#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩০তম_পর্ব
দু দিন পর,
শাশ্বত চেয়ারে বসে রয়েছে। সামনে থাকা গোলাকার পেপার ওয়েটটির দিকে তার নজর। ঠোঁটের কোনায় বিস্মিত হাসি। আজ সকালে খবর পেয়েছে এবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অভিনব সিংহ দাঁড়াচ্ছে না। অথচ রুদ্র মেম্বারের পদে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা তাকে শুধু বিস্মিত ই করে নি, বিনোদন ও দিয়েছে। বাপ ছেলে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছে কিন্তু সংগোপনে। এখন তার সামনে একটা প্রশ্ন, প্রশ্ন টা সহজ। সে কার হয়ে লড়বে এবং কার বিপক্ষে লড়বে! নাকি সে সমাজবাদী পার্টির মতো দুজনের বিরুদ্ধে লড়বে। শাশ্বত গভীর চিন্তায় মগ্ন ঠিক সেই সময় একখানা খাম দিয়ে যায় পিয়ন। খাদি খামটা দেখে খানিকটা অবাক হয় শাশ্বত। অবাক কন্ঠে বলে,
“কে পাঠিয়েছে মন্সুর মিয়া?”
“জানি না স্যার”
পিয়ন চলে গেলে খামটি খুলে শাশ্বত। খামটি খুলতেই হাসির প্রলেপ বিস্তৃত হয় তার। সে বুঝে গেছে কার পাল্লা ভারী। শাশ্বতের মামা মশাই অর্থাৎ অভিনব সিংহ এতোকাল নিজের এক অভেদ্য প্রাচীর গড়েছিলেন। আজ সেই অভেদ্য প্রাচীরে ফাটল ধরেছে। আর এই সূক্ষ্ণ ফাটলের নাম রুদ্র। খামটিতে সেই নীলনকশা রয়েছে যাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে অভিনব সিংহের লংকায় আগুন জ্বলতে বেশি সময় বাকি নেই। কিন্তু রুদ্র এতোটাই ধূর্ত সে ঠিক নিজেকে সেই আগুনের তাপ থেকে বাঁচিইয়ে নিবে। ইতিহাস জানে, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরেজ হারালেও সেখানে ঘি ঢেলেছিলো মীর জাফর। অভিনব সিংহের ক্ষেত্রে সেই মীর জাফরটি তার আপন পুত্র রুদ্র। কিন্তু প্রশ্নটি একটি খামটি কে পাঠালো! সে কি চায়! শাশ্বত মনে মনে স্থির করলো সে এখন রুদ্রের সাথে থাকবে, কারণ পরিষদে রুদ্র নিজের এক চ্যানেল বানিয়ে ফেলেছে, সেই চ্যানেল অনুসারে আসছে ভোটে সে শুধু বিজয়ী ই হবে না, আগামী নির্বাচনে তাকে চেয়ারম্যানের পদে দাঁড় করানো হবে। রুদ্র এই রাজনীতিতে এসেছে মাত্র এক মাস, অথচ সে অভিনব সিংহের বিরুদ্ধে বিষাক্ত জাল বুনেছে, যে জালে অভিনব সিংহ পা রাখলেই চোরাবালির ন্যায় তলিয়ে যাবে। তবে শাশ্বতের একটি ব্যাপার কিছতেই মাথায় ঢুকছে না, ছেলে হয়ে নিজের পিতার বিরুদ্ধে এতো ভয়ংকর ষড়যন্ত্র রুদ্র কেনো করছে! কি এমন কারন রয়েছে যার জন্য রুদ্র ই অভিনব সিংহ এর সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছে, রকিবুল মাস্টার এবার আবারো সাহস করে নির্বাচনে দাঁড়াবেন। এবার তার চেয়ারম্যান হবার সম্ভাবনা অধিক। কিন্তু রাজনীতির চালটি দাবার মতো, ঘোড়ার আড়াই চাল কখন কিভাবে সব এলোমেলো করে দেয় সেটা আন্দাজ করা দুষ্কর। এবার খেলা জমেছে, দেখা যাক এই খেলায় কে বাজীমাত করে!
১৭.
মাঘের মাঝামাঝি, নিন্মচাপের আবির্ভাব বাড়ছে। দুদিন ধরে কেমন নরম আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ, সূর্যের প্রভা যেনো কালো মেঘের আধারে কোথাও ঢেকে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, শীত ও বেড়েছে। চাদরেও শীত কাটছে না। অনেকে বলছে তাকি ঘূর্নিঝড় হবে, হলেও হতে পারে। বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে এই সাতক্ষীরা জেলার উপর তো কম ঝড় যায় না। আর সবথেকে বেশি ঝুকিতে থাকে গ্রামাঞ্চল। উমার ঘুম প্রতিদিনের ন্যায় আপনাআপনি ভেঙ্গে যায়। শাড়িখান জড়িয়ে স্নানে যায় সে। শীতে স্নান করার পর গায়ে কাটা দেয় ফলে চেয়ারের উপর থাকা লাল কার্টিগানটি গায়ে জড়ায় উমা। ভোরের সূর্য ঢাকা পড়েছে কালো মেঘের আধারে। রুদ্র তখন ও লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুম। উমা আয়নার সামনে দাঁড়ালো ভেজা চুলটা ছেড়ে দিতেই সাপের মতো নেমে এলো কাধ বেয়ে। আয়না দিয়ে রুদ্রের ঘুমন্ত স্নিগ্ধ মুখখানা দেখতে পাচ্ছে সে। কাল রাতের মূহুর্তগুলো জীবন্ত হয়ে যায় উমার চোখে। উমা খেয়াল করো রুদ্রের সান্নিধ্য পেতেই কেমন যেনো নেতিয়ে পরে উমা। মোম যেমন অগ্নির কাছে যেতেই গলে যায়, তার অবস্থাটিও তাই হয়েছে। যে মানুষটির স্পর্শ তাকে বিষিয়ে তুলতো আজ সেই মানুষটির বেষ্টনিতে থাকতে মন আকুল হয়ে উঠে। এ বাড়িতে আসার পর যেনো তা বহুগুনে বেড়ে গিয়েছে। উমার মনে হুট করেই একখানা দুষ্টুমি খেলে গেলো, সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রুদ্রের দিকে; ভেজা চুলের মাথা থেকে শীতল জলবিন্দু গড়াচ্ছে, সেই চুলগুলো ঝাড়তেই রুদ্রের মুখে পানি ছিটা পড়লো। পৌষের ঠান্ডায় গায়ে কাটা দিলো রুদ্রের। কপাল কুঞ্চিত করে চোখ মেলতেই উমা খিলখিল করে হেসে উঠলো। রুদ্রের রাগ যেনো বাস্পীভূত্ হলো উমার কোমল কল্লোলে, হবে না কেনো ষোড়শী মুক্তদানা হাসি যে তার হৃদয় ভেদ করে। ভোরের উমার স্নিগ্ধতা তার শীতলে হৃদয়ে উষ্ণতার ওম দেয়। রুদ্র ও কম যায় না, হাত টেনে নিজের কাছে টেনে নেয় উমাকে। উমা ভীত কন্ঠে বললো,
“কি করছেন?”
উত্তর দেয় না বরং বাঁকা হাসি হাসে রুদ্র। তারপর শক্ত করে নিজ বেশ বেস্টনীতে নিয়ে অধর ছোয়ায় উমার কোমল অধরে। রুদ্রের এমন কার্যে লজ্জায় লাল হয়ে উঠে উমা। কোমল গালে রক্ত জমে। অধর আলাদা হতেই উমা লজ্জায় বুক গুজে রুদ্রের বুকে। তার হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। নিশ্বাস ঘন হচ্ছে। রুদ্র ভাবে তার ষোড়শী হার মেনেছে। কিন্তু তার ষোড়শী তাকে অবাক করে দু হাত মেলে জড়িয়ে ধরে তাকে। উমার এমন কার্যে অবাক হয় রুদ্র। কাছে তো আগেও এসেছে সে। প্রতি রাতে আসে, কিন্তু উমা নিজ থেকে কখনোই তার আবেশে নেয় নি রুদ্রকে। বরং সর্বদা একটা ভীত নজরে তার দিকে চাইতো সে। উমার এমন কার্যে অবাক কন্ঠে রুদ্র প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে উমা?”
উত্তরে কেমন ছলছল নয়নে তার দিকে যায় উমা। সেই চাহনী যেনো অনেক কিছু ব্যাক্ত করছিলো। তবুও কন্ঠের তৃষ্ণা রুদ্রকে উতলা করে তুললো, রুদ্র ব্যাগ্র কন্ঠে বলল,
“কাঁদছো কেনো?”
উমা উত্তর দিলো না, শুধু চোখের কোনা দিয়ে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো। রুদ্র গভীর চুম্বন দিলো তার চোখে, পুনরায় বলল,
“বললে না যে কাঁদছো কেনো?”
“আমার ভয় হয়”
এবার মুখ খুললো উমা, রুদ্র আকুল কন্ঠে বললো,
“কিসের ভয়?”
“হারানোর ভয়”
“আমায় হারানোর ভয়? আমি তো জানতাম আমার মত নিষ্ঠুর মানুষটিকে কেবল ঘৃণা করো তুমি। তাহলে এই ভয়টা কেনো?”
রুদ্রের প্রশ্নে থমকে যায় উমা, হ্যা লোকটিকে ঘৃণা করতো। খুব ঘৃণা করতো। এই বিয়ের প্রথম রাত থেকে ঘৃণা করতো। কিন্তু এখন সেই ঘৃণাটি যেনো কোথাও মিলিয়ে গেছে। মনমন্দিরের দ্বারে প্রবল বেগে এই মানুষটি করা নেড়েছে। যা উপেক্ষা করাটা ছোট্ট উমার পক্ষে সম্ভব নয়। লোকোটি খারাপ উমাও জানে, রাগ উঠলে কিছুই মনে থাকে না। কিন্তু এই লো্কটিই তার পেছনে ঢাল হয়ে থাকে। তার জীবনের নিভু দীপখানা জ্বালিয়ে নিকষকৃষ্ণ পথে আলোর কীরন দিয়েছে। এই লোককে কিভাবে ঘৃণা করবে সে। তার জানা নেই ভালোবাসা কি, তার জানা নেই প্রেম কি। তবে এটুকু জানে রুদ্র ছাড়া জীবনটা তার বৃথা। তার মস্তিষ্ক, হৃদয়, সর্বত্র কেবল একজন পুরুষের রাজত্ব, সে কেবল রুদ্র। রুদ্র হাল ছেড়ে দিলো, ভাবলো উমা তাকে কখনোই আপন করে নিবে না। উমার নরম মনে তার বাজে প্রভাব ফেলেছে সে, জোর করেছে ইচ্ছের বিরুদ্ধে। এই মেয়েটি কেনো তাকে ভালোবাসবে। কম অত্যাচার তো করে নি সে। রুদ্রের হৃদয় আহত হয়। সে উমাকে ছেড়ে দিতে নিলেই উমা তাকে অবাক করে আরোও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে। ধীর স্বরে বলে,
“যাকে মনে ঠায় দিয়েছি, তাকে ঘৃণা কিভাবে করি”
ষোড়শীর শান্ত বাক্যে কি জানি ছিলো। কঠিন রুদ্রের চোখের কোনায় আবেগ জমলো। আপ্লুত হৃদয় যেনো আজ বাধ মানছে না। হাতের খোলা বাধন হলো শক্ত, সুগভীর। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সর্বগ্রাসী অগ্নির ন্যায় তুমি
যতবার ছুয়ে যাও
ততবার পুড়ি
ছারখার হই
তবুও খেই হারা পথিকের ন্যায় বারে বারে তোমার কাছে আসি
চরম অবহেলায় বুজে আসা আখির নেত্রে শুধু তোমাকেই রাখি
ভঙ্গুর হৃদয়ের শুধু একটাই বুলি
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি” ………………………
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩১তম_পর্ব
ষোড়শীর শান্ত বাক্যে কি জানি ছিলো। কঠিন রুদ্রের চোখের কোনায় আবেগ জমলো। আপ্লুত হৃদয় যেনো আজ বাধ মানছে না। হাতের খোলা বাধন হলো শক্ত, সুগভীর। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“সর্বগ্রাসী অগ্নির ন্যায় তুমি
যতবার ছুয়ে যাও
ততবার পুড়ি
ছারখার হই
তবুও খেই হারা পথিকের ন্যায় বারে বারে তোমার কাছে আসি
চরম অবহেলায় বুজে আসা আখির নেত্রে শুধু তোমাকেই রাখি
ভঙ্গুর হৃদয়ের শুধু একটাই বুলি
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি”
রুদ্রের চোখের পানে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো উমা। চোখ থেকে নোনাজলের স্রোত গড়িয়ে পড়লো, কোমল গাল জোড়া ভিজে এলো। এই জলের উৎস কোনো বেদনা কিংবা বিষাদ নয় বরং প্রশান্তির উষ্ণ পরশ। রুদ্র উমার দিকে আবেগপ্রবন চাহনীতে তাকিয়ে রইলো। প্রবল আকাঙ্ক্ষায় তৃষিত হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠলো। তীব্রর নিষিদ্ধ ইচ্ছা ডানা মেললো সংগোপনে। বাধাহীন মিলনে লিপ্ত হলো কপোত কপোতী। শীতল মাঘের প্রকোপের মাঝে দুটি হৃদয়ের অবাধ্য ভালোবাসায় উষ্ণ হয়ে উঠলো শীতল ঘরটি।
এখানের হেসেলটি গ্রামের মতো না, গ্যাসের চুলো অথচ ম্যাচ লাগে না। বেশ দাম দিয়ে কিনেছে রুদ্র। শহরের ধাচে অনেকটাই সাজানো গুছানো। উমা রান্না সেরে তারপর যায় কলেজে। রুদ্র নির্বাচনের কাজে তাড়াতাড়ি বের হয়। তাকে খাবার প্যাকেট করে দিতে হয়। নয়তো বান্দা বাসায় আসে সেই রাতে, কাজের টানে খেতেই ভুলে যায় সে। বেশ কর্মঠ হয়েছে রুদ্র। সকাল সকাল বেরিয়ে দোকানে যায়, সেখানে কাজ সেরে পরিষদের অফিসে যায়। আগের ন্যায় বেলা অবধি ঘুমোয় না সে। উমার তাই রান্নাটা সকালেই সেরে ফেলতে হয়। উমার কলেজ শেষ হয় একটা নাগাদ, তারপর প্রাকটিক্যাল থাকলে থাকতে হয় নয়তো বাড়ি চলে আসে সে। বাসায় এসে একা একা ই খেতে হয় তার। রুদ্র টেলিফোন লাইন নিয়েছে, তাই মাঝে মাঝে রাজশ্রী এবং গোপালের কন্ঠটি শোনার ভাগ্য হয় তার। আগে মনে হতো চেয়ারম্যান বাড়ি বন্দী শালা কিন্তু এখন এই বাড়িটিকে বন্দীশালা লাগে তার। ও বাড়িতে শাশুড়ী ছিলেন, পিসি ছিলেন, সবথেকে বড় ফুলির মা ছিলেন। ফুলির মা মানুষটার সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করতে ভালোই লাগতো তার। কিন্তু এখানে সারা বাড়ি জুড়ে দুটো জীব। একজন কাজের মহিলা আছেন, কিন্তু সে ছোটা কাজ করে। তার নখরা অন্যরকম। উমা কতোবার বললো,
“মাসি, স্নান করে পুজোর ঘর কুড়িয়ো”
কিসের কি, চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা হিনহিনে স্বরে সাফ মানা করে দিলেন,
“তোমার এক ঘর কুড়োতে আমার স্নান করতে হবে? দুবার স্নান করবো নাকি?”
উমাও তেজ দেখিয়ে বলেছে,
“তাহলে আমার পুজোর ঘরে তুমি পা দিবে না।“
উমাকে আজকাল গিন্নী গিন্নী ঠেকে রুদ্রের কাছে। ও বাড়িতে একটা মোবাইল কিনে পাঠিয়েছে, কিন্তু নে্টওয়ার্ক না পাবার কারণে পনেরো হাজার টাকার যন্ত্রটি হয়ে গেছে নির্জীব জড় পদার্থ। উমা চিঠি লেখে, তার চিঠি লিখতে খুব ভালো লাগে। রাজশ্বীর বেশ ভালোভাবে পড়তে পারে বিধায় তার দায়িত্ব চিঠি পড়ে সবাইকে শোনানো। লক্ষী দেবী ছেলের জন্য ব্যাকুল হয়েছেন। কিন্তু কাজের চাপে রুদ্রের ও বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না। যদিও কারণটি সেটি নয়। আসল কারণটি উমার জানা নেই। রুদ্র স্নান সেড়ে কালো একখানা শার্ট পড়েছে। লোকটিকে দেখতে একেবারে উত্তম কুমারের ন্যায় লাগছে। ফর্সা মুখে চাপ দাঁড়িটি বেশ চমৎকার বানিয়ে। উপরে ঘোলাটে চোখে এক অজানা আকর্ষন। টেবিলে বসে সে হাক দিলো,
“কই গো, নাস্তা দাও। দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।“
“দেরী টি কি আমার জন্য হচ্ছে?”
“বাহ রে আমি কি করলুম? সকালে দুবার স্নান আমার কার জন্য করা লেগেছে শুনি?”
উমা চোখ গরম করে ঈষৎ রাগান্বিত কন্ঠে রুদ্র দমলো। হ্যা, দোষটি বেশিরভাগ ই তার। কিন্তু উমার ও রয়েছে, কে বলেছে এতো মায়াবিনী হতে? রুদ্র অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে বলল,
“নব্বই ভাগ নিলেও দশ ভাগ দোষ তোমার আছে”
“কি করে শুনি?”
“এতো সুন্দরী বউ থাকলে ভালোবাসতে ইচ্ছে হবে না?”
“তাহলে হোক দেরী, আমি তো মা দূর্গা নই। আমার দুটো হাত।“
স্পষ্ট স্বরে কথাটা বললো উমা। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“এজন্যই বাবাকে বলেছিলাম, বাচ্চামেয়ে বিয়ে দিয়ো না। এরা বড্ড ঝগরুটে”
“তা কে বলেছিলো শুনি, ভরা লোকের সামনে আমাকে সিঁদুর পরাতে?”
উমা ছেড়ে দেবার পাত্রীটি নয়। সে তার বিতর্ক যুদ্ধে আজ রুদ্রকে পরাজিত করবেই। রুদ্র উঠে তার পেছনে দাঁড়িয়ে বললো,
“সেখানেও কোথাও না কোথাও তোমার দোষ, কে বলেছে এতো মায়াবন বিহারিনী হতে?”
“হয়েছে, টেবিলে বসুন। আলুরদম হয়ে গিয়েছে।“
“আজ, লুচি আলুর দম?”
“হ্যা, ভাত হতে একটু দেরি হবে। হলেই টিফিনে পুড়ে দিচ্ছি।“
ঠিক সেই সময়ে বসার ঘরে রাখা ফোনটি বেজে উঠে। রুদ্র ফোনটি ধরে। পরমূহুর্তে তার মুখোভাব পালটে যায়। ধীর স্বরে বলে,
“বিকালে দোকানে আসিস, সেখানেই তোর সাথে কথা বলবো আমি।“
ফোন রেখে দিতেই উমা প্রশ্ন করে উঠে,
“কার ফোন এসেছে? গ্রাম থেকে?”
“না গো, নির্বাচনের কাজে”
পুরোপুরি কথাটা এড়িয়ে যায় রুদ্র। উমা সেদিকে মনোবেশ না করে বলে,
“নির্বাচনের কেন্দ্র আমাদের কলেজ ও হয়েছে জানেন?”
“জানি, সেদিন তো তোমার বন্ধ।“
“হ্যা, সারাদিন বাসায় ই তাকতে হবে।“
“আচ্ছা, পড়ালেখা ভালো হচ্ছে তো? মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়া কিন্তু চারটে খানি করা না? বহু মানুষের মধ্যে বাছাই হয়। আর লেটার না পেলে কিন্তু চলবেই না। এখন নতুন কি এক গ্রেড সিস্টেম করেছে। জিপিএ ফাইভ বলে। তাই কিন্তু ভালো করে পড়তে হবে।“
উমা বোকা হাসি দিলো, লোকটির সবকিছুর মাঝেও উমার পড়ালেখার দিকে খোঁজ আছে দেখে বেশ খুশি ই হলো সে। রুদ্র চলে যাবার পর সব গুছিয়ে নিলো। নয়টা বাজলেই রওনা দিবে। আজ নয়টার ক্লাসটি হবে না। নতুন সই, নতুন পরিবেশে মন্দ লাগছে না উমার। পড়াশোনার বেগ ও মন্দ নয়। শুধু একটু বেশি কষ্ট করতে হচ্ছে কারণ সে বড্ড পিছিয়ে আছে।
সূর্য পশ্চিমে হেলে গেছে। চারটা বাজতেই আজকাল বিকেল হয়ে যায়। দোকানে অপেক্ষা করছে রুদ্র। অপেক্ষা শাশ্বতের। শাশ্বত টেলিফোন করেছিলো। খবর নিয়ে জেনেছে শাশ্বত নাকি সাতক্ষীরাতেই বদলি হয়ে এসেছে। তার মনোবাঞ্ছা এখনো জানতে পারে নি যদিও তবে এটা তার জন্য যে শুভ নয় সেটা রুদ্র জানে। শাশ্বত এলো সাড়ে চারটার দিকে,
এসেই হেসে বললো,
“আসলে কাজের জন্য দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিলি কি?”
রুদ্র বিরক্তি প্রকাশ করলো। চোখ কুচকে বললো,
“কেনো এতো জরুরী তলপ?”
“আরে দাঁড়া এতো তাড়া কেনো? একটু বসতে দে। সময় তো আছে”
“দেখ শাশ্বত অহেতুক সময় নষ্ট করার সময় আমার নেই, আজ কাজ শেষ দ্রুত যাবো বাড়ি। উমা একা রয়েছে বাসায়।“
“ওহ, তাহলে ছোট করে বলি। কান টানলে মাথা আসে জানিস তো?”
শাশ্বতের প্যাচানো কথায় চোখ কুচকে আসে রুদ্রের। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,
“সোজাসোজি বল কি বলতে চাস?”
“এতোকাল অভিনব সিংহ অর্থাৎ মামা মশাই কি কি কার্য সাধন করেছে তার সকল প্রমাণ আমার কাছে আসে। আমি সেটা নিয়ে কাজ করতেই পারি, যেহেতু এখন আমি একজন সিনিয়র রিপোর্টার। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে কাজ করলে তোর রাজনীতি জীবনের অংকুরেই বিনাস হবে। আমি বড্ড দ্বিধায় আছি কি করব?”
“আমার থেকে কি চাস, ঝেড়ে কাশ তো”
“মামা মশাই এর পতন গোড়া থেকে। আমি চাইলেও তাকে নাড়াতে পারবো সরাতে নয়, আর তাকে নাড়ালে তোর পতন হবে। আমি চাই না সেটা। কারণ তুই আমার তুরুপের এক্কা।“
“বাবার পেছনে লাগার কারণ?”
“তোকেও তো আমি জিজ্ঞেস করি নি মামার বিরুদ্ধে এতো ষড়যন্ত্র কেনো করছিস?”
রুদ্র বাকা হাসি হাসলো। তার হাসি দেখে শাশ্বত স্পষ্ট স্বরে বলল,
“তাহলে আমাকে সাহায্য করছিস?”
“শর্ত আছে?’
“কি?”
“আমার ঢাল হতে হবে, আমার জন্য নয় উমার জন্য। সেদিন বলেছিলি না সময় হলে ওকে বলি দিবো কি না, আমি সেটা পারব না। কিন্তু শেয়াল কুকুরের ত অভাব নেই, তাই আমার ঢাল হতে হবে।“
“যদি কোন অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকিস তবেই আমার সাহায্য পাবি।“
স্পষ্ট কন্ঠে শাশ্বত কথাটা বললো, রুদ্র উত্তর দিলো না। শুধু হাসলো। তার মস্তিষ্কের ভেতর কি চলছে তা শাশ্বতের অজানা। হয়তো শাশ্বত কখনো জানবেও না এই মাতালটি যে জাতে মাতাল তালে ঠিক_______
নির্বাচনের দিন,
অবস্থা ভালো নয়, দেশের রাজনীতি দলের মাঝে এক অরাজকতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবার এবং না হবার জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ ছেলের প্রথম নির্বাচনে তাকে সাহস দিতে এসেছে। এদিকে নিজের মনে এক ছাই ছাপা আগুন জ্বলছে। এই প্রথম সে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে না। কিন্তু তাতে কিছুই হবে না, অভিনব সিংহ কাঁচা খেলোয়াড় নন। তিনি তার ভিত্তি মজবুত রাখার জন্য সকল পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছেন। নির্বাচন শুরু হয়েছে, রুদ্র ভোট দিয়ে পার্টির লোকের সাথে কথা বলছিলো, তখন বাদল এসে তাকে এক পাশে টেনে বলে,
“রুদ্র, সর্বনাশ হয়েছে”
“কি হয়েছে?”
অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে রুদ্র। বাদল বলে,
“উমা বৌদি বাড়ি নেই……………
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩২তম_পর্ব
নির্বাচনের দিন,
অবস্থা ভালো নয়, দেশের রাজনীতি দলের মাঝে এক অরাজকতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবার এবং না হবার জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ ছেলের প্রথম নির্বাচনে তাকে সাহস দিতে এসেছে। এদিকে নিজের মনে এক ছাই ছাপা আগুন জ্বলছে। এই প্রথম সে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে না। কিন্তু তাতে কিছুই হবে না, অভিনব সিংহ কাঁচা খেলোয়াড় নন। তিনি তার ভিত্তি মজবুত রাখার জন্য সকল পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছেন। নির্বাচন শুরু হয়েছে, রুদ্র ভোট দিয়ে পার্টির লোকের সাথে কথা বলছিলো, তখন বাদল এসে তাকে এক পাশে টেনে বলে,
“রুদ্র, সর্বনাশ হয়েছে”
“কি হয়েছে?”
অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে রুদ্র। বাদল বলে,
“উমা বৌদি বাড়ি নেই, সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুজেছি কিন্তু তাকে কোথাও পাই নি।“
বাদল হাফাতে হাফাতে কথাটি বললো, এদিকে বাদলের চিন্তিত কন্ঠের বলা কথাটি শুনে চমকে উঠলো রুদ্র। ব্যাগ্র কন্ঠে বলল,
“কোথাও পাওয়া যায় নি মানে?”
বাদল এক নিঃশ্বাসে সব কিছু খুলে বলতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পূর্বে,
মাঘের প্রকোপে রোদের কঠিন তেজ মিইয়ে যাচ্ছে, দক্ষিণের শীতল হিনহিনে বাতাসে উড়ছে উমার কোকড়া চুল গুলো। পদার্থবিজ্ঞানের বইটি খোলা। খাতাটা অবহেলায় তার দিকে চেয়ে আছে, কিন্তু উমার যেনো সেদিকে মোটেই মনোযোগ নেই। মহাকর্ষের অংক কষতে কষতে তার অবুঝ মন খানা অন্য অংক কষতে ব্যস্ত। রুদ্র বেড়িয়ে যাবার পর থেকে একাকীত্বের কালো মেঘ হর্তালে নেমেছে। একাগ্রতা যেনো বাস্পের মতো উড়ে গেছে। ও বাড়িতে থাকলে এতো কষ্ট হতো না। হবে কেনো, সকাল হতেই লক্ষী দেবীর হিনহিনে স্বরটা কর্নকুহরে যেয়ে উত্তেজনা তৈরি করতো। মালিনী দেবীর ঠেস মারা বাক্য আর ফুলির মার মুখড়া স্বভাব। উমার যেনো সবকিছুই বড্ড মনে পড়ছে। ক্লেশ থাকলেও অবাড়িতে মানুষ তো ছিলো, কিন্তু এ বাড়িতে সেই মানুষের বড্ড অভাব। বই এ মুখ গুজে রাখলেও বেশিক্ষন থাকতে পারে না সে। এই তো বিগত এক ঘন্টা যাবৎ কেবল পাঁচ খানা অংক করেছে সে। চিন্তা ছিলো রুদ্রের আসার আগে পুরো অধ্যায় শেষ করবে, কিন্তু হলো কোথায়। সাদা তুলোর মতো উড়ে যাওয়া মেঘের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক রাশ উদাসীনতা নিয়ে। উমার উদাসীনতা বাড়ার আগেই নিচের কলিংবেল বাজলো। এ এক অন্য জিনিস, গ্রামে থাকতে এই কলিংবেলটি শুধু ভ্যান এবং রিক্সাতে দেখেছিলো সে। এখানে একটা কলিংবেল আছে। রুদ্র তাকে সর্বদা দরজা আটকে রাখতে বলেছে। যে আসে সে এই কলিংবেল বাজায় উমা “কে” বলে হাক দেয়। বাহিরের মানুষটির কন্ঠ চেনা মনে হলেই সে দরজা খুলে। উমার বইটি বন্ধ করে নিচে নামে। কোমল কন্ঠে বলে,
“কে?”
“বৌদি আমি, শাবীব”
শাবীবের রুদ্রের বন্ধু, শুধু বন্ধুটি বললে কম হবে। তার দোকানের হিসাব ও সেই দেখে। বাদল, রক্তিম, শাবীব এই তিনজন যেনো রুদ্রের তিনটি ঢাল। বাদলের সাথে রুদ্রের মারপিট লাগলেও সে ক্ষমা চাইবার পর সে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কালীগঞ্জের দোকানটিতে তারা তিনজন কর্মরত। শাবীবের কন্ঠ শুনে খানিকটা অবাক হলো উমা। এই সময়টাতে তাদের রুদ্রের সাথে থাকার কথা বলেই তার জানা ছিলো। কিন্তু হুট করেই তার এখানে আগমনটি বেশ অবাক করলো উমাকে। উমা দরজা খুলে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এ কি শাবীব দাদা আপনি এখানে?”
“বৌদি, আপনাকে নিতে আসলাম, তৈরি হয়ে নিন”
শাবীবের কথায় চোখজোড়া কুচকে আসলো উমার। বিস্ময় যেনো দ্বিগুন হলো। কোথায় যাবে তারা? কে পাঠিয়েছে শাবীবকে? অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“নিতে আসলেন? কোথায় যাবো আমরা?”
“রুদ্র পাঠিয়েছে, আসলে আজ তো নির্বাচন তাই ওকে বাহিরেই থাকতে হবে। কেন্দ্রে গ্যাঞ্জাম হবার একটা সম্ভাবনা আছে। তাই ও পাঠালো আপনাকে নিতে। বাড়িতে একা একা থাকাটা ঠিক হবে না আপনার”
উমার মনে ঈষৎ সন্দেহ জাগলো। রুদ্র তাকে এমন কিছু বলে নি। তাহলে হুট করে কেনো শাবীবকে পাঠালো। কিন্তু মানা ও করতে পারছে না, রুদ্র অকারণে তো তাকে পাঠাবে না। আর শাবীব রুদ্রের বিশ্বস্ত একজন বন্ধু। সে উমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তাই ক্ষীন সন্দেহের রেখাটি মুছে ফেললো সে। স্মিত হেসে বললো,
“আপনি দাঁড়ান, আমি তৈরি হয়ে আসছি।“
ঘন্টা খানেক বাদে উমা শাড়ি বদলে এলো। শাবীব একটা জীপ গাড়িতে করে এসেছে। গাড়িটা বেশ নতুন। হয়তো নেতাদের কারোর হবে। তাই বেশী সন্দেহ করলো না উমা। এদিকে, বাদল তার মিনিট পনেরো বাদেই রুদ্রের বাড়ি আসে। বাসার দ্বারে ঝুলতে থাকা তালা তাকে চিন্তায় ফেলে। আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে একটি জীপে করে উমা চলে গিয়েছে। ভয়ের চোটে সে ছুটে যায় রুদ্রের কাছে।
রুদ্র শান্ত চিত্তে সবকিছু শুনলো। কিছুক্ষণ থেমে সে উলটো বাদলকে প্রশ্ন করে উঠলো,
“তুই আমার বাড়ি কেনো গিয়েছিলি?”
রুদ্রের প্রশ্নে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলো বাদল। আমতা আমতা করে বললো,
“আমি গিয়েছিলাম দোকানের চাবি নিতে। তুই তো বলেছিলি বৌদিকে দিয়ে আসবি”
রুদ্র শান্ত দৃষ্টিতে বাদলের দিকে তাকিয়ে রইলো, তার কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না রুদ্রের। কিন্তু এখন সবথেকে প্রধান প্রশ্ন উমা কোথায়? কার জীপে উঠেছে উমা? উমা এতটা বোকা নয় যে অপরিচিত কারোর সাথে চলে যাবে। রুদ্রের চোখ গেলো অভিনব সিংহের দিকে। তিনি নির্বাচন অফিসারের সাথে বেশ হেসে হেসেই কথা বলছেন। রুদ্র জায়গা থেকে নড়তে পারছে না। নিজের মেম্বার হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। ভয়টি রকিবুল মাস্টারকে নিয়ে। রকিবুল মাস্টারের বিরোধীরা ভোট চুরির পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে আছে। তার মাঝে তার বাবাও রয়েছে। অভিনব সিংহ চান না নির্বাচন টি সুষ্ঠুভাবে হোক। রকিবুল মাস্টার চেয়ারম্যান হোক সেটা সে কখনোই চান না। অপর পক্ষে রুদ্র চায় যেনো রকিবুল মাস্টার চেয়ারম্যান হন। এই মানুষটি গোবেচারা দেখালেও চরম ধূর্ত, সেকারণে সে চায় যেনো এই মানুষটি তার বাবার জায়গায় আসুক। তাই সে এখান থেকে সরতে চাচ্ছে না। কিছুক্ষন পর নির্বাচন শেষ হবে, ব্যালোট গোনা হবে। তাই চাইলেও রুদ্র সরতে পারছে না। বাদল চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“বৌদিকে খুজতে যাবি না?
“দেখছি”
শান্ত কন্ঠে কথাটা বললো রুদ্র। রুদ্রের মস্তিষ্কে কি চলছে তা আন্দাজ করতে পারলো না বাদল। এদিকে শাশ্বত এই কেন্দের রিপোর্টিং এর জন্য সকল কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই কেন্দ্রেও এলো সে। তাকে দেখেই রুদ্র গেলো তার কাছে। বাদল তার সাথে আসতে চাইলে রুদ্র করা কন্ঠে মানা করে দিলো। শাশ্বত রুদ্রকে দেখেই বলল,
“কি অবস্থা? কে জিতবে?”
“মাস্টার জেতার সম্ভাবনা বেশী। কিন্তু একটা ঝামেলা হয়েছে”
“কি?”
রুদ্র খানিকটা বসা গলায় বললো,
“কেউ উমাকে অপহরন করেছে”
কথাটা শুনতেই থমকে গেলো শাশ্বত। রুদ্রের চোখজোড়া এক অজানা ভীতি দেখতে পেলো শাশ্বত। কিন্তু ভীতিটি উমার জন্য কি না ঠাহর করতে পারলো না।
জিপ থামলো অজানা এক জায়গায়। উমার জায়গাটি চেনা নেই। শাবীব গম্ভীর স্বরে বললো,
“বৌদি, থেমে পড়ুন”
শাবীবের কন্ঠে গায়ে কাটা দিলো উমার। বক্ষস্থলে এক অজানা ভয় তাকে আষ্টেপিষ্টে ধরলো। কন্ঠে জড়তা এলো উমার। কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“এটা কোথায় শাবীব দা?”
“নামুন, জেনে যাবেন”
“উনি কোথায়? উনাকে তো দেখছি না”
“রুদ্র সময় হলে ঠিক আসবে। আপনি ভয় পাবেন না। থেমে আসুন”
শাবীবের কন্ঠে শীতল, শীতল কন্ঠ উমার হৃদয়কে আরোও বেশি ভীতু করে তুললো। তার সন্দেহ হলো, শাবীব এখানে তাকে শুধু শুধু আনে নি। খুব বড় কিছু ঘটতে চলেছে। উমা মাথানত করে জীপ থেকে নামলো। খুব পুরোনো একটি জায়গা, ভাঙ্গা বাড়ি। সূর্যালোকেই গা ছমছম করছে, না জানি সন্ধ্যের পর কিরুপ দেখাবে। লাল বাড়িটির জানালা, দরজা কিছুই নেই। ভাঙ্গা অংশে মস, ফার্ণের বসবাস। পরগাছা থেমে এসেছে দেয়াল ভেদ করে। এই বাড়িতে কোনো শুভ মতলবে তাকে আনা হয় নি সেটা বুঝতে বাকি রইলো না উমার। উমার নিজের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করলো তার পালাতে হবে। শাবীব তার পাশেই চলছিলো। তার খেয়াল অন্যদিকে যেতেই উমা পালানোর জন্য ছুট লাগালো। কিন্তু তার ইচ্ছে থাকলেও সফল হতে পারলো না। যেই না পালাতে যাবে অমনি পেছন থেকে সজোরে কেউ আঘাত করলো তাকে। প্রচন্ড ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো উমা। চাহনী ঝাপসা হতে লাগলো। ক্রমেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে…………………
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৩তম_পর্ব
উমার নিজের মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করলো তার পালাতে হবে। শাবীব তার পাশেই চলছিলো। তার খেয়াল অন্যদিকে যেতেই উমা পালানোর জন্য ছুট লাগালো। কিন্তু তার ইচ্ছে থাকলেও সফল হতে পারলো না। যেই না পালাতে যাবে অমনি পেছন থেকে সজোরে কেউ আঘাত করলো তাকে। প্রচন্ড ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো উমা। চাহনী ঝাপসা হতে লাগলো। ক্রমেই উমা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। শাবীব তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে চায় নি উমাকে আঘাত করতে, কিন্তু উমা পালাতে চাচ্ছিলো। এটা যে কোনো ভাবেই হতে দিতে পারে না সে। ঝাপসা নজর ধীরে ধীরে নিকষকৃষ্ণ আভায় মিলিয়ে যেতে লাগলো। উমার মনে হতে লাগলো সে তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের মায়াজালে। বক্ষস্থলে একটি আকাঙ্খা, যদি আজ ই তার অন্তিম দিন হয় তবে একটি বার রুদ্রকে দেখতে চায় সে। শুধু একটি বার।
নির্বাচন শেষ হবার দিকে, রুদ্র এখনো কেন্দ্র থেকে বের হয় নি। এদিকে ওসি আবদুল্লাহ এসে পৌছেছে কেন্দ্রে। অরাজকতা সৃষ্টি হবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। শাশ্বত রুদ্রের মতিগতি বুঝতে পারছে না, উমা খুজতে এখনো কেনো রুদ্র যাচ্ছে না এই প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছে না সে। পরমূহুর্তে একটি চিন্তা তাকে ব্যকুল করে তুলছে এতো বড় জায়গায় কে উমাকে অপহরণ করেছে সেটাই বুঝে পাচ্ছে না সে। তার সন্দেহ হচ্ছে কাজটি অভিনব সিংহের। রুদ্র সেদিন দোকানেও এই কথাটি বলেছিলো, উমার সবথেকে বড় শত্রু অভিনব সিংহ। কারণ তিনি জানেন রুদ্রের দুর্বলতা উমা। বাবা হয়ে সরাসরি তাকে আক্রমন করলে ব্যাপারটি ভালো দেখায় না। তাই তিনি লুকিয়ে রুদ্রের হাটু ভাঙ্গতে চান। শাশ্বত কিছু একটা ভেবে রুদ্রের কাছে গেলো, স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“তুই উমাকে খুজতে যা, আমি আছি এখানে”
“কোথায় খুজবো?”
রুদ্রের প্রশ্নে চুপ করে যায় শাশ্বত। রুদ্র শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় শাশ্বতের দিকে। শাশ্বত কি বলবে নিজেও বুঝতে পারছে না। তখন রুদ্র বলে,
“উমার কোনো ক্ষতি ওরা করবে না। কারণ ওরা চায় যেনো আমি কেন্দ্র থেকে বের হই, উমার কিছু করলে আমি ওদের আস্তো রাখবো না।“
“তাহলে কিসের অপেক্ষায় আছিস?”
“কোনো ছুতার, আমাকে বের করতে হলে কোনো চিঠি বা ফোন আসবে। সেটার অপেক্ষা।“
শাশ্বত তখন বলে উঠে,
“এমন ও তো হতে পারে তোর বাড়িতে কোনো চিঠি রেখে গেছে।“
“হতেই পারে, কিন্তু বাদল খালি হাতে ফিরেছে। ধরা যেতেই পারে কোনো চিঠি রেখে আসে নি।“
“বাদলের সাথে আরেকবার কথা বলে দেখ, যদি কিছু মনে পড়ে ওর।“
রুদ্র ছোট করে “হু” বলে। শাশ্বত খেয়াল করলো রুদ্রের কন্ঠে চাপা ভয়ের সূক্ষ্ণ রেখা ফুটে উঠছে। কিন্ত সেটা সে প্রকাশ করছে না। মানুষই তো ভয় তো হবেই, এটাই তার বৈশিষ্ট্য। রুদ্র শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। উত্তেজনায় গা কাঁপছে। কিন্তু এই সময়টা ব্যাকুল হবার নয়। শান্ত থেকে দৃষ্টির অগোচরে লুকিয়ে থাকা শত্রুকে পরাজিত করার।
এদিকে বাদলের মাঝে এক অস্বস্থিবোধ লক্ষ্য করা গেলো। তাকে বেশ অস্তির এবং চিন্তিত ঠাহর হলো। সুযোগ খুজতে লাগলো কখন একটু অভিনব সিংহ এর সাথে কথা বলবে। কিন্তু অভিনব সিংহ আজ অনেক ব্যাস্ত, হবে না কেনো? বিগত তিনবার উনি ই চেয়ারম্যান হয়েছেন, উনার প্রভাব পরিচিতি চিন্তার বাহিরে। তাই তাকে সবার সাথেই কথা বলতে হচ্ছে। সবাই তাকে সালাম ঠুকছেন। আর না পেরে বাদল দীপঙ্করের কাছে গেলো। দীপঙ্কর তাকে দেখে অবাক কন্ঠে বলে,
“এ কি তুমি এখানে?”
“জ্যেঠুর সাথে কথা বলতাম”
“জ্যেঠু ব্যস্ত আছেন, নির্বাচন শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু তুমি এখানে কেনো? কাজ হয়েছে?”
“কাজ হলে তো হয়েই যেতো, খুব দরকার আমার। জ্যেঠুর সাথে না কথা বললে অনর্থ হবে”
ব্যাগ্র কন্ঠে বাদল কথাটা বললো, দীপঙ্কর চোখ কুচকে তাকালো তার দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো তার ধৈর্য্যহারার কারণ। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো,
“আসো আমার সাথে”
একটা শ্রেণীকক্ষে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে অভিনব সিংহ এবং বাদল। অভিনব সিংহের মুখশ্রীতে একরাশ বিরক্তি। তেতো কন্ঠে বাদলকে শুধালো,
“কি এমন হয়েছে যে তোমার তর সইলো না। আর তুমি এখানে কেনো?”
“জ্যেঠু খুব খারাপ খবর আছে।“
“কি হয়েছে?”
ভ্রু যুগল কুচকে আসলো অভিনব সিংহের। মুখোভাব বদলে গেলো তার। এক রাশ ভীতি এবং বিস্ময় জড়ো হলো মুখে। বাদল আমতা আমতা করে বললো,
“আমি বৌদিকে অপহরণ করতে পারি নি।“
“মানে?”
বাদল বড় সড় ঢোক গিলে বললো,
“আমি গিয়েছিলাম, কিন্তু ঘরে তালা মারা। বৌদিকে অন্য কেউ ধরে নিয়ে গেছে। আমাদের পরিকল্পনা জলে চলে গিয়েছে জ্যেঠু”
“রুদ্র জানে?”
“জানে, আমি এসেই ওকে বলেছি।“
অভিনব সিংহ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বাদল বুঝতে পারলো তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। কিছুসময় বাদে তার মুখমন্ডল উজ্জ্বল হলো। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,
“উমা অপহরণ হয়েছে এটাই আমাদের জন্য সবথেকে বড় সুখবর। রুদ্রের শত্রু কেবল আমরাই নই, সুতরাং উমাকে কে অপহরণ করেছে সেটা নিয়ে আমাদের না চিন্তা করলেও হবে। এখন রুদ্র সবথেকে দুর্বল অবস্থায় আছে। আমাদের লোহা গরম থাকতেই হাতুড়ি মারা উচিত। তুমি যাও, রুদ্রকে কেন্দ্র থেকে বের করার প্রচেষ্টা করো। আর দীপঙ্কর তুমি চিঠিটা রুদ্রের হাতে দেবার ব্যাবস্থা করো।“
“কিন্তু জ্যেঠু বাদল তো অপহরন করে নি।“
“তাতে কি, অপহরণ তো হয়েছে। যাও যাও”
অভিনব সিংহের মুখে উজ্জ্বল হাসির প্রলেপ দেখা গেলো। দীপঙ্কর সময় নষ্ট না করে রুদ্রকে অপহরণের পত্রটি রুদ্রের কাছে দেবার ব্যাবস্থা করলো। বাদলের চিন্তা দূর হলো না। রুদ্রের শান্ত স্বভাব তাকে চিন্তিত করছে। রুদ্র এমনেই মাথা গরম প্রকৃতির ছেলে, রাগ উঠলেই তার মুখশ্রী সেটার জানান দেয়। অথচ আজ রুদ্র শান্ত। বাদলের গতবারের মারটা আজও মনে আছে তার। একটুর জন্য যমের দোয়ারে তাকে যেতে হয় নি। বাদলের মনে হচ্ছে এটা ঝড় আসার পূর্ব সংকেত। তার ভয় বাড়ছে, ভয়ার্ত কন্ঠে সে অভিনব সিংহকে বললো,
“জ্যেঠু আমি না গেলে হবে না?”
“এটা তো কথা ছিলো না?”
“আসলে”
“রুদ্রকে ভয় পাচ্ছো নাকি?”
“জ্বী, পরান কাঁপতেছে।“
“আমার কাছ থেকে মোটা অংক নিয়েছো ভুলে যেও না”
বাদল চুপ মেরে গেলো, হ্যা সে তার বন্ধুর পিঠে ছুরি মারার জন্য মোটা টাকা নিয়েছে। শুধু তাই নয়, উমার প্রতি নোংরা লালসাটা পুনরায় মাথা চারা দিয়ে উঠেছিলো। কিন্তু সবকিছুই যেনো গুবলেট হয়ে গেলো। মাথা নত করে বেরিয়ে গেলো বাদল। বের হতেই রুদ্রের সাথে তার দেখা হলো। রুদ্র উগ্রীব কন্ঠে বললো,
“বাদল, উমার অপহরণকারীর খোঁজ পেয়েছি, চল আমার সাথে”
রুদ্রের মাঝে শান্ত ঢেউ নিয়ে, সে খানিকটা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ দীপঙ্কর তার কাজ করে ফেলেছে। বাদল ঢোক গিলে বলল,
“চল”
রুদ্র তার বাইক স্টার্ট দেয়। তারা কেন্দ্র থেকে বেড়িয়ে যায়। এদিকে নির্বাচন শেষ। সব ব্যালোট বক্সগুলো এক ঘরে আনা হয়েছে। নির্বাচন অফিসাররা ভোট গণনা করবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। রুদ্রের লোকেরা বাহিরে তদারকি করছে, যেনো কেউ ভেতর প্রবেশ না করতে পারে। অপরদিকে আবদুল্লাহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ নিয়োগ করেছে। যতগুলো কেন্দ্র আছে সব জায়গায় কড়া পাহারা।
পিচের রাস্তা চিরে মোটরসাইকেল চলছে। বাতাসের বেগে উড়ছে রুদ্রের চুল। সাইকেলের বেগ বাড়ছে। বাদলের মনে হলো তারা হাওয়ার গতিতে যাচ্ছে। একটু হলেই ছিটকে পড়বে তারা। রুদ্রের মাঝে একটা তাড়া আছে। তবে বাদলের ভয় কমলো না, যা তারা পরিকল্পনা করছে সেই অনুযায়ী রুদ্র এবং সে বেড়িয়ে পড়বে। কিন্তু রুদ্রের সাথে রুদ্রের সাঙ্গপাঙ্গ গুলোও বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু সেটি হলো না। রুদ্র একাই বের হলো। শুধু তাই নয়, তারা এমন কোথাও যাচ্ছে যেটা পরিকল্পনার বাহিরে। হঠাৎ ব্রেক কষলো রুদ্র। বাদল অবাক কন্ঠে শুধালো,
“থামলি কেনো?”
“এসে পড়েছি। নাম”
“অসম্ভব আমাদের তো নদীর পাশ টায় যাবার কথা”
“তুই কিভাবে জানিস? আমি তো তোকে স্থান বলি নি”
রুদ্রের শান্ত কন্ঠে বলা কথাটি শুনে বাদলের বুক কেঁপে উঠে। এবার রুদ্র মোটর সাইকেল থেকে নামলো, বাদল ও নামলো তার পিছু পিছু। রুদ্র রাস্তার এক কোনায় বসলো, জায়গাটি খুবই নীরব। বিকালেই আধার নেমে এসেছে, না জানি সন্ধ্যের পর কি হবে। এখানে কাউকে মেরে ফেললেও কেউ টেরটি পারে না। রুদ্র চোখ তুলে তাকালো বাদলের দিকে। তার কপালের বা পাশের শিরাটি ফুলে উঠেছে। ধীর স্বরে বললো,
“উমা কোথায়?”
“জানা নেই, সত্যি আমি জানি না দোস্ত”
“দোস্ত শব্দটি বলিস না, বড্ড কুৎসিত লাগে তোর মুখে”
বাদল মাথানত করে ফেললো। ভয়ে গা ছমছম করছে তার। রুদ্র কি করবে জানা নেই। তবে তার জন্য খুব খারাপ কিছুই অপেক্ষা করছে। সূর্যের লাল রেখা দেখা যাচ্ছে, নীল আকাশে রক্তিম সূর্যটি ডোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শীতল হাওয়া বইছে। বাতাসে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, মৃত্যুর নোংরা গন্ধ
______________________________
উমার জ্ঞান ফিরলো। চোখ পিটপিট করে বড্ড কষ্ট খুললো সে। চোখ ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখলো সে। সে তার নিজের ঘরে ছিলো। মাথার পেছনটা ব্যাথা করছে প্রচন্ড। খুব কষ্টে উঠে বসলো সে। তখন ই রুদ্র এগিয়ে আসলো, ধীর স্বরে বলল,
“কেমন লাগছে?”
“আমি বাড়ি কিভাবে আসলাম? শাবীব দা আমাকে তো………”
উমার কন্ঠ কাঁপছে, দলা পাকিয়ে যাচ্ছে কথাগুলো। রুদ্র তার কপালে উষ্ণ পরশ দিয়ে বলল,
“কালো মেঘ কেটে গেছে, ভয় নেই। আমি আছি।“
উমা আর কথা বললো না। জড়িয়ে ধরলো সে রুদ্রকে। রুদ্র পরম আবেশে আলিঙ্গনে নিলো সে উমাকে। শাবীবকে সেই পাঠিয়েছিলো উমাকে সুরক্ষিত করতে। উমা পালাচ্ছিলো বলে শাবীব বাধ্য হয়ে তাকে আঘাত করেছিলো। সেজন্য তাকে শাস্তিও দিয়েছে রুদ্র। এই পুরো পরিকল্পনাটি ছিলো তার এবং শাশ্বতের। তারা জানতো এমন কিছু হবে। সেকারণে পরিকল্পনা করেছিলো তারা। উমাকে আগ থেকে জানাতে পারে নি। কারণ পরিকল্পনাটি সকালে করেছিলো। বাদল আগের রাতে অভিনব সিংহ এবং দীপঙ্করের সাথে কথা বলেছিলো সেই মূহুর্ত দেখে ফেলেছিলো শাশ্বত। রুদ্রকে জানাতেই সে এই পরিকল্পনা করে। বাদলকে হাতে নাতে ধরেছে সে। অপরদিকে, রুদ্র যাবার পর ব্যালোট চুরি করতে গিয়েছিলো অভিনবের লোক। আবদুল্লাহ তাদের হাতেনাতে ধরে। তারা যদিও মুখ খুলে নি। কিন্তু বিপুল ভোটে রকীবুল মাসটার হয়েছে এবারের চেয়ারম্যান। মেম্বার হয়েছে রুদ্র। এবার আর লুকিয়ে খেলবে না রুদ্র। অভিনব সিংহকে উত্তর দিতে হবে সব প্রশ্নের। আর বাদল সে এখন হাসপাতালে ভর্তি। বাঁচা মরাটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে রুদ্র। বিশ্বাসঘাতক যে তার পছন্দ নয়। উমাকে শুয়িয়ে দিলো রুদ্র। ধীর স্বরে বললো,
“কাল গ্রামে যাবো। তৈরি থেকো”
রুদ্রের মুখোমুখি বসে আছেন অভিনব সিংহ। তার কপালের চিন্তার রেখা। তরতর করে ঘামছেন তিনি। একটু পর পর রুমাল দিয়ে মাথা মুছছেন। রুদ্র শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আজ তার মাথানত নেই। বরং মুখে এক অনন্য আত্নবিশ্বাস দেখতে পাচ্ছে সে। চুরুটের পাইপটা হাতে নিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো অভিনব সিংহ। রুদ্র কঠিন কন্ঠে বললো,
“কাজটা ভালো করেন নি বাবা, আগেও বলেছি এখনো বলছি উমার দিকে হাত বাড়াবেন না। যদি আমাকে হারাতে হয় আমাকেই নিশানা করবেন। কিন্তু আপনি সেটা করেন নি।“
“আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি বলছো”
“স্বীকার না করলে আপনার ব্যাপার, তবে বাদল কিন্তু সবটা বলেছে আমায়”
অভিনব সিংহের চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। সে আতংকিত চাহনীতে তাকালো রুদ্রের দিকে। রুদ্র এবার এগিয়ে এসে ঝুকলো খানিকটা। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“ইট মারলে পাটকেল খেতেই হয়, প্রস্তুত থাকুন। এই সাম্রাজ্য যদি মিশিয়ে না ফেলি আমার নাম রুদ্র নয়। এবার যুদ্ধ ঘোষনা করলাম, যা করার করুন”
বলেই সোজা হয়ে দাঁড়ায় সে। ঘুরে দাঁড়াতেই অভিনব সিঙ্ঘের কাঁপা স্বর শুনে সে,
“যার জন্য এতো কিছু, সময় আসলে তাকে পাশে পাবে তো?”
রুদ্র কিছুক্ষন থমকে দাঁড়ালো। পরমূহুর্তে উত্তর না দিয়েই বেড়িয়ে গেলো। অভিনব সিংহ চুরুট টানতে লাগলো। তার মুখে নিকষকৃষ্ণ ভয়ের রেখা স্পষ্ট। সাম্রাজ্য হারাবার ভয়।
উমা বসে রয়েছে নিখিলের ঘরে, হাতে নিখিলের লেখা চিঠি। রতী নিখিলের কাপড়ের সাথে পেয়েছিলো। যত্নে রেখে দিয়েছিলো। আজ উমা আসলে তাকে দিয়েছে। উমা চিঠিটি পড়ে নি এখনো। বুকটা কাঁপছে। উথাল পাতাল দিয়ে কান্না পাচ্ছে। হিচকি তোলা কান্না। জমা পাথরটা আজ নামছে বুক থেকে। আজ বাবাকে খুব স্মরন হচ্ছে। চিঠিটা হাতে নিয়ে ক্রন্দনমাখানো কন্ঠে বললো,
“বাবা, আরেকটু সময় কেনো থাকলে না তুমি।“
তখন রুদ্রের ডাক শোনা গেলো। সে ও বাড়ি থেকে চলে এসেছে। উমা চোখ মুছে নিলো। ধীর পায়ে দরজায় দাঁড়ালো। রুদ্রকে উঠানে দেখা যাচ্ছে। চিঠিটা এখন পড়বে না উমা। সময় আসলে পড়বে। রুদ্রের হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখা যাচ্ছে। গোপালের সাথে হাসছে সে। উমার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। তার জীবন এখন এই মানুষটাকে ঘিরে, এটাই হয়তো জীবন________________
চলবে