শেষ বিকেলে এলে তুমি পর্ব -২৮+২৯

#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_২৮
#Tahmina_Akhter

তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ বন্ধ করে রাখতে পারছি না কিন্তু চোখ মেলে যে তাকাবো সেই শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই আমার মাঝে।

কিছু একটা মনে পড়তে আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। চারদিকে তাকাতেই দেখলাম অচেনা একটি ঘর।

মাথায় হাত দিয়ে বসলাম আমার জীবনের সমীকরণ মেলানোর চেষ্টায়। কি এমন অপরাধ ছিল আমার? কেন এত কিছু আমার সাথেই ঘটবে?মিসবাহ কিভাবে পারলো আমার সাথে এমনটা করতে!

ভাবতে লাগলাম সেইসময়ের কথা,
মিসবাহ আমার থেকে বিয়ের অনুমতি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বহুকষ্টে চেপে রাখা কান্নাগুলো আমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।চিৎকার করে যে কান্না করবো তাও পারছিলাম না।

জানিনা কতটুকু সময় অতিক্রম হয়েছিল? দরজা ঠেলে একজন মধ্যবয়স্ক নারী রুমের ভেতর প্রবেশ করে। আমার পাশে এসে বসে এরপর আমার চোখ-মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলে,

-এই মেয়ে কান্না বন্ধ করো। একটু পর কাজি সাহেব আসবে।

-আমাকে প্লিজ সাহায্য করুন আমি মিসবাহকে বিয়ে করতে চাই না।
উনার পায়ে ধরে কথাগুলো বলছিলাম আমি কিন্তু উনি আমার মুখের না করে দিলো।

-দেখো এই ব্যাপারে আমি কথা বলতে চাই না।
বলেই আমার শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দিয়ে আমার পাশেই বসে রইলেন।

দরজা খুলে কারা যেন প্রবেশ করলো?উনাদের কথোপকথনে বুঝতে পেরেছিলাম কাজি সাহেব এসেছেন। আমার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো কিন্তু চোখের পানি মুছে দেয়ার মতো কেউ ছিলো না। একসময় কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই,কি করবো এইসবে খেয়ালে রেখে আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ত হুট করে এসে আমার কাঁধে পড়েছে।

একসময় আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে সেই নারীটি বারবার বলতে লাগলো,

-কবুল বলো।

আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না কান্না ব্যতিত।মিসবাহর কথাগুলো মনে পড়ে গেলো, ও তো বলেছিলো, ও আমার অচেতনতার সুযোগ নিয়ে আমার সাথে? হায় আল্লাহ, সারাজীবন কি তবে একটি ধর্ষকের সাথে আমার জীবন পাড়ি দিতে হবে!
বুকের মাঝে নিজের কষ্টগুলোকে দাবিয়ে রেখে কবুল বলে দিলাম।

কাজি সাহেবসহ আর দুজনের কন্ঠে শুনলাম যারা বলছিলো,

-আলহামদুলিল্লাহ

কাজি সাহেব পরপর দুবার বললেন কবুল বলতে এবার আর সময় না নিয়ে কবুল বলে দিলাম।

উনারা বোধহয় ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।এরপর, কি হয়েছিলে আমি জানি না? আর এখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো। কেন আমি চেতনা ফিরে পেলাম! মরে গেলে বুঝি সকল কলঙ্কের বোঝা মাথা থেকে নেমে যেত!

আমি মাথা নিচু করে যখন নিজেই নিজের সাথে কথা বলছিলাম, ঠিক তখনি কেউ এসে আমার সামনে বসলো?
ঝাপসা চোখে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি,কালো রঙের শার্ট পরিধান করা এক পুরুষ। চোখের পানি না মুছে তাকে বললাম,

-এবার নিশ্চয়ই শান্তি পাচ্ছো তুমি?এটাই তো তুমি চেয়েছিলে। যতটুকু নিচে নামা যায় ঠিক ততটুকু নিচে নেমেছো তুমি। একটি নারীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ তার সম্ভ্রম। তুমি আমার সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছো, শুধুমাত্র আমাকে বিয়ে করার জন্য। কি লাভ হলো বলো?বিয়ের মতো একটা পবিত্র সম্পর্ককে তোমাদের মতো কিছু লোক মজা বানিয়ে রেখেছে।একটি মেয়ের নিজস্ব মতামত তোমাদের কাছে গুরত্বপূর্ণ নয় কারণ তোমাদের ইগোতে লাগে। কেন একটি মেয়ে তোমাদের পছন্দকে অস্বীকৃতি জানাবে? রিজেকশন মেনে নিতে না পেরে হয়তো মেয়েটিকে এসিডে ঝলসে দিবে, নয়তো তুলে এনে রেপ করবে, নয়তো জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করবে।
যখন দেখলে আমি তোমায় রিজেক্ট করেছি তখন তুমি কি করলে আমায় তুলে এনে আমার অচেতনতার সুযোগ নিয়ে রেপ করলে। যাতে তোমাকে বিয়ে করতে আমি বাধ্য হই। বাহ! এই হচ্ছে আমাদের শিক্ষিত সমাজের পুরুষ, যারা নারীদেরকে অসম্মান করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না।
এখন, কেন এসেছো আমার কাছে? নাকি আরও কিছু বাকি আছে?
বেশ তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বললো রুশা।

-মিসবাহ, তোমাকে রেপ করেনি রুশা?

মাথা উঁচু করে করে দেখার চেষ্টা করলাম, কে কথা বলছে আমার সামনে বসে? এটা তো মিসবাহর কন্ঠ নয়! চোখের পানিটুকু মুছতেই সামনের দৃশ্য পরিষ্কার হয়ে গেলো। দেখলাম আয়াত ভাই আমার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে।

আয়াত ভাইকে দেখতে পেয়ে আমার চোখগুলো আবারও ঝাপসা হয়ে এলো,আপন কাউকে পেলে বুঝি এমনই হয়!

-রুশা, তোমার সাথে খারাপ কিছু ঘটেনি। প্লিজ, কান্নাকাটি বন্ধ করো৷ মিসবাহ এখন পুলিশি হেফাজতে আছে।

-আপনাকে কে বললো, আমার সাথে খারাপ কিছু ঘটেনি? মিসবাহ, নিজ মুখে আমাকে বলেছে যে ও আমাকে?

-ও শুধুমাত্র তোমাকে ভয় দেখাতে মিথ্যা কথা বলেছে। যেন তুমি ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও।

-কিন্তু, মিসবাহ সফল হয়েছে আমাকে বিয়ে করতে।
ও যেটা সবসময় চেয়ে এসেছে।

-তোমার সাথে মিসবাহর বিয়ে হয়নি, রুশা।

আয়াত ভাইয়ের মুখে বিয়ে হয়নি কথাটি শুনে আমার পুরো শরীর শীতল হয়ে এলো পরম শান্তিবোধে।কিন্তু, মনের মাঝে একটু খচখচানি রয়ে গেলো। তাই আয়াত ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম,

-কিন্তু, আমার মনে আছে, আমি অচেতন হওয়ার আগে কাজি সাহেবের সামনে কবুল বলেছিলাম আর আমার পাশেই একজন মধ্যেবয়সী নারী বসে ছিলো।

-তোমার বিয়ে হয়েছে তবে মিসবাহর সাথে নয় আদিল রহমানের সাথে।

আয়াত ভাইয়ের মুখে আদিল স্যারের নাম শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। মানে কি স্যারের সাথে আমার বিয়ে!

-দেখো রুশা। কান্নাকাটি বন্ধ করে আমার কথাগুলো দশমিনিট মনোযোগ দিয়ে শুনো।

আয়াত কথাটা শেষ করে রুশার মুখের দিকে তাকালো উত্তরের আশায়। কিন্তু, রুশাকে দেখে মনে হচ্ছে তার এই জগতের প্রতি খেয়াল নেই।
তবুও,আয়াত দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুশাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো।

-তুমি নিখোঁজ হবার পর থেকেই আদিলের নাকি মিসবাহর উপর সন্দেহ হচ্ছিল।তাই মিসবাহকে কোথায় গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে সেজন্য রিধিমাকে কল দিলে, রিধিমা জানায় মিসবাহকে আজ ওদের বাড়িতে পাওয়া যাবে না তবে ফার্ম হাউসে পাওয়া যাবে। সেই ফার্ম হাউসের ঠিকানা নিয়ে আদিল আমাকে কল করে জানায়,আমি যেম পুলিশ নিয়ে সেই ফার্ম হাউসে পৌঁছে যাই৷ আমিও আদিলের কথামতো সেই ফার্মহাউসে চলে গেলাম পুলিশকে নিয়ে৷ সেখানে যখন আমরা পৌঁছালাম তখন দেখতে পেলাম, আদিল পায়ের কাছে মিসবাহ পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। পুলিশের কিছু লোক যেয়ে মিসবাহকে আদিলের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে৷
মিসবাহ যখন দেখলো পুলিশ এসে পড়েছে অর্থ্যাৎ ওর প্লেন ফ্লপ। তাই ও সকলের সামনে চিৎকার করে বলতে লাগলো,

-আমাকে পুলিশের কাছে দিলে কিছু হবে না, স্যার? কারণ, আমার যা পাওয়ার ছিলো তা আমি আদায় করে নিয়েছি। এখন আর কেই বা রুশাকে বিয়ে করবে বলুন। আপনিই বলুন না একটি ধর্ষিতা মেয়েকে কে বিয়ে করবে? আমি ছাড়া পেলেই রুশাকে বিয়ে করবো কারণ আমি ছাড়া ওর তো আর গতি থাকবে না। বলেই বিদঘুটে হাসি দিচ্ছিলো মিসবাহ।

তখনি দরজা দিয়ে কাজি সাহেব প্রবেশ করেছিলো। পুলিশ আর আমাদেরকে এবং মিসবাহর অবস্থা দেখে উনি উল্টো পথে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, আদিলের ডাক শুনে উনি হাঁটা বন্ধ করে এগিয়ে এলেন। কাজি সাহেব সামনে এসে দাঁড়াতেই আদিল বললো,

– আমি রুশাকে বিয়ে করতে চাই এবং এই মূহুর্তে। কাজি সাহেব আপনাকে হয়তো এখানে বিয়ে পড়ানোর জন্য ডেকে আনা হয়েছে। আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।

ব্যস, মিসবাহর সে কি চিৎকার! কিন্তু, সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আদিল একজন লেডি কনস্টেবলকে তোমাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সে ঘরে পাঠিয়ে দেয়। এরপরের, ঘটনা তো তুমি জানো।

তোমার কাছ থেকে কবুল নেয়ার সময় আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এরপর,আদিলের কবুল নেয়া শেষ হতেই মিসবাহ আচমকা আদিলের উপর হামলে পড়ে।কিন্তু, পুলিশ মিসবাহকে ধরে ফেলে।এরপর, আদিল মিসবাহর সামনে যেয়ে বললো,

-এখন দেখলে তো রুশাকে কে বিয়ে করলো?রুশা হাসান এখন শুধুই আদিল রহমানের অর্ধাঙ্গিনী।এখন ওকে কে ধর্ষিতা বলবে আমিও দেখি?

-স্যার, রুশা ধর্ষিতা নয় ও পবিত্র। আমি শুধুই ওকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম যেন ও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। আমার এক মেইড ওর কাপড় বদলে দিয়েছিলো। আর এতেই রুশাকে আমি বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে আমি ওর সাথে খারাপ কিছু করেছি। আমার প্লান মোতাবেক সব হচ্ছিল। কিন্তু, স্যার আপনি এসে সব নষ্ট করে দিলেন।রুশাকে আমি চিরদিনের মতে হারিয়ে ফেললাম।

-তুমি ওকে বিয়ে করার জন্য যে পথ অনুসরণ করেছো সেটা ভুল পথ। আশা করছি তুমি আর কোনোদিনও মেডিকেলে পড়তে পারবে না। তোমাকে শাস্তি দিতে আমার যা যা করনীয় আমি তাই পালন করবো।

এরপর, মিসবাহকে পুলিশ নিয়ে যায়। আর আমরা তোমাকে অচেতন অবস্থায় আদিলের বাড়িতে নিয়ে আসি।এইটা আদিলের ঘর।

আয়াত কথাগুলো শেষ করতেই রুশার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, রুশা মাথা নিচু করে বসে আছে। তাই রুশাকে ডাক দিলো আয়াত। রুশা আয়াতের ডাক শুনে আয়াতের দিকে মুখ তুলে তাকালো।

-রুশা, তুমি যদি চাও তবে এই বিয়ের কথা সবাই জানবে নয়তো এই বিয়ে যেমন গোপনে হয়েছে ঠিক তেমনভাবে গোপনে ভেঙে যাবে। তুমি কি করতে চাও এই বিয়ের ব্যাপারে আমায় বলতে পারো নয়তো আদিলের সাথে?

-আয়াত ভাই, আমি একটু আদিল স্যারের সাথে কথা বলতে চাই।

-আচ্ছা, তুমি বসো। আমি আদিলকে এই ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আয়াত ভাই চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর আদিল স্যার মাথানিচু করে ধীরপায়ে এই ঘরে প্রবেশ করলেন। দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি আদিল স্যারকে ডাক দিলাম। উনি আমার ডাক শুনতে পেয়ে আমার দিকে তাকালেন। এরপর, আমি ইশারা করলাম, আমার সামনে এসে বসতে। স্যার কিছু একটা ভেবে আমার থেকে কিছুটা দূরত্বে এসে বসলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

-আপনি না আপনার মাধুর্যকে ভালোবাসেন, স্যার? তবে আমায় বিয়ে করতে গেলেন, কেন?
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#পর্ব_২৯
#Tahmina_Akhter

-আপনি না আপনার মাধুর্যকে ভালোবাসেন, স্যার? তবে আমায় বিয়ে করতে গেলেন, কেন?

“মাধুর্য” নামটি শুনে আদিল অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রুশার পানে।কারন,রুশার তো জানার কথা না মাধুর্যের ব্যাপারে,তবে ও কার কাছ থেকে জেনেছে?কৌতূহল দমাতে না পেরে আদিল রুশাকে জিজ্ঞেস করলো,

-তুমি মাধুর্যের কথা জেনেছো কার কাছ থেকে?

-আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র নওশিন আপুর কাছে থেকে।
মাথা নিচু করে উত্তর দিলো রুশা।

আদিল রুশার থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে অর্থ্যাৎ জানালার পর্দায় রাখলো।গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে।

আদিলের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে রুশা মুখ উঁচিয়ে তাকালো, দেখলো আদিল সামনের জানালার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। রুশা আদিলের দৃষ্টি আর্কষন করার জন্য গলা খাঁকারি দিতেই আদিল রুশার মুখের দিকে তাকালো। রুশা যখন দেখলো আদিল ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাবে ঠিক সেই মূহুর্তে মুখ নিচে নামিয়ে ফেললো।

-রুশা???

-জী স্যার।
মাথা নিচু করে সাড়া দিলো রুশা।

-আমি মাধুর্যকে ভালোবাসি, এটা আমার জীবনের অপরিবর্তনীয় সত্য। কিন্তু, ওকে যে ভালোবাসি ও কি জানে? ও জানে না। ও আমার হৃদয়ের খুব কাছে থাকলেও বাস্তবিক অর্থে ও আমার থেকে বহু ক্রোশ দূরে।

উপরোক্ত কথাগুলো বলতে বলতে আদিল রুশার দিকে তাকালো, দেখলো রুশার মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই, তবে খুব মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনছে। আদিল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলতে লাগলো,

-এখন থাক সেসব কথা৷ তোমাকে আমি স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রী এখন তুমি।আশা করছি, আমার মাধুর্যকে নিয়ে তোমার কোনো সমস্যা হবে না।কারণ, সে যেমন আমার মন-মস্তিষ্কে জুড়ে আছে ঠিক তেমন তুমিও আমার জীবনের সাথে জরিয়ে আছো।

আদিল একনাগাড়ে কথাগুলো বলে শেষ করলো। রুশা এতক্ষণ খুব মনোযোগ সহকারে আদিলের কথাগুলো শুনেছে। মনের একটি কোণ থেকে কেউ রুশাকে বলছে,

-মাধুর্য অনেক ভাগ্যবতী দেখলি,রুশা। সে কাছে না থেকেও কত কাছে আদিল স্যারের।এমন মানুষের ভালোবাসা পেলে জনমসার্থক।

-তোমার কিছু বলার আছে রুশা, এই বিয়ের ব্যাপারে। কারণ, যা হয়েছে তোমার অজান্তেই, তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে আমি মেনে নিব।

আদিলের প্রশ্ন শুনে ভাবনাচ্যুত হলো রুশা। মিনিট দু’য়েক কি যেন ভেবে আদিলকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

-আমাদের বিয়ে যেই পর্যায়ে হয়েছে তা আসলে ইসলামধর্ম মোতাবেক কতটুকু গ্রহণযোগ্য আপনি, আমি ভালোভাবে জানি।তবুও, একটা কথা বলি স্যার? আপনি আরও ভালোভাবে ভেবে দেখুন, আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।কারণ,স্বজ্ঞানে আপনাকে আমি গ্রহণ করিনি আর আমাদের ধর্মে মেয়েদের ওয়ালি মানে অভিভাবকের অনুমতি না থাকলে সেই বিয়ে বাতিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) তিনবার বাতিল শব্দটি উচ্চারিত করেছেন। আমার অভিভাবক হিসেবে এই পৃথিবীতে শুধু রায়হান আঙ্কেল আছেন। আপনি যদি উনাকে এই বিয়ের ব্যাপারে রাজি করাতে পারেন তবেই আমি?

বাকি কথাটা আর পূর্ণ করলো না রুশা হয়তো লজ্জায় বা সংকোচে।
আদিল দেখলো রুশার সারা মুখ লজ্জার রেখা ভেসে উঠেছে।শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় উপর টেনে দিয়ে বসলো রুশা।কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আবার বলা শুরু করলো,

-যদি রায়হান আঙ্কেল মেনে নেয় আমাদের বিয়ে। তাহলে আমার পক্ষ থেকে হ্যা আর আমাদের বিয়ের কথা আর কেউ যেন জানতে না পারে আমার এমবিবিএস কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত। একপ্রকার শর্তই বলা চলে, এখন আপনার কি সিদ্ধান্ত ,স্যার?
বলে রুশা আদিলের দিকে তাকালো,
দেখলো আদিল ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছে।

রুশা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে রইলো। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর, রুমে আয়াত আর আদিল প্রবেশ করলো। আয়াত ভাই রুমে এলেও অদূর সোফায় বসে রইলেন। আদিল স্যার আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,

-তুমি এখন আয়াতের সাথে কুঞ্জ বাড়িতে ফিরে যাও। তোমার দেয়া শর্তগুলো নিয়ে ভাববো এরপর জানাবো তোমাকে আমি কি চাই? আয়াত?

-জি ভাইয়া।

-রুশাকে নিয়ে যাও আর বিয়ের ব্যাপারটা কেউ যাতে না জানে শুধুমাত্র কাজল ব্যতিত।

-জি ভাইয়া।

রুশার মাথায় আলতো করে হাত রেখে আদিল বললো

-একটুও চিন্তা করবে না। কারণ, তুমি এখন আদিল রহমানের স্ত্রী।বাড়িতে পৌঁছে একটা লম্বা ঘুম দিবে।

কথা শেষ করে হাত নামিয়ে ফেললো আদিল। আর রুশার মস্তিষ্কে শুধু একটি বাক্যের বিচরণ,” আদিল রহমানের স্ত্রী তুমি “আসলেই কি তাই! আমার কি এই মানুষটার স্ত্রী হবার যোগ্যতা আছে?

রাত তখন দু’টো বাজে যখন রুশা আর আয়াত আদিলের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে কুঞ্জ বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়।

আদিল জানালা দিয়ে দেখলো রুশা গাড়িতে উঠে বসতেই আয়াত গাড়ি চালানো শুরু করলো। আদিল জানালা থেকে সরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো।সিলিংফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। আদিলের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। মোবাইল হাতে নিয়ে গ্যালারিতে যেয়ে রুশার ছবির উপর ক্লিক করতেই রুশার ছবি স্ক্রীনে ভেসে উঠলো। আদিল, রুশার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

-তুমি আমার হবে না বলে কত আক্ষেপ ছিল বিধাতার উপর আর আজ সেই তুমি অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার হলে, এসব কি আমার বিধাতার কৃপায় নয়!

———————

সূর্যের মিষ্টি আলোর স্পর্শে রুশার ঘুম ভেঙে গেলো। রুমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে তাকিয়ে দেখলো, রুশার পাশে কাজল মাথায় হাত রেখে চোখে বুঁজে বসে আছে। জানালার পাশে যে রিডিংটেবিল রাখা সেখানে রাখা চেয়ারটায় রায়হান আঙ্কেল বসে বসে কি যেন ভাবছেন?

-আঙ্কেল?
খুবই ধীর কন্ঠে রায়হান সাহেবকে ডাক দিলো রুশা।

রুশার ডাক শুনে রায়হান সাহেব তৎক্ষনাৎ ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো রুশা উনার দিকে তাকিয়ে আছে।
চেয়ার ছেড়ে রুশার কাছে এসে দাঁড়ালেন।এরপর, মমতামাখা কন্ঠে রুশাকে বললো,

-কি রে কেমন আছিস,মা ? ঘুম হয়েছে তো?

-ভালো আছি আর ঘুম অনেক ভালো হয়েছে।

রুশা কথা বলতে বলতে উঠে বসলো। এরপর, রায়হান সাহেবকে ইশারা করলো ওর সামনে বসার জন্য। রায়হান সাহেব খাটের উপর বসে রুশার মুখপানে তাকিয়ে বললো,

-মা রে, আমি কেন গতকাল গাড়ি পাঠালাম না!নইলে তো এতকিছু হতো না রে মা।
কথাগুলো বলতে বলতে চোখের পানির ছেড়ে দিলেন রায়হান সাহেব।

রুশা রায়হান সাহেবের চোখের পানি দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছে। রায়হান সাহেব যেন রুশার আপন বাবা, মেয়েরা কষ্ট পেলে যেমন বাবারা কষ্ট পায়। ঠিক তেমনি কষ্ট পাচ্ছেন তিনি।

-আঙ্কেল, আপনি কাঁদবেন না আমি সহি সালামতে আছি।

-আমি মিসবাহর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করবো।মিসবাহ জানে না ও কার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে?
রুশা, মা আমার। তুই কোনো চিন্তা করিস না। আগামী কয়েকদিন তোর হসপিটালে যাওয়ার দরকার নেই৷
আমি যাই গিয়ে ফাহিমাকে গিয়ে বলি সকালের নাশতা তৈরি করতে।

রায়হান সাহেব চোখের পানি মুছতে মুছতে ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।

রায়হান সাহেব চলে যেতেই কাজল উঠে বসলো।এরপর,রুশা গলা জরিয়ে ধরলো। আচমকা, কেউ জরিয়ে ধরতেই রুশা ভয়ে চিৎকার দিবে এমন সময় কাজল ওর মুখ চেপে বললো,

-পুতুল, আরে আমি। এভাবে দিনদুপুরে চিৎকার করলে লোকে কি ভাববে?

-তুমি আচমকা আমাকে ধরতে এলে কেন?

-তুমি তো আমার পুতুল বোন। তোমাকে না ধরলে কাকে ধরবো?
বলেই রুশার গলা জরিয়ে ধরলো কাজল।
ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলছে,

-যখন জানতে পারলাম যে তুমি নিখোঁজ। জানো,আমার কেমন লেগেছে?আব্বা, তো ছটফটিয়ে একবার বসেন তো একবার বাড়ির বাইরে গেটের কাছে গিয়ে দেখছিলেন তুমি আসছো কি না?
এরপর, যখন রাত বারোটায় আয়াত কল করে বললো, তোমাকে পাওয়া গেছে। ঠিক সেসময় থেকে যেন আমাদের কলিজায় ঠান্ডা মিলেছে।
আমি কিন্তু এতক্ষণ ধরে আব্বার আর তোমার কথা শুনছিলাম। কারণ, আমি যদি জেগে থাকতাম আব্বা তোমার সাথে বসে কথা বলতে চাইতো না। আব্বার একটা বিষয় না আমার কাছে অনেক অদ্ভুত লাগে,আমাদের ভাইবোনের সাথে আব্বা কোনোদিনও এভাবে হাসিমুখে কথা বলেনি যতটা তোমার সাথে বলে।

-হয়তো, আমার প্রতি উনার মায়া জমেছে তাই।

-হতে পারে। এখন চটজলদি গোসল সেরে আসো। সবাই একসাথে খাবার খাবো।

রুশা হালকা হেসে চলে গেলো ওয়াশরুমে।ওয়াশরুমে যাবার পর রুশা আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো,

-আচ্ছা, কাজল আপু আর আঙ্কেল যখন জানবেন আমার আর আদিল স্যারের বিয়ে হয়েছে, তখন উনাদের রিয়েকশন কেমন হবে?

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here