#গল্পঃ_ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে
#পর্ব: দ্বাদশ
# Tuhina pakira
১২.
-” তুই যা না দাদা, আমার ভালো লাগছে না। ”
-” মারবো টেনে এক চড়, ভালোলাগছে না ।মানে কি? তোর না একমাত্র দাদার বিয়ে, আর তুই কিনা মন মরা হয়ে ঘরের অন্ধকারে বসে রয়েছিস।
-” কোথায় মনমরা, আমি তো ঠিকই আছি। ”
-” তুই যে কত ঠিক আছিস তাতো আমি জানি। চল আজ শপিংয়ে যাবো। তোর মনে আছে নিশ্চয়, একসপ্তাহ পড়ে আমার বিয়ে! ”
‘ বিয়ে’ শব্দটি শুনতেই নিষ্প্রাণ চোখে সামনের দেওয়ালের আলোর দিকে তাকালো পিয়াল। আগে হলে ও হয়তো তীব্র আলোর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতো না, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর মন চলে গেছে অন্য কোথাও। ওর ও তো বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু তাও আজ ওরা আলাদা। গত একটা মাসের বেশি কেটে গেলো, কিন্তু তাদের তো আর দেখা হলো না।
-” কী রে, মনে আছে!”
অভির কথায় কতকটা চমকে উঠলো পিয়াল। কী বলবে মনে আছে! কিন্তু ও যে ঠিক মত জানেই না। শুধু জানে একদিন তাদের বাড়িতে মেয়ের বাড়ির লোকেরা এসেছিল। কিন্তু ও তো সেই সময় সেখানে উপস্থিত ছিল না। কথাগুলো ভাবনার মাঝেই অভি বললো,
-” কী রে যাবি তো?”
পিয়ালের কী হলো কে জানে, যাবে বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। ওর কথা শুনে অভি ওকে তাড়া দিয়ে রেডি হতে চলে গেল।
হ্যাঁ সেই দিনের পর কেটে গেছে এক মাস। এই এক মাসে পিয়াল ও সাম্য কারোরই দেখা হয়নি। পিয়াল ছিল নিজের বাড়িতে। এক প্রকার ও নিজেকে ঘর বন্ধ করেই রেখেছে। অপর দিকে সাম্য একেবারে শান্ত হয়ে গেছে। নিজের মতো থাকে। দিনের বেলা অফিস ও রাতে একলা আকাশ দেখে কাটিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ওর ফ্ল্যাটেও চলে যায়। পিয়ালকে নিয়ে কাটানো সময় গুলো মনে করেই ওর রাত কেটে যায়। আবার সকাল থেকে শুরু হয় নতুন দিনের শুরু। এই সবের মাঝে ও যায়নি পিয়ালের কাছে। অভিমানে জর্জরিত হয়ে রয়েছে সে। এক আকাশ অভিমান সে তার মধ্যে রেখে দিয়েছে। এতো কিছুর পড়ে ও ভেবে পায় না, পিয়াল কিভাবে ওর হাতটা সেইদিন ছেড়ে দিল! কেনো রাখলো না আগলে।
-” দাদা তুই। এখানে দাঁড়া, আমি দেখছি ও কোথায় আছে?”
সাম্য কে মলের সামনে দাঁড় করিয়ে সামান্তা চলে গেলো তার প্রিয় মানুষটাকে খুঁজতে। প্রিয় মানুষটার সঙ্গে আজ ও শপিং করবে, বিয়ের। সামনের সপ্তাহে ওদের বিয়ে।
———;
-” পিয়াল তুই ততক্ষণ সামনে যা, আমি গাড়িটা পার্ক করে আসছি। তোর বৌদি মলে চলে এসেছে, তুই গিয়ে ততক্ষণ ওর সাথে দেখা কর।”
পিয়াল কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে গেল। পরক্ষনেই কিছু মনে পড়তে, গাড়ির জানালা দিকে তাকিয়ে অভিকে বলল,
-” কিন্তু, আমি তো তাকে চিনি না!”
-” আচ্ছা তুই যা, আমি ওকে নিয়ে আসছি।”
ππππ
পিয়াল মলের সামনে যেতেই ওর মধ্যে এক অদ্ভুত ভালোলাগার সৃষ্টি হলো। তা বেশি প্রগাঢ় হলো যখন সামনে চোখে পড়লো সাম্যকে। তীব্র এক ঝাঁক ভালো লাগা নিয়ে ও এগিয়ে গেল সাম্যের দিকে। বিস্মৃত হয়ে গেল পুরোনো কিছু স্মৃতির কথা।
সরু ফ্রেমের চশমাটা চোখ থেকে খুলতেই আচমকাই যেনো ওটা হাত থেকে নীচে পড়ে গেল। মুখে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে সাম্য চশমাটা তুললো। আর তার চোখ পড়লো তার প্রাণায়ণীর দিকে। একটা মাসের ব্যবধানে অনেকটা অন্যরকম লাগছে পিয়ালকে। আগের তুলনায় অনেকটা বিধ্বস্ত লাগছে ওকে। চোখের তলায় কালো দাগ পড়েছে। সাম্য যখনই ওর দিকে এগিয়ে যেতে গেল, পিয়ালের মনে পড়লো ওদের বর্তমান পরিস্থিতির কথা। তাই আর আগালো না বরং পিছিয়ে গেল। পিয়ালের এই পিছিয়ে যাওয়াটা গভীর ভাবে ক্ষত বিক্ষত হলো সাম্যের হৃদয়ে। তৎক্ষণাৎ ও পিছন ফিরে গেলো। হাত দুখানা মুঠো করে চেপে ধরলো। এই মেয়েটার সামনে ও কিছুতেই ওর দুর্বলতা দেখাবে না, কিছুতেই না।
-” কী রে তোরা এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে! চল। ”
অভির দিকে তাকাতেই একপ্রকার অবাক হয়ে গেল পিয়াল। অভির পাশে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সামান্তা। পিয়াল খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো সামান্তার সঙ্গে অভির বিয়ে হচ্ছে। কিন্তু ওর বাবারা এটা কি করে মানলো, এটা ভাবতেই পারছে না পিয়াল।
-” বলছি অভি দা তোমরা কি শপিং করবে, না আমি চলে যাব। আমার এখানে একদম ভালো লাগছে না।”
-” আরে না না তোমাকে যেতে হবে না। এই সবাই চলো দেরি হচ্ছে।”
পিয়াল গভীর চোখে তাকিয়ে রইল সাম্যের দিকে কিন্তু সাম্য ওর দিকে তাকালো না। অভিদের সঙ্গে মলের দিকে পা বাড়ালো। পিয়াল চোখে জমে থাকা জল মুছে পা বাড়ালো। এইখানে দাঁড়িয়ে থেকে ও কিছুতেই বোঝাবে না কাউকে, যে ওর কষ্ট হচ্ছে। খুব খুব কষ্ট হচ্ছে।
ππππ
রাত সাড়ে নয়টা,
গাড়ির পিছনের সিটে জড়ো সরো হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে পিয়াল। সন্ধ্যার দিকে ওরা শপিং করতে এসেছিল। বিয়ের নানরকম কেনাকাটা করতে করতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। পড়ে ওরা রেস্টুরেন্টে ডিনার করে গাড়ির কাছে আসতেই অভি কিছু দরকারে সামান্তা কে নিয়ে পাশের একটা শপে গিয়েছে। মূলত ওরা চেয়েছিল
পিয়াল আর সাম্য কে একটু একা ছেড়ে দিতে। কিন্তু সাম্যের একটা ফোন এলে ও কথা বলতে একটু দূরে চলে যায়। অপরদিকে পিয়াল গাড়িতে ঘুমিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর সাম্য গাড়ির কাছে এলে পিয়ালকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে নিঃশব্দে গাড়ির দরজাটা খুলে সামনে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে পড়লো। পিয়াল মাঝে মাঝে নড়ে চড়ে উঠছে। বেচারি গাড়িতে বসে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারছে না। সাম্য নিজের দুই হাত মুড়ে হেলান দিয়ে বসলো, সামনের মিররে পিয়ালকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। নিজের মনে জমে থাকা অভিমান গুলোও যেনো আস্তে আস্তে কোথাও হারিয়ে গেল। খুব করে ওর বলতে ইচ্ছে করছে, ” তোমার কি ঘুম হয় প্রাণায়ণী? নিজেকে একা লাগে না! জানোতো আমি না ঠিক মত ঘুমাতে পারি না। রাতের নিঝুম সময় আমাকে দুই হাত বাড়িয়ে টেনে ধরে। আমি চেয়েও দুই চোখ এক করতে পারি না। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়লেও মাঝ রাতে চমকে উঠে পড়ি। সকালের প্রথম আলোয় আর নিজের পাশে তোমাকে পাই না। আমার পাশের জায়গাটা শূন্য হয়ে রয়েছে, কেনো? তুমি কি জানো? হ্যাঁ তুমি তো জানো। সব জানো,সেই দিন তোমাকে ছেড়ে মৈত্রী কে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম, তাই বুঝি এই শাস্তি! বেশ তোমার শাস্তিতে আমি জ্বলবো। কিন্তু তোমার এই বিধ্বস্ত রূপ কেনো? কিসের তাগিদে তোমার এই কষ্ট! কেনো তোমার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখ আমাকে বলছে, তুমি আমাকে খুব করে চাও!”
পিয়ালকে দেখতে দেখতে এক সময় সাম্যের চোখ দুই জোড়া বুজে আসে। একসময় সেও ঘুমিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর অভি আর সামান্তা ফিরে আসে। পিয়ালের ততক্ষনে ঘুম ভেংগে গেছে। অভি গাড়ি স্টার্ট দেয়। সামান্তা পিয়ালের পাশে বসে নিজের ক্লান্ত শরীরটা সিটে এলিয়ে দেয়।
গাড়ি কিছুটা দূর যাবার পর ঝাঁকুনিতে সাম্যের ঘুম ভেংগে যায়। প্রথমেই চোখ যায় সামনের মিররে। পিয়াল তখন সাম্যকে দেখতেই ব্যস্ত। হঠাৎই দুই জনের চোখে চোখ পড়ে গেলে পিয়াল নিজের চোখ সরিয়ে নিলো। সাম্যের মনে পিয়ালের এই রূপ ব্যবহার গভীর রেখাপাত করে। দুই জনেই নিজেদের দিকের জানালার দিকে তাকিয়ে রাতের গভীরতা মাপার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
——————
ব্যালকনির জানালা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মৈত্রী। জীবন এখন তাকে নতুন রূপ দেখাচ্ছে। জীবন সেই দিনের পর পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। ওর জীবনে আর কিছু নেই। সেই দিন ওর সব কথা শুনে শায়ন ওকে মুক্ত করে দিয়েছে। জোর করে ও বাঁধতে চায় না মৈত্রী কে। মৈত্রীর বাবাকে বুঝিয়ে মৈত্রীকে বাড়িতে দিয়ে এসেছে। এতে অবশ্য মৈত্রী খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু একটা দিন ঘুরতে না ঘুরতেই নিজের মাঝে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। তার সব ভাবনাকে যেনো শায়ন বলে দিয়েছে, ওর স্বামীকে নিয়েই কেবল ভাবতে। এখন ও আর সাম্যকে মনেই করে না। নতুন করে ও শায়নের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু শায়ন ওর জীবনের কোথাও নেই। ও এখন খুব করে চায় শায়নের কাছে ফিরে যেতে, কিন্তু শায়ন যে ওর ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যাকে এক সময় দূর ছাই করে গেছে, সে আর ওর জীবনের কোথাও নেই, হারিয়ে গেছে। গত একটা মাস ধরে ও শায়নকে খুঁজছে। কিন্তু তার অস্তিত্ব এর নাগাল ও মৈত্রীর হাতে নেই। ও বুঝে গেছে এটাই ওর কর্ম ফল। যা ও ভোগ করতে প্রস্তুত। এই বিচ্ছেদের মাঝে থাকা কষ্ট টাকে ফিল করতেও ওর ভালো লাগছে। খুব করে ভালো লাগছে।
(চলবে)
{ বিঃ: কালকে গল্পটি শেষ হলেও হতে পারে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন}