#অপ্রিয়_সেই_প্রিয়জন
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
#পর্ব~৯
সাদা আর আসমানী রঙের মিশ্রণের বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। বাড়িটা বিশাল বড়ো। রাস্তা থেকে বাড়ির অর্ধেক ই দেখা যায়। ছোট ভেনিস শহর যেন এই বাড়িটার সৌন্দর্যে বিমোহিত। আশেপাশের রাস্তা ফাঁকা। মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। মানুষ থাকবেই বা কি করে?? এখন তো সকাল। যদিও এখানকার মানুষ হাঁটতে বের হয় সকালে কিন্তু সেজন্য আলাদা পার্ক আছে। মীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যা এটাই ইফাজের বাড়ি। গতকাল ট্যুর থেকে এসেই সাবরিন মীরাকে ইফাজের বাড়ির ঠিকানা সেন্ড করে। মীরা দেরি না করেই আজকে এসেছে। কারণ আজকে নাকি ইফাজ বাড়িতেই থাকবে। তাই সকাল সকাল মীরা এখানে এসে পড়েছে। কিন্তু মীরা ভাবছে ওকে ভেতরে ঢুকতে দেবে তো??কড়া সিকিউরিটি গার্ড এর ব্যবস্থা রয়েছে এই বাড়িতে। সেখানে বিনা পরিচয়ে মীরাকে কি বাড়িতে ঢুকতে দেবে??
মীরা আজকে বাঙালি সাজে আসেনি। ওয়েস্টান ড্রেস পরে এসেছে। হাটু পর্যন্ত টপসের সাথে জিন্স আর গলায় স্কার্ফ ঝোলানো। চোখে সে কালো সানগ্লাস এঁটেছে।কালো খয়েরী রঙের টপস টা বেশ মানিয়েছে মীরাকে। পুরোই কিলার লুক। কাঁধে তার মাঝারি সাইজের ব্যাগ। মীরা ধীর পায়ে গেইটের দিকে এগিয়ে গেল। একজন সিকিউরিটি গার্ড তাকে জিজ্ঞেস করল,’হু আর ইউ??’
মীরা এদিক ওদিক তাকিয়ে ওর শুস্ক ঠোঁটজোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে বলল,’আই উড লাইক টু মিট ইফাজ খান।’
কিন্তু গার্ড মীরাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো না। কারণ মীরা তার পরিচয় ঠিকমতো দিতেই পারেনি। মীরা বারবার রিকোয়েস্ট করতে লাগলো। কিন্তু গার্ড তাকে ভেতরে যেতে দিতে নারাজ। এমন সময় কেউ পেছন থেকে বলে উঠলো,’হোয়াট হ্যাপেন্ড??’
মীরা পেছনে তাকিয়ে দেখলো ইশান দাঁড়িয়ে আছে পরনে তার জগিং পোশাক। ইশানকে দেখে মীরার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। অনেক কষ্টে মীরা নিজের রাগ কন্ট্রোল করলো। তবে সে এবার ইশানকে ভয় পেলো না। উল্টে ইশানের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে ইশানের চোখে চোখ রাখলো। এতেই ইশানের মেজাজ বিগড়ে গেলো। ওর চোখে চোখ রাখার সাহস হলো কিভাবে এই মেয়েটার?? তবে বাড়ির সামনে বলে ইশান কোন সিনক্রিয়েট করলো না। মীরা তার সানগ্লাস ব্যাগে ঢুকিয়ে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’আই ওয়ান্ট টু মিট ইউর ফাদার??’
ইশান গরম চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’হোয়াটস ইউর প্রবলেম?? আর ইউ ফলোইং মি??’
মীরা ফিক করে হেসে ফেললো তারপর খাঁটি বাংলাতেই বলল,’বাঙালি ছাপ গায়ে থেকে মুছে ফেলার সাথে সাথে কি বাংলা ভাষা ভুলে গেছেন মিস্টার ইশান খান?? আমাকে লন্ডনের মেয়ে ভাবলে খুব বড় ভুল করছেন। আপনাকে ফলো করার কোন প্রশ্নই আসে না।’
ইশান এবার বাংলাতেই উওর দিলো,’তোমার সাহস দেখে আমি দিনদিন অবাক হচ্ছি। এর পরিনাম কি হতে পারে তা তুমি ভেবে দেখেছো??’
‘কার পরিণতি কি হবে তা তো সময় বলবে মিস্টার ইশান।’
মীরার তেজ জড়িত কন্ঠে ইশানের আরো রাগ হলো বলল,’কেনো এসেছো এখানে??আর আমার আব্বুর সাথে কেন দেখা করতে চাও??’
মীরা দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বলে,’কিছু হিসেব নিকেশ আছে আপনার বাবার সাথে। সেটাই করতে এসেছি।’
ইশান বুঝলো না যে কি হিসেব করবে মীরা। মীরা আবার বলল,’আমরা কি যেতে পারি??’
ইশান স্বর নিচু করে বলল,’সিওর।’
ইশান বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। মীরা তার পিছু পিছু বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। বাড়ির প্রাঙ্গনে বড় করে বাগান করা হয়েছে। নাম না জানা ফুল গাছে ভরপুর সেখানে। একজন মালি গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। পানির পরশ পেয়ে রঙিন ফুলগুলো চিকচিক করছে। মীরার আপাতত এসব দেখার ইচ্ছা নেই। সে ইশানের পিছু পিছু হেঁটে চলছে।
বাড়িতে ঢুকতেই বিশাল বড় ড্রয়িং রুমে এলো মীরা। চারিদিকে চোখ বুলায় সে। দামি দামি সব আসবাবপত্র দিয়ে ড্রয়িং রুম সাজানো। সবকিছুতেই অভিজাত্যের ছোঁয়া।
ইফাজ ডাইনিং এ বসে আছে। আজও সে ইশানের সাথে জগিং এ যায়নি। ইফাজের বাবা জাফর খান আর মা রেহানা বেগম ও বসে আছে। তারা ইশানের জন্য অপেক্ষা করছে। ইশান আর মীরাকে একসাথে দেখে ইফাজ বলে উঠলো,’তোর সাথে এই মেয়েটা কে ইশান??’
মীরা মনে মনে তাচ্ছিল্য করে হাসলো। কালকে দেখলো আর আজই ভুলে গেলো। তাহলে তো পিহুকে সে কবেই ভুলে গেছে। ইশান ওর দাদুর পাশে বসতে বসতে বলল,’তোমার সাথে মিট করতে এসেছে।’
ইফাজ মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’তুমি আমার সাথে মিট করতে এসেছো??কেন??’
মীরা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,’আগে আপনারা খেয়ে নিন তারপর সব বলবো। সতের বছরের হিসেব তো একটু দেরি লাগবেই। তাই ব্রেকফাস্ট সেরে নিন।’
মীরার কথা শুনে ইফাজ অবাক হলো। সতেরো বছরের হিসেব মানে?? কিন্তু ইফাজ কিছু বলার আগেই মীরা সোফায় বসে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিলো। ইফাজ আর কিছু বলল না খাওয়ায় মন দিলো। ব্রেকফাস্ট শেষ হতেই ইফাজ উঠে মীরার কাছে গেলো। মীরা সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে বলল,’আপনার বাড়ির সবাইকে লাগবে। হিসেব টা সবার সাথেই।’
ইফাজ দফায় দফায় অবাক হচ্ছে মীরার কথা শুনে। মেয়েটা কি হিসেব করবে??জাফর খান ও রেহানা বেগম ও এসে সোফায় বসেছে। ইশান মীরার কথা পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগল। কিন্তু তখনই মীরা জোরে ডেকে উঠল,’মিস্টার ইশান খান। আপনি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনেছেন। এক কথা আমি দুবার বলতে পছন্দ করি না। যদি এখানে আসুন তো ভালো হবে।’
মীরার কথা শুনে রাগে ইশান কেঁপে উঠলো। কিন্তু ইফাছ সামনে থাকায় কিছু বলল না। সোজা এসে মীরার সামনে দাঁড়ালো। মীরা হাতের ম্যাগাজিন টেবিলের উপর রেখে বলল,’তো শুরু করা যাক।’
মীরা ওর সামনে বসা জাফর খান আর রেহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,’আচ্ছা আপনাদের বিয়ের কতবছর হলো?? অন্তত ফিফটি ইয়ারস এর বেশি হবে তো??’
রেহানা বেগম মাথা নাড়িয়ে বলল,’হ্যা তা তো হবেই।’
‘গুড, আপনাদের তো হাফ সেঞ্চুরি হয়ে গেছে তাহলে আপনার নিজের ছেলেকে দিয়ে কেনো তের বছর সংসার করালেন??অন্তত পঁচিশ বছর হওয়া উচিত ছিলো। যেখানে তার বিয়ের প্রায় ঊনত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে।’
মীরার কথা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক। কি বলছে এসব??রেহানা বেগম বলল,’কি বলতে চাও তুমি??’
‘খুব সিম্পেল। মানুষ মৃত্যুর আগে পাপ মোচন করার চেষ্টা করে। কিন্তু আপনারা তো এখনও
করছেন না কেন বলুন তো??মানে আপনাদের যা বয়স,পরপারে যাওয়ার ঘন্টি তো বাজতে চলেছে।’
মীরার এহেম কথায় ইফাজ রেগে যায়। উঠে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে,’হাউ ডেয়ার ইউ?? আমার সামনে বসে তুমি আমার বাবা মায়ের মৃত্যু কামনা করছো কোন সাহসে??’
ইশান ইফাজের দিকে এগিয়ে এসে বলল,’এই মেয়েটাকে বের করে দাও। ও এভাবেই কথা বলে। নূন্যতম ম্যানার্স ও নেই।’
মীরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,’আমি আপনাদের বাড়িতে বেড়াতে আসিনি। আর আমার কাজ হলে আমি নিজেই চলে যাবো আপনাকে বের করে দিতে হবে না।’
মীরা নিজের ব্যাগ থেকে চিঠি তিনটা আর ডায়রিটা বের করে বলল,’আমি একজন স্পেশাল পিওন। অনেক দূর থেকে আপনাদের পার্সেল দিতে এসেছি।’
মীরা ইশানের দিকে এগিয়ে গেল তার পর একটা চিঠি ইশানের হাতে দিয়ে বলল,’এতে আপনার সতের বছরের হিসেব আছে। পড়ে দেখবেন কোন ভুল আছে কি না??’
ইশান হাতের চিঠির দিকে তাকালো। তারপর আবার মীরার দিকে। মীরা ততক্ষণে ইফাজের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ইফাজের হাতে চিঠি আর ডায়রিটা দিয়ে বলল,’আপনার হিসেব টা অনেক বড় তাই একটু সময় নিয়ে পড়বেন। সতের বছর আগের মতো ভুল করবেন না যেন??’
ইফাজ ভ্রু কুঁচকে মীরার দিকে তাকালো। এতক্ষণে সে মীরাকে চিনতে পেরেছে। কালকে তো মীরা লং ফ্রক পড়েছিল। কিন্তু আজকে ওয়েস্টান ড্রেস পরায় ইফাজ চট করে মীরাকে চিনতে পারেনি। ইফাজ বলল,’তুমি কালকের সেই মেয়েটা না??কি যেন নাম??হুম হানি!!’
মীরা শব্দ করে হেসে উঠে বলে,’যাক তাহলে চিনতে পেরেছেন। জিনিয়া আমাকে ভালোবেসে হানি বলে ডাকে। কিন্তু আমার নাম হানি নয় আমি মীরা। মিলন এবং পুষ্পার মেয়ে মীরা।’
ইফাজ এক ধ্যানে মীরার দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটা মীরা। ওর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।মীরা নামটা শুনে ইশান ও চমকালো। একটু না অনেকটা। এতদিনে সে মীরার দিকে ভালো করে তাকায়নি পর্যন্ত। কিন্তু এখন তাকালো। ভালো করে মীরাকে দেখতে লাগলো সে। সেই ছোট্ট মীরা কত বড় হয়ে গেছে। ইশান ভাবতে লাগলো, আচ্ছা আজও কি মীরা একটুতেই অভিমান করে?? কেঁদে ভাসিয়ে দেয়??নাকি সে বদলে গেছে। ইশান এতক্ষণ রেগে থাকলেও এখন ওর রাগ সব পানি হয়ে গেছে। মনের মধ্যে শান্তি অনুভব করছে। এই মীরাকে একটিবার দেখার জন্য তো ইশান বাংলাদেশ যেতে চেয়েছিল। অথচ মীরা নিজে এসেই তাকে ধরা দিয়েছে। ইশান অস্ফুট স্বরে বলল,’মীরা,,,,!!’
বাকিটুকু মীরা বলতে দিলো না। হাত উঁচু করে ইশানকে থামিয়ে দিলো। কিন্তু মীরা একবারের জন্য ইশানের দিকে তাকালো না। তার চোখ এখনও ইফাজের দিকে। তারপর বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল,’আমার কাজ শেষ।’
মীরা তার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’আমাকে বের করে দিতে হবে না। চলে যাচ্ছি।’
মীরা পা বাড়াতেই ইশান আবার ডেকে উঠলো,’মীরা,,,,’
মীরা থমকে দাঁড়ায় ইশান জলদি করে মীরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও এখন মীরা তার রাগ কন্ট্রোলে আনতে পারছে না। তবুও সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইশান বিমোহিত চোখে মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’তুই মীরা??আর আমি তোকে চিনতে পারলাম না। উফফফ,,,মীরা তুই,,,,’
মীরা ইশানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য সরি। ওহ আরেকটা জিনিস দিতে ভুলে গেছি।’
মীরা তখন ব্যাগ থেকে ইশানের দেওয়া টেডিটা বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল,’এটা আপনি ফেলে এসেছিলেন। এতো দামি গিফট যার তার হাতে মানায় না তাই ফেরত দিলাম। আসি,,,’
মীরা যেতে উদ্যত হতে আবার ইশান বলল, ‘মীরা দাঁড়া??’
মীরা ইফাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,’মিস্টার ইফাজ খান আপনার ছেলেকে একটু সামলান।’
মীরা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। ইশান থ হয়ে মীরার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। মীরা বের হয়ে যাওয়ার পর ইশান টেডিটার দিকে তাকালো। এটাতো সেই টেডি বিয়ার যেটা সে মীরাকে দিয়ে এসেছিল। কিন্তু মীরা এসব দিতে লন্ডন এসেছে?? কিন্তু কেনো??ইশানের কাছে সবটা গোলমাল লাগছে।
…………….
মীরা বাড়িতে ফিরে এসেছে। রাগে তার শরীর কাঁপছে। ইচ্ছে করছিল আরো কতগুলো কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু পিহু ওকে বারবার করে বারন করেছে যাতে ও ঝামেলা না করে। তাই মীরা চুপ করে ছিলো। জিনিয়া বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে কে জানে?? মীরা নিজের রুমে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। এই সকাল বেলা সে লম্বা শাওয়ার নিয়ে বের হল। একটা কুর্তি পরে চুল মুছতে লাগলো। চুল মুছতে মুছতে মুহিতকে ফোন করল সে। মুহিত ফোন রিসিভ করে বলল,’হ্যালো বউ কেমন আছো??কি করছো??কি খাইছো??’
মীরার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ঝাঁঝালো গলায় বলল,’বেশি পকপক করবি না। আমি খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ ফিরছি। আঙ্কেল আর আন্টিকে বলে দিস। মনি’মাকে কিছু বলবি না। সারপ্রাইজ দিবো মনি’মাকে।’
মুহিত অবাক হয়ে বলল,’কি??তুমি ওদের পেয়ে গেছো??’
‘হুম। আর আমার কাজ শেষ তাই ফিরবো।’
‘ইশান ভাইয়াকে দেখেছো??’
মীরা ছোট করে বলল,’হুম।’
‘খুব সুন্দর দেখতে?? বিদেশিদের মতো??’
মীরা এবার রাগ নিয়ে বলল,’বিদেশি বাঁদরদের মতো দেখতে। তুই এতকিছু জেনে কি করবি??’
‘নাহ তুমি যদি আবার প্রেমে পড়ে যাও??প্লিজ প্রেমে পড়ো না। তাহলে আমার কি হবে??বিরহের একটা গান গাই হ্যা,,,’
‘এই থাম থাম। এখন আমি তোর সাথে মজা করার মুডে নেই রাখছি।’
মীরা ফোন কেটে দিতেই কলিং বেলের শব্দ আসতে লাগলো। মীরা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। কারণ ও বেশ বুঝেছে যে কে এসেছে। কিন্তু মীরা দরজা খুলল না। পুরো রেডি হয়ে সে দরজা খুলে। মীরার ভাবনাই ঠিক। স্বয়ং ইফাজ আর ইশান ওর সামনে দাঁড়িয়ে। মীরা চিন্তিত ভঙ্গিমা করে বলল,’একি আপনারা এতো তাড়াতাড়ি??সতেরো বছরের হিসেব কি শেষ?? কোথাও কোন ভুল হয়নি তো??’
মীরা ইফাজের দিকে তাকিয়ে রইল তার জবাব শোনার জন্য। ইফাজকে দেখে তার মোটেও ঠিক লাগছে না। ভিশন চিন্তিত আর ব্যতিব্যস্ত দেখাচ্ছে। মুখের অবস্থা ও ভালো নয়। মীরা ইশানের দিকে একবারও তাকালো না। সে ইফাজের দিকে তাকিয়ে আছে। ইফাজ কিছু বলার চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু বলতে তার কষ্ট হচ্ছে। অনেক চেষ্টা করে ইফাজ মুখ খুলল,’মীরা আমি,,,,,’
‘আপনাদের কথা শোনার কোন ইচ্ছা আমার নেই আমি এখন বের হবো আপনারা আসতে পারেন।’
মীরা বের হয়ে দরজা আটকিয়ে রাস্তার দিকে হাটা ধরলো। পিছন থেকে ইফাজ বলল,’মীরা দাঁড়াও??পিহু কোথায় মীরা??’
ইফাজের মুখে পিহুর নাম শুনে মীরা দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘুরে ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনার মুখে ওই নামটা শোভা পায় না মিস্টার ইফাজ খান।’
ইফাজ দুকদম এগিয়ে মীরার সামনে গিয়ে বলে,’আমি পিহুর সাথে দেখা করতে চাই মীরা। প্লিজ আমাকে বলো পিহু কোথায়??’
মীরা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,’হঠাৎ এতো বছর পর কেন দেখা করবেন??আর তাছাড়া ওই চিঠির কথাগুলো আপনার বিশ্বাস হলো কেন?? সেদিন তো মনি’মায়ের কোন কথাই শোনেননি তাহলে আজ কেন সামান্য চিঠির কথা বিশ্বাস করেছেন??লেখাগুলো তো মিথ্যা হতে পারে!!’
‘মীরা আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। সত্যি সেদিন আমার পিহুর কথাগুলো শোনার দরকার ছিল। আমি পিহুর সাথে দেখা করতে চাই। আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইব।’
মীরা এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো। ইশান আর ইফাজ দুজনেই মীরার দিকে তাকিয়ে রইল। মীরার এই হাসির আড়ালে যে একরাশ অভিমান আর ঘৃনা রয়েছে তা বুঝতে ওদের বেগ পেতে হলো না। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা হাসির পেছনে কষ্ট লুকিয়ে রাখে। কিন্তু সে বলা না পর্যন্ত কেউ সেই কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে না। কিন্তু যে হাসির আড়ালে রাগ আর অভিমান থাকে তা সহজেই বোঝা যায়। বিশেষ করে তার কাছের মানুষেরা সহজেই তা ধরতে পারে। মীরার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ইশান তা বেশ বুঝতে পেরেছে। মীরার চোখে যে সে ঘৃনা দেখতে পাচ্ছে।
ইশান মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,’মীরা আমি আর আব্বু,,,,,’
মীরা রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলল,’আমি আপনার সাথে কোন কথা বলতে চাই না।’
‘মীরা আমার কথাটা তো একবার শোন??’
‘কি শুনব আপনাদের কথা?? সেদিন আপনারা আমার মনি’মায়ের কথা শুনেছিলেন??তার কথা বোঝার চেষ্টা করেছিলেন??উল্টে তাকে ছুঁড়ে ফেলে চলে এসেছিলেন। অথচ সেদিন মনি’মায়ের সবচেয়ে বেশি দরকার আপনাকে ছিল মিস্টার ইফাজ খান।’
কথাটা মীরা ইফাজের দিকে তাকিয়ে বলল। তারপর ইফাজের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,’সেদিন মনি’মা আপনাকে পাশে চেয়েছিলেন। ঘৃন্য ব্যক্তিটার হাত থেকে বাঁচতে তো আপনার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আপনি তাকে ফেলে এসেছেন। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছেন। একটাবার কি ভেবে দেখেছিলেন যে মানুষটা থাকবে কিভাবে?? ভাবেননি আপনি। সেদিন প্রশ্নের ঝুলি তার উপর চাপিয়ে চলে এসেছিলেন। কিন্তু এবারও প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করেননি। প্রশ্নের সমাধান তো উওর হয় তাহলে আপনি কেন উওর জানার অপেক্ষা করেননি??আর আজ কেন একটা সামান্য চিঠিকে বিশ্বাস করছেন? ডিভোর্সের এতো বছর পর হঠাৎ কি হলো আপনার??’
ইফাজের চোখ ভিজে গেছে। কিন্তু কাঁদতে পারছে না। কাঁদার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে।সে মীরাকে কিছু বলতে গেলে মীরা তাকে থামিয়ে বলল,’আমি আপনাকে অনেক প্রশ্ন করে ফেলেছি কিন্তু একটারও উওর আমি শুনতে চাই না। যেমনভাবে আপনি শোনেননি।’
মীরা হাপাচ্ছে। তার ও কষ্ট হচ্ছে পিহুর জন্য। এতবছর পর আবার পুরোনো ঘা তাজা হয়েছে কষ্ট তো হবেই। ইশান তার বাবার দিকে তাকালো। ইশানের ও এবার কষ্ট হচ্ছে। মীরা ভাবছে ইফাজ হয়তো এতবছর স্বাচ্ছন্দে কাটিয়েছে কিন্তু ইশান জানে তার বাবা সতের বছর কিভাবে কাটিয়েছে??ইশান মীরার দিকে এগিয়ে এসে বলল,’মীরা সত্যি আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা আম্মুর কাছে,,,’
‘আম্মু কাকে বলছেন??তাকে তো আপনি ঘৃণা করেন। তাহলে কেন আম্মু বলছেন??’
ইশান অনুনয় করে বলল,’আমাকে লাস্ট একটা সুযোগ দে মীরা!!’
‘আপনি সেদিন কি করেছিলেন?? খুব তো বলেছিলেন যে তখন আপনি বড় হয়ে গিয়েছেন। সব বোঝেন। কিন্তু এটা বোঝেননি যে আপনার মাকে একটা সুযোগ দেওয়া যায় কি না?একবার ও ভাবেননি যে মা আপনাকে ছাড়া থাকবে কিভাবে?? আমি ছিলাম বলে মনি’মা আমাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিল। যদি আমি না থাকতাম তাহলে মানুষটা এতদিন মরে যেতো। বছরের পর বছর ধরে তাকে কষ্ট পেতে দেখেছি। আমার চোখের আড়ালে কাঁদতে দেখেছি। কিন্তু সে শত চেষ্টা করেও আমার চোখের আড়ালে তার কষ্টগুলো লুকিয়ে রাখতে পারতো না। নদীতে যেমন কচুরিপানা ভাসে তেমনি মনি’মায়ের কষ্টগুলো তার চোখে ভাসে। সেটা দেখা বা বোঝার ক্ষমতা আপনার না থাকলেও আমার আছে। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে যে তোমার সবচাইতে ঘৃণিত ব্যক্তি কে?? নিঃসন্দেহে আমি বলব ইফাজ খান আর ইশান খান। সতের বছর ধরে তাদের আমি ঘৃণা করেই আসছি।’
‘মীরা একবার তো,,,,’ বলতে বলতে ইশান মীরার দিকে এগিয়ে আসতেই মীরা বলল,’আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না ইশান খান। আমি আপনাকে ঘৃণা করি সাথে আপনার বাবাকেও। আপনাদের জন্য আমার
মনি’মা আজ মৃত্যুর দোড়গোড়ায়। তবে এখন ভালো থাকলেও কতদিন ভালো থাকবে তা জানি না।’
ইফাজ উদগ্রীব হয়ে বলল,’পিহুর কি হয়েছে মীরা??আমি যাব পিহুর কাছে।’
‘আর যাওয়ার দরকার নেই। এখন এসব ভাবছেন কেন??এই ভাবনাটা যদি ডিভোর্স লেটার পাঠানোর সময় ভাবতেন তাহলে তা কাজে লাগতো!!’
ইফাজ এবার অবাক হলো। মীরা বারবার এসব বলছে কেন??ইফাজ তো পিহুকে ডিভোর্স পেপার পাঠায়নি তাহলে??সে বলল,’আমি পিহুকে ডিভোর্স পেপার পাঠাইনি। পিহু নিজে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিল আমাকে।’
‘মনি’মা আপনাকে ডিভোর্স পেপার পাঠায়নি। আপনি পাঠিয়েছিলেন।’
ইফাজ জোর গলায় বলল,’আমি পাঠাইনি। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম হয়তো আমার কোথাও ভুল হচ্ছে। পিহুকে হয়তো আমি ভুল বুঝেছি কিন্তু যখন পিহুর পাঠানো ডিভোর্স পেপার পেলাম তখন ভেবেছিলাম যে পিহু সত্যি আমার সাথে থাকতে চায় না। সেজন্য আমি পেপারে সাইন করেছিলাম।’
‘সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে চলে আসার পরের দিন কেন লন্ডন চলে এসেছিলেন??’
‘আমারা তার সাতদিন পর লন্ডন চলে এসেছিলাম মীরা তার পরেরদিন না।’
ইফাজের কথা শুনে মীরা একটু অবাক হলো। তারপর বলল,’তার পরেরদিন যে মনি’মা আপনার বাড়িতে গিয়েছিল আপনাকে সবটা জানাতে সেদিন তাকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দিলেন না কেন??এটাও কি আপনার না জানা??আর কত নাটকে করবেন??এসবে আমি অভ্যস্ত আমাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করবেন না।’
এবার ইশান বলল,’আব্বু সত্যি কিছু জানে না মীরা। আম্মু আসার কথা যদি জানতো তাহলে আব্বু ঠিকই আম্মুর সাথে দেখা করতো।’
মীরা কটাক্ষ করে বলল,’বাবার হয়ে আর সাফাই গাইতে হবে না। অবশ্য আপনার থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। যদি সত্যি আপনারা কিছু না জানতেন তাহলে জিজ্ঞাসা করুন জাফর খানকে?? তিনি অবশ্য সবটা জানতেন। আমার থেকে আর কিছু জানতে চাইবেন না আমি উওর দিতে বাধ্য নই। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে আমি আসি।’
মীরা রাস্তা বরাবর হাঁটতে শুরু করল। ইফাজ এখনও দাড়িয়ে আছে। মীরার বলা কথাগুলো সব গুলিয়ে যাচ্ছে তার। মীরা চলে আসার পরেই সে চিঠি পড়েছে। নেহালের চিঠি পড়ে সে প্রথমে কিছুটা বিশ্বাস করতে চায়নি তবে সে যখন পিহুর দেওয়া চিঠিটা পড়লো তখন মনে হচ্ছিল কেউ ওর বুকে পাথর চেপে ধরেছে। ইশান নিজের চিঠিটা খুলে পড়েছে সাথে নেহালের দেওয়া চিঠিটাও পড়েছে। ইফাজ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিল চিঠি হাতে নিয়ে তারপর সে মীরার কাছে আসে সবটা খোলাসা করে জানার জন্য।
মীরা চলে যাচ্ছে দেখে ইশান মীরার পিছু পিছু যেতে যেতে বলল,’মীরা স্টপ। এরকম করিস না তোর সাথে আমার কথা আছে।’
মীরা উওর না দিয়ে হেঁটেই চলল। ইশান তাতে হাল ছাড়লো না। সেও মীরার সাথে সাথে হেঁটে চললো। মীরা একটা ক্যাব ডেকে তাতে উঠতে নিলে ইশান বলল,’মীরা প্লিজ যাস না আমার কথাটা একবার শোন।’
মীরা ক্যাবে ওঠার আগে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’লন্ডনের মেয়েরা যেই ইশানের পিছনে ঘুরে বেড়ায় সেই ইশান আমার মতো সামান্য একটা মেয়ের পিছনে ঘুরছে??এটা বড়ই অসম্মানজনক ব্যাপার। শুধু শুধু আমার পিছনে ঘুরে নিজের মান সম্মানের ফালুদা বানাবেন না।’
মীরা চলে গেল। ইশান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মীরার চলে যাওয়া দেখলো। কোন কিছু সে বলতে পারলো না। ইশান ভেবেছিল যে মীরা হয়তো একটুখানি বদলেছে। কিন্তু মীরা যে এতোটা বদলে গেছে তা ভাবেনি সে।
#চলবে,,,,,,,