শেষ বিকেলে এলে তুমি পর্ব -০১

-আপনাদের মতো কিছু কুলাঙ্গার আছে বলে আজ মানুষ বলতে পারে এই পৃথিবীতে আর মনুষ্যত্ব বেঁচে নেই।এত বৃষ্টির মাঝে একটি অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে রাস্তার পাশে অচেতন হয়ে পড়ে আছে আর উনারা মেয়েটাকে সাহায্যে না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে।
এই জনি এইদিকে এসে সাহায্যে কর আমাকে মেয়েটিকে গাড়িতে তুলতে। হসপিটালে নিতে হবে না জানি কতক্ষণ এভাবে বৃষ্টিতে পরে পরে ভিজছিলো!

এতক্ষন কথাগুলো বলছিলেন ডা.রায়হান বয়স হয়েছে প্রায় ষাটের কাছাকাছি কিন্তু এখনো শরীরে জৌলুশ কমে নি। কারো প্রতি অন্যায় হতে দেখলে উনি প্রতিবাদ না করে থাকতে পারেন না।

হসপিটালের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছিলেন ডা.রায়হান কিন্তু পথিমধ্যে বৃষ্টি এসে পড়ে গাড়ি তখন ধীরগতিতে চলছিল। কিছুদূর যাবার পর দেখলেন একটি দোকানের সামনে অনেক মানুষ জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য এই দোকানটিতে সকলে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু, মনের কোণে খচখচানিটা বেড়েই চলছিলো তাই বৃষ্টির মাঝে ছাতা হাতে নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে এরপর এগিয়ে গেলেন সেখানে। যেখানটায় সবাই দাঁড়িয়ে ছিলো।

ভীর ঠেলে ভিতরে ঢুকতে দেখতে পেলেন একটি মেয়ে অচেতন অবস্থায় পরে আছে।আরো ভালো করে লক্ষ্য করতে বুঝতে পারলেন মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা।
তখনই উনার মেজাজ বিগড়ে গেলো আর সবাইকে কথা শুনিয়ে দিলো।

জনি আর রায়হান সাহেব মিলে মেয়েটিকে খুব সাবধানে গাড়িতে তুললো।মেয়েটির পাশে বসলেন রায়হান সাহেব আর ড্রাইভিং সিটে জনি। জনিকে তাড়াতাড়ি উনার হসপিটালে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালেন বেশ মায়া হলো মেয়েটির জন্য । কারণ উনিও একজন মেয়ের বাবা।

হসপিটালে পৌঁছে মেয়েটিকে এডমিট করালেন। এরপর, গাইনি ডাক্তার এসে মেয়েটিকে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে রায়হান সাহেবকে জানালেন মেয়েটি সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ভেজার কারণে বাচ্চা এবং মায়ের দু’জনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েটির বিপি লো হয়ে গেছে তাই উনারা চাচ্ছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করাতে।

রায়হান সাহেব সব শুনে বললেন,

-যা যা করা লাগে করুন কিন্তু মেয়েটি আর তার বাচ্চা যেন সুস্থ থাকে।

-কিন্তু, স্যার প্রিমেচুয়ার্ড বেবি ঠিক কেমন সুস্থ থাকবে আপনি আমরা সবাই জানি। তবুও সর্বাত্মক চেষ্টা করবো আমরা বাকিটা উপরওয়ালার হাতে।

বলে চলে গেলো মেয়েটির দায়িত্বরত ডাক্তার। আর রায়হান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে রইলেন উনার কেবিনে।

দু’ঘন্টা চেষ্টার পর অপারেশন শেষ হলো। কর্তব্যরত ডাক্তার এসে রায়হান সাহেবকে জানালেন, মেয়েটি সুস্থ আছে তবে ওর বাচ্চাকে বাঁচানো যায় নি।

রায়হান সাহেব শুধু শুনে গেলেন কিছু বললেন না শুধু দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলো।

————————-

চোখ বন্ধ করে থাকার পরও কেমন যেন চোখে আলো বিঁধছে। পুরো শরীর দূর্বল লাগছে আর নাকে স্যাভলনের কড়া গন্ধ আসছে। আস্তে করে চোখ খুলে তাকালাম। সর্বপ্রথম নজরে এলো চরকির মতে ঘুরতে থাকা ফ্যান। কিছু মনে পড়তেই আশেপাশে তাকালাম। ওমা, এ তো দেখি হসপিটাল!

আমি হসপিটালে এলাম কি করে?আমি যখন এইসব ভাবছি ঠিক তখনি কেউ দরজা খুলে প্রবেশ করলো ।

রায়হান সাহেব সাথে করে একজন নার্স নিয়ে এলেন মেয়েটিকে দেখতে। কি অবস্থা কে জানে? জ্ঞান ফিরলো কি না?

দরজা দিয়ে প্রবেশ করে বেডের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেয়েটি আমাদের দিকে নরম চোখে তাকিয়ে আছে৷ মেয়েটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম এরপর জিজ্ঞেস করলাম,

-এখন কেমনবোধ করছো মা? তোমার নাম কি?

অপরিচিত এক লোকের মুখে মা ডাক শুনে অবাক হলাম প্রায় তার উপর তিনি হয়তো ডাক্তার কারন উনার পরনে সাদা এপ্রোন।

– আমি রুশা। কিন্ত আমার পেটে এত ব্যাথা অনুভব করছি কেন?

বলেই আমার পেটে হাত দিলাম। পেট এতো হালকা লাগছে কেন? বাবু নড়াচড়া করছে না কেন? আমি বেশ ভয়ে পেয়ে গেলাম।

-আমার বাচ্চা কই? আমি এখানে কি ভাবে এলাম আমি তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।

-তুমি শান্ত হও আমি সব বলবো।

মেয়েটি শান্ত হতে পারছিলো না। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে রায়হান সাহেব মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-তোমার মৃত মেয়ে ভূমিষ্ট হয়েছে।

রুশা শক পেলো এই কথা শুনে। তার মেয়ে মৃত হয়েছে। এত পোড়া কপাল কেন ওর! যে ডাল ধরে আঁকড়ে বাঁচতে চায় সে ডাল কেন ভেঙে পড়ে!
হু হু করে কাঁদতে লাগলো। বেশি জোরে কাঁদতে পারছে না। পেটের অপারেশনের জায়গায় ব্যাথা পাচ্ছে। সন্তান হারানো ব্যাথার সামনে এই ব্যাথা কিছু না।

একটি চেয়ার টেনে বসলেন রায়হান সাহেব। আর উনার পাশেই বসলেন নার্সটি। রুশার কান্না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন তিনি কারণ উনার জানতে হবে কি এমন দরকারে মেয়েটি বাড়ি থেকে বের হলো আর এমন দূর্ঘটনা ঘটে গেলো। আর মেয়েটির পরিবারের কেউ কি নেই? কারণ মেয়েটির মোবাইল থাকা স্বত্তেও কেউ কল করলো না। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে লাগছে উনার কাছে।

একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন মেয়েটির দিকে এরপর, বললেন

-এক চুমুক করে অল্প অল্প পানি পান করো। আর একবারও কান্না করবে না।

ধমকের সুরে বললেন রায়হান সাহেব। রুশা কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। অনেক চেষ্টার পর কান্না থেমে গেলো। রায়হান সাহেবের বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে অল্প করে পানি পান করলো রুশা। কান্না থেমে গেলেও হিচকি রয়ে গেলো।

-তোমার পরিবারের কেউ নেই? আর বাচ্চার বাবা কোথায়?

-আমি এতিম। আমি ছোট থাকতেই আমার বাবা মারা যায়। আমার মা’কে উনার পরিবারের লোকেরা অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। তখন থেকে আমি মামা-মামীর কাছে বড় হয়েছি। এইচএসসি পরীক্ষার পর আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয় আমার মামা-মামী।

-তোমার স্বামী, সে কোথায় আছে? আর তুমি বা কেন বৃষ্টির মাঝে রাস্তায় পড়ে রইলে।

ডা. রায়হানের কথা শুনে রুশা বেদনার হাসি হাসলো। রুশার এই হাসি দেখে নার্স আর রায়হান সাহেবের মন কেমন ছ্যাত করে উঠলো।এরপর, রুশা বলতে শুরু করলো,

-স্যার, আমি আজ বাইরে বৃষ্টিতে কেন ছিলাম জানেন কারণ আমার মেয়ে হবে তাই। আলট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে আমার শ্বাশুড়ি মেয়ের কথা শুনে আমার সাথে যা ইচ্ছে তাই ব্যবহার করলো। আমি ভেবেছিলাম আমার স্বামী হয়তো খুশি হবে মেয়ের কথা শুনে কিন্তু না আমার স্বামী খুশি হয় নি বরং রাতের আঁধারে আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে সকালে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমি তখন কি করবো দিশেহারা বোধ করছিলাম তবুও মনে সাহস নিয়ে মামার বাড়ির পথে রওনা হচ্ছিলাম।
এই প্রথম আমি একা কোথাও যাওয়ার সাহস করেছিলাম।
কারণ,আমি যে মা। আমার মেয়েকে সবাই অবহেলা করতে পারবে আমি তো পারবো না। কারন, সে আমার রক্তে মাংসে বেড়ে উঠা আমার দেহের অংশ। তাকে নিয়ে বাঁচতে হলে এরকম শ’খানেক যুদ্ধে নামতে পারবো আমি।
মাঝপথে আসার পর বাসের ভাড়া দিতে পারিনি বলে আমাকে বৃষ্টির মধ্যে বাস থেকে নামিয়ে দেয়। বাসে থাকা অনেক লোকের কাছে সাহায্যে চেয়েছিলাম কিন্তু সাহায্যে করে নি। বাস থেকে নামার পর কোথায় যে দাঁড়াবো সে জায়গাটুকু পাচ্ছিলাম না। গতকালের সারাদিনের অভুক্ত শরীর আর ধকল সামলাতে পারেনি কখন যে অচেতন হয়ে গেলাম। আর এখন চেতনা ফিরে আসার পর কি জানলাম, যার জন্য আমি সব ছেড়ে নতুন করে বাঁচতে চাইলাম সে আমাকে না জানিয়ে, না দেখা করে চলে গেলো।

বলে উঁচু কন্ঠে কেঁদে উঠলো রুশা। সেই সাথে চোখে বেয়ে পানি পরতে লাগলো রায়হান সাহেবের এবং উনার সাথে থাকা নার্সের।

#চলবে

#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#সূচনা_পর্ব
#Tahmina_Akhter

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here