#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_3
রাত দিন এক করে পড়া শোনা চালাচ্ছে অনিন্দিতা। মেয়ের পড়া শোনা দেখে বেশ খুশি হলেন আরশাদ। এন এস ইউ তে এডমিশন নেওয়ার জন্য কি খাটুনি টাই না খাটছে। আরশাদ হক পেশায় একজন সৎ ডক্টর। দুটো মেয়ে , আর স্ত্রী কে নিয়েই তাঁর পরিবার। বাবা মা গত হয়েছে বহু বছর। অনেক কষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আর তাই পড়া শোনার গুরুত্ব বুঝেন। ঘড়িতে টাইম দেখে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। মাসে দু একবার সরকারি কাজে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। এবার যাচ্ছেন পঞ্চগড়।
শাহানার মন খারাপ। কারন পুরো পনের দিনের জন্য যাচ্ছে আরশাদ। স্বামীর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। এরেঞ্জ ম্যারেজ হলে ও ভালোবাসায় কমতি নেই।
আরশাদ বাসা থেকে বের হতেই চাঁপা কান্নায় ভেঙে পরলেন। হীর মায়ের কান্নাতে বিরক্ত হলো ।
_ আম্মু এই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না থামাও প্লিজ। তুমি যেই ভাবে কাঁদো আমার বান্ধবী রা তাঁদের বাইশ দিনের রিলেশন ভেঙে গেলে ও এভাবে কাঁদে না।
হীরের কথায় শাহানা চোটে গেলেন। পায়ের জুতা টা উঠিয়ে বললেন
_ মারবো এক চর। অসভ্য মেয়ে , মায়ের কাছে বন্ধু মহলের কুকর্ম শোনাচ্ছে। তোর বাবার সাথে আমার বাইশ বছরের সম্পর্ক বুঝলি বাইশ বছরের সম্পর্ক।
_ তো ? এর জন্য ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবে ? আব্বু তো পনেরো দিন পরে চলেই আসবে। সমস্যা কোথায় বলো তো ?
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন শাহানা। এই মেয়েটা যেমন ত্যাড়া ঠিক তেমনি অসভ্য। অন্য দিকে বড় মেয়ে টা হয়েছে পাগল প্রকৃতির। ফাস্ট চয়েজ যেটা সেটাই চাই। দুটো মেয়ে কে প্রায় বিশ বছর যাবত সহ্য করে যাচ্ছে। এতো আদর দিয়ে বাঁদর হয়েছে।
_ কি বির বির করছো আম্মু ?
অনিন্দিতার কথাতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। ডাইনিং গোছাতে গোছাতে বললেন
_ এসে পরেছিস। তোর আব্বু তো এই মাত্র পঞ্চগড় চলে গেল।
_ কি ?
_ হ্যাঁ মিনিট দশেক হলো।
_ আমাকে ডাকবে না একবার ? আব্বু তো পনেরো দিনের জন্য গেল।
_ তোর আব্বু ই বারন করেছে। ফোন করে কথা বলতে বলেছে। আপাতত এই গ্লুকোজ টা খা শরীরে জোর আসবে। একটা বছর ধরে কম খাটনি তো যাচ্ছে না।
অনিন্দিতা গ্লুকোজ এর পানি টা নিলো। একটু খেয়ে আবার রেখে দিলো।হঠাৎ ই মনে পরলো আজ শুক্রবার। উল্লসিত মন নিয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো।
লাল নীল নানা রঙের নয়ন তারা ফুল ফুটে রয়েছে। ছাঁদের এক অংশ জুড়ে বাগান করেছে নির্ভীক। পড়া শোনা টা বিদেশে করলে ও প্রতি তিন মাস অন্তর বাংলাদেশে এসে ঘুরে যেত সে । প্রায় ছয় বছর যাবত এই বাগান তৈরি করা হয়েছে। গত চার বছর ধরে অনিন্দিতা নিজে ও এই বাগানের যত্ন করে ।
অবশ্য সেটা নির্ভীক এর অগোচরে। কারন নির্ভীক দেখে ফেললেই সর্বনাশ। এক বালতি কথার সাথে জ্ঞান শুনিয়ে দেয়। বাগানের ফুল গুলো একটু একটু করে ছুঁইয়ে দিলো। বড্ড আপন এ ফুল গুলো। কারন প্রতি টা ফুলে নির্ভীকের স্পর্শ। যা ওর কাছে ভীষন প্রিয়।
চিলেকোঠা দিয়ে কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। অনিন্দিতা দ্রুত সরে গেল। পানির ট্যাঙ্ক এর পেছনে লুকিয়ে পরেছে। নির্ভীক এই সময় টাতে প্রতি শুক্রবার স্পেশাল ভাবে বাগানের যত্ন করে। সাথে খানিক টা শরীর চর্যা।
নির্ভীক বাগানের ভেতরে প্রবেশ করলো। দুটো গাছ কে স্পর্শ করেই ভ্রু কুঁচকে নিলো। একটু একটু করে প্রতি টা গাছ স্পর্শ করলো। কিছু ক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।
পেছন ঘুরে তাকালো। চোখ দুটো রক্ত লাল। শ্যাম রঙা গালে লাল আভা যেন কাঠিন্য প্রকাশ করছে। প্রচন্ড রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। কপালে ভাঁজ পরেছে।
অনিন্দিতার চিত্ত কেঁপে উঠলো। নির্ভীকের মুখের এমন ভঙ্গিমা দেখে অনিন্দিতার মন বিষিয়ে গেল। কোথাও এক অদ্ভুত কষ্ট অনুভব হলো। নির্ভীক কেন এতো রেগে আছে। একটু আগেই তো ঠিক ছিলো। অনিন্দিতার ভাবনার মাঝে নির্ভীকের কঠিন স্বর ভেসে আসলো।
_ বেরিয়ে আসুন অনিন্দিতা।
মেয়েটা চমকে গেল। নিজের কান কে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। ফাঁকা ঢোক গিলে আরেকটু চেপে লুকিয়ে রইলো।
_ দ্রুত বেরিয়ে আসুন অনিন্দিতা। খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
অনিন্দিতা কাঁপা শরীরে বেরিয়ে আসলো। নির্ভীক তার দিকে এক পলক তাকিয়ে পেছন ঘুরে নিলো। অনিন্দিতা কষ্ট পেল। নির্ভীক কখনো তাঁকে ভালো করে দেখে না। মানুষ এতো টা নিষ্ঠুর হতে পারে। চোখে পানি চিক চিক করে উঠলো। এমন এক মানুষের প্রেমে পরেছে যে বিন্দু মাত্র সহ্য করতে পারে না তাকে।
তবু ও মেয়েটা হাসলো। নির্ভীকের ঠোঁটের হাসি দেখার জন্য নির্দ্বিধায় এক সমুদ্র ডুব দিতে পারে।
_ এই সময়ে কেন এখানে এসেছেন ?
_ এমনি ভালো লাগছিলো না তাই।
_ মিথ্যে বলছেন আপনি।
অনিন্দিতা উত্তর দিলো না। নির্ভীক কাঁটা যুক্ত গোলাপ গাছে হাত বুলাতে লাগলো। অনিন্দিতা চমকে উঠলো। চোখ দুটো যেন হন্তদন্ত হয়ে গেছে। এক পা এগিয়ে বলল
_ নির্ভীক ভাইয়া আপনি
অনিন্দিতা নাম নেওয়ার সাথে সাথে গোলাপ গাছ টাকে চেপে ধরলো নির্ভীক। মুহুর্তেই হাত টা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্ত ঝরতে লাগলো। অনিন্দিতা ডুকরে কেঁদে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে নির্ভীক বলল
_ এখানেই থেমে যান। আর এক পা বাড়ালে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যাবে।
_ নির্ভীক ভাইয়া।
_ আগাবেন না।
অনিন্দিতা নির্ভীকের কথার দিকে পাত্তা দিলো না। জল ভরা নয়নে ছুটে আসলো নির্ভীকের কাছে। নির্ভীকের হাত দুটো চেপে ধরলো। ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিলো নির্ভীক। অনিন্দিতা যেন ভয় পেয় গেল। কারন নির্ভীক কাঁটা স্থানে ক্যাকটাস গাছের পাতা চেপে ধরেছে।
মেয়েটা ডুকরে কেঁদে উঠলো। হাতে নির্ভীকের রক্ত লেগে আছে। নির্ভীকের চোখ দুটো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ব্যথায় মাথা টনটন করে উঠছে। ধরা গলায় নির্ভীক বলল
_ আপনি আরো ভয়ঙ্কর কিছু দেখতে চান ?
অনিন্দিতা মাথা ঝাঁকালো। নির্ভীকের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। কষ্টে বুক ভারী হয়ে উঠেছে। টপ টপ করে রক্ত পরছে। লাল রঙে সেই স্থান টা জ্বলজ্বল করছে।
_এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? বলেছিনা এই সময় টা তে ছাঁদে আসবেন না।
অনিন্দিতা ছাঁদের মেঝে তে বসে পরলো। নির্ভীকের পা তাঁর এক হাত দূরে। পা স্পর্শ করতে যেতেই নির্ভীক দু কদম পিছিয়ে গেল। অনিন্দিতা নির্ভীক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে মাথা ঠেকিয়ে দিলো। নির্ভীক ফিরে ও তাকালো না।
_ আমি আর কখনো আসবো না ,শুধু হাত টা সরিয়ে ফেলুন। রক্ত ঝরছে , আপনি কষ্ট পাচ্ছেন।
_ তাঁর থেকে বেশি কষ্ট আপনি আমাকে দিচ্ছেন। আপনি কেন বুঝতে চান না আমি আপনাকে পছন্দ করি না।
_ আমি চলে যাচ্ছি নির্ভীক ভাইয়া। প্লিজ হাত টা সরিয়ে ফেলুন।
নির্ভীক সরালো না। অনিন্দিতা বুঝতে পারলো বিষয় টা। নির্ভীকের দাড়িয়ে থাকা জায়গায় চুমু খেল। ছাঁদে পরে থাকা রক্ত গুলো দু হাতে মেখে নিলো। নির্ভীকের হাতের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে মেয়েটা । নির্ভীকের দৃষ্টি স্থির। এখনো ক্যাকটাস গাছের পাতা চেপে আছে। সুচের মতো বিঁধে গেছে কাঁটা গুলো। অনিন্দিতা পেছনে তাকালো না আর , ছুট লাগালো। অনিন্দিতা চলে যেতেই নির্ভীক হাত টা সরিয়ে ফেললো। পুরো হাতে শত শত কাঁটা বেঁধে আছে। ব্যথায় চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো। ছাঁদের এক কোনে বসে কাঁটা গুলো উঠাতে লাগলো।
*
যন্ত্রনায় হাঁফসাঁফ করছে অনিন্দিতা।যত টা যন্ত্রনা নির্ভীক পেয়েছে তাঁর থেকে দ্বিগুন যন্ত্রনা সে পেয়েছে। মনের যন্ত্রনা তেই থেমে থাকে নি। হাতে কাঁটা কম্পাস ঢুকিয়ে নিয়েছে। ক্ষত হয়ে গেছে , কিছু টা মাংস ও উঠে গেছে। সাদা মাংস বেরিয়ে জায়গা টা ভয়নাক দেখাচ্ছে। রক্ত পরছে টপ টপ করে ।
তাঁতে কোনো ধ্যান নেই। মেঝে তে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মাথার কাছে নির্ভীকের রক্তের ছাপ। খুব যত্ন করে ডায়েরী তে আগলে রেখেছে নির্ভীকের রক্ত। হাতের ব্যথা যেন কিছু ই নয়। তবে নির্ভীকের রক্ত তাকে পাগল করে দিচ্ছে। শাহানা এসে দু বার ডেকে গেছে। অজুহাত হিসেবে মাথা ব্যথা বলেছে।
বিকেলে হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে হীর। অনিন্দিতা অনুভূতি শূন্য। শাহানা চোখের পানি ফেলেছেন বহুক্ষণ। কান্না থামিয়ে গেছেন নির্ভীক দের বাসায়। হীরের চোখে পানির ধারা নেমে এসেছে।
_ কেন এমন করলে আপু ? তুমি এমন কেন করো ? হাত টার কি অবস্থা করেছো কোনো খেয়াল আছে। নিজের প্রতি কেন এতো রাগ দেখাচ্ছো। এন এস ইউ তে এডমিশন নেওয়ার জন্য একি পাগলামি। নির্ভীক ভাইয়া তো বললো আরো ভালো ভালো ভারসিটি আছে। ওনি তো এন এস ইউর লেকচারার । ওনি বললেন তাঁরপর ও শুনলে না ?
হীর একা একাই বক বক করছে। অনিন্দিতা উত্তর দিলো না। অনুভূতি গুলো কোথাও আটকে আছে। চোখের সামনে ভাসছে নির্ভীকের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কাঁটা হাত। যে হাতে সহস্র বার চুমু খাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে। সে হাত আজ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। কি করে সইবে এ ব্যথা । অনিন্দিতা হুট করে কেঁদে উঠলো।
_ আপু এই আপু। কাঁদছো কেন ? ব্যথা হচ্ছে খুব ? কেন করলে এমন টা ?
হীর কান্না করে যাচ্ছে। অনিন্দিতার বুক ফেটে যাচ্ছে। মেইন ডোর দিয়ে কারো আসার শব্দ পেল। হীর কান্না থামিয়ে বলল
_ নির্ভীক ভাই।
অনিন্দিতা ঘার ঘুরিয়ে তাকালো। চকলেট রঙের টি শার্ট পরে আছে নির্ভীক। অনিন্দিতার চোখ দুটো নির্ভীকের হাতের দিকে গেল। হাতে সাদা রঙের ব্যান্ডেজ করা। বুকের ভেতর যেন কেউ ছুড়ি ঢুকিয়ে দিয়েছে। নির্ভীকের দৃষ্টি অন্য দিকে। পেছন থেকে চারুলতা হন্তদন্ত হয়ে আসলেন। হীর উঠে দাঁড়ালো।চারুলতা ব্যস্ত হয়ে পরলেন। অনিন্দিতা কে কথা শুনাতে লাগলেন।
সে কথা মেয়েটার কর্নপাত হলো না। মিনিট দশেক এভাবেই কেঁটে গেল। নিভীর্কের চোখে মুখে কোনো কষ্টের ছাপ নেই।
একটু ও মায়া নেই অনিন্দিতার জন্য। অথচ নির্ভীকের কষ্টের স্বাদ নিতে নিজেকে আঘাত করলো মেয়েটা।
চারুলতা নির্ভীকের দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালেন।
_ এই ছেলেটা আর তুই দুজনেই পুরো অধম। দেখ সকাল বেলায় ক্যাকটাস গাছের কাঁটা বিধিয়ে এনেছে। গাছের যত্ন নিবি ভালো কথা তাই বলে সাবধানতার অবলম্বন করবি না ?
আর এ দিকে তুই এন এস ইউ তে এডমিশনের জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিস। হাতের কি অবস্থা করেছিস।
নির্ভীক চরম বিরক্তি নিয়ে তাকালো। এখানে থাকতে ভালো লাগছে না তার। নেহাত ই ভদ্রতার খাতিরে দাঁড়িয়ে আছে।
পনেরো মিনিট পর শাহানা আর নিহাল আসলো। সাথে ডাক্তার ও আছেন। নিহালের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। চারুলতা পাশ থেকে উঠে গেলেন। ডাক্তার চেক আপ করে ঔষধ পানি লিখে দিলেন। বাসার একজন ডাক্তার থাকলে ও বাইরের ডাক্তারের প্রয়োজন হয় তা আবারো প্রমান হয়ে গেল। নিহাল ডাক্তার কে এগিয়ে দিতে গেলেই নির্ভীক বাঁধা দিলো।
_ আমি যাচ্ছি তুই এখানেই থাক।
নিহাল কথা বাড়ালো না। অনিন্দিতা পাশে এসে বসলো। মাথায় হালকা করে গাট্টা মেরে বলল
_ ফাজিল মেয়ে হাতের কি অবস্থা করেছো। এতো ভালো স্টুডেন্ট হতে হবে কোন সংবিধানে লেখা হয়েছে। এন এস ইউর থেকে অনেক ভালো ভারসিটি আছে সেগুলো তে পড়তে পারতে।
অনিন্দিতা মৃদু হাসলো। চারুলতা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন
_ বোঝা একটু।
শাহানা প্রচন্ড রেগে আছেন। তবু ও কিছু বলছেন না। মেয়ের হাতের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড কষ্ট হলো। হীর সবার জন্য সরবত বানাতে গেল। প্রচন্ড গরম পরেছে তাঁর উপর সবাই ছুটের উপর ছিলো।
_ আমি কি সত্যি ই চান্স পাবো না নিহাল ভাইয়া ?
_ কেন পাবে না ? অবশ্যই পাবে। ভালো করে মনোযোগ দিয়ে পড়ো। তবে নিজর ক্ষতি কেন করলে। এখন তো কয়েক দিন পড়াশোনা বন্ধ।
চারুলতা পাশে এসে বসলেন। অনিন্দিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
_ একদম চিন্তা করবি না। তুই চান্স পাবি , আত্মবিশ্বাস আছে না ?
অনিন্দিতা মাথা ঝাঁকালো। নির্ভীক মাত্র ই ফিরে এসেছে চারুলতা বললেন
_ নির্ভীক কে বলবো তোর এডমিশন টেস্ট অব্দি যেন পড়ায়।
দেখবি এবার চান্স পাবি ই পাবি।
অনিন্দিতা সম্মতি জানিয়ে দরজায় তাকালো। বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে আছে নির্ভীক। যেন এখনি সব কিছু ধ্বংস করে দিবে।
#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_4
টানা সারা দিন কান্না করায় কন্ঠ ভেঙে গেছে অনিন্দিতার। হাতের ব্যাথায় আর টানা কান্না করায় ঠান্ডা লেগে জ্বর ও এসে গেছে। তিন দিন অব্দি এ জ্বর বেড়েই চললো। সাত দিনের মাথায় জ্বর নামলো। সবাই দেখতে আসলে ও নির্ভীক দেখতে এলো না এতো টা হেলায় ও মেয়ে টা নির্ভীক কে খুঁজে চলেছে। কিন্তু কোথাও নির্ভীক কে দেখা গেল না। মাঝে একদিন ডাক্তার দেখানোর জন্য বের হচ্ছিলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চোখাচোখি হয়। তবে নির্ভীক তাঁর খোঁজ নেয় নি। শাহানার সাথে দু একটা কথা বলে চলে গেছে। প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে দশ দশ টা দিন কাটিয়ে দিলো অনিন্দিতা। এখন শরীর অনেক টাই সুস্থ। চারুলতার কথা অনুযায়ী আজ নির্ভীক পড়াতে আসবে। বেজায় খুশি মেয়েটা। কতো দিন পর আজ নির্ভীক কে দেখতে পাবে।
পরিপাটি হয়ে বসে আছে অনিন্দিতা। যদি ও নির্ভীক তাঁর দিকে ফিরে ও তাকায় না তবু ও নিজেকে পারফেক্ট দেখানো চাই ই চাই।
হঠাৎ করেই ফোন বেজে উঠলো। ইনতেহা কল করেছে। রিসিভ করেই বললো
_ হ্যাঁ ইনতেহা বল।
_ এখন কেমন আছিস তুই ?
_ ভালো ।
_ এখনো মন খারাপ ? নির্ভীক ভাইয়া তোকে দেখতে আসে নি না ?
_ আরে তা কেন হবে। এই তো সেদিন ওহ সিঁড়ি তে দেখা হলো। অতো ঘটা করে দেখা সাক্ষাৎ হয় নাকি ?
কথা গুলো বলার সময় অনিন্দিতার স্বর কেঁপে উঠলো। কতো কষ্টে নিজের আবেগ লুকিয়ে আছে তা নিজে ও জানে না। ইনতেহার দীর্ঘশ্বাস বুঝিয়ে দিলো সে ধরা পরা গেছে।
_ আমাকে বোঝাতে হবে না আর। আজ থেকে নির্ভীক ভাইয়ার তোকে পড়ানোর কথা তাই না?
_ হ্যাঁ। আন্টি তো বলেছে দেখি ওনি আসেন কি না।
_ আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো করে পড়িস কিন্তু এমনিতেই একটা বছর পিছিয়ে গেলি। এখন রাখছি কেমন ?
_ আচ্ছা।
অনিন্দিতা ফোন রেখে দিলো। চোখে পানি চিক চিক করছে। পেছন ঘুরতেই নির্ভীক কে দেখতে পেল। অবাক চোখে তাকালো। নির্ভীক তাঁর বুকসেলফ নাড়াচাড়া করছে। কখন এলেন ওনি ?
_ কিছু ম্যাথ লিখে দিয়েছি সলভ করুন।
অনিন্দিতা মাথা ঝাঁকালো ঠিক ই তবে চোখ সরালো না।ব্ল্যাক ট্রাউজার এর সাথে ছাই রঙা টি শার্ট টা এতো ভালো যায় জানা ছিলো না।
নির্ভীক পেছন ঘুরে তাকালো। অনিন্দিতা কে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ বিব্রত হলো। তবে তেমন কিছু না বলে বই দুটো টেবিলে রাখলো। অনিন্দিতার সে দিকে খেয়াল নেই।
_ দেখা শেষ হলে পড়তে বসুন।
অনিন্দিতা চমকে তাকালো। নির্ভীক এর কথায় খানিকটা লজ্জা পেল। নির্ভীকের ডান হাতের দিকে বার বার তাকানোর চেষ্টা চালালো। তবে ব্যর্থ হলো। ছেলেটার হাতে এখনো কি যন্ত্রনা হয় ?
স্কেল দিয়ে টেবিলে বারি দিতেই অনিন্দিতা চমকে উঠলো। নির্ভীক মুখে কাঠিন্য এনে বলল
_ আমি কি চলে যাবো ?
_ স্যরি।
নির্ভীক উত্তর দিলো না। অনিন্দিতা পড়তে বসলো। বার বার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটছে। হঠাৎ করে নির্ভীকের ফোন আসলো। ফোন রিসিভ করে ব্যলকনিতে চলে গেল।
*
লেকের ধারে বসে আছে রোজ। মেয়েটার সুশ্রী মুখে বিন্দু বিন্দু চিন্তার ছাপ। সূর্য তাঁর সারাদিনের কর্মব্যস্ততার জীবন পেরিয়ে আকাশের বুকে নিজে কে লুকিয়ে নিয়েছে। ভারী নিশ্বাসের শব্দ কেমন নিস্তব্ধতার সুর তুলেছে । বার বার ঘড়ি দেখছে সে। উপায় না পেয়ে ফোনে নাম্বার ডায়াল করে কল লাগালো।
_ আর কতোক্ষন লাগবে নির্ভীক ?
_ আসছি তো। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম ইয়ার।
_ জ্যামে বসে থাক তুই। এদিকে পুরো লেক ফাঁকা হয়ে গেছে। কেউ তুলে নিয়ে গেলে আমাকে আর পাবি বল ?
_ রাগ করিস না একটু ওয়েট কর। এসেই পরেছি ।
_ আচ্ছা আয়।
রোজ কল কেঁটে মৃদু হাসলো । ফোনের লক স্ক্রিনের তাঁর আর নির্ভীকের হাস্য উজ্জল ছবি।
কানাডা তে ভারসিটির শেষ দিনে ছবি টা তোলা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্ভীকের অপেক্ষা করতে লাগলো।
মিনিট দশেক পর নির্ভীক চলে আসলো। রোজ হালকা হেসে সে দিকে আসলো। নির্ভীককে এক হাতে জড়িয়ে বলল
_ অসভ্য প্রথম দিনেই এতো লেট ?
_স্যরি।
রোজ বিগলিত হাসলো। নির্ভীকের বা হাত টা গুটানো দেখে ভ্রু কুঁচকালো। খপ করে নির্ভীক এর হাত ধরতে যেতেই নির্ভীক সরে গেল
_ দেখা হাতে কি আছে !
_ দেখাবো না।
_ খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
_ তো ?
_ নির্ভীক আমি কিন্তু তোকে খুব মারবো।
নির্ভীক ভয় পাওয়ার ভান করে বলল
_ মাফ কর আমায়। দেখাচ্ছি তো একটু ওয়েট।
রোজ মাথা ঝাঁকালো। নির্ভীক পেছন থেকে এক গুচ্ছ অর্কিড বের করে দিতেই রোজ লাফিয়ে উঠল। নির্ভীক মৃদু হাসি ফুঁটিয়ে তাকালো । রোজের সামনে আসা চুল টেনে দিয়ে বলল
_ এটার জন্য ই এতো লেট হলো। কতো গুলো ফুলের দোকান ঘুরতে হয়েছে। সময় আর টাকা দুটোই গেছে।
_ খোটা দিচ্ছিস ?
_ একটু একটু।
রোজ খিল খিল করে হাসে। নির্ভীক ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল
_ কোন রেসট্রন ?
_ রেসট্রন নয় ক্যাফে তে যাবো।
*
রক্ত রাঙা কাগজ টা তে নাক ডুবিয়ে রেখেছে অনিন্দিতা। নির্ভীকের রক্তের ঘ্রান যেন তাঁকে পাগল করে দিচ্ছে। বার বার রক্ত রাঙা কাগজ টা তে ঠোঁট ছোয়াচ্ছে।
নির্ভীকের স্পর্শ করা বই গুলো বুকে চেপে ধরেছে। বিকেলে কারো সাথে কথা বলে বেরিয়ছিলো নির্ভীক। তাঁতে একটু মন খারাপ হয়েছিলো তবে ভীষন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে।
যাওয়ার আগে নির্ভীক তাঁকে এক বার ঘুরে দেখেছে । যদি ও চোখে মুখে ছিলো বিরক্তির নীল ছায়া।
_ অনি এই অনি ।
_ আসছি আম্মু ।
বই গুলো গুছিয়ে অনিন্দিতা চলে গেল। শাহানা ব্যথায় কুকরে গেছেন। হীর পা টিপে দিচ্ছে।
_ কি হয়েছে আম্মু ?
_ বাতের ব্যাথা টা বোধহয় বেরেছো। সাথে মাথা টা ঝিম মেরে আছে।
_ আচ্ছা আমি তেল মালিশ করে দিচ্ছি।
_ তাঁর আগে নাস্তা টা খেয়ে নে।
_ পরে খাবো।
খুব যত্নে মায়ের মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে অনিন্দিতা। হীর পা টিপে দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে।শাহানার চোখ ও প্রায় লেগে এসেছে।
_ আম্মু
_ হুমম
_ মনে আছে ছোট বেলায় একটা গল্প শুনিয়ে ঘুম পারাতে আমায় ?
_ হুমম। তাঁতে কি হয়েছে ?
_ গল্প টা শোনাও না প্লিজ।
_ এখন কি বাচ্চা আছিস তুই ? ঐ সব তো রূপকথার গল্প। বাস্তব হয় না কখনো।
_ আহা বলো ই না।
_ আচ্ছা বলছি।
গল্পের কথা শুনে জেগে বসেছে হীর। শাহানার পায়ের কাছে আরাম করে বসলো দুজনে। থুতনি তে হাত দিয়ে গল্পের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
“একি দেশে বাস করতো এক রাজ পুত্র আর এক রাজকন্যা। দুজনের মাঝে তেমন কিছুই মিল ছিলো না। তবে রাজকন্যা বেশ পছন্দ করতো রাজপুত্র কে। আর রাজপুত্র তাঁর উল্টো। রাজকন্যা কে একদম ই দেখতে পারতো না। এক টা সময় সে ও রাজকন্যা প্রেমে পরে যায়। তখন রাজকন্যা বেঁকে বসে। আর রাজপুত্র পাগলের মতো করতে থাকে। হাজারো কষ্টের মাঝে জর্জরিত রাজ পুত্র ভেঙে পরে। রাজকন্যা নিজের প্রিয়তমর কষ্টে কষ্টিত হয়। সমস্ত কিছু ছাপিয়ে রাজপুত্রর কাছে ফিরে আসে। আর তারপর রাজ পুত্র আর রাজকন্যা একটা লম্বা জীবন এক সাথে কাঁটায়। ”
হীর হাত তালি দিয়ে উঠলো। শাহানা হেসে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। অনিন্দিতার চোখ চকচক করছে। আচ্ছা তাঁর রাজপুত্র কি কখনো তাঁর হবে ? সে ও কি নির্ভীকের সাথে লম্বা একটা জীবন কাটাবে ?
নাকি রূপকথার গল্প রূপকথাই থেকে যাবে।
*
” আব্বু আমি আবার কানাডা ফিরে যেতে চাই। তিন মাস অন্তর অন্তর না হয় দেশে আসবো। তবু ও বারন করো না প্লিজ । ”
ছেলের কথা তে প্রচন্ড চমকালেন আজমল। সাত বছর বিদেশে পড়াশোনা করেছে । তাই বলে এখনো বিদেশে চলে যাবে?
আজমল একটু সময় নিয়ে ভাবলেন। মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন
_ তোমার এমন সিদ্ধান্তের কারন কি নির্ভীক ?
_ এমনি । তুমি জানো কানাডা তে আমার খুব ভালো জব হয়েছিলো। সেলারি ওহ ছিলো তিন গুন।
_ টাকার জন্য কানাডা ফিরতে চাচ্ছো ?
_ তেমন টা নয়। আসলে আমার ভালো লাগছে না বিডি তে।
_ যদি টাকা নিয়ে ভেবে থাকো তাহলে আমি বলবো তোমার বাবার যা টাকা আছে এতে তুমি বেশ ভালো জীবনযাপন করতে পারবে।
আর যদি অন্য কিছু হয়ে থাকে তাহলে বলবো ভুলে যাও সেই সব বিষয়। এইচ এস সি পরীক্ষার পর ই বিদেশে পারি জমিয়েছো । আমাদের বয়স হয়েছে তোমাদের প্রয়োজন।
_বিদেশে থাকলে ও তো আমি তোমাদের কাছে ফিরবো। তাহলে সমস্যা কোথায় আব্বু ?
_ ভুলে যেও না তিন বছরের চুক্তি করেছো এন এস ইউর সাথে।
_ সেটার জন্য ই তো তোমার সাহায্য প্রয়োজন।
বাবা ছেলের এক প্রকার কথা কাঁটা কাটি হয়ে গেল। নির্ভীক রেগে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আজমল কিছু একটা ভাবলেন। চারুলতা কে আশে পাশে খুঁজলেন ।
কিচেনে দেখতে পেয়ে সে দিকেই পা বাড়ালেন।
_ চারু ।
_ হুমম বলো।
_ তোমার ছেলে কি কাউকে পছন্দ করে ?
_ কার কথা বলছো ?
_ নির্ভীকের কথা বলছি। কানাডা ব্যাক করতে চাচ্ছে।
চারুলতা ভীষন অবাক হলেন। একটু ভেবে বললেন
_ ছাড়ো তো ওর কথা। ছেলে মানুষ , খাম খেয়ালি হলে যা হয় আর কি।
আজমল ওহ আর কথা বাড়ালেন না। চারুলতার থেকে চা নিয়ে লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ালেন। বহু দিন হলো বই পড়া হয় না। মন টা অশান্ত বইয়ের সাথে ডুবে যেতে হবে।
একের পর এক কলে বিরক্ত হলো নির্ভীক। চারুলতা ফোন করে যাচ্ছে। রাত প্রায় দেড়টার কাছা কাছি অথচ নির্ভীক বাসায় নেই। অনিন্দিতার পরিবার সহ আর ও কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। অনিন্দিতা ঘুমে ছিলো। নির্ভীক বাসায় নেই কথা টা শুনেই লাফিয়ে উঠে পরেছে।
বার বার বাইরের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে। নির্ভীক আসছে না। ছেলেটার কোনো বিপদ হলো না কি সেটা ভাবতেই হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। হৃদপিন্ড যেন বুক চিরে বের হতে চায়। দম বন্ধকর অবস্থা । কিন্তু কোনো এক শক্ত বলের কারনে ব্যাঘাত ঘটছে।
চারুলতা কান্না জুড়ে দিয়েছে। রাত দুটো বাজতে চলেছে। নিহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্ভীক কে খুঁজতে বের হবে তখনি গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো।
সবাই সে দিকে ছুটে গেলে ও অনিন্দিতা গেল না। ওর দৃঢ় বিশ্বাস ওকে দেখলে আবার রাগ করবে নির্ভীক।
তাই পিলারের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট পাঁচেক পর সবাই চলে আসলো। নির্ভীক কে দেখতে পেল না। মনের ভেতর যেন ঝড় তুলেছে।
সবাই ভেতরে চলে গেলে ও অনিন্দিতা গেল না। ছুটে গেল বাইরের দিকে। অসাবধানতার কারনে ধুম করে মাথায় বারি খেল। তখনি বাসার ভেতরে আসলো নির্ভীক।
অনিন্দিতা অশ্রু শিক্ত নয়নে তাকালো। প্রানে যেন পানি ফিরে পেয়েছে। নির্ভীকের মুখে চরম বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ। তাঁতে ও যেন মেয়েটার শান্তি।