মহুয়া পর্ব -২৩

#মহুয়া
‌লেখা: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ২৩

প্রেমার থে‌কে অনেকটা দূ‌রে গি‌য়ে প্রিয়‌তি ব্যাগ থে‌কে পা‌নির বোতল বের ক‌রে এক নিশ্বাসে পু‌রো বোতলের পা‌নিটু‌কো শেষ ক‌রে ফেললো। শরীরটা থরথর ক‌রে কাঁপ‌ছে ওর। এমন শক্ত গলায় কখ‌নো কথা বলতে পার‌বে ব‌লে ভাবে‌নি ও। তাও আবার প্রেমার মত মে‌য়ের মু‌খের উপর। প্রিয়‌তি নি‌জেও ভাব‌তে পা‌রে‌নি ও এমন ক‌রে কা‌রো সা‌থে কথা বল‌তে পার‌বে। ত‌বে কথাগু‌লো বল‌তে পে‌রে প্রিয়‌তির মনটা স‌ত্যি হালকা লাগ‌ছে। কিছুদূর যে‌তেই দেখল হৃ‌দিতা দাঁ‌ড়ি‌য়ে ফুচকা খা‌চ্ছে।

প্রিয়‌তি ওর কা‌ছে গি‌য়ে বলল,
” আমার জন্যও এক‌প্লেট অনেক ঝাল দিয়ে।”
হৃ‌দিতা বলল,
” ভা‌বি তু‌মি তো ঝাল তেমন পছন্দ ক‌রো না।”
” আজ একজ‌নের উপর নি‌জের ম‌নের অনেক ঝাল ঝে‌ড়ে‌ছি। এখন অনেক ঝাল খা‌বো, তারপর কেকের দোকা‌নে গি‌য়ে চিজ কেক খা‌বো। বা‌ড়ির জন্য রেড ভেল‌ভেট ‌চিজকেক কি‌নে নি‌য়ে যা‌বো।”
” আজ এত চিজ খা‌বে যে?”
” একটা শয়তান চিজ‌কে একটু শা‌য়েস্তা ক‌রে‌ছি।”
” কী হ‌য়ে‌ছে ভা‌বি পু‌রোটা বলো তো।”

‌প্রিয়‌তি ফুচকার প্লেটটা হা‌তে নি‌য়ে এক পা‌শে গি‌য়ে দাঁড়া‌লো, হৃ‌দিতা ওর পা‌শে দাঁ‌ড়ি‌য়ে বলল,
” হুঁ ব‌লো।”
‌প্রিয়তি পু‌রোটা বলার পর হৃ‌দিতা বলল,
” ভা‌বি তু‌মি স‌ত্যি এসব কথা প্রেমা‌কে ব‌লে‌ছো?”
” হুঁ।”
” বাহ্ ভা‌বি সাব্বাস! দেখ‌লে তো আমার সা‌থে থাকার ফল। আরও ক‌দিন আমার সা‌থে থা‌কো দেখ‌বে তোমা‌কে পুরা চালু বা‌নি‌য়ে দিব।”

হৃ‌দিতা আর প্রিয়‌তি বাড়ি ফি‌রে কিছুক্ষণ ড্র‌য়িং রু‌মে বস‌লো। প্রিয়‌তি হৃ‌দিতা‌কে বলল,
” তুই বসে রেস্ট নে। আমি রুমে গেলাম। মা কোথায়?”
‌প্রিয়তি রিদুর মা‌য়ের কা‌ছে গি‌য়ে বলল,
” মা কী কর‌ছেন?”
‌দিলারা হে‌সে বল‌লেন,
” মাছটা ভাজা শেষ এখন একটু ভূনা করব।”
” স‌রি মা ক‌দিন যাবত ঘ‌রের সব কাজ আপনা‌কে কর‌তে হ‌চ্ছে। এখন তো আমার শরীর ভা‌লো। এখন থে‌কে আপনা‌কে কিছু কর‌তে হ‌বে না।”
” ‌সে নাহয় তুই পু‌রোপু‌রি সুস্থ হ‌য়ে ক‌রিস। এখন ঘ‌রে যা হৃদয় ফি‌রে‌ছে অনেক্ষণ হলো।”
” রিদ‌ু এত তাড়াতা‌ড়ি বা‌ড়ি ফিরল?”
” বিকা‌লে না‌কি আবার যা‌বে। অফি‌সের কাজ না‌কি আজ‌কে শেষ। বা‌কি বিকা‌লে না‌কি মি‌টিং আছে একটা।”
” ওহ।”
” যা তুই ফ্রেশ হ‌য়ে নামাজ প‌ড়ে নে। আর রিদু‌কেও বল জল‌দি ফ্রেশ হ‌তে।”
” আচ্ছা মা।”

‌প্রিয়‌তি রু‌মে ঢু‌কে দেখ‌লো হৃদয় নি‌জের ফো‌নে কিছু একটা কর‌ছে। প্রিয়‌তি রিদুর দি‌কে কো‌নো ভ্রু‌ক্ষেপ না ক‌রে নি‌জের কাপড় নি‌য়ে গোসলখানায় চ‌লে গে‌লো, গোসল ক‌রে বের হ‌য়ে গুনগুন ক‌রে গান গাই‌তে গাই‌তে মাথার চুল মুচ‌ছে। রিদু ভ্রু কুচ‌কে সে‌দিক তাকাল। তারপর বলল,
” জান তোমার শরীরটা কী আজ ভা‌লো, মনটাও ম‌নে হ‌চ্ছে বেশ ভা‌লো?”
‌প্রিয়‌তি গান থা‌মি‌য়ে ‌বেশ খু‌শি ম‌নেই বলল,
” হ্যাঁ মনটা আমার ভীষণ ভা‌লো।”
‌প্রিয়তির মন ভা‌লো দে‌খে রিদুর বেশ ভা‌লো লাগ‌ছে। তাই বেশ উৎসুক হ‌য়েই বলল,
” কে‌নো?”
” আজ আমার ভীষণ প্রিয় বন্ধু সৌর‌ভের সা‌থে দেখা হ‌য়ে‌ছিল। আহা কত‌দিন পর তার সা‌থে দেখা। দে‌খেই খু‌শি‌তে জ‌ড়ি‌য়ে ধরতে চে‌য়ে‌ছিল, কিন্তু পাব‌লিক প্লেস ব‌লে ধর‌তে পা‌রে‌নি।”
‌রিদু ভ্রু কুচকাল। ম‌নে ম‌নে বলল এ সৌরভটা আবার কে? একটু হিংসা বোধও কর‌ছে ও। নি‌জের হিংসা নি‌জের ম‌ধ্যেই গোপন রে‌খেই বলল,
” সৌরভ কে?”
” আমার খুব খুব খুব ভা‌লো বন্ধু।”
” আগে তো কখ‌নো তার কথা ব‌লোনি। আর তু‌মি তো ব‌লে‌ছি‌লে তোমার কো‌নো ছে‌লে বন্ধু ছিল না। ত‌বে সৌরভ কোথা থে‌কে উদয় হ‌লো?”
” ব‌লে‌ছিলাম না‌কি? হ‌তে পা‌রে ভু‌লে গে‌ছি। বা ইচ্ছা ক‌রে ব‌লি‌নি।”
” ওহ। ত‌া ইচ্ছা ক‌রে ব‌লো‌নি কেন? আমি কী তোমার বন্ধু‌দের কথা জান‌তে পা‌রি না?”
” অবশ্যই জান‌তে পা‌রো। ত‌বে আমি এম‌নি ব‌লি‌নি। তু‌মিও তো প্রেমার কথা ব‌লোনি।”

‌প্রেমার প্রসঙ্গ টানায় রিদু খা‌নিকটা চুপ হ‌য়ে গেল। তারপর বলল,
” সব কথায় প্রেমা‌কে টানা কী জরু‌রি?”
” তু‌মি আমার সংসা‌রে প্রেমা‌কে টান‌তে পার‌লে আমি কেন কথায় টান‌তে পারব না। তাছ‌াড়া বাদ দাও আমি এখন তুমি কিংবা প্রেমা‌কে নি‌য়ে কথা বল‌তে ইন্টা‌রে‌স্টেট না। আজ মনটা ভীষণ ভালো।”
” বাহ্। তা কারণ কী এত খু‌শির?”
” সৌরভ আবার কে? যা মজার মানুষ। ও এমন মজার মজার কথা ব‌লে না যে, আমা‌কে হাসা‌তে হাসা‌তে পেট ব্যথা ক‌রে দি‌য়ে‌ছে।”

‌রিদু খা‌নিক সময় চুপ থে‌কে রুম থে‌কে বের হ‌য়ে গেল। রিদু বের হ‌তেই প্রিয়‌তি মৃদু হে‌সে বলল,
” আজ খুব জ্বল‌ছে সা‌হে‌বের। তোমার আর প্রেমার কান্ড শু‌নে আমার যেমন জ্ব‌লে‌ছিল তোমার ততটা না জ্বল‌লেও, বেশ জ্বল‌ছে।”
‌রিদু অন্য রুমে গি‌য়ে শব্দ ক‌রে হাসল বেশ। তারপর বলল,
” পাগলী একটা। ও ভে‌বে‌ছে অন্য ছে‌লের কথা শু‌নে আমি খুব জ্বলব। অথচ পাগলীটা এখনও বুঝ‌তে পা‌রেনি ওর প্র‌তিটা শ্বাস প্রশ্বাস কে আমি চিনি। সৌরভ না‌মে কেউ নেই। জাস্ট আমা‌কে পিঞ্চ কর‌তে একটা নাম হাওয়া থেকে তু‌লে দিল। যে মে‌য়ে তার ব‌রের কা‌ছে কে ‌কে প্র‌পোজ কর‌ছে, ফেইসবুকে কে বা‌জে ক‌মেন্ট কর‌ছে, কে বা‌জে মে‌সেজ কর‌ছে সব ব‌লে, সে কিনা তার ছে‌লে বন্ধুর কথা তার ব‌রের থে‌কে লুকা‌বে। দুষ্টুপাখি তে‌ামার দুষ্টু‌মি আমি ধ‌রে ফে‌লে‌ছি। যাক তু‌মি যখন আমা‌কে জ্বলা‌তে চাচ্ছ তাহ‌লে আমিও নাহয় কদিন জ্বলার নাটক ক‌রি।”

‌রিদু রান্না ঘর থে‌কে চা নি‌য়ে রু‌মে ঢুক‌তেই হা হ‌য়ে গেল। প্রিয়‌তি কাঁচা হলুদ র‌ঙের সুন্দর একটা জর‌জেট শা‌ড়ি প‌রে‌ছে। ওদের বি‌য়ের গা‌য়ে হলু‌দের দিনও এত সুন্দর হলুদ শা‌ড়ি প‌রেছিল। সেটা সু‌তির ছিল কিন্তু এটা জর‌জে‌টের হওয়ায় ওর শরী‌রের শেপটা সুন্দর লাগ‌ছে। রিদু প্রিয়‌তির কা‌ছে গি‌য়ে বলল,
“‌তোমা‌কে খুব সুন্দর লাগ‌ছে। ঠিক হলুদ প্রজাপ্র‌তির মতো।”
” শা‌ড়িটা সৌরভ গিফ্ট ক‌রে‌ছে।”
‌রিদু ম‌নে ম‌নে হাস‌লেও, মু‌খে বিরস ভাব এনে বলল,
” প্রথম দেখায়ই শা‌ড়ি গিফ্ট করল?”
‌প্রিয়‌তি খোঁচা মে‌রে বলল,
” কত মানুষ ক‌’দি‌নের দেখায় কত কী ক‌রে, সেখা‌নে সৌরভ শা‌ড়ি গিফ্ট কর‌লে দো‌ষের কী?”
‌রিদু বলল,
” তাও ঠিক।”

‌প্রিয়‌তি রিদুর সাম‌নে গুন গুন ক‌রে গান গাইতে রিদুর সাম‌নে থে‌কে চ‌লে গেল। গানটা সুন্দর ছিল,
গুন গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়
গুন গুন গুন গান গাহিয়া
নীল ভ্রমরা যায়।
সেই গানের তালে ফুলের বনে
ফুলের মধু উছলায়, উছলায়।
গুন গুন গুন গান গাহিয়া
নীল ভ্রমরা যায়।
আহা গুন গুন গুন গান গাহিয়া
নীল ভ্রমরা যায়।
প্রিয়‌তির এমন সব কান্ড দে‌খে ‌রিদু ম‌নে খুব হাসল। ত‌বে প্রিয়‌তি‌কে আজ কিছুটা স্বাভা‌বিক দে‌খে ওর ভা‌লো লাগ‌ছে।

২৬!!

আজ অনেক‌দিন পর প্রিয়ম খুলনা থে‌কে বা‌ড়ি‌তে ফিরল। প্রিয়ম‌কে দে‌খে ওর মা রে‌হে‌না বেগ‌মের স‌ত্যি খুব মায়া হ‌লো। ছে‌লেটার চোখমুখ একদম ব‌সে গি‌য়ে‌ছে। চো‌খের নি‌চে কা‌লি জ‌মে গে‌ছে। এত সুন্দর ছে‌লেটার কি অবস্থা হ‌য়ে‌ছে। রে‌হেনা বেশ মায়াভরা ক‌ন্ঠে বলল,
” কেমন আছিস বাবা?”
‌প্রিয়ম ফ্যাল ফ্যাল ক‌রে তা‌কি‌য়ে বলল,
” ভা‌লো আছি মা তোমরা?”
” হ্যাঁ ভালো।”
‌প্রিয়ম আর কো‌নো কথা বল না। চুপ ক‌রে নি‌জের রু‌মের দি‌কে পা বাড়াল। রু‌মে ঢোকার ঠিক আগ মুহূ‌র্তে তি‌থি‌কে দেখল। মে‌য়েটা বি‌য়ের পর দেখ‌তে আরও রূপবতী হ‌য়ে‌ছে। চেহারার লাবন্যতা আরও বে‌ড়ে‌ছে। বেশ ক‌‌য়েক দি‌নে বয়‌সেও যে‌নো বড় লাগছে। সু‌তির শা‌ড়ি‌তে বেশ বড় বড় লাগ‌ছে ছোট্ট তি‌থি‌কে। তি‌থি আজ সু‌তির প্র‌িন্টের শা‌ড়ি প‌রে‌ছে। কারণ আজ সন্ধ্যার পর র‌কিব আস‌বে। ইদা‌নিং র‌কি‌বের জন্য সাজ‌তে তি‌থির বেশ লাগে। প্রিয়ম‌কে দে‌খে ‌তি‌থি খা‌নিকটা অপ্রস্তুত হলেও নি‌জে‌কে যথা সম্ভব স্বাভা‌বিক রে‌খে বলল,
” কেমন আছেন প্রিয়ম ভাই।”
” ভা‌লো তুই?”
” হ্যাঁ খুব ভা‌লো আছি।”
” র‌কিব সা‌হেব কেমন আছেন?”
” হ্যাঁ ভা‌লো।”
” ‌বি‌য়ের পর তোর সা‌থে তার দেখা হ‌য়ে‌ছিল?”
” হ্যাঁ অনেকবার।”
‌প্রিয়ম বলল,
” লম্বা জা‌র্নি ক‌রে এসে‌ছি তো তোর সা‌থে প‌রে কথা বলব।”
” আচ্ছা।”
‌তি‌থি চ‌লে যে‌তেই প্রিয়ম ওর যাবার পা‌নে ক‌য়েক মুহূর্ত তা‌কি‌য়ে থে‌কে নি‌জের রু‌মে গি‌য়ে দরজা বন্ধ করল।

সন্ধ্যার পর র‌কিব আস‌লে তি‌থির মা জাহানা র‌কি‌বের বেশ খা‌তির যত্ন কর‌লেন। নতুন জামাই ব‌লে কথা। দু তিন রকম পিঠা বা‌নি‌য়ে‌ছি‌লেন। তাছাড়া আরো ক‌য়েক রক‌মের নাস্তা। র‌কিব সব থে‌কে একটু একটু খে‌তে খে‌তেই পেট ফুল হ‌য়ে গেল। প্রিয়ম নি‌চে আস‌তেই র‌কিব‌কে দে‌খে কুলশ বি‌নিময় করল। র‌কিব প্রিয়ম‌কে ওদের বি‌য়েতে না থাকার কারণ জান‌তে চাই‌লে বলল,
” আস‌লে বি‌দেশ যাবার ট্রাই কর‌ছি। সে কার‌ণে সেসব কা‌জে একটু ব্যস্ত ছিলাম।”
‌তি‌থি বা জাহানা দুজ‌নেই চুপ ক‌রে রইল। জাহানা তি‌থি‌কে বলল,
” তি‌থি তুই র‌কি‌বকে রু‌মে নি‌য়ে গি‌য়ে গল্প কর। ততক্ষ‌ণে আমি রা‌তের খাবার রে‌ডি ক‌রি। র‌কিব না‌কি আবার চ‌লে যা‌বে। তো খে‌য়েই যাক। তি‌থিও যে‌নো প্রিয়‌মের নজ‌রের বাই‌রে যে‌তে চা‌চ্ছিল। ওর মা যে‌নো ওর ম‌নের কথা বুঝতে পে‌রে‌ছিলেন। তি‌থি র‌কিব‌কে বলল,
” চলো রু‌মে গি‌য়ে কথা ব‌লি।”
র‌কিব প্রিয়‌মের কাছ থে‌কে যে‌তে খা‌নিক অস্ব‌স্তি বোধ কর‌লেও ‌প্রিয়ম বিষয়টা সহজ কর‌তে বলল,
” র‌কিব সা‌হেব চ‌লে যে‌হেতু যা‌বেন সে‌হেতু আপনার উচিত আপনার স্ত্রীকে একটু সময় দেয়া।”
র‌কিব প্রিয়‌মের থে‌কে বিদায় নি‌য়ে তি‌থির সা‌থে হাঁটা শুরু করল। হাঁট‌তে গি‌য়ে তি‌থির কোম‌রে ছোট্ট একটা চিম‌টি কাটল। তারপর তিথির হাত ধরল। সব দেখে প্রিয়‌মের প্রচন্ড কষ্ট হ‌লেও ওর করার কিছু ছিল না। যা হবার তা হ‌য়ে গে‌ছে।

চল‌বে_______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here