#ভাগ্য ৩ পর্ব
দুশ্চিন্তা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।
একবার মনে হয় আদিবকে বলে দেই আমি তার সাথে ইংল্যান্ড যাবো না, কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করি না করাটা কি ঠিক হবে।
আমি অনেক ভেবে সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম আদিবের সাথে ইংল্যান্ড যাবো না।
দরকার হয়, এই দেশে থেকে মানুষের বাসায় কাজ করে খাবো তাও আদিব পাষণ্ডের সঙ্গে আমি বিদেশে যাবো না।
মাকে ফোন করে বলি, মা আমি ইংল্যান্ড যাবো না এখানেই আদিব আমার উপর যে নির্যাতন করে বিদেশে নিয়ে গিয়ে কি যে করবে তার কোন হিসেব নেই।
আমার কথা শুনে মনে হয় আকাশ ভেঙে মায়ের মাথায় উপর পড়ছে,
ইসরাত তুই কি পাগল হয়ে গেলি, কি বলছিল এইসব, তুই জামাইয়ের সঙ্গে কেন যাবি না, না গিয়ে কই থাকবি, তোর আরো দুইটা বোন আছে তাদের বিয়ে দিতে হবে।
তুই যদি স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসিস মানুষে কি বলবে।
বলবে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে সংসার করতে না পেরে বাপের বাড়ি চলে আসছে, ছোট মেয়েগুলো আর কত ভালো হবে। তোর জন্য আমার আরো দুইটা মেয়ের জীবন নষ্ট হোক সেটা আমি চাইনা, তুই আদিবের সাথে ইংল্যান্ড যা, সেটাই তোর জন্য আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
মায়ের কাছ থেকে এমন কথা শুনে, আমার আর কিছু বলতে মন চাইল না ফোনটা কেটে দিলাম।
আমি আদিবের সাথে ইংল্যান্ড যাবো যা হবার হবে, আজ থেকে আমার কেউ নেই, আপনজনেরা আমাকে বুঝল না, না হয় ইংল্যান্ড নিয়ে আদিব আমাকে মেরে ফেলবে, আর বাঁচার ইচ্ছা নেই যা ইচ্ছে করুক।
ইংল্যান্ড যাবার দিন বাবা মা দুই বোন আসছে আমাকে বিদায় দিতে, আমি মা বাবার সাথে তেমন কথা বললাম না। ছোট বোনদেরকে বললাম ভালো মত লেখাপড়া করতে, ভালভাবে বুঝে শুনে চলতে।
এয়ারপোর্ট পর্যন্ত মা বাবা বোন, শ্বশুর শাশুড়ী আমাদেরকে এগিয়ে দিয়ে আসল।
আদিব আমাকে নিয়ে লন্ডন শহরে অভিজাত এক ফ্ল্যাটে উঠলো, সেখানেই শুরু হলো আমার পরবাস জীবন।
আদিব সকাল দশটায় অফিসে যায় আসে পাঁচটায়।
এসে খেয়ে রেষ্ট নিয়ে আবার বাহিরে চলে যায়, আসে রাত এগারোটা বারোটায়, এসেই সেই চিরাচরিত অত্যাচার।
সারাদিন আমি রুমের ভিতর আর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কাটাই, খুব একা মনে হয় নিজেকে। বাংলাদেশে থাকতে বাসায় শ্বশুর শাশুড়ী কাজের মেয়ে ছিল, তাদের সাথে কথা বলতে পারতাম।
এখানে সারাদিন রুমের ভিতর আমি একা, একদম ভালো লাগে না, অসহ্য অনুভূতি বন্দী জীবন।
আদিব পাঁচটায় এসে খেয়ে আবার যখন চলে যায় আসে মাঝ রাতে, একা একা এতো বড় ফ্ল্যাটে থাকতে ভয় পাই। আদিবকে একদিন বলেছিলাম এতো রাত করে বাসায় ফিরেন একা থাকতে আমার ভয় করে।
আদিব বলেছিল,
তোমার জন্য আমি সন্ধ্যা রাতেই রুমে বসে থাকি, আমার সব ফ্রেন্ডস তাদের বউকে নিয়ে নাইট ক্লাবে যায়, কত মাস্তি করে, আমার তো আর সেই ভাগ্য নেই, তোমার মত মেয়েকে নিয়ে কই যাবো, বাহিরেই তো যেতে পারি না লোকজন হাসাহাসি করবে যদি দেখে আমার মত ছেলের এমন কালো বউ।
কিছু বলার সামর্থ্য ছিল না আমার আদিবের কথা গুলো শুনে, অপমানের লজ্জায় আমার চোখে পানি চলে আসছে।
নিজেকে খুব ছোট মনে হয়, আদিব ঠিক বলেছে তার মত ছেলের বউ হবার কোন যোগ্যতা নেই আমার, আমার সব যোগ্যতা কেড়ে নিয়েছে আমার গায়ের কালো রঙ, দোষটা তো আমারি আমি কালো।
এখন আবার আরেক ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে, আদিব প্রায় প্রতিদিন তার ইংলিশ ফ্রেন্ডদের সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে আসে বাঙালী খাবার খাওয়াতে, আমাকে ভালো ভালো খাবার রান্না করে তাদেরকে খাওয়াতে হয়।
আদিবের ইংলিশ ফ্রেন্ড গুলো বাঙালী খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলে, মিস্টার আদিব তোমার ওয়াইফ হেব্বি জোস খাবার বানাতে পারে, সে কিন্তু দেখতেও অনেক সুইট।
ফ্রেন্ডসদের প্রশংসা শুনে আদিব অবাক হয়ে যায়, তার কাছে মনে হয় তার ফ্রেন্ডরা মজা করছে।
তার এক ফ্রেন্ড টনি মাভরোগর্দে আদিবকে বলল, রিয়েলি আদিব বাঙালী মেয়েরা অনেক সুন্দরী হয়, আমাদের দেশে সাদা চামড়ার মেয়ে গুলো কিন্তু সুন্দরী না, ফর্সা হলেই সুন্দর না ফেস সুন্দর হলেই সে সুন্দর।
টনির কথা শুনে আদিব আমার মুখের দিকে চেয়ে ছিল।
আদিব একদিন তার বসকে নিয়ে আসলেন আমার হাতের রান্না খাওয়ানোর জন্য।
বস দেখতে সেই লম্বা মোটা ফর্সা ধবধবে, এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল, আমি দূরে সরে গেলাম, বস মনে হয় অপমানিত বোধ করলেন, তাতে আমার কি।
রান্না করতে আমি কিচেনে গেলাম, আদিব আর বস মিলে ড্রিংক করছে, বুঝতে পারলাম পিছন থেকে কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরছে।
ভাবলাম আদিব, কিন্তু চেয়ে দেখি বস, আমি বললাম ছাড়েন আমাকে, বস আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমাকে, আমি চিৎকার করে আদিবকে ডাকলাম, আদিব কিচেনে আসার সাথে সাথে বস আমাকে ছেড়ে দিয়ে আদিবকে বলল,
আদিব তোমার ওয়াইফ আমাকে অপমান করছে, আমি চাইলে তোমাকে চাকরিচ্যুত করতে পারি, কিন্তু তা আমি করব না, তোমার ওয়াইফে আমার ভালো লাগছে, আমি চাই সে আজ রাতটা আমার সঙ্গে কাটাবে, তুমি তোমার ওয়াইফকে রাজী করাও না হলে তোমার চাকরি থাকবে না, অফিস থেকে তোমাকে এই ফ্ল্যাট আর গাড়ি দেওয়া হয়েছে সেগুলো কেড়ে নেওয়া হবে, তোমাকে লন্ডনের রাস্তায় পড়ে থাকতে হবে, আমার কথা মানবে কিনা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।
বস কথাগুলো বলে কিচেন থেকে বের হয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসল।
আদিব আমাকে বলল, ইসরাত তুমি কি চাও আমার চাকরি চলে যাক, সবকিছু কেড়ে নিক, যদি না চাও একটা রাতের জন্য বসের সঙ্গে রাত কাটাও।
আপনি কি বলছেন আমি পরপুরুষের সঙ্গে রাত কাটাব আপনি স্বামী হয়ে এই নির্দেশ, আসলে আপনি তো আমাকে কখনো স্ত্রী মনে করেননি, তাই আজ আমাকে পরপুরুষের হাতে তুলে দিতে আপনার বিবেকে বাধছে না। আমি আপনার এই অন্যায় আদেশ মানতে পারব না।
আমার কথা শেষ না হতে আদিব আমার গালে থাপ্পড় মেরে বলল, যা বলছি কর, এতো নীতিকথা শোনার সময় আমার নেই, রান্না শেষ করে ডিনারের পর সেজেগুজে বসের কাছে যাবি।
আমার মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করি, মরে যাবো তবু অন্য পুরুষের ভোগের সামগ্রী হবো না।
মৃত্যু ছাড়া আর উপায় নেই, কোথায় যাবো আমি এই শহরে কিছুই তো চিনিনা কোন আপন মানুষ নেই, বাংলাদেশ হলে এখনি বাসা থেকে চলে যেতাম।
কিন্তু কি করব এখন আত্মহত্যা করার সাহস ও পাচ্ছিনা, যা আছে কপালে আমি পালাবো। পিছনের দরজা দিয়ে আমি নিচে নেমে আসলাম, পা বাড়ালাম অজানা গন্তব্যে, ভাগ্যে কি আছে জানিনা, লন্ডন শহরের রাস্তা দিয়ে হাটছি আমি।
রাত দশটা বাজে কোথায় যাবো কার কাছে যাবো কিছু ভাবতে পারছিনা।
হাটছি তো হাটছিই মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে হেটে চলছি, লন্ডনের রাস্তায় বড় বড় ঘড়ি লাগানো, ঘড়িতে দেখলাম রাত দুইটা, আমি সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে হাটছি।
খুব পানি তৃষ্ণা পেয়েছে, সামনে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে এগিয়ে গেলাম ভাবলাম এক গ্লাস পানি খাবো আর কিছুক্ষণ বসে রেষ্ট নিবো।
চলবে,,,
সাদমান হাসিব সাদ