ভালোবাসার রংমশাল পর্ব-২০

#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-২০
#সিফাতী সাদিকা সিতু

নিঝুমের আজ ছুটি, অফিস যাবে না সে।তাই বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠলো। নাজনীন বেগম নাস্তা দিলেন।

মামনি কোথায়ও বেড়াতে যাবে নাকি?

নাহ্,আজ বাসায় আছিস,বিশ্রাম নে। বাইরে বের হতে হবে না। সবসময় তো কাজের মাঝে থাকতে হয়।

উফ, মামনি তুমি এত চিন্তা করো কেন বলতো?কাজের প্রেশার না থাকলে এমনিতেই আমি বিশ্রাম নিতে পারি।আর, তোমাদের সাথে বের হলে সত্যি খুব ভালো লাগে,চলো প্লিজ! তুমিও তো সারাদিন বাসায় পরে থাকো?

কবেই বা বেড়িয়েছি?সংসার নামের মায়ার জালে জড়িয়ে গেলে নিজের কথা ভাবার সময়টাই বা কোথায়?কত ভালোবেসে আগলে রাখতে চেয়েছি, কিন্তু হলো কই?স্বামী, সংসার কোনোটাই তো রইলো না!
নাজনীন বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

নিঝুমের কান্না ঠেলে আসতে চাইছে।মামনির কষ্টটা সে বেশ অনুভব করতে পারে।অথচ, কষ্ট গুলো দূর করে দিতে পারেনা।যার নিজের মনে কষ্টের পাহাড় জমে আছে সে কি করে কমাবে অন্যের কষ্ট?মন খারাপ হলো খুব।

নাজনীন বেগম নিঝুমের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, কথা গুলো এমন ভাবে বলা তার উচিত হয়নি।দ্রুত বললেন,চল সুপ্তিকে বলে তৈরী হই।আমরা তিন মা,মেয়ে আজ ঘুরতে যাবো।

নিঝুম হেসে নাজনীন বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।

***

সবকিছু ঠিকঠাক চললেও হঠাৎ খবর আসে “আয়ানের” এক্সিডেন্টের। আয়ান নাজনীন বেগমের বড় ছেলে। কানাডায় স্টাডি করে।সন্ত্রাসীর আঘাতে মারাত্মক ভাবে ইনজুরিড হয়েছে, এই খবর পাওয়ার পর সবাই ভেঙে পরে, একদম।কয়েকদিনের মধ্যে ভিসা প্রসেসিং করে সাম্য চলে আসে কানাডায়।সাম্যর পৌঁছানোর এক সপ্তাহের মধ্যে আয়ান মারা যায়।খবর পাওয়ার পর নাজনীন বেগম ভেঙে পরেন।আমির এবং সাম্যর বাবা সেই খবর শুনে বাড়ি আসার পথে তারাও মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেন। সামির বেঁচে গেলেও একপা কেটে যায়।আমির স্পট ডেথ হয়!সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায়।রক্তাক্ত লাশটা বাড়িতে আসলে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়।সামিরকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়।জামিরকে একা সব সামলাতে হিমসিম খেতে হয়।এক ভাইয়ের লাশ দাফন করে হসপিটালে ছুটতে হয়ে আরেক ভাইয়ের জন্য।বিপদের গারো ছাঁয়া যেন পিছু ছাড়েনি তখনো।কানাডায় সাম্যর বিপদ হয়!দুর্বৃত্তরা ভেবে নেয় সাম্য হয়ত আয়ানের মৃত্যুর জন্য আইনের কাছে যাবে।তারা এক রাতে সাম্যকে মারধর করে, হুমকি দেয়,সেই সাথে সাম্যর পার্সপোর্ট,ভিসা কেড়ে নেয়।সাম্য দিশেহারা হয়ে যায়।বাবা,বড়বাবার অবস্থা শোনার পর পাগলপ্রায় হয়ে যায়।নিজের বিপদের কথা জানাতে পারে না।শুধু মেঝ চাচাকে জানিয়ে ব্যবস্থা করতে বলে, তার ফেরার।কিন্তু কোহিনূর বেগম বাঁধা দেন।তিনি সাম্যকে কানাডায় থাকতে বলেন।সাম্য কথা শোনে না, মায়ের।ফেরার চেষ্টা করেও পারেনা।এদিকে ভিসার মেয়াদ পার হয়ে গেলে তাকে জেলে যেতে হয়।তিন মাস জেলে থাকে সে।সেই তিন মাসে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়।জামির, ভাইয়ের ব্যবসা নিজের নামে করে নেয়।কোহিনূর বেগমও সাথে যোগ দেয়।সামির সবকিছু দেখেও কিছুই করতে পরেনা।একজন পঙ্গুর কতটুকুই বা ক্ষমতা থাকে।ব্যবসার কিছু শেয়ার নাজনীন বেগমের নামে থাকায় জামির,কোহিনূর জোর করে নিজেদের নামে করতে চায়।নাজনীন রাজি হয় না।কোহিনূর বেগম তাকে যথেষ্ট পরিমাণ হেনস্তা করে। নাজনীন বেগম একা পেরে ওঠেন না।নিঝুমের সাথেও প্রচুর খারাপ ব্যবহার করে। একদিন চড় মেরে নিঝুমকে বলেছিলো,সাম্য আর ফিরবে না দেশে।সে নিঝুমকে কখনো মেনে নিতে পারেনি।

নিঝুম, নাজনীন বেগম বিশ্বাস করেন না সে কথা।তাড়া মুখ বুজে সহ্য করে সব।অপেক্ষায় থাকে সাম্যর ফেরার।কিন্তু সাম্য ফেরে না।তারা কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারে না সাম্যর সাথে।এদিকে কোহিনূর বেগমের খারাপ ব্যবহার বেড়েই চলে।সুপ্তি,নিঝুমকে নিয়ে থাকতে ভয় হয়।নিঝুমকে সবসময় নানান কারনে অপমান করতে থাকে।মাঝে, মাঝে হাত তুলতেও দ্বিধা করে কোহিনূর। কোহিনূর বেগম হুমকি দেয় সাম্যর সাথে নাজনীন বেগম বা নিঝুম যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে সামিরের ক্ষতি করতে একটুও ভাববেন না।নাজনীন বেগম কোহিনূরের এমন রূপে ভয় পান।এতোদিন এদের সাথে বাস করেছেন,ভালোবেসেছেন ভাবতেই ঘৃণা হয়।নিঝুম, সুপ্তিকে নিয়ে বেড়িয়ে আসেন স্বামীর তিলে, তিলে গড়া বাড়ি থেকে,সংসার থেকে।বাবার বাড়িতে এসে উঠেন এবং অসুস্থ হয়ে পরেন।সেই সময় নিঝুমকে সামলাতে হয় সবকিছু। হঠাৎ মনে পরে তার বাবার সম্পত্তি গুলো বিক্রি করে মনি বাবা তার নামে অ্যাকাউন্টে টাকা রেখেছে।নিঝুম আশার আলো দেখতে পায়। কিছুদিন পর মোট বাইশ লাখ টাকা নিয়ে সে নতুন লড়াইয়ে নামে।এক মামার সহায়তায় ব্যবসা শুরু করে।”বুটিক ফ্যাসান হাউজ “ধীরে, ধীরে বেড়ে ওঠে।আজ সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উঠেছে। নিঝুমের নানা বাড়ি চট্টগ্রামে হওয়ায় সেখানেই ব্যবসা শুরু করে।নিজেদের সমস্ত কষ্টকে ছাপিয়ে,পুরোনো সম্পর্ক ভেঙে নতুন করে বাঁচতে শেখে ওরা।

সাম্য অনেক চেষ্টা করেও নিঝুমের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না। দেশেও ফিরতে পারেনা।মায়ের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।রাফাতের মাধ্যমে নিঝুমের খোঁজ চালায়।রাফাত নিঝুমের সাথে সাম্যর যোগাযোগ করিয়ে দিতে চাইলেও, নিঝুম সেটা চায় না।বলে দেয় সে সাম্যকে স্বামী হিসেবে মেনে নেয়নি কখনো।এমনকি ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় ডির্ভোস পেপার সাইন করে এসেছে।রাফাত অনেক চেষ্টা করেও কিছু বোঝাতে পারে না, নিঝুমকে।সাম্য দেশে ফেরার চেষ্টা বন্ধ করে দেয়।কার জন্য ফিরবে সে?সবকিছুই তো হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। কঠিন অভিমানে দগ্ধ হয় প্রতিনিয়ত। নিঝুমের সাফল্যই তাকে বুঝিয়ে দেয় নিঝুম তাকে ভুলে গেছে।ভুলবে নাই বা কেন?সাম্যর অব্যক্ত ভালোবাসা যে নিঝুমকে ছুঁতে পারেনি?

শান্তার চোখ দিয়ে অনবরত জল ঝরছে।সাম্য এত কষ্ট পাবে তা কখনো জানা ছিলো না।কখনোই সে সাম্যর খারাপ চায়নি বরং সাম্যকে ভুলে নিজের জীবনে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। সাম্য,নিঝুমের জীবন থেকে সে তো অনেক দূরে চলে এসেছিলো।অথচ,সাম্য, নিঝুম একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে গেছে।

আশফির খারাপ লাগলো খুব।হঠাৎ নিঝুমের মুখটা মনের কোণে উঁকি দিলো। সেই সাধারণ মেয়েটাকে হাঠাৎ ভালোবেসে ফেলেছিলো।কিন্তু, যখন শুনতে পেয়েছে নিঝুম বিবাহিত তখন নিজেকে বুঝিয়েছে,মানিয়েছে।থমকে যেতে চায়নি।শান্তার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সুখেই আছে সে।শান্তাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলবে তা যেন কল্পনাই করেনি।নিঝুমকে কেন যেন সহজেই ভুলে যেতে পেরেছিলো।আজ এসব ঘটনা শুনে খুব খারাপ লাগলো।

সাম্য মাথা নিচু করে রেখেছে। চোখের জল লুকাতে চাইছে।সে কারে কাছে নিজের কষ্টটা প্রকাশ করতে চায় না।শান্তার জোরাজুরিতে সব বলতে হলো তাকে।

সাম্য, আপনি কি সত্যি দেশে যেতে চান না?

নাহ্।

নিঝুমকে ভালোবাসেন না?

সাম্য এবার জবাব দিলো না।

“আমাদের অভিমান গুলো ভালোবাসার মতোই তীব্র হয়।কিন্তু কখনোই অভিমানকে জিতিয়ে দিতে নেই।তাহলে জীবনের মানেটাই হারিয়ে যাবে।জানার মাঝেও অনেক কিছু অগোচরে থাকে।আপনি দেশে যেতে চাইলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি!”

সাম্য চট করে মাথা তুলে তাকালো।চোখে,মুখে বিস্ময়!

কিভাবে, কি করবো, সব আমার ব্যাপার,আপনি শুধু বলেন দেশে যেতে চান কিনা?

সাম্যর চোখে জল দেখা দিলো।আশফিকে এক সময় হিংসা হতো।সে জানে আশফি নিঝুমকে পছন্দ করতো।আজ তারই বিপদে আশফি পাশে দাঁড়াবে তা কি জানতো আগে?জীবন আমাদের কখন,কোন অবস্থায় এনে দাঁড় করায় তা সত্যি বোঝা কাম্য নয়!

আশফি চেয়ে থাকলো সাম্যর জবাবের আশায়।সাম্য হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরলো।আশফি তার উত্তর পেয়ে গেল।

শান্তা চোখ, মুছে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।আজ নিজের হাতে রান্না করবে সাম্যর জন্য।

নিঝুমরা পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে এসেছে।ওরা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে। ঢেউ গুলো এসে পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। সমস্ত ক্লান্তি,অবসাদ দূর হয়ে গেল সবার।সুপ্তির চোখে, মুখে উচ্ছাস।

হঠাৎ কোথা থেকে আরোহী এসে নাজনীন বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।সবাই চমকে গেল!ওরনা দিয়ে শরীর ঢাকা ছিল নাজনীন বেগমের আরোহীর কারণে সে ওরনায় খুলে গেল।নাজনীন বেগম চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন।

বড়মা,ও বড়মা তুমি কেমন আছো গো?আমায় কেন শাস্তি দাও তোমরা।আমিতো ভালোবাসি তোমাদেরকে।

শান্ত হো মা।সবই তো তোর জানা।

আরোহী কথা বললো না।শুরু কেঁদেই গেল।নিঝুম আর সুপ্তির চোখেও জল গড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি এতোক্ষণ খেয়ালই করেনি আরোহীর স্বামীও আছে দাঁড়িয়ে। আরহীর কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here