একটি বৃষ্টির রাত – ৩ শেষাংশ!
____________________________
মিরপুর খুব চঞ্চল এড়িয়া। এখানে রাতের দুটো হোক বা ভোরের পাঁচটা মানুষ এক’দুজন ঠিক থাকে। কিন্তু এমন আকাশ ফাটা ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও যে রাস্তায় দু’একজন চুপিসারে ঘুরাফেরা করবে এটা খুশবু প্রত্যাশা করেনি। টেক্সি থেকেই দেখা যাচ্ছে , বৃষ্টির মধ্যে একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা হাতে হাত রেখে চা খাচ্ছে , আরেক জোড়া খুব দূরে বৃষ্টি থেকে আশ্রয় নিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভোর তাকে ডাকল খুব ধীর গলায়,
‘খুশবু?’
যেই পুরুষ তোমার মনের , যাকে তোমার পছন্দের তার পুরুষালী কন্ঠে উচ্চারিত নিজের নাম শুনতে কোনো নেশারঝোঁকে মাতোয়ারা থেকে কম হবেনা। খুশবুর ক্ষেত্রে বুঝি তাই ঘটছে? নেশা লেগেছে, না লেগে যাচ্ছে?
‘জি?’
‘আমার মানিব্যাগটা।’
‘ওহ, হ্যাঁ।’
বাহিরে বৃষ্টির তেজ তখনো প্রখর। খুশবু বেরোতে নিলে বিভোর না করে দেয়,
‘ বসেন।’
তারপর ড্রাইভার মামাকে ইশারা করল আরেকটু সামনে যেতে। যেখানটায় একটি চা’য়ের স্টল রয়েছে। সেখানে পৌঁছাতেই বিভোর নেমে যায়। মুহূর্তেই হালকাপাতলা শুঁকানো সে পুনরায় ভিজে যায়। পেছনে বসে থাকা খুশবু নিজের শরীরে থাকা বিভোরের কোর্টের দিক তাকাল। কোর্ট পরেও তার শরীর কাঁপছে ঠান্ডা আবহাওয়ায় । তাহলে বিভোরের কী অবস্থা হচ্ছে ? তার শরীরে তো শুধু মাত্র একটি পাতলা সাদা শার্ট। শাড়ী কিছুটা শুঁকিয়েছে ভেবে খুশবু কোর্টটা খুলে ফেললো। কোর্ট হাতে সে দ্রুত বেরিয়ে , দৌড়ে স্টলের সামনে চলে এলো। চুলগুলো ঝাড়তে নিয়ে ভাবল , বিভোর আসলে টেক্সি ভাড়া এবং কোর্ট দুটো একত্রে দিবে। কিন্তু টাকা কী নিবে ? ড্রাইভার মামাকে পাঠিয়ে বিভোর ঘুরতেই দেখতে পেলো খুশবুর কীর্তিকলাপ। শাড়ী মানেই সুন্দরী নারী ? তাইতো ? আর সাথে যদি হয়, ভেজা বড় চুল, দুহাত ভর্তি চুরি এবং বৃষ্টি। অতুলনীয় । বিভোর এগিয়ে বলল,
‘ খুশবু চা খাবেন? একদম খাটি দুধের চা। দুই নাম্বারের এই স্টলের চা খুব মজার এবং ফেমাস। খেয়ে দেখেন কেমন।’
বলতে বলতে বিভোর দুটো চা’য়ের অর্ডার দিলো। খুশবু তখন সবে চেয়ারে বসেছে,
‘ প্রায়শই আসেন বুঝি? ‘
‘ হ্যাঁ। কমবেশ সবখানে ঘুরা হয়েছে।’
‘ কোথায় কোথায় ?’
‘ সেন্টমার্টিন , সিলেট , রাজশাহী , ময়মনসিংহ আরো অনেক।’
‘ওয়াও। ভেরি এডভেঞ্চার্যাস। একা একা যান বুঝি ?’
‘ না। ফ্রেন্ডস সার্কেল আছে তারপর ওদের গার্লফ্রেন্ডস।’
খুশবুর ঠোঁট কাঁপছে অবশেষে প্রশ্ন করেই বসলো,
‘ আপনার ?’
বিভোর শব্দ করে হাসলো।
‘ গার্লফ্রেন্ড ? না নেই।’
খুশবু কী প্রশ্ন করবে কেনো নেই ?আপনার মতো এতো কন্সিডারেট মানুষের কেনো গার্লফ্রেন্ড নেই? এটা কী বিশ্বাস করার মতো ? বিভোর যেমন খুশবুর মনের কথা জেনে গিয়েছে , সে চা খেতে খেতে জবাব দিলো,
‘ গার্লফ্রেন্ড থাকতেই হবে এটা মাস্ট নাকি? আজকাল ট্রেন্ড চলছে ওর গার্লফ্রেন্ড আছে আমারো থাকতে হবে। আম নট লাইক দ্যাট। ‘
খুশবুর আরো কিছু প্রশ্ন ছিল। কিন্তু মেয়ে মানুষ হিসেবে সে বেশি ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছে। তাই নিজেকে সংযত করলো। চা শেষ হতেই দুজন পুনরায় হাঁটা ধরেছে। বাস নেই রাস্তায় কোনো। খুব জোড়াজুড়ি করে একটি সিএনজি পেয়েছে দুজন। ব্যস , চড়ে বসলো সেটায়। খুশবুর হাতে তখনো বিভোরের কোর্ট। বিভোর নেয়নি। অগ্যত সে আবারো পরে নিলো। সাহেবের শীত না করলেও তার করে। তাই সে পরবে। হঠাৎ, খুশবুর ব্যাগ ভাইব্রেট হতে শুরু করেছে। বিভোরের সেলফোন বাজছে। একবার নয় বরং অনেকবার বেজেছে। কিন্তু খুশবু বলেনি।এবার সে বলল,
‘আপনার ফোন বাজছে?’
‘ থাক, বাড়িতে পৌঁছে দেখে নিবো। ‘
সিএনজি এসে থেমেছে ধানমন্ডি তেত্রিশের লেকের সামনে। বৃষ্টি ও অনেকাংশে কমে এসেছে৷ আশ্চর্যজনক ভাবে খুশবু দেখল একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছাতা হাতে কিছুটা দূরে।ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই চিনে ফেললো তার বাবাকে।
‘ বাবা।’
আশরাফুল সাহেব দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসলেন। খুশবু বিভোরকে তার বাবার সাথে পরিচয় করাতে গিয়ে দেখল , বিভোরের চেহারার রঙ বদলাচ্ছে। আশরাফুল সাহেব ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
‘ বিভোর যে।’
‘আসসালামু আলাইকুম চাচা।’
আশরাফুল সাহেব পরক্ষণেই হাসতে শুরু করলেন ,
‘ অলাইকুমস সালাম বাবা, আলাইকুমস সালাম৷ নিশ্চিন্ত করলে অনেক। চিন্তায় ছিলাম কার না কার সাথে আছে মেয়েটা।’
খুশবু তখনো অন্ধকারে। মানে কী?
‘ বাবা ?’
আশরাফুল সাহেব ও অন্ধকারে। তিনি বুঝলেন খুশবু বিভোর দুজন দুজনকে জেনে নিয়েছে। তাই তিনি আর কিছু খোলাখুলি বললেন না। বরং নিজের মতো বিভোরের সাথে কথা বলতে বলতে বাড়ির দিক এগোচ্ছেন। বাড়ির সামনে পৌঁছাতেই আশরাফুল সাহেব দ্রুত মেয়েকে ভেতরে ঠেলে দিলেন,
‘ দ্রুত যাও কাপড়চোপড় পরিবর্তন করো। ঠান্ডা লেগে যাবে।’
খুশবু নিরাশ চোখে বিভোরের দিক তাকাল৷ পরিস্থিতি বেশ হতাশাজনক৷ সে কী মনমতো বিদায় জানাতে পারবে না ? একটু সংকেত তো দিতে হবে, নাহলে যদি বিভোর তাকে না খুঁজে? নাম্বার ও দেওয়া-নেওয়া হলো না৷ এদিকে আশরাফুল সাহেব তখনো কথা বলে চলেছেন বিভোরের সঙ্গে। আশরাফুল সাহেব ভেতরে যেতেই, বিভোর নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। যাবার পথে সে কপাল চাপড়াল। কী ঝামেলা হলো ? এটা তাহলে আশরাফুল চাচার মেয়ে? আয়হায়।
বিভোরের আম্মু সোহেলা বেগম ছেলের জন্য ডাইনিংয়ে বসে। ছেলে ফিরতেই তিনি দ্রুত তাকে ঠেলে ওয়াশরুম পাঠিয়ে ,খাবার সার্ভ করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। এদিকে বিভোর এখনো গভীর চিন্তায়। অবশেষে খেতে বসে সে মুখ খুলল,
‘ বাবা কী না করেছিলো আশরাফুল চাচাকে? ‘
‘ তোর বাবার কী সেই সাহস আছে? আমিই বলবো। ছেলের পছন্দ আগে। পরিবার মিলে বিয়ে দিয়ে দিলে তো আর হলোনা। বছরের পর বছর সংসার করবি। একটা আন্ডার্স্ট্যান্ডিং থাকতে হবেনা ? ‘
বিভোর মনেমনে ছোটখাটো নিশ্বাস ছাড়লো। হুট করে বলে দিলো,
‘ মা আমি এই বিয়েতে রাজি।’
তরকারি বাড়তে গিয়ে থমকে রইলেন সোহেলা বেগম।
‘ কী ?’
‘ আমি খুশবুকে বিয়ে করতে রাজি মা।’
এই সম্পূর্ণ বিষয়ে অজানা খুশবু। গতরাত সে উথালপাতাল ভাবনায় রাত কাটিয়েছে। সকাল সকাল উঠে খুঁজতে বেরিয়েছে বিভোরদের বাড়ি। বাড়ি পেয়েছে কিন্তু ভেতরে ঢুকবার সাহস পায়নি৷ লুকিয়ে বেশ কয়েকবার ঘুরে এসেছে যদি বিভোর বেরোয়? কিন্তু না৷ বাড়ি ফিরে কল দেবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ফোন সুইচডওফ বলছে। মনের আনচান নিয়ে খুশবু একপ্রকার পাগল প্রায়।
শুক্রবার চোদ্দগুষ্টি দিয়ে বাড়িঘর ভরপুর। রান্নাবান্না চলছে জমিয়ে। খুশবু সন্দেহ দৃষ্টিতে সকলকে একবার দেখে নিল৷ কিছু একটা তো পাকাচ্ছে৷ কী পাকাচ্ছে তা ধরতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হলো না৷ কারণ কাজিনরা এসেছে তাকে সাজাতে৷ আর সাজানোর মানে কী দাঁড়ায় তা তাকে আর বলতে হবেনা৷ পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে৷ মুহুর্তেই হাঙ্গামা শুরু করেছে বাড়িতে। বিয়ে করবেনা, পাত্রপক্ষের সামনে যাবেনা। কেউ খুশবুকে বুঝিয়ে পারছেনা। পরপর আশরাফুল সাহেব ধমকাতেই কান্না শুরু করেছে সে। দরজা আটকে রেখেছে , কাউকে প্রবেশ করতে দিবেনা আর বেরোবেও না।
বিভোরের পরিবার যখন এসেছে খুশবু তখনো নিজের রুমে বন্দী৷ তার হুটহাট চেঁচামেচি বসার ঘর থেকে সকলেই শুনতে পারছে৷ বিভোর সবে বসেছিল সোফায়। পরক্ষণেই হাসতে শুরু করলো। তার ঠোঁট জুড়ে অমায়িক হাসি ফুটে৷ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, আশরাফুল সাহেবকে বলল,
‘ চাচা আমি কথা বলি খুশবুর সঙ্গে ?’
‘ বাবা মেয়েটা প্রচন্ড জেদি। যদি..’
‘ কিচ্ছু হবেনা। ভরসা করতে পারেন৷ ‘
আশরাফুল সাহেবের শায় পেতেই বিভোর খুশবুর রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে খুশবুর চাচাতো-মামাতো ভাইবোন৷ তারা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে সুদর্শন বিভোরের দিক৷ ভেতর থেকে রাগী গলার হুশহুশ শোনা যাচ্ছে৷ বিভোর স্বাভাবিক কন্ঠে ডাকল,
‘ খুশবু ?’
খুশবু ডাস্টবিনে টিস্যু ফেলাতে নিয়ে থেমে গেলো৷ চেনাপরিচিত সেই কন্ঠের স্বর শুনে নিজের কানকে যেমন বিশ্বাস করতে পারছেনা৷ বিদায় ছোট আওয়াজ দিলো,
‘ কে ?’
‘ আমি বিভোর। ‘
মুহূর্তেই দরজা শব্দ করে খুলে গেলো। বিভোর নেভিব্লু ওয়েস্টার্ন শার্ট পরে আছে। তাকে লাগছে নিট, ক্লিন অ্যান্ড ফ্রেস। অপরদিকে খুশবু পাগলের ন্যায়ে আছে। চুলগুলো কোনো নিয়মে নেই৷ হাতে তখনো ভেজা টিস্যু৷ বিভোর মুচকি হাসলো,
‘ হেই৷ ‘
‘ হু? ‘
‘ কী মিস ? ‘
কিংকর্তব্যবিমূঢ় খুশবুর জবাব,
‘ জি ?’
‘ পাত্রপক্ষের সামনে আসবেন না ?’
‘ হাহ? ‘
‘ আমাকে বিয়ে করবেন না ?’
‘ হাহ? ‘
খুশবুর চোখজোড়া টনটন হয়ে আছে। পাশে দাঁড়ানো কাজিন রুবাইয়া খুশবুর মাথায় টোকা মারল৷
‘ বোকা৷ দেখতে আসছে তোকে৷ তৈরি হবি নাকি ফেরত পাঠাব? ‘
কাহিনি বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো খুশবুর৷ মুহুর্তেই সব অভিমান যেমন ধুয়েমুছে চলে গেলো৷ দিয়ে গেল এক অদ্ভুত অনুভূতি৷ খুশবু লাজুক চোখে আশেপাশে তাকিয়ে শেষমেশ জবাব দিয়ে ফেললো৷
‘ হ্যাঁ। ‘
সমাপ্ত।
নাবিলা ইষ্ক৷