পর্বঃ৩
সময়টা সন্ধ্যাবেলা। প্রিয়ম ড্রাইভ করছে ওর পাশেই সানিকে কোলে নিয়ে বসে আছে কুহু। পেছনের সিটে সানির বাবা মা মাইশা আর ওর হাজবেন্ড নাদিম। উদ্দেশ্য সবাই মিলে আইসক্রিম খাবে। আইসক্রিম পার্লারের সামনে গাড়ি থামাতেই সানি গো ধরলো ও ভেতরে যাবেনা। প্রিয়ম ওকে কোলে নিয়ে বলল, “আমাদের সানি সোনা ভেতরে না গেলে আইসক্রিম খাবে কিভাবে বলো তো? তাহলে তো কুহু আন্টি সবগুলো আইসক্রিম একাই খেয়ে ফেলবে।”
কুহু অগ্নিবর্ণ চোখ নিয়ে প্রিয়মের দিকে চাইলেও প্রিয়ম সেটাকে বিশেষ একটা পাত্তা দিলোনা।
সানি দূরে একটা আইসক্রিমের ভ্যানে আঙ্গুল তাক করে বলল, “আমি ওখান থেকে খাবো।”
শেষপর্যন্ত সানির জেদ রক্ষার্থে সবাই ভ্যানটার দিকে এগিয়ে গেলো। যার যার পছন্দসই আইসক্রিম নিয়ে সবাই খেতে লাগলো। সানি ওর পুরো মুখে আইসক্রিম লেপ্টে ফেলেছে। সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো কুহুরও একই অবস্থা। মাইশা আর নাদিম কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মতো কথা বলতে বলতে খাচ্ছে। প্রিয়ম একটা টিস্যু বের করে আগে সানির মুখটা ভালো করে মুছে দিলো। কুহুর আইসক্রিম খাওয়া শেষ হতেই বেশ যত্নসহকারে ওর মুখটাও মুছে দিলো। কুহু তীক্ষ্ণ চোখে একবার প্রিয়মের দিকে চাইলে প্রিয়মকে বেশ ভাবলেশহীন দেখলো। তাই ব্যাপারটাকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে চলে গেলো।
__________________
কুহুর ব্যবহারিক পরীক্ষা চলছে। লিখিত পরীক্ষাগুলো আগেই শেষ হয়ে গেছে। ব্যবহারিক পরীক্ষার আজকেই শেষ দিন। পরীক্ষার দিনগুলোতেও প্রিয়ম রোজ ওকে নামিয়ে দিয়ে যেতো। আর পরীক্ষা শেষ হলেও সময়মত এসে নিয়ে যেতো। আজ দেরি হচ্ছে দেখে অবাক হলো। কুহুর পাশে রাহিও দাঁড়িয়ে আছে। আরো প্রায় আধাঘণ্টা পর ওদের সামনে এসে কালো রঙের মার্সিডিজটা এসে থামলো। কুহু অবাক হলো গাড়ি থেকে ওর বড় বাবাকে নামতে দেখে। কারণ তিনি এ সময়টা অফিসেই থাকেন। কুহুর বিহ্বল চাহনিকে উপেক্ষা করে ওকে টেনে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে দিলেন। রাহিকে বললেন, “সময়মত চলে এসো।” রাহিও মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করলো।
কুহু এসবের কিছুই বুঝতে পারছেনা। গাড়ি তার আপন গতিতে চলছে। কিছুদূর যেতেই রাস্তাটা কেমন অপরিচিত মনে হলো। ভালোভাবে খেয়াল করলে বুঝতে পারলো এটা বাড়ির রাস্তা নয়। প্রশ্নবাচক দৃষ্টিতে রাফসান সাহেবের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই তিনি স্বভাবসুলভ একটা হাসি দিয়ে বললেন, “আর একটু পরেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমার মা-টার জন্য ছোট্ট একটা সারপ্রাইজ আছে।”
গাড়ি এসে একটা লেডিস পার্লারের সামনে থামলো। কুহুর ভ্রুজোড়া আপনাআপনি কুঁচকে এলো। রাফসান সাহেব ইশারায় ভেতরে যেতে বললেন। কুহু ভেতরে যেতেই মাইশা আর সানিকে দেখতে পায়। সানি ওর সাইজের একটা শেরওয়ানি পড়েছে। শেরওয়ানিটা একটু বেশি ফিট হওয়ায় গায়ে আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে। বেচারা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আর একটু পরপর শেরওয়ানিটা টানছে। মাইশাও শাড়ি পরে চুলগুলোকে কার্ল করে রেখেছে। সেজেছেও বেশ। সবকিছুই কুহুর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। হুট করেই কুহুর আজকের তারিখটা মনে পড়ে গেলো। এই প্রথমবার নিজের জন্মদিনের কথা নিজেই ভুলে বসে আছে। অবশ্য ভুলে থাকলেই বোধহয় ভালো ছিলো। ভেতরটা কেমন ভারি হয়ে আছে। ভারাক্রান্ত মন নিয়েই চুপচাপ বসে রইলো। লেহেঙ্গাটা পড়ানো কমপ্লিট করে ইতোমধ্যে ওকে সাজানোর কাজটাও শুরু করে দিয়েছে পার্লারের মেয়েটা। কলের পুতুলের মতো চুপচাপ বসে আছে কুহু। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আর কিছুদিন পরেই হয়তো চেনা ঘর, চেনা মানুষ সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে। বাবা মাকে হারানোর পর কখনো মামনি আর বড়বাবাকে ছাড়া থাকেনি। তাহলে এখন কিভাবে পারবে! বাবা মায়ের কথাটাও আজ বড্ড মনে পড়ছে। শত যুদ্ধ করেও চোখের জলগুলোকে আটকে রাখতে পারলোনা। পার্লারের মেয়েটা আৎকে উঠে বিরক্তি মিশ্রিত গলায় বলল, “আরে আরে কি করলেন এটা আপনি? চোখের সাজ তো পুরোটাই নষ্ট করে দিলেন।” মাইশা এতক্ষণ সানিকে সামলাচ্ছিল পার্লারের মেয়েটার কথাটা ওর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাতেই কুহুর কাছে গিয়ে বসলো। কুহুর হাতটা নিজের কোলে নিয়ে কুহুর একটা গালে হাত রেখে বলল, “কিরে পাগলি এভাবে কাঁদছিস কেন?”
মাইশার স্নেহমাখা কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছাতেই কুহুর কান্নার বেগ বেড়ে যায়, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। পার্লারের মেয়েটা বেশ বিরক্ত হয়। মাইশা ইশারায় বোঝালো ও দেখছে ব্যাপারটা। কুহুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “এমন করলে হয়, বলতো? সেই কবে থেকে আমরা আজকের দিনটার অপেক্ষায় আছি। আর তুই এইভাবে কাঁদছিস!”
কুহুকে তবুও চুপ করে থাকতে দেখে মাইশা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তোর যদি আপত্তি থাকে তাহলে আমি বরং বাবাকে গিয়ে মানা করে দিয়ে আসি। মাইশা উঠতে নিলেই কুহু ওর হাতটা ধরে আটকে নিলো। বলল, “না আপু। আসলে বাবা মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিলো তো তাই কাঁদছিলাম।” চোখের জলগুলো নিজের হাত দিয়ে মুছে নিলো। পার্লারের মেয়েটা সব ক্লিন করে আবার নতুন করে সাজাতে শুরু করলো।
__________________
রাফসান সাহেব ওদেরকে নিয়ে সোজা রিসোর্টে চলে গেলেন। বাকিরা আগেই পৌঁছে গেছে। সেখানেই সব আয়োজন করা হয়েছে। সানি কুহুর একটা আঙ্গুল ধরে আছে। দুজনেই এগিয়ে আসছে। প্রিয়ম কথা বলছিলো ওর বাবার এক ক্লায়েন্ট সোহেল চৌধুরীর সাথে। অনেক পূর্বপরিচিত হওয়ায় সম্পর্কটা বেশ গভীর। কথা বলতে বলতে সামনে দৃষ্টি পরতেই স্থির হয়ে গেলো ওর চাউনি। সময়টাও যেন ওখানেই থমকে গেলো। সেই সাথে বেড়ে গেলো হৃদস্পন্দনের গতি। বুকে হাত দিয়ে একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে নিলো সে। সোহেল চৌধুরী খুব রসিক মানুষ। প্রিয়মকে এইভাবে কুহুর দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা কেশে বললেন, “কি ব্যাপার ইয়াং ম্যান! হবু স্ত্রীকে যদি এখনই এভাবে দেখতে থাকো তাহলে বিয়ের পর কি করবে? পরের জন্যেও একটু কিছু বাকি রাখো।”
উনার কথায় প্রিয়ম বেশ লজ্জা পেলো। যদিও ও জানে যে মানুষটা এমনই। তাও বাবার বয়সী একটা লোকের মুখে এমন কথা শুনে ওর বেশ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে এবার মাথা চুলকাতে লাগলো। প্রিয়মের অবস্থা দেখে তিনি হেসে ফেললেন। বললেন, “আরে ব্যাটা এতে এতো অস্বস্তির কি আছে। নিজেদের মাঝেতো এরকম হাসিমজা চলেই। নাকি!”
প্রিয়ম মাথা দুলালো। যা দেখে তিনি আরেকদফা হাসলেন।
সানি কুহুকে নিয়ে প্রিয়মের কাছে এলো। প্রিয়মকে এক ঝলক দেখেই চোখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। ওর কাছে একটা বিষয় খুব অবাক লাগছে প্রিয়মের পরণের শেরওয়ানিটা। যার বুকের অংশের ডিজাইনটা ওর লেহেঙ্গার মতোই। আর রঙটাও সেইম।
সানিকে দেখেই প্রিয়ম হাটুমুড়ে বসে পড়লো ওর সামনে। সানি বলল, “মামা দেখো তো, কুহুপাখিকে সুন্দল লাগছে না? একদম মিষ্টি পাখি।”
প্রিয়ম সানির গাল টেনে দিয়ে বলল, “হ্যা বাবাই, খুব সুন্দর লাগছে তোমার কুহুপাখিকে।” কথাটা বলার সময় আড়চোখে আবারো দেখে নিলো কুহুকে। কুহু অন্যদিকে মুখ করে আছে।
সানি কুহুর হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজের গাল দুহাত দিয়ে ডেকে বলল, “তোমলা সবাই পচা। খালিখালি আমাল গাল তানো।”
ওর কথাশুনে ওরা তিনজনেই হেসে উঠলো।
প্রথমেই কেক কাটার পালা। মাঝে একটা টেবিলের উপর কেকটা রাখা যাতে লেখা আছে শুভ জন্মদিন আওয়ার প্রিন্সেস। লেখাটা দেখেই কুহুর চোখে জল চলে এলো। বাবা মাকে হারিয়েও আরো দুজন বাবা মা পেয়েছে সে। কজনই বা পায় এমন! কুহু পেয়েছে। এদিক থেকে ও বেশ ভাগ্যবতী বলা চলে। মানুষ দুটো প্রমাণ করে দিয়েছে সব সম্পর্কের জন্য রক্তের সম্পর্কের প্রয়োজন পড়েনা। কিছুকিছু সম্পর্ক আত্মা দিয়েও তৈরি হয়। নয়তো এখনকার যুগেও বন্ধুর মেয়ের জন্য কেউ এমনটা করে!
কুহু একবার সবার দিকে তাকালো। এখানে সবই পরিচিত মুখ। অপরিচিত কাউকেই তো দেখছে না। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছেনা ওর। ছেলে কি তাহলে পরিচিত কেউ?
চলবে,,,
[