোক বা মিথ্যে, মেহরাব পরিবারের বউরা চোখ উঁচু করে চলে।তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি।ইচ্ছেকৃত বা অনিচ্ছাকৃত আমাদের মাঝে একটা সম্পর্ক আছে আর থাকবে।”
জেরিনের চোখ থেকে টুপ করে দুফোটা পানি গড়িয়ে পরলো।স্পর্শ ডান হাতে তা মুছে শান্ত গলায় বলে,
—-“আমার বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে।আপনি কী যাবেন আমার সাথে?”
জেরিন নাক টেনে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।কিছু সময়ের মাঝে স্পর্শ শার্ট এর বোতাম লাগাতে লাগাতে রুমে প্রবেশ করে ভ্রু উঁচিয়ে ভালো করে সামনে থাকা রমণিকে দেখে।কাধের এক পাশে বেনি করা।হলুদ আর সাদার মিশ্রনে লং কামিজ আর ব্লু জিন্স পরে জেরিন আয়নায় নিজেকে দেখছে।অদ্ভুত ভাবে আজ অন্য রকম সুন্দর লাগছে।জেরিন সাইড ব্যাগ কাধে তুলে স্পর্শের দিকে ফিরতেই কিছুটা চমকে যায়।সাদা শার্ট আর কালো জিন্স পরিহিত স্পর্শ কে বিড়বিড় করে জেরিন বলে,
—-“মাশাল্লাহ! ”
শার্ট এর হাতা ফোল্ড করে স্পর্শ ভালো করে দেখে বলে,
—-“আজ অদ্ভুত লাগছে আপনাকে।অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।”
জেরিন চোখ নামিয়ে নিচুস্বরে বলে,
—-“আমার ও তাই মনে হচ্ছে।”
স্পর্শ আরো গভীর ভাবে দেখে অবাক হলো।ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ফুটিয়ে উৎফুল্ল গলায় বলে,
—-“আপনি আমার দেওয়া নোস পিন পরেছেন?ওহ মাই গড!”
জেরিন মৃদু হেসে বলে,
—-“আমার জন্যই তো এনেছেন তাই না?”
স্পর্শ অন্য দিক মুখ করে হাসলো।মৃদু গলায় বলে,
—-“তাহলে যাওয়া যাক?”
জেরিন সম্মতি দিয়ে বলে,
—-“চলুন!”
চলবে
চলবে…..,
পর্ব১২
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/388747806180331/