বাসন্তী প্রেম পর্ব ৪

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#চতুর্থ_পর্ব

বেডরুমের ঠিক বাম পাশেই অবস্থিত বিশালাকার স্টাডি রুমে ইজি চেয়ারের উপর বসে একমনে বইয়ের মাঝে চোখ বুলাচ্ছে ফাইয়াজ। পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। শুধু মাঝেমধ্যে বইয়ের পাতা উল্টানোর মৃদু শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে।
– ” আমার দৃষ্টিশক্তি অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে।”
সিরাতের বলা শেষ কথাটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সারাক্ষণ। আর সেটা এখন আবারো মনে পড়তেই হাতে থাকা বইটা ঠাস করে বন্ধ করে দিল ফাইয়াজ।
মার্সেল প্রুস্টের লিখা ‘ ইন সার্চ অব লস্ট টাইম ‘ এর ৬ নং ভলিউম টা সবেমাত্র পড়া শুরু করেছিল ফাইয়াজ তবে সকালের কথা কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছে না যার ফলস্বরূপ বইটা আবারো পাশের টেবিলে ঠাস করে রেখে দিলো সে।
– ” ওফ্ কি হচ্ছে আমার সাথে! আমি কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে পারছি না কেন? যা করছি তাতেই ঐ মেয়েটার বলা কথাগুলো কানে এসে বিঁধছে। কেন হচ্ছে এমনটা? মেয়েটা অন্ধ বলে আমার খারাপ লাগছে? কিন্তু কেন!”
মনে মনে প্রলাপ বকে উঠে ফাইয়াজ। রাগকে কন্ট্রোল করার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।

– ” এ কারণেই আমি সিরাত আর নিশাত‌ দুজনকেই এখানে আমার সাথে চট্টগ্রাম নিয়ে এসেছি! আর সবটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমি চাই এরা দুজন চট্টগ্রামেই থাকবে!”
গম্ভীর গলায় আনোয়ার সাহেবকে বলে উঠলো চন্দ্রিকা।
– ” যাক এতদিনে রবের কাছে আমার সব চাওয়া পাওয়া কবুল হয়েছে। তোকে আমি একজন সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি। তোরা আমার কাছে যতদিন খুশি থাক, আমার কোনো আপত্তি নেই। তোমরা তো আমার মেয়ের মতোই!”
চন্দ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন আনোয়ার সাহেব।

– ” আচ্ছা অনেক কথা হয়েছে। ওদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে। তোমরা সবাই দুপুরের লাঞ্চ করে কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। কাল রাত থেকেই তোমাদের উপর অনেক ধকল গিয়েছে।”
বলেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় চন্দ্রিকা।

ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে একমনে মেঝেতে বসে আছে সিরাত‌। সূর্যের প্রখরতা অনেকাংশে কমে গেলেও তার মৃদু আঁচ এসে সিরাতের মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে।
– ” আপু, তুই একা একা বসে কি করছিস?”

হুট করে নিশাতের কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মাথা তুলে তাকায় সিরাত। কার্নিশ বেয়ে উপরে উঠে দাঁড়ায় সে।

– ” হ্যাঁ আসলে বিকেলে ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না তাই ফাতেমা খালাকে বলে উপরে চলে আসলাম। জানিসই তো এই বিকেলটা আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু এই প্রিয় জিনিসটাই এখন আর তৃপ্তি ভরে দেখতে পারি না। শুধু ছুঁয়ে অনুভব করে যেতে হয়। ”
বলেই একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললো সিরাত‌। যেখানে হাজারো ব্যর্থতা, কিছু নিশ্চুপ বেদনা লুকিয়ে আছে অজান্তেই।

– ” আপু তুই চিন্তা করিস না, সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ্ চাইলে তোর চোখের দৃষ্টি আবারো আসবে। তুই ধৈর্য ধর‌। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নিশাতের কথা শুনে ধীর গতিতে নিজের মাথাটা নিশাতের কাঁধে এলিয়ে দিল সিরাত‌। চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।

————————
সামনে পাঁচ ছয়টি কাঁচের খালি গ্লাস সহ বিভিন্ন হুইস্কি, মদের বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে রিয়ানের সামনে। আর বিছানার সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে রয়েছে রিয়ান‌। নেশায় বুঁদ হয়ে যখন উল্টোপাল্টা প্রলাপ বকছে তখন রুমের দরজা ভিড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন সেলেনা চৌধুরী।
রুমের বেহাল দশা চোখ এড়ালো না সেলেনা চৌধুরীর‌। মদের গন্ধ নাকে যেতেই নাক সিঁটকালেন তিনি।

– ” কি শুরু করেছিস কি রিয়ান! দিন নেই রাত নেই যখন সময় পাচ্ছিস মদ আর ছাইপাশ গিলে এভাবে মাতাল হয়ে পড়ে থাকিস। বলি কি এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে এই প্রোপার্টি আমাদের হাতে আসবে কি করে?
আর ঐ সিরাত ও তো আমাদের নাকের নিচ দিয়ে নিশাতের সাথে পালিয়ে গেল আর আমরা কিছু করতে পারলাম না!
কিছু একটা কর রিয়ান‌। নাহলে সব সম্পত্তি আমাদের হাতছাড়া হবে।”
রিয়ানের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠলেন সেলেনা চৌধুরী।
মায়ের কথা শুনে নেশায় মত্ত থাকা রিয়ান সরু চোখে একবার সেলেনা চৌধুরীর তাকিয়ে পরক্ষণেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
সেলেনা চৌধুরী সেটা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলতেই রিয়ান‌ বলে উঠলো,

– ” কাম অন মা! আজ পর্যন্ত এমন কোনো নেশা নেই যে আমাকে কাবু করতে পেরেছে। আর যদি কোনো নেশা নামক জিনিস থাকে সেটা হচ্ছে ঐ সিরাত‌। এই সম্পত্তি না হলেও আমার ওকে চাই। আর তাইতো ওকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছি।
আর সেটা খুব শীঘ্রই হবে। রিয়ানের খাঁচায় তোমাকে বন্দি হতেই হবে সিরাত!”
অট্টহাসি দিতে দিতেই অত্যন্ত হিংস্র ভাবে কথাগুলো বলে উঠলো রিয়ান‌।
রিয়ানের কথার ভাবার্থ না বুঝতে পেরে বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লেন সেলেনা চৌধুরী।

– ” চাচা, আমি আপনার কাছ থেকে এটা আশা করি নি! আপনাকে তো বলেছি আমার এই সব বিয়েশাদী নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আর আমি এগুলো নিয়ে ভাবতেও চাই না! কিন্তু তারপরও আপনি?”
অবাক হয়ে ইয়াসিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল চন্দ্রিকা।

– ” দেখ মা, আমি জানি সেসব কথা। কিন্তু তুই নিজেই বল। অনেক তো হয়ে গেল সময়। পাঁচ টা বছর তো কম কথা না। যে মানুষটা তোকে ছেড়ে অন্য আরেকটা মানুষের সাথে দিব্যি সংসার করতে ব্যস্ত সেখানে তুই থেমে আছিস কেন?
তোর নিজের ও তো মুভ অন করা উচিত। আমি বলছিনা তোকে বিয়েটা করতেই হবে! আমি শুধু তোকে তোর অতীত থেকে বের হয়ে আসার জন্য বলছি। আর তুই নিজেই যথেষ্ট বড় হয়েছিস, ভালো মন্দ বুঝিস!”
ইয়াসিন সাহেব চন্দ্রিকাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে ধীর পায়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং হলরুম প্রস্থান করলেন।
এদিকে এতক্ষণ নিজেকে শান্ত রাখলেও এবার আর পারলো না চন্দ্রিকা। চোখের কার্নিশ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে গালে এসে পড়েছে। ফলস্বরূপ ফর্সা মুখটা আর নাকের ডগা মিনিট পাঁচেক পরেই লালচে বর্ণ ধারণ করা শুরু করলো।
ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই আনোয়ার সাহেব আর চন্দ্রিকার কথোপকথন কানে পৌঁছালো সিরাতের‌। ধীর পায়ে নেমে বিভিন্ন জিনিস হাতড়ে হাতড়ে চন্দ্রিকার পাশে এসে বসলো সিরাত‌।
কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে চন্দ্রিকা। তড়িঘড়ি করে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানিটুকু মুছে পাশ ফিরে তাকালো সে।
– ” আরে পূরবী তুই? এখানে কি করছিস? কিছু লাগবে?”
– ” শুধু শুধু আমার কাছ থেকে চোখের পানি লুকাচ্ছো কেন চন্দ্রিকা আপু?”
আরেক দফা অবাক হয় চন্দ্রিকা।
– ” কি ব্যাপার, অবাক হচ্ছো কেন? ভাবছো চোখে না দেখতে পেয়েও কি করে বলছি? আমি সবটা শুনেছি।
ইয়াসিন চাচা তো ঠিকই বলেছে। ঐ একটা মানুষের মোহে সারাজীবন আটকে থাকলে কি করে চলবে আপু?
সে মানুষটা তো তোমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য আরেকজনের সাথে ভালোই আছে। যদি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসতো তাহলে এভাবে ছেড়ে চলে যেত না।
( কিছুটা থেমে)
তুমি কি আজও আরমান ভাইয়াকে ভালোবাসো?”
সিরাতের প্রশ্নে অবাক না হয়ে পারলো না চন্দ্রিকা। বিস্ফোরিত চোখে সিরাতের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,

– ” আ,আর্‌,আরমানের কথা তুই কি করে জানিস?

– ” গত বছর মনে আছে লাস্ট তোমার সাথে একটা ট্যুরে দেখা হয়েছিল তখন তোমার ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি পেয়েছিলাম সেটাতেই সব লিখা ছিল।”‌
সিরাতের প্রশ্নোত্তরে ছোট্ট একটা শ্বাস নিল চন্দ্রিকা।

– ” আগামীকাল রাতে তোকে কনসার্ট শো করতে হবে। এখানে সেসব শিডিউল দেয়া আছে।”
ফাইয়াজের দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো ধ্রুব। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা পাশের টেবিলে রেখে দিল ফাইয়াজ। কাগজটা হাতে নিয়ে কয়েক পলক তাকিয়ে সেটা পাশের ড্রয়ারে রেখে দিলো।
সামনে তাকাতেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল আপনাআপনি।
ধ্রুব একমনে ফোনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে চলেছে। আর সুযোগ পেয়ে হুট করেই ফোনটা ধ্রুবর হাত থেকে কেড়ে নিল ফাইয়াজ। হঠাৎ করেই যে এমন হবে তা ঠিক ভাবতে পারেনি ধ্রুব।
– ” কি ব্যাপার ফোনের দিকে তাকিয়ে এভাবে মিটমিট করে হাসছিস কেন? কি আছে ফোনে?”
বলেই ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলল ফাইয়াজ।
– ” আরে এটা তো কালকের ঐ মেয়েটা না যার সাথে প্ল্যাটফর্মে দেখা হয়েছিল? কি যেন নাম? হ্যাঁ নিশাত‌!
নিশাতের ছবি তোর ফোনে কি করছে!”
সন্দেহপ্রবণ চোখে ধ্রুবের দিকে তাকাতেই বেচারা ভয়ে চুপসে গেল।
– ” আসলে ওটা এমনিতেই তুলেছিলাম। খেয়াল করিনি!”

– ” আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছিস? এখন জলদি বল নিশাতের ছবি তোর ফোনে কি করছে? কি কানেকশন তোদের মাঝে!”
পরমুহূর্তেই ধ্রুবের কথা শুনে চেহারার রং উড়ে গেল ফাইয়াজের।………….

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here