উমা পর্ব -১৩

#উমা [কপি করা নিষেধ]
#১৩তম_পর্ব

ব্যাগটা নিয়ে নিচে নামতেই রুদ্রের চক্ষুচড়ক গাছ। সে কল্পনাতেও ভাবে নি এই সময়ে তার সামনে শাশ্বতের আগমন ঘটবে। বলা নেই কয়া নেই শহর থেকে শাশ্বত এসেছে। সে তো শুধু বছরে এক বার ই গ্রামে আসে। কিন্তু এখন তার আসার কি কারণ। শাশ্বতের আকস্মিক আগমনে অভিনব সিংহের থমথমে মুখে বাক্য নেই। শাশ্বত কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে অবাক কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“রুদ্র কি কোথাও যাচ্ছিস?”

আমতা আমতা করে রুদ্র বললো,
“কাজে যাই”
“কি কাজ? আমি যতদূর জানি গ্রামের বাহিরে তেমন কোনো কাজ নেই মামা মশাই এর। কি কাজে যাচ্ছিস?”

শাশ্বতের হঠাৎ প্রশ্নে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রুদ্র। সে কিছু বলার আগেই অভিনব সিংহ গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
“ও বেনাপোল যাচ্ছে শাশ্বত। বর্ডার থেকে আঙ্গুর আসছে। জানোই তো শীত এসেছে। এখন ফলফলাদি আসবে, বেশ কিছু মালামাল ও আসছে। আমাদের আমদানি রপ্তানির ব্যাবসা৷ প্রতি মাসেই বেশ কিছু মালামাল আসে, আবার যায়। এ নিয়ে এতো প্রশ্নের কি আছে? প্রতিবার আমি যাই, এবার রুদ্র যাবে।”

শাশ্বত, মামা মশাই এর উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না। কারণ একজন গ্রামের চেয়ারম্যানের এতো বড় ব্যাবসা হওয়াটা পূর্বে সন্দেহ না জাগালেও এখন কেনো যেনো খটকা লাগছে। মালামাল আমদানি রপ্তানি ব্যাবসা অভিনব সিংহের। ব্যাবসাটা প্রথমে এতো বড় ছিলো না, অভিনব সিংহের পিতার মৃত্যুর পর সে এই গ্রামের চেয়ারম্যান হন। তাদের কারবার বলতে গ্রামের বাজারের বড়ো চালডালের আরদটাই ছিলো। এই আরদের ব্যাবসা হুট করেই আমদানী রপ্তানিতে পরিবর্তিত হলো। গ্রামের চেয়ারম্যান রাজনীতিতে যোগ দিলেন। বিভিন্ন পার্টির উচ্চপদস্থ নেতাদের সাথে বেশ ভালোই পরিচিতি হলো অভিনব সিংহের। তিনি চাইলে শহরে পাড়ি জমাতেই পারতেন কিন্তু গ্রামের সত্ত্বা ছাড়তে চাইলেন না। এটা অবশ্য একটা দিকে বের উপকার ও হয়েছে। দলের লোকে তার একটা বেশ ভারী প্রভাব রয়েছে। উপজেলার চেয়ারম্যান পদেও তিনি বিগত পনেরো বছর যাবৎ এক তরফা জিতে আসছেন। কিন্তু একটা আরদ ব্যাবসায়ীর এতো দাপট কিভাবে? শুধু রাজনীতিতে নেতাদের সাথে ভালো সম্পর্ক তাই? শাশ্বত অংক মেলাতে পারছে না। গণিতে যেমন ডানপক্ষ এবং বামপক্ষের মিল হলেই সমাধান বেড়িয়ে যায় ঠিক তেমন ই জীবনের গণিতেও ডানপক্ষ বামপক্ষ মিলাতে হয়। নয়তো অজানা সংখ্যাটির মান বের করা যায় না। শাশ্বত সেই অজানা সংখ্যাটি ই খুঁজতে এসেছে। ইচ্ছে করেই সে ঢাকা থেকে বদলি টা বিভাগীয় শহরে না করে সাতক্ষীরার মতো ছোট জেলায় করেছে। শাশ্বতের এই হুট করে বদলিটা মামা মশাই এর অজানা থাকাটাই শ্রেয়। সময় আসলে সব কিছুই সবাই জানবে। মামামশাই মাত্রাতিরিক্ত বুদ্ধিমান ব্যাক্তি। তিনি খুব সহজেই শাশ্বতের আকস্মিক আবির্ভাবের কারণ বের করে ফেলবেন। তাই তার সন্দিহান নজর এড়াতে শাশ্বতও রুদ্রকে ছেড়ে দিলো। ঠোঁটে হাসির প্রলেপ একে বললো,
“মামামশাই, রাগ করবেন না। আমি তো এমনেই প্রশ্নটি করেছি। কৌতুহল বলতে পারেন।”
“বেশি কৌতুহল কিন্তু ভালো নয় শাশ্বত”
“কৌতুহল না থাকলে রহস্যের উম্মোচন কি করে করবো বলুন তো মামামশাই? তাহলে তো আমার সাংবাদিকতাই বৃথা।”

অভিনব সিংহ দমলেন। শাশ্বতকে ঘাটানোটা ঠিক উচিত হবে না। ঘুমন্ত সিংহ জাগলেই বিপদ। মহা বিপদ। নিজের ক্ষীন ভয়কে নিপুন ভাবে আড়াল করে তিনি রুদ্রের উদ্দেশ্যে বললেন,
“মা এর নাম নিয়ে বের হও। তিনি চাইলে এবারের কাজে কোনো বিপদ হবে না আশা করি।”
“জ্বী বাবা, ভরসা রাখুন। কোনো অসুবিধা হবে না”

রুদ্রের সাথে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দৃষ্টি বিনিময় ঘটলো শাশ্বতের। এই দৃষ্টি বিনিময় প্রতিদ্বন্দীকে ভয় দেখানোর প্রচেষ্টা। তাকে সতর্ক করা, সাবধান করা যেনো তার সীমানা লঙ্ঘন না করে শত্রু৷ শাশ্বতের ঠোঁটে হাসির প্রলেপ, চোখে এক অদ্ভুত রহস্য। রুদ্র বেরিয়ে গেলো। লক্ষী দেবী প্রনাম করে বললেন,
“দূগগা, দূগগা”

রুদ্রের চলে যাবার পর নিজ ঘরে আসে উমা। ঘরটা নিস্তব্ধ, কোনো চিৎকার নেই, কোনো কোলাহল নেই। কারোর নিষ্ঠুরতার ছাপ নেই, নেই কোনো ক্রুদ্ধতা। টেবিলের উপর অবহেলিত আলতার বাটিটি পরে রয়েছে। বিকেলের সেই মূহুর্তগুলো চোখের সম্মুখে ভেসে উঠলো। মূহুর্ত যেনো জীবন্ত। রুদ্রের যাবার পর থেকেই এক অদ্ভুত বিষন্নতা ভর করলো উমার হৃদয়ের প্রাচীরে। কেনো যেনো এক সূক্ষ্ণ শূণ্যতা অনুভব হচ্ছে উমার। শুন্যতার কারণ কি! রুদ্রর অনুপস্থিতি! উমার জানা নেই এই শুন্যতার কারন। বিছানায় গা এলিয়ে উমা। ক্লান্ত বিষন্ন চোখজোড়া নিমিষেই বুজে আসে। তলিয়ে পড়ে ঘুমের সমুদ্রে।

৯.
রকিবুল মাষ্টারের ঘরে বসে রয়েছে শাশ্বত। তার সামনে তেলের পিঠা এবং পেয়ারা কেটে দেওয়া হয়েছে। রকিবুল মাস্টারের বউ হাসনা তাকে আপ্পায়ন করতে ব্যাস্ত। চেয়ারম্যানের ভাগ্নে বলে কথা। তার সম্মান তো রাখতেই হয়। শুধু রকিবুল মাষ্টার নির্বিকার। সে সরু দৃষ্টিতে শাশ্বতের দিকে চেয়ে রয়েছে। তার মনে বহু প্রশ্ন। ছেলেটা পুজোর সময় বেশ তার আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে। তথ্য যোগাড় করতে নানা ভাবে নিজের উপর বিশ্বাস তৈরি করতে চেয়েছে, কিন্তু রকিবুল মাষ্টারকে ভোলানো এতো সোজা নয়। সে কিছুতেই ভুলবার ব্যাক্তি নয়। তাই নিপুন ভাবে কাটিয়ে দিয়েছে সকল কিছু। তবে এখন মনে হচ্ছে আটঘাট বেঁধে এসেছে শাশ্বত, তাই তো কথায় কথায় বারংবার তার মেয়ের কথা তুলছে। শিমুল সাতক্ষীরার সরকারি কলেজে ইন্টার পড়ছে। মেয়েটি গ্রামের প্রথম মেয়ে যে কি না মেট্রিক পাশ দিয়ে সাতক্ষীরা জেলায় প্রথম হয়েছে। তাই জেলা কমিশনার নিজ থেকে মেয়েটিকে খরচা দিয়ে ভালো সরকারী কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। শাশ্বত বারবার শিমুলের কথাই তুলছে। হাসনা ঘরের ভেতর চলে গেলে রকিবুল মাষ্টার ভনিতা ছেড়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“এতো সক্কালে আমার কাছে কি চাই তোমার? শুধু শিমুলের খোঁজ দিতে তো আসো নি তুমি। তাহলে?”
“উত্তর চাই? প্র্শ্নের উত্তর। প্রশ্নগুলো কি তা আপনার জানা”
“যদি না দেই?”
“সমস্যা নেই, আমি আবার আসবো। বারবার আসবো। প্রশ্নের উত্তর যে আমার চাই রকিব সাহেব”

শাশ্বতের উত্তরে হাসলো রকিবুল মাষ্টার। তার হাসিতে তাচ্ছিল্য, তারপর হাসি থামিয়ে বললো,
“বেশ তবে এবার আসো।“
“উত্তর দিবেন না তবে?”
“নাহ, আজ দিবো না। আগে তুমি নিজে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করো, গ্রামের দক্ষিণের নদীতে একটা ব্রীজ করা হয়,। উপজেলার চেয়ারম্যান হিসেবে ব্রীজটা তোমার মামাই করেছিলেন কিন্তু ব্রীজটা এক মাসের ভেতর ভেঙ্গে যায়। যে ইঞ্জিনিয়ার পদে ছিলেন তিনি গায়েব। কোথায় তিনি? খুজে আনো, নয়তো উত্তর আনো”

রকিবুল মাষ্টার কথায় মাথায় বাজ পড়ে শাশ্বতের। একটা ব্রিজ ধসেছে অথচ এই খবর উপজেলা থেকে বের হয় নি। এও কি সম্ভব? তোর শব্দ নেই, কোনো তথ্য নেই একজন ইঞ্জিনিয়ার উধাও তো হয়ে যাবে না। তার কিছু তো তথ্য হবে। শাশ্বতের চিন্তিত মুখখানা দেখে হাসে রকিবুল মাষ্টার। তারপর বলে,
“উত্তর নিয়েই আসবে, কেমন? এবার আসো”

শাশ্বত কথা বলে না। একরাশ প্রশ্ন এবং চিন্তার স্রট ণীয়ে বেরিয়ে যায় রকিবুল; মাষ্টারের বাড়ি থেকে। মাথাটা শুন্য হয়ে রয়েছে। রহস্যের জাল তাকে মাকড়সার জালের ন্যায় জড়িয়ে ফেলছে। এই মনে হচ্ছে জালের প্রকটতায় দম আটকে যাবে শাশ্বতের। গ্রামের পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শাশ্বত। সূর্যের প্রখরতা তাকে ছুয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তার দৃষ্টি নেই। তার মস্তিষ্ক একটাই প্রশ্ন করছে। ব্রীজটা ভাঙ্গলো কিভাবে? আর ইঞ্জিনিয়ার কোথায়?

গভীর রাত,
বর্ডারের সীমান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। সাথে পাঁচজন লোক। মালের গাড়ি প্রবেশ করছে চোরাই পথে। একে একে মাল বুঝে নিচ্ছে রুদ্র। মুখে প্রশান্তির হাসি। এবার বাবা সন্তোষের কারণ হবে সে। হঠাৎ কালো অন্ধকার চিরে একটা সোনালি আলো চোখে এসে বিধলো রুদ্রের। চোখ কুচকে এলো তার। তখনই…………………

চলবে

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here