।। ও চোখে বৃষ্টি এলে।।
৩.
সাম্যকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ওর বাবা বললো,
-” কী হলো সাম্য? সাইন কর।”
সেখানে উপস্থিত সকলেই সাম্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু সাম্য নির্বিকার, ওর মাথায় চলছে অন্য কিছু। সাম্য কে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মৈত্রী পাশ থেকে ঠেলা দিলো। এতে সাম্যের হুশ ফিরল বলে মনে হয় না।
-” কী হলো সাম্য সাইনটা করো তাড়াতাড়ি!”
কিন্তু সাম্য তার ভাবনায় ভাবিত। মাথার মধ্যে ঘুরছে অনেক কিছু, বারবার ঘুরে ফিরে একটা প্রতিচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিশেষ করে তাদের শেষ দিনের ক্যাফেতে দেখা হওয়ার মুহূর্তটা। সেই দিন পিয়ালের মুখের হাসির মধ্যে থাকা হাজারো কষ্ট সাম্যের চোখে পড়ে ছিল তাইতো তাড়াতাড়িই সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
সাম্যের ভাবনার মাঝেই মৈত্রী পৈশাচিক হাসি দিয়ে ফিসফিস করে বললো, ” সেই দিন কতো করে তোমার পিয়ালকে বললাম, আমাদের বিয়ের সময় যেনো সে থাকে। কিন্তু সে তো এলোই না। আমি বরং ওকে ফোন করে দেখি, যাতে ও এখানে এসে তোমার আমার বিয়েটা দুই চোখ ভরে দেখে আমাদের জন্যে প্রার্থনা করে, কী বলো?”
সাম্যের এবার হুশ ফিরল, করুণ দৃষ্টিতে একবার মৈত্রী কে দেখে ওর বাবার হাত থেকে পেন টা নিলো।
যার মন অন্য বাঁধনে বাঁধা পড়ে রয়েছে, তাকে কী অন্য বন্ধনে জড়ানো যায়, যায় না। সাম্যের ক্ষেত্রেও তাই। ওর হাত অনবরত কেঁপে চলেছে। ও যেখানে পেন ঠিক করে ধরতে পারছে না, সে কীকরে রেজিস্ট্রি পেপারের দিকে দেখবে।
সাম্যের এই ভাবে বসে থাকতে দেখে সাম্যের বাবা অধৈর্য্য হয়ে উঠলো,
-” তাড়াতাড়ি সাইনটা করতো। একটা সাইন করতে কতক্ষন লাগে!”
সাম্যের বাবার কাছে এটা একটা সহজ কাজ হলেও, এই একটা সাইন সাম্যের কাছে মৃত্যুসম। ওর ভিতরের মন যে ওকে একটা জড় পদার্থ বানিয়ে দিচ্ছে।
হুট করেই উঠে দাঁড়ালো সাম্য। ওকে এই ভাবে উঠতে দেখে মৈত্রী ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে বললো, ” ওই কেউ আমার ফোনটা দে তো!”
মৈত্রী হয়তো ভেবেছিল সাম্য ওর কথায় চুপ করে বসে সাইনটা করে দেবে। কিন্তু সাম্য উন্মাদের মত পেপারটা ছুড়ে ফেলে বলল, ” আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।”
কথাটা বলেই বাইরের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু বাঁধ সাধলো ওর বাবা।
-” কোথায় যাচ্ছিস তুই? ভুলে যাসনা, আজ তোর বিয়ে।”
কিন্তু সাম্য পাগলের ন্যায় বলে গেলে, ” আমাকে যেতেই হবে। ”
সাম্য ওর বাবার থেকে হাত সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। এখন ও বিয়ে করবে কী, সেটা পরের বিষয়। এখন ওর খুব করে পিয়ালকে দেখতে ইচ্ছে করছে। আর ওকে ওর কাছে যেতেই হবে, আর ও যে কোনো মূল্যেই যাবে।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। সাম্য বাইরে বেরিয়ে দেখলো, ওর এক বন্ধু নীল বাইরে দাঁড়িয়ে কারোর অপেক্ষা করছে। সাম্য কে দেখে ওর কাছে এগিয়ে গেল একটা আশায়, যে সাম্য বিয়েটা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে।
-” সাম্য!”
সাম্য একবার নীলের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে বললো, ” আমাকে যেতে হবে এক্ষুণি।”
সাম্য যাবো বলতে যে পিয়ালের কাছেই যাবে ওটা হয়তো নীল ভালো ভাবেই বুঝেছে, তাই ওকে দাঁড়াতে বলে কোথাও গেল।
ততক্ষণে মৈত্রী বাইরে বেরিয়ে এসেছে, আর ওর পিছনে ওর পরিবারের লোকেরা। সাম্যকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছুটে গিয়ে মৈত্রী ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
-” প্লিজ সাম্য, আমাকে এভাবে ছেড়ে যেও না। তুমি দেখো সবাই কিভাবে আমাকে দেখছে। তুমি কি বুঝতে পারছো একটা মেয়েকে এই ভাবে বিয়ের আসরে ছেড়ে গেলে তার কতোটা অসম্মান হয়। আমি তো এইভাবে কোনোদিন মাথা তুলে বাঁচতে পারবো না। ”
মৈত্রীর কথায় সাম্য ওকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বললো, ” আমাকে ছাড়ো, যেতে হবে আমাকে।”
মৈত্রী এবার সাম্যের জামার কলার চেপে ধরলো,
– ” বলছিনা তুমি কোথাও যাবে না। তুমি এক্ষুনি আমাকে বিয়ে করবে, চলো। ওই মেয়ের থেকে আমি তো কম কিছুতে নয়। দেখবে দুইদিন পর ঠিক অন্য কাউকে জুটিয়ে নেবে।”
এতক্ষণে সাম্য স্বাভাবিক থাকলেও, এবার ওর মাথা গরম হয়ে গিয়েছে। নিজের কলার থেকে মৈত্রীর হাত ছড়িয়ে ওকে পিছনের দিকে ঠেলে দিলো। মৈত্রীর বাবা মেয়েকে দুহাতে আগলে নিলেন, যেমনটা ছোটো বেলায় করতেন। নিজের মেয়ের প্রতি এই রূপ ব্যবহারে তিনি খুব রেগে ছিলেন। এতক্ষণে যেনো রাগের মাত্রা ভেঙে গেলো। চিৎকার করে বললো, ” এই ছেলে, সাহস তোমার কম না তো! আমার মেয়ের গায়ে হাত দাও কোন সাহসে, আর বিয়েটা এতদূর এনে তুমি বিয়ে থেকে পালিয়ে যাও কোন সাহসে। তাড়াতাড়ি বিয়েটা করো, লোকজন এখানে তামাশা দেখতে আসেনি।”
-” আমাকে এখান থেকে যেতে হবে মানে হবেই, বিয়ের কথা সে না হয় পরে ভাবা যাবে। ”
সাম্যের বাবা হুট করে এসে ছেলের গালে চড় মেরে বললো, ” বিয়েটা করবে চলো সাম্য।”
কিন্তু সাম্য কোনো কিছু পরোয়া করলো না। ততক্ষনে নীল ওর বাইক নিয়ে চলে এসেছে। সাম্য বাইকের কাছে যেতেই মৈত্রী ওর হাত টেনে ধরলো।
-” আমি কিন্তু পুলিশের কাছে যাবো সাম্য। ”
সাম্য হাতটা ছাড়িয়ে বেশ ভদ্র ভাবে বললো,
-” বেশ তবে যাও।”
-” আমি তোমার পিয়ালের নামে কেস করবো!”
সাম্য ঠাস করে একটা চড় মারতে গিয়েও থেমে গেল। রক্ত লাল চোখে বললো, ” তোর মতো মেয়ের গায়ে হাত তুলতেও ঘৃণা হয় আমার। আর কেস করবি না, যা তুই যার নামে পারিস কেস কর। তোকে আমি ভয় পাই না। আর তখন তুই নিজের সঙ্গে পিয়ালকে মেলাচ্ছিলি না, তুই কি জানিস তুই পিয়ালের নখের যোগ্য নয়। ফালতু মেয়ে।”
-” তুমি আমার মেয়েকে এই সব বলতে পারো না। তোমাকে তো আমি পুলিশে দেবো। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তুমি বিয়ে না করে চলে যাচ্ছো।”
-” ওই খানেই তো ভুলটা করবেন আঙ্কেল। কারণ আপনার মেয়ে যে জোর করে আমাকে বিয়ে করছে তার প্রমাণ আমার কাছে আছে। সো, আপনি যা পারেন করে নিন। ”
পিয়ালের বাবার মুখ বন্ধ হয়ে গেলো নিজের মেয়ের জন্যে। চারিদিকে ততক্ষনে ছি ছি করছে।
সাম্য আর দাঁড়ালো না বাইকে উঠে বসলো। বাইক স্টার্ট দিয়ে মৈত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো, ” কোনো মেয়েকে বিয়ের মণ্ডপে ছেড়ে যেতে আমি কখনোই পারবো না, তাই তোমাকে বহুবার বলেছি আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু তুমি আমার বাবাকে হাত করে বিয়ে পর্যন্ত এলে তো ঠিক তবে বিয়েটা হলো না। তুমি একটা জঘন্য, জেদি মেয়ে। তোমার যা পছন্দ তুই তাই চাও , পারলে ছিনিয়ে নিতেও পারো। কিন্তু ভালোবাসা কখনও ছিনিয়ে নেওয়া যায় না, গেলেও তার মর্যাদা থাকে না। ”
সাম্য যেতে গেলে ওর একমাত্র বোন সামান্তা ছুটে এসে ওর ফোনটা দাদার কানে ধরলো,
-” যদি তাকে ভালবাসিস, তবে তাকে নিয়েই এই বাড়িতে আসিস। আমি অপেক্ষা করবো তোদের। আমার মিথ্যে অসুখের বাহানায় তোর থেকে নেওয়া কথায় নিজেকে খুব ছোট লাগছিল, পারলে ক্ষমা করে দিস। ”
-” মা!”
-” তবে কখনো যেনো তোর না মনে হয় মা, বাবা সেই দিন ঠিক ছিল, আর তুই ভুল।”
-” না কখনো হবে না।”
-” সেটা হলে সব থেকে খুশি আমি হবো। আমরা ভুল হয়ে তুই ঠিক এটাই যেনো হয়। এবার যা, বৌমাকে নিয়ে আয়।”
সাম্য ওর বোনের দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে হাসলো।
-” যা এবার দাদা।”
-” তুই ?”
সাম্যের কথায় ওর বোন আর বন্ধুগুলো একসঙ্গে হেসে উঠলো। সোহেল হেসে বললো, ” আরে বিয়ে বাড়িতে বিয়ে না দেখে বাড়ি যেতে নেই, আমরা আছি তুই যা। ”
সাম্য আর দাঁড়ালো না বাইক চালিয়ে রওনা দিলো, কাউকে দেখতে, কাউকে বলতে, শুধু তাকেই ভালোবাসে।
অপরদিকে, সাম্যের মায়ের কথা ভুল নয়। আজকাল কার দিনে হাজার হাজার টাকা খরচ করে, ভালোবাসার মানুষটাকে বিয়ে করলেও খুব কম সম্পর্কই টিকে রয়েছে। বাকি গুলো কোথাও যেনো হারিয়ে যায়। প্রেমের শুরুতে করা হাজার হাজার প্রতিশ্রুতি হুট করেই হারিয়ে যায়। এমন নয় যে শুধু ভালোবেসে বিয়ে করলেই সম্পর্ক টেকে না। বাবা, মা পছন্দ করে দিলেও সম্পর্ক নাও টিকতে পারে।
(চলবে)
#গল্পঃ_ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে
#পর্ব: তৃতীয়
# তুহিনা পাকিরা
{বিঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং। }