মুনেম ভাই পর্ব -০১

#মুনেম_ভাই(১)
#কুরআতুল_আয়েন

বাসার সামনের বড়সড় মাঠের মতোন জায়গা টায় কোমরে ওড়না বেঁধে উড়নচণ্ডীর মতো কুতকুত খেলায় ব্যস্ত ঝিনুক।তিনতলা জাঁকজমক বিল্ডিং টা থেকে চামেলি তালুকদার কোমড়ে আঁচল গুজে খুন্তি নিয়ে বের হয়েছেন।রাগান্বিত হয়ে এগিয়ে আসছেন ঝিনুকের দিকে।ঝিনুক তখন তিনের ঘরে গুটি ফেলে পা শূন্যে রেখে দম নিয়ে প্রথম ঘর পেরিয়ে দ্বিতীয় ঘরে যাবে তখনই পাশে তাকিয়ে মাকে নিজের দিকে খুন্তি নিয়ে তেড়ে আসতে দেখে সেখান থেকেই দৌড় দিতে শুরু করে দিলো।চামেলি তালুকদারও কম না।তিনিও নিজের মেয়ের পিছনে পিছনে দৌড়তে শুরু করেছেন।মা,মেয়ের এমন দৌড়ানি দেখে কলোনির বাকি মেয়েরা টুপ করে কুতকুত খেলা বাদ দিয়ে তারাও একপ্রকার দৌড়ে ঝিনুকদের বাসার গেইট পেরিয়ে নিজের দের বাসার দিকে রওনা হলো।

ঝিনুক রশিদ তালুকদার এবং চামেলি তালুকদারের পঞ্চমতম সন্তান।চার ভাইয়ের আদরের বোন।কলোনির অনেকেই মজার ছলে বলে উঠেন চার ভাইয়ের ঝিনুকমালা।বাবা আর চার ভাইয়ের আদরে আদরে বড্ড উশৃংখল তৈরি হয়েছে ঝিনুক।সদ্য কিশোরী ঝিনুকের মধ্যে চঞ্চলতা ভরপুর।যশোরে স্থানীয় ঝিনুকরা।রশিদ তালুকদারের যশোর শহরে বেশ নামকরা দুটো ফার্ণিচারের শোরুম আছে।এমনকি আরেকটা শোরুম খোলার প্রচেষ্টা চলছে।

চামেলি তালুকদার বেশ হাপিয়ে উঠেছেন।এই বয়সে কি আর দৌড়ানো যায়।দৌড়ানোর গতি কমিয়ে দিয়ে পাশে থাকা বিদ্যমান লিচু গাছটার ডালটায় ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।ঝিনুক পিছনে ফিরে মাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সেও চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সটান করে দূর্বাঘাসের উপর বসে পড়লো।রোদে মুখটা লাল হয়ে আছে ঝিনুকের।অবশ্য লাল হওয়ারই কথা এই ভরদুপুরে কুতকুত খেলা আবার তার উপর বাসার এরিয়া জুড়ে প্রায় দুই রাউন্ডের মতো দৌড়ানো। সবমিলিয়েই ঝিনুকের গাল দুটো টগবগে রক্তের মতো লাল হয়ে আছে।অতিরিক্ত ফর্সা না হলেও উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ টায় লাল গাল দুটো চোখে পড়ার মতোন।চামেলি তালুকদার ঝিনুকের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে রইলেন।মায়ের কটমটানি চোখ দেখে ঝিনুক আর দাঁড়িয়ে না থেকে এক দৌড়ে তিনতলা বিল্ডিংটায় ঢুকে সোজা দোতলায় চলে গেলো।চামেলি তালুকদার রাগে গজগজ করতে করতে বিল্ডিংয়ের সামনে এগিয়ে আসছেন আর বিরবির করে বলতে লাগলেন,এতো বড় এরিয়া করে কেন যে নূরের বাপ বাসা করতে গেলো।এমন উড়নচণ্ডীর মতো মেয়ে হলে জানলে কখনোই বলতাম না এতো বড় এরিয়া করে বাসা করতে।এই বয়সে কি মেয়ের পিছনে দৌড়ানো যায় নাকি।হঠাৎ করেই বেগুন ভাজার কথা মনে পড়ে যায় চামেলি তালুকদারের।চুলোয় বসিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।বেগুন ভাজার কথা মনে পড়তেই আবারও দৌড়তে শুরু করেন আর বলেন,সবই কপাল!এখন বেগুন ভাজার জন্যও দৌড়াতে হবে।

মাগরিবের আজানের ধ্বনি ঝিনুকের কানে আসতেই বিছানা থেকে একপ্রকার ধড়ফড়িয়ে উঠলো।মায়ের দৌড়ানি খেয়ে সেই যে রুমে এসে ঘুমের ভান করে পড়ে রয়েছিলো এখন উঠেছে।এমনকি গোসলও করেনি।ঘামে,ধুলোবালিতে শরীরটা কেমন ত্যাজমরা হয়ে আছে।মা যে কয়েকবার এসে তার রুমে উঁকিঝুঁকি মেরেছিলো তাও বুঝেছিলো।চোখ দুটো ঘুমের ভান করে থাকলেও মায়ের উপস্থিতি ঠিকই টের পেয়েছিলো।ঝিনুক খুব দ্রুত গতিতেই কাপড়চোপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।চার মগ পানি দিয়ে কোনোরকমে গোসল করে নিলো।ওযু করে এসে নামাজটাও সেরে নিলো।গুটি গুটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গেলো মায়ের মতিগতি বুঝার জন্য।চামেলি তালুকদার চুলোয় চা বসিয়েছেন।সাথে ট্রেতে বাহারি রঙের খাবার গুছিয়ে রাখছেন।ঝিনুক পিছন থেকে চামেলি তালুকদার কে বললো,

–“মা!কেউ আসবে?”

ঝিনুকের আওয়াজ শুনে চামেলি তালুকদার একবার পিছনে তাকালেন।মেয়েকে গোসল করে পরিপাটি হয়ে আসতে দেখে মনে মনে অনেকটাই খুশি হলেন কিন্তু বাহিরে তা প্রকাশ করলেন না।কিছুটা গম্ভীর গলায় বললেন,

–“নামাজ পড়া হয়েছে?”

ঝিনুক সাথে সাথে উত্তর দিলো,

–“হ্যাঁ!মা।এবার তো বলো কেউ আসবে নাকি বাসায়?”

–“হ্যাঁ!আজকে তোর ছোট ভাইয়ার অফিসের কিছু কলিগ আসবে।তাই এইসবের তোরজোর করছি।”

ঝিনুক শুধু”ওহহ”বলে সেখান থেকে চলে আসলো।সোফায় বসে টিভিটা ছেড়ে দিয়ে একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টাতে লাগলো।
ঝিনুকের বড় ভাই নূর কলেজের প্রফেসর,মেজো ভাই নাদিম বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে সেখানেই জব করে সেখানকার নাগরিকত্ব পেয়ে যায়।তবে বাংলাদেশে মাঝে মধ্যে আসা যাওয়া হয়।সেজো ভাই ইশরাক বাবার সাথে ফার্নিচারের দোকানে বসেন।ঝিনুকের সেজো ভাই ইশরাক পড়াশোনার ধারে কাছে একটু কমই ঘেঁষেছে।এতে রশিদ তালুকদার আর চামেলি তালুকদারের কোনো মাথা ব্যথা নেই।হাতের পাঁচ আঙুল তো আর কখনো সমান হয় না।আর,ঝিনুকের ছোট ভাই হাসিব চুয়েট থেকে পাস করে আপাতত একটা কোম্পানিতে আছে।

কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘর থেকে চামেলি তালুকদার চেঁচিয়ে ঝিনুককে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“ঝিনুক দরজা টা খোলে দিয়ে আয়।মনে হয় তোর বাবা এসেছে।”

মায়ের কথায় ঝিনুক টিভির রিমোট টা পাশে রেখে দৌড়ে চলে যায় দরজার সামনে।দরজা খোলে অপরিচিত কতগুলো মুখ দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে যায়।কপাল টা কুঁচকে কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে বললো,

–“আপনারা কারা!”

দরজার কলিংবেল চেপে সবাই টুকটাক কিছু কথা বলছিলো।হঠাৎ মেয়েলি একটা কন্ঠস্বর পেয়ে সবাই কথা থামিয়ে দিয়ে দরজার দিকে তাকালো।সামনে কিশোরী একটা মেয়েকে দেখে সবাই একসাথে বলে উঠলো,

–“আমরা হাসিবের বন্ধু।আজকে আমাদের আসার কথা ছিলো।”

ঝিনুক কিছুটা সরু চোখে বললো,

–“মা যে বললো কলিগ আসার কথা ছিলো।”

ঝিনুকের কথায় সবাই হাসলেও একজন ঠিকই হাসে নি।মুখটাকে গম্ভীর করে রেখেছে।কিছুক্ষণ ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে নিলো।পরক্ষণেই আবার হাতে থাকা ফোনটায় চোখ গুজে দিলো।

পিছন থেকে দ্রুত গতিতে দরজার সামনে হাসিব এসে দাঁড়ালো।ঝিনুকের কাঁধে হাত রেখে বললো,

–“ওরাই আমার বন্ধু আর কলিগ।বলতে গেলে দুটোই এক।আর এখন তুই সোজা রুমে যাবি।”

ছোট ভাইয়ার আদেশ পেয়ে ঝিনুক দৌড় লাগালো রুমের দিকে।ভাইয়ারা যেমন আদর করে তেমন মাঝে মধ্যে শাসনও করে।

সবাই রুমে ঢুকে সোফায় বসে পড়লো।চামেলি তালুকদার রান্নাঘর থেকে এসে কিছুক্ষণ বসে সবার সাথে কথা বলে নিলেন।সবার সাথে কুশল বিনিময় করে নাস্তা আনার জন্য উঠে পড়লেন।সোফার বামপাশে বসা মুনেম খুব মনোযোগ দিয়ে চ্যাট করে যাচ্ছে।চ্যাট করার সঙ্গী তার সামনের সোফাতেই বসা নীলা।একসাথে চাকরি সূত্রেই দেখা তাদের।তারপর থেকেই দুজনের মধ্যে একভালো লাগা কাজ করে।কিন্তু,মুনেমের নীলার প্রতি ভালোলাগাটা একটু বেশিই।সামনাসামনি থেকেও তারা দুজনে চ্যাটের মাধ্যমে খুনসুটি করেই যাচ্ছে।অন্যরা সবাই কথা বলতে ব্যস্ত।

ছোট ভাইয়ার কথায় ঝিনুক ঠিকই রুমে চলে এসেছে।কিন্তু তার কিছুতেই রুমে মন বসছে না।সোফার রুম থেকে ভেসে আসা সবার হাসির আওয়াজ টা তাকে খুব টানছে।কিন্তু অস্বস্তির কারণে যেতেও পারছে না।তাই বুদ্ধি করে দরজার সামনে এগিয়ে গেলো।পর্দাটাকে একটু আড়াল করে সোফার দিকে বসা মানুষগুলোর দিকে তাকালো।মোট পাঁচজন এসেছে।তাদের মধ্যে দুজন মেয়ে।মেয়ে দুজনকে এক দেখাতেই ঝিনুকের মনে ধরে যায়।জিন্স,টপস পড়া দুজনকেই বেশ ওয়েস্টার্ন লাগছে।কিন্তু,কালো জিন্স,আর টপস পড়া মেয়েটাকে একটু বেশিই ভালো লাগছে।তার উপর অনেক সুন্দর দেখতে।ঝিনুক ভেবে নিয়েছে এক ফাঁকে মেয়ে দুটোর সাথে কথা
বলে নিবে।

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই এখন আড্ডার জন্য ছাদের দিকে যাবে।এই কথাটা ঝিনুক ঠিকই রুম থেকে শুনে নিয়েছে।তারও খুব ইচ্ছা করছে সবার সাথে ছাদে যেতে।কিন্তু ভয়ের ঠেলায় বলতেও পারছে না।অনেক ইতস্তত করে একটু বের হলো।বের হতেই সামনে ছোট ভাইয়ার দেখা পেয়ে সেখানেই দৌড়ে গেলো।কিছুটা করুণ গলায় বললো,

–“ভাইয়া আমিও যাবো তোমাদের সাথে ছাদে।”

হাসিব বোনের করুণ গলার আওয়াজ টা শুনে হেসে দিলো।এমতাবস্থায় বললো,

–“ঠিকাছে চল।”

ঝিনুক অনেকটা খুশি হয়ে যায়।কেন জানি তার খুব ভালো লাগছে।
সবাই ছাদের ফ্লোরটায় গোল করে বসে আছে।ঝিনুক হাসিবের সাথে বসেছে।সবার সাথে টুকটাক কথা হয়েছে কিন্তু,মুনেম আর নীলার সাথে এখনো কথা হয়নি।আসলে কথা বলার সুযোগ এই পায় নি।যখনই ঝিনুক নীলার সাথে কথা বলতে যাবে তখনই মুনেম নামের ছেলেটির সাথে এককোনায় চলে যায়।ঝিনুক ব্যাপার টায় কিছুটা কষ্ট পায়।তাতে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে আড্ডায় মেতে উঠলো।আড্ডার একপর্যায়ে সবাই অনেকটা জোড়াজুড়ি করে মুনেমকে গান গাইতে বলে।সবার অনুরোধ মুনেম ফেলতে পারে নি।আর মুনেমের জন্য এইটাই সুযোগ নীলাকে ডেটিকেটেড করে গান গাওয়া।মুনেম কিছুটা আঁড়চোখে তাকিয়ে নিলো নীলার দিকে।মুনেম নীলার দিকে তাকিয়েই ‘কন্যারে’ গানটা গাওয়া শুরু করলো।এমনকি পুরো গানটাই নীলার দিকে তাকিয়ে গাওয়া শেষ করলো।নীলারও মুনেমের গাওয়া গান টা শুনে মুখে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠেছে।
ঝিনুক একমনে মুনেমের গাওয়া গানটা শুনলো।মুনেমের গলার আওয়াজে ঝিনুক অনেকটাই হুশ হারিয়ে ফেলেছে।কিশোরী মনটাতে এক সুপ্ত অনুভূতির জন্ম নিলো।হঠাৎ করেই ঝিনুকের লজ্জা লাগতে শুরু করলো।লজ্জায় একদম মাথাটা নিচু করে ফেলেলো।আর কিছু না বলে ঝিনুক উঠে দৌড়ে চলে আসলো ছাদ থেকে।
—————————————————————–
ওইদিনের পর প্রায় কয়েকসপ্তাহ কেটে গেলো।এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ঝিনুক কেমন নেতিয়ে গিয়েছে।আগের চঞ্চল ঝিনুকের সাথে এখনের নেতিয়ে যাওয়া ঝিনুকের খুব পার্থক্য রয়েছে।একটা গানের ভিত্তিতেই মুনেম ঝিনুকের মনে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে।যেখানে শুধু মুনেমের বসবাস।খুবই অদ্ভুত তাই না!গানের দ্বারা মুনেম আজকে ঝিনুকের ছোট মনটায় জায়গা করে নিয়েছে।যেখানে তাদের মধ্যে না হয়েছে কোনো কথা।এই কয়েক সপ্তাহে ঝিনুক তার ছোট ভাইয়ার কাছে অনেক ইনিয়েবিনিয়ে মুনেমের আসার খবর নিয়েছে।কিন্তু,ঝিনুক তার ছোট ভাইয়ার কাছ থেকে যখন শুনে মুনেম আসবে না তখনই তার মনটা বিষাদে ভরে উঠলো।আগের মতো না খেলতে বের হয়।শুধু মনমরা হয়ে বসে থাকে।চামেলি তালুকদার বেশ চিন্তিত মেয়েকে নিয়ে।তাঁর চঞ্চল মেয়েটা কেমন একটা চুপ হয় গেলো।বয়ঃসন্ধিকালের সময় ভেবে তেমন একটা গুরুত্ব দেন নি।

এইভাবে প্রায় কয়েক মাস কেটে যায়।ঝিনুক যেনো আরো চুপচাপ হয়ে গেছে।একদিন মনমরা হয়ে সোফায় বসে ছিলো।হুট করেই দরজার সামনে তার ছোট ভাইয়ার সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ব্যক্তিটিকে দেখে খুশিতে মন ভরে উঠলো।ঝিনুক বুঝে উঠতে পারছিলো না সে কি করবে।অতিরিক্ত খুশিতে যেনো ভুলেই গিয়েছে তার কি করা উচিত।ঝিনুক মনভরে চেয়ে আছে মুনেমের দিকে।চোখের কার্ণিশ তার ভিজে উঠছে।ঝিনুক সেখানে আর না থেকে দৌড়ে চলে আসলো নিজের রুমে।দরজাটা লাগিয়ে বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো।হঠাৎ করেই জোর গলায় কেঁদে উঠলো।এই কান্না হলো ভিতরে জমে থাকা কষ্টের কান্না।যা আজকে বর্ষণে পরিনত হয়েছে।

মৃদু মৃদু পায়ের আওয়াজে ঝিনুক ছাদের দিকে রওনা হলো।ভিতরে কাজ করছে খুব উত্তেজনা আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে ভয়ও।যখন শুনেছে আজকে রাতে মুনেম এইখানে থাকবে তখনই নিজের মনে মনে একটা বড়সড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে ঝিনুক।নিজের সিদ্ধান্ত টা পূরণ করার উদ্দেশ্যেই ছাদে আসা মূলত।

মুনেম ছাদের গ্রিলে হাত দিয়ে দূরের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছে।আজকে তার মন খুব ফ্রেশ।অনেকটা সময় নীলার কাছে কাটিয়েছে সে।কিন্তু এখনো কেউ কাউকে মনের কথা টুকু বলেনি।নীলার কথা মনে পড়তেই মুনেম ফোনটা অন করে সময় টা দেখে নিলো।একটু পরেই ফোন দিবে নীলাকে।
————-
আস্তে আস্তে ঝিনুক মুনেমের কাছে এগিয়ে গেলো।কোনো কিছু না ভেবেই হুট করে বলে উঠলো,

–“আমি আপনাকে ভালোবাসি মুনেম”

মৃদু মৃদু বাতাস তার উপর আজকের রাতের বিশাল আকাশটা অন্যরকম সুন্দর।ছাদে দাঁড়িয়ে এই পরিবেশটা মুনেম খুব উপভোগ করছিলো আর নীলার কথা ভাবছিলো।হঠাৎ করেই এমন অযৌক্তিক একটা কথা শুনে মুনেম চট করে পিছনে ফিরলো।সামনে ঝিনুককে দেখে ভ্রু দুটো কুঁচকে গেলো।মুনেম ভেবে পাচ্ছে না যার সাথে কোনোদিন কথা হয়নি তার মুখ থেকে এমন একটা কথা শুনতে পাবে।বড়োজোর দুবার দেখা হয়েছিলো।তাও,আবার ভালো করে দেখেই নি।আসলে মুনেম নীলাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে চায় না।
ঝিনুক মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।মুনেম বুকে হাত গুজে ঝিনুকের দিকে এগিয়ে গেলো।থমথমে গলায় বললো,

–“কি বললে আবার বলো?”

ঝিনুক কিছুটা কেঁপে উঠলো।তাও সাহস করে বলে উঠলো,

–“আমি আপনাকে ভালোবাসি মুনেম।”

মুনেম কিছুটা শান্ত চোখে ঝিনুকের পানে চেয়ে বললো,

–“তুমি এখনো ছোট।কি যেনো নাম তোমার হ্যাঁ!ঝিনুক।শোনো ঝিনুক তোমার এখন যে বয়স টা চলছে এই বয়টা খুবই অদ্ভুত।তোমার এখন অনেক কিছুই ভালো লাগবে।কিন্তু,ভালো লাগলেও তোমাকে সেগুলো পাত্তা দেয়া যাবে না।এইগুলোর জন্য উপযুক্ত বয়স থাকে,ম্যাচুরিটি লাগে।”

ঝিনুক কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।কেনো জানি তার মুনেমের কথাগুলো ভালো লাগে নি।ঝিনুক একপ্রকার নাছোড়বান্দা হয়েই বললো,

–“কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি।ওইদিন আপনার গান শোনার পর আমি আপনার উপর অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়ি।তারপর থেকে আমি শুধু অপেক্ষা করতাম কখন আবার আপনি আসবেন!কবে আপনাকে আমি একটু দেখতে পারবো।এই কয়েক মাসে আমি আপনাকে খুব উপলব্ধি করেছি মুনেম।”

মুনেম ঝিনুকের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো।মুখে কিছুটা হাসি টেনে বললো,

–“তুমি বুঝার চেষ্টা করো ঝিনুক।তুমি যা বলছো সব আবেগ থেকে বলছো।একটা সময় এইসব কেটে যাবে।আর,ঝিনুক আমি তোমাকে বোনের চোখে দেখি।হাসিবের বোন মানে আমারও বোন।আমার মন অলরেডি একজন দখল করে নিয়েছে।তাকে ছাড়া বলতে গেলে আমি অচল।”

মুনেমের প্রতিটা কথায় ঝিনুকের মনে অনেক আঘাত হেনেছে।চোখ দিয়ে তার পানি পড়ছে।মুনেম অন্যকারোর তা যেনো কিছুতেই ঝিনুক মানতে পারছে না।আচমকাই ঝিনুক মুনেম কে জড়িয়ে ধরলো।কান্না করতে করতে বললো,

–“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি মুনেম।একটু বুঝার চেষ্টা করুম।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”

ঝিনুকের এই আচরণে মুনেম অনেকটাই রেগে যায়।তার উপর তাকে জড়িয়ে ধরায় যেনো রাগ আর থামছে না।ঝিনুককে জোর করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সজোড়ে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।এতে ঝিনুক অনেকটাই থতমত খেয়ে যায়।ভেবে পায় নি মুনেম তার গায়ে হাত তুলবে।
মুনেমের রাগে শরীর কাঁপছে।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

–“এতো অসভ্য কেন তুমি?ভালো করে বলেছিলাম তখন ভালো লাগেনি।এই থাপ্পড় টা যদি আগেই মেরে দিতাম তাহলে হয়তো এই সাহস টা আর দেখাতে পারতে না।ভুল টা আমারই।যত্তসব!”

হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় মুনেম ফোনের কাছে এগিয়ে গেলো।একবারও ঝিনুকের দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ মনে করেনি।ফোনের স্ক্রিনে নীলার নাম টা দেখে রাগ টা কিছুটা দমিয়ে নিলো।ফোন টা তুলে কানে চেপে ধরলো।
ঝিনুক এখনো দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।তার চোখের কার্ণিশ বেয়ে বাধাহীন ভাবে পানি পড়ছে।

ফোনের অপাশ থেকে নীলা বলে উঠলো,

–“তোমার কথা এমন শোনাচ্ছে কেন মুনেম?কিছু হয়েছে তোমার?”

মুনেম রাগান্বিত চোখে একবার ঝিনুকের তাকিয়ে বললো,

–“পাগল ছাগলের কাহিনি আর কি বাদ দাও।এইসব কথা বলে আমাদের সময় গুলো শেষ করতে চাই না।”

মুনেমের কথায় বিস্ময় নিয়ে তাকালো ঝিনুক।পাগল ছাগল কথাটা তার মনের গহীনে গিয়ে আঘাত করেছে।এইখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে নিচে নেমে পড়লো।

তার দুদিন পর অফিসের ক্যান্টিনে বসে আছে হাসিব,মুনেম আর নীলা।তিনজনের হাতেই কফি।মুনেম কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরপর হাসিবের দিকে তাকাচ্ছে।হাসিব কেমন একটা অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে।এমনকি কফিটাও অযত্নে পড়ে আছে।মুনেম হাসিবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

–“কিরে তোর কিছু হয়েছে?”

হাসিব দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বললো,

–“ঝিনুকের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।”

মুনেম চমকে উঠলো।হুট করেই বুকের ভিতর টা কেমন যেন করতে শুরু করলো।ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

–“মানে!”

–“গতকাল রাতেই ঝিনুক চলে যায় ঢাকায়।মামা,মামীর কাছে।এইখানে নাকি তার থাকতে ভালো লাগছে না।ওইখানে থেকেই পড়াশোনা করবে।এই শহরে নাকি তার দমবন্ধ হয়ে আসছে।একপ্রকার জোর করেই চলে গেলো।মা অনেক বুঝিয়েছিলো কিন্তু ঝিনুক টা কিছুতেই রাজি হয়নি।কি হলো যে আমার বোনটার।”

মুনেম আর কোনো কথা বলেনি।কফিটাও রেখে দিয়েছে।ওইদিনের পরের দিন সকালেই ঝিনুকদের বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিলো।ছাদের ওই কথাগুলো বলার পর থেকে আর দেখা হয়নি ঝিনুকের সাথে।কিন্তু,মুনেমের ভিতর টায় কেমন জানি এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে।ঝিনুকের চলে যাওয়ার কথাটা শুনে খুবই কষ্ট হচ্ছে তার।ঝিনুকের কালকের কান্নামাখা চেহারা টা যেনো হুট করেই নিজের চোখের সামনে ভেসে উঠলো।এতে যেনো কষ্টটা আরো দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে মুনেমের।এমন কেন হচ্ছে তার কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না।পরমুহূর্তেই ভেবে নিলো,হয়তোবা তার ভিতর অপরাধ বোধ কাজ করছে।কারণ,তার জন্যই তো ঝিনুক চলে গিয়েছে।

চলবে..
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here