#ভালবাসার_প্রহর
#লেখনীতে_মায়া_মনি
#পর্ব৪০(অন্তিম পর্ব)
সোনালি আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে।রাতের শহরে আলোকিত হয়েছে জেরিনদের বাড়ি।ছাদে রঙিন কাপড়ে সজ্জিত চারপাশ,ফুলে ফুলে সাজিয়ে আছে পুরো বাড়ি।আয়নার সামনে বসে নিজেকে একবার দেখে নিলো জেরিন।পিছন থেকে রিয়া, নাজমুল,শাওন মন দিয়ে দেখছে জেরিন কে।এক বছর আগে এমন ভাবেই সজ্জিত ছিল এ বাড়ি কিন্তু বাজেনি বিয়ের সানাই।সাজেনি কেউ বউ, হয়নি দুটি মনের মিলন এখানে।আজ আবারো সাজিয়ে রাখা হয়েছে এই বাড়ি।সেজেছে অপরুপ সাজে জেরিন।হইচই আর গানে মুশঘুল সবাই।জেরিনের চোখে নতুন করে স্বপ্ন দেখা যাচ্ছে।রিয়া পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে মধুর কন্ঠে বলে,
—-“মাশাল্লাহ, আমার জেরি কে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।”
জেরিন মৃদু হাসলো।শাওন গভীর কন্ঠে বলে,
—-“গত বছর এদিনে ভয় ছিল মনে,আজ শুধু আনন্দ আছে মনে।আমার বেস্টু আজ নিজের আসল গন্তব্যে যাবে।”
—-“আমাদের সেই পরী আজ বধু সেজে রাজকুমারের কাছে যাবে।আজ নেই কোনো ভয়,আছে শুধু ভালবাসার জয়।”
নাজমুলের কথায় জেরিনের চোখে পানি চলে আসে।জীবনে এত ভালবাসা আর স্বপ্ন নিয়েও বউ সাজা যায়। স্পর্শ কে না পেলে বুঝতেই পারতো না।মৃদু ধরা গলায় রিয়ার দুহাত ধরে জেরিন বলে,
—-“আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, আমি বউ সেজেছি।”
রিয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-“বিশ্বাস তাহলে কখন হবে শুনি?”
নাজমুল হেসে বলে,
—-“রেহানের বউ হয়ে তুমিও গেলে।”
রিয়া খেপে বলে,
—-“ভালো হবে না বলে দিলাম কিন্তু!”
—-“কেনো বেয়াইন সাব,যাবেন না আমার রাজ্যে?”
রেহানের কথায় সবাই রুমের দরজায় চোখ দিলো।রেহান মুচকি হেসে জেরিনের কাছে আসে
দুহাত ধরে দাড় করিয়ে বলে,
—-“মাশাল্লাহ ভাবি! একদম বন্ধুর বউ লাগছে!”
জেরিন লজ্জিত হাসি দিলো।রিয়া ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
—-“আপনি এখানে কি করছেন?”
রেহান জেরিনের হাত ছেড়ে রিয়ার হাত ধরে বলে,
—-“সত্যি বলতে এসে ছিলাম ভাবিকে দেখতে কিন্তু,এসে তো আরো একটা পরী পেয়ে গেলাম।”
রিয়া স্তব্ধ হয়ে গেলো।কিছুটা এলোমেলো হয়ে বলে,
—-“কি সব বলছেন?যান তো এখান থেকে।”
রেহান মুচকি হেসে বলে,
—-“যাবো তবে আপনাকে নিয়েই!”
______________________________
ছাদের বিশাল সজ্জিত স্থানে বউ সেজে দাঁড়িয়ে আছে জেরিন।চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সোনালি শেরওয়ানি পরিহিত অতি সুদর্শন যুবক স্পর্শ। চারপাশে হইচই আর আনন্দ। দুজনের হাতে ফুলের মালা। যেই প্রহর, যেখানে শুধুই ভালবাসা আছে।আজ সেই “ভালবাসার প্রহর” যার অপেক্ষায় জেরিন বেচে আছে।স্পর্শের মুখে সেই দুর্লভ হাসি।স্পর্শের পাশেই শুভ, রেহান,আকাশ,নীল।জেরিনের পাশে রিয়া,শাওন,সাদিয়া,নাজমুল,নিলয়,রাফি,সাকিব।শাওন আর রাফি জেরিনকে উঁচু করে কোলে তুলে নিলো।স্পর্শ মালা পরানোর চেষ্টা করছে।জেরিনের মুখে অসম্ভব সুন্দর হাসি।চোখে হাজার পাওয়ার আনন্দ।অনেক চেষ্টার পর স্পর্শ জেরিনের গলায় মালা দিলো।জেরিন মালা পরাতে চাইলে স্পর্শ হাটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে।জেরিন এক সমুদ্র ভালবাসা নিয়ে স্পর্শের গলায় মালা পরিয়ে দিলো।সবাই হাতে তালি দিচ্ছে।রেহান মুচকি হেসে বলে,
—-“বেয়াইন সাব আপনি যদি বলেন,আমি ও পরিয়ে দেই আপনার গলায় মালা।”
রিয়া না চাইতেও মৃদু হেসে দিলো।ভেঙচি কেটে বলে,
—-“এতো সহজ? আগে দুলাভাইয়ের মতো বিশ্ব প্রমিক হয়ে দেখান।”
সবাই হেসে দিলো।আজ আবারো পুরো দুনিয়ার সামনে স্পর্শ জেরিন কে ধার্মিক এবং আইনত ভাবে নিজের করে নিলো।জেরিনের চোখ থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পরে।স্পর্শ তা ভালবেসে মুছে দিলো।সবাই ছবি তুলে ফাটিয়ে দিচ্ছে।আড্ডা আর, স্পর্শের বন্ধুদের বিশেষ আপ্যায়নে কেটে গেলো মধুর আরো একটা “ভালবাসার প্রহর”।
সাদিয়া গেস্টদের শরবত দিচ্ছে।হঠাৎ পাশে কারো কন্ঠ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো।আকাশ ও একটা শরবতের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে।সাদিয়া ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
—-“আপনি কী করছেন?”
আকাশ মুচকি হেসে বলে,
—-“ভাবলাম আপনাকে একটি সাহায্য করি।একা একা আর কতদিন? মানে আর কত কাজ করবেন?”
সাদিয়া কপাল কুঁচকে বলে,
—-“ফ্লাটিং করছেন? ”
আকাশ লজ্জিত হাসি দিয়ে বলে,
—-“চেষ্টা করছি যদি,আপনি পোটে যান।”
সাদিয়া হেসে দিলো।তা দেখে আকাশ সামনে পা দেওয়ার অনুমতি পেলো।এক সাথে অনেকটা সময় পার করল শরবত দেওয়ার বাহানায় দুজন।
_____________________
মেয়েদের জীবন বড়ই অদ্ভুত।যেখানে জন্ম হয় সেখানেই থাকার অনুমতি থাকে না একটা সময়।ভালবাসার মানুষটা কী সবার থাকে? জেরিন উপর ওয়ালা কে আজ অনেক ধন্যবাদ দিচ্ছে স্পর্শের জীবনে পা রাখতে পেরে।বিদায় বেলা খুবই বেদনার হয়।নাজমুন বেগম মেয়েকে ধরে আজ কাঁদছে। বুক ফাটিয়ে কাঁদছে। হাসানের জন্য কত মধুর দিন গুলো থেকে মেয়ের সাথে আলাদা ছিল।আজ চলে যাচ্ছে অন্যের ঘরে।মনে হচ্ছে এইতো সেদিন হাত ধরে হাটা শিখেছিল।মা বলে ডাকা শিখছিল।স্কুল থেকে এসে গলা জড়িয়ে আম্মু বলে ডাকতো।একবার মায়ের হাতে খাওয়ার জন্য সারাদিন না খেয়ে থাকতো।আজ সেই মেয়েটা চলে যাচ্ছে।জেরিনের চোখ থেকে শব্দহীন পানি ঝরছে।জসীম সাহেব নিঃশব্দে?মেয়েকে ধরে কাঁদছেন। সেলিনা এবং লতিফ সাহেব ও কাঁদছে অনেক।সেলিনা স্পর্শের হাত ধরে ফুপিয়ে বলেন,
—-“জেরিন আমাদের খুব আদরের বাবা।আমার নিজের পেটের কোনো সন্তান নেই।জন্মের পর থেকে আমাকে ছোট আম্মু বলেই ডাকতো।আমাদের কলিজা আজ তোমাকে দিলাম বাবা।”
স্পর্শ হাল্কা হেসে বলে,
—-“আপনাদের কলিজা সেই কবে আমার দুনিয়া হয়ে গেছে।”
জসীম সাহেব স্পর্শের হাতে জেরিনের হাত তুলে দিয়ে বলেন,
—-“জীবনে কখনো মেয়েটাকে হাসাতে পারিনি আমি।একটু সময় ও দিতে পারিনি।হাত ধরে হাটাতেও পারিনি।তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, ওর না পাওয়া আদর ভালবাসা তোমরা পূরণ করবে।”
স্পর্শ জেরিনের অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রইল স্তির নয়নে।আশরাফ মেহরাব জেরিনের মাথায় ভরসার হাত রেখে বলেন,
—-“জেরিন এখন থেকে আমার মেয়ে।আমি আমার মেয়ের সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করবো।আজ থেকে ওর নতুন জন্ম হবে।নতুন একটা দুনিয়া হবে।”
নাজমুন বেগম মেয়ের পুরো মুখে ভালবাসা দিয়ে যাচ্ছে।না চাইতেও বিদায় দিতে হলো।বন্ধুদের ধরে জেরিন মন খুলে কেঁদেছে।
______________________________
মেহরাব ম্যানশনে মহিনি মেহরাব অপেক্ষা করছেন ছেলের বউ কে বরণ করবে তাই।আত্মীয়দের জমেছে আসর।ফুলের সজ্জিত গাড়ির দরজা খুলে স্পর্শ হাত বাড়িয়ে দিলো জেরিনের দিকে।জেরিন স্তির চোখে তাকিয়ে সেই হাত ধরে নিলো।স্পর্শ মুচকি হেসে জেরিন কে কোলে তুলে নিলো।রেহান,আকাশ,নীল চেঁচিয়ে বলে,
—-“সেই বন্ধু…!”
জেরিন লজ্জায় লাল হয়ে নিচুস্বরে বলে,
—-“কি করছেন সবাই দেখছে।”
স্পর্শ শান্ত গলায় বলে,
—-“আমার বউকে আমি তুলেছি।পুরো দুনিয়া দেখলেও কি আসে যায়?দুই বার বিয়ে করেছি বুঝলে?”
জেরিন মুচকি হেসে দিলো।স্পর্শের গলা জড়িয়ে মেহরাব ম্যানশনে পা রাখলো।মহিনি মেহরাব জেরিন কে বরণ করে আদুরে গলায় বলে,
—-“এখন যেভাবে কোলে রেখেছিস, এভাবেই আজীবন জেরিন কে রাখবি।আমার মেয়েটা জেনো মাটিতে না থাকে।”
স্পর্শ জেরিন কে কোলে রেখেই বলে,
—-“চিন্তা নেই মা,আমার জীবন থাকতে মাটিতে কখনোই থাকবে না।”
শুভ পাশ থেকে বলে,
—-“বাবা,আমরা শুধু শুধু ভয় পেতাম দেখো।স্পর্শ তো দেখছি সিনেমা থেকেও রোমান্টিক। ”
জেরিন লজ্জায় স্পর্শের বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো।স্পর্শ জেরিনের দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি দিলো।সবাই মন ভরে দোয়া করে দিলো দুজন কে।কোলে করেই স্পর্শ নিয়ে গেলো জেরিন কে তার সাজানো রুমে।
.
.
.
.
রজনীগন্ধা আর গোলাপে সাজানো রুমটা
বিছানায় শতশত ফুলের ছড়াছড়ি। ফ্লোরে কত মোম আর ফুলের পাপড়ি।জেরিন মুগ্ধ চোখে চারপাশে দেখছে।স্পর্শ কোল থেকে নামিয়ে দিলো।বিছানার মাঝে হাস্যউজ্জ্বল মুখে থাকা স্পর্শ জেরিন কে হিমুর হলুদে ঝাপটে ধরে হলুদ পরাচ্ছে তার ছবি।দেখতে একদম জীবন্ত। চোখ জেনো সরছেইনা জেরিনের।মুখে হাত দিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।স্পর্শ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জেরিন কে।একদম শান্ত গলায় বলে,
—-” একদম কাঁদবে না তুমি।আমি হাসি দেখতে চাই প্রিয়।তোমার জীবনে সব হাসির কারণ আমি হতে চাই।তোমাকে আমি এমন ভাবে চাই, জেনো কোনো বাচ্চা ছেলে অনেক দামি খেলনা চায়।জীবনের থেকেও বেশি সেই খেলনা আগলে রাখবে। আমি আমার প্রিয়তমাকে আমার দুনিয়া বানিয়ে রেখেছি।আমার দুনিয়াতে শুধু “ভালবাসার প্রহর” থাকবে।”
জেরিন ধরা গলায় বলে,
—-“জীবনে এতো স্বপ্ন,ভালবাসা নিয়েও বউ সাজা যায় তা তোমার না হলে জানতামই না।নতুন করে হাসা যায়,বাচা যায় তাও জানা হতো না।এতো ভালবাসি যে তোমায়,আমি মরতেও পারবো।”
—-“অনেক ভালবাসি প্রিয়তমা।”
জেরিনের কপালে স্পর্শ গভীর চুমু খেলো।জেরিন দুহাতে স্পর্শের গলা জড়িয়ে ধরলো।আজ দুনিয়াতে সব চেয়ে খুশি ওরা দুজন।
__________________________
—-“খুব তো বলে ছিলেন বেয়াইন সাব,আমার হবেন না।এখন তো আমারই হলেন।”
মালা বদলের সময় রেহানের এমন কথায় রিয়া লজ্জিত হাসি দিলো।আজ রেহান আর রিয়ার বিয়ে।স্পর্শ আর জেরিনের বিয়ের ৪টা বছর হয়ে গেলো।দুজনের কোল জুড়ে তাদের পুত্র পরশ হাসছে।মাত্র ১ বছর পরশের।পরিবারের সবার প্রিয় স্পর্শ জেরিন দের।নাজমুন বেগম ছেলের থেকেও বেশি ভালবাসে স্পর্শ কে।মেহরাব ম্যানশনে স্নেহা আর জেরিন জেনো দুই বোন
স্নেহা ও মা হবে।এদিকে আকাশ ও সাদিয়াকে বিয়ে করে ফেলেছে।রিয়া রেহানের গলায় মালা দিয়ে বলে,
—-“তবুও স্পর্শ ভাইয়ার মতো বিশ্ব প্রেমিক হতে পারলেন না।”
সবাই হেসে দিলো।রেহান হতাশ হয়ে বলে,
—-“বিয়ের মালা গলায় দিও বেয়াইন সাব দেখি,আগের মতোই ধানিলঙ্কা আছে।”
রিয়া হেসে দিলো।জেরিন পাশ থেকে বলে,
—-“দেখতে হবে না রিয়া কার জান?”
স্পর্শ পরশ কে কোলে নিয়ে মুচকি হেসে বলে,
—-“আমার শালিকা একদম ঠিক আছে।তোকে যে দয়া করে বিয়ে করছে এটাই অনেক।”
সবাই খিলখিল করে হেসে উঠে।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশ সাদিয়ার হাত ধরে মৃদু গলায় বলে,
—-“আমি সব থেকে ভালো আছি,সাদিয়া আমার জীবনে আছে।রাগ করলেও ভালবাসার কমতি নেই।”
স্পর্শ জেরিন কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-“প্রিয় মানুষটার সাথে প্রতিটা সময় জেনো “ভালবাসার প্রহর” হয়েই থাকে।”
সবাই এক সাথে বলে উঠে,
—-” ভালবাসার প্রহর শুধু প্রিয় জনের জন্যেই।”
সমাপ্ত…