সঞ্চারিণী
আফনান লারা
৩.
শাওন হেঁটে উপরের তলায় যেতে যেতে হোয়াটস্এ্যাপে আসা একটা ছবি চেক করলো তার ফোন হাতে নিয়ে।মিসেস রেদোয়ানের মৃতদেহের ছবি।ল্যাব থেকে পাঠানো হয়েছে।
-‘এরকম ভারী একটা টব পড়লে তার মাথা থেতলে যাওয়ার কথা আর এখানে দেখি মাথা ফেটে কিঞ্চিত রক্ত বেরিয়ে এসেছে মাত্র।মনে হচ্ছে কেউ সামনে একবার এক রঙের পর্দা টাঙাচ্ছে।
আমি বুঝতেছি না খুনি আমাদের গোল গোল ঘুরাচ্ছে কেন?
যাই হোক।ফুলদানির পেছনে হয়ত অন্য কারণ আছে।ওয়েট আ মিনিট!!!’
শাওন ফোন পকেট ঢুকিয়ে ফুলদানির কাছে ব্যাক আসলো এক ছুটে।
একটা ফুলদানির সব ফুল উঠিয়ে নিচে ফেললো সে।ভেতরে মাটি দেখা যাচ্ছে।
-‘মাটির ওজন এত??আই কান্ট বিলিভ।’
জোর গলায় নুহাশকে ডাকলো শাওন।নুহাশ একটা আপেল খেতে খেতে এসে বললো,’কি ভাই?’
-‘ টবের মাটি সরাতে হবে।আমি এই টবের মাটি সরাচ্ছি তুমি ঐ টবের মাটি সরাও।’
নুহাশ আপেল ফেলে শুরু করে দিয়েছে কাজ।দুজন মিলে মাটি ফেলতে ফেলতে মিনিট পাঁচেক পর খেয়াল করলো আর কোনো মাটি নেই।মানে টবটার অর্ধেক জায়গা অবধি মাটি ভর্তি ছিল।তাহলে বাকি অর্ধেক কই গেলো?সিমেন্ট দিয়ে লেপ লাগানো।অথচ ফুলদানির এখনও অনেক জায়গা বাকি নিচে।
শাওন নুহাশের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলো।
দুজন মিলে টবটাকে নাড়িয়ে দেখলো এবারও সেই একই ওজন।অথচ তারা মাটি ফেলে দিয়েছে অনেকগুলো।তাহলে এত ভার কিসের হতে পারে।
রায়হান ওজন মাপার মেশি নিয়ে হাজির।পাঁচজন ধরাধরি করে একটা মাটি সমেত টব মেশিনে ওঠালো।মাটি সহ ফুলদানির ওজন আর মাটি ছাড়া ফুলদানির ওজনের পার্থক্য এক কেজির।তার মানে টবে অন্য কিছু আছে।নাহলে এত ভার হবার কথানা। নুহাশের বুদ্ধিতে ফুলদানিটা নিয়ে সবাই বাড়ির মেইন ফটকে এসে হাজির।এক দুই তিন বলে পাঁচজন মিলে ফুলদানিটা হাত থেকে ছেড়ে দিলো।সেটা গড়িয়ে গড়িয়ে সিঁড়ি টপকে বাগানে গিয়ে পড়েছে।তিন টুকরো হয়ে গেছে ফুলদানিটা।সবাই দম ফেলে কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো।ফুলদানি ভর্তি টাকা।আশ্চর্য ব্যাপার স্যাপার।ব্যাংক থাকতে মানুষ ফুলদানিতে টাকা রাখে?তাও এই লেভেলের মাস্টারমাইন্ড?বাপরে বাপ!চোরই তো সন্ধান পাবেনা।আমরা ক্রাইম ব্রাঞ্চের লোক হয়ে এত কাঠ খড় পুড়িয়ে তবে জানলাম এর ভেতর আসলে কি আছে।
শাওন গালে হাত দিয়ে বললো,’এই টাকার ট্যাক্স দিতে চান না তিনি তাই এখানে লুকালেন।বাট আমার কথা হলো সবগুলো ফুলদানিতে টাকা ভর্তি থাকলে ৬ষ্ঠ ফুলদানি কোথায় গেলো?একজনের পক্ষে একটা ফুলদানি লুকিয়ে ফেলা একেবারে অসম্ভব ব্যাপার।শুধু একজন না।পাঁচজন ছাড়া এই কাজ কিছুতেই করতে পারবেনা তার প্রমাণ আমরা পাঁচজন।’
নুহাশ টাকার বান্ডিল নিয়ে উল্টো পাল্টে বললো,’হয়ত পাঁচজন এসেছিল ডাকাতি করতে।’
শাওন মাথা ঘুরিয়ে বললো,’একেকটা ফুলদানিতে পঞ্চাশ লাখ টাকা করে ৬টাতে মোট ৩০০লাখ টাকা লুকানো।মানে তিন কোটি টাকা।ডাকাত এটা জেনেও শুধু মাত্র একটা ফুলদানি কেন নিলো?পাঁচজনে আরেকটু কষ্ট করলেই তো অন্য একটা ফুলদানি নিতে পারতো’
রায়হান ফুলের টবের টুকরো হাতে নিয়ে বললো,’আই থিংক ফুলদানি যেটা মিসিং ওটা খুনি নেয়নি।ওটা এখানেই কোথাও আছে।বাট কেস অন্যদিকে যাবে।এবারের খুনি তার নিজের পরিচয় লুকাতে একের পর এক ধামাকা দিয়ে আমাদের ঘুরিয়ে যাচ্ছে।সে ইচ্ছে করে একটা ফুলদানি সরিয়েছে আবার জায়গা মতন বাকি পাঁচটা রেখেছে আমাদের সময় নষ্ট করতে। তার যত পেঁচানো কারসাজি’
শাওন টবটাতে একটা লাথি মেরে বললো,’খুনি নিজেও জানেনা এর ভেতর টাকা আছে তাহলে সে খুন টাকার জন্য করেনি।আমাদের সে কতদিন ঘুরাবে?একদিন না একদিন তাকে ধরা পড়তেই হবে’
নিতু টাকা গুলো হাতে নিয়ে বললো,’এত টাকা কি হবে স্যার?’
নুহাশ ওর হাত থেকে টাকা কেড়ে নিয়ে রেখে দিয়ে বললো,’গিয়াস স্যার জানেন।ধরবা না একদম’
-‘হ্যালো গাইজ!’
শাওন পাশে তাকিয়ে দেখলো মেধা এসে হাজির।পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুখে এক রাশ হাসি নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আছে সে।শাওন ওকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সে বললো,’আসলে হলো কি!আমি নিউমার্কেটের জ্যামে পড়ে বসে বসে ভাবলাম বাসায় গিয়ে কি হবে।লাঞ্চ করবো তার পর টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়বো লাভ তো হবেনা।তার চেয়ে বড় এখানে এসে আপনাদের কিছু হেল্প করি।আপনাদেরই উপকার হবে। আফটার অল আমিও তো আপনাদের টিমের অন্তর্ভুক্ত’
শাওন এক ধমক দিয়ে বললো,’আমি তাদের পছন্দ করিনা যারা আমার কথা শোনেনা।এত অফিসার অফিসার কি লাগাই রাখছো?পদে তুমি আমার চেয়েও এক অংশ নিচে।সুতরাং আমার কথা শুনতে তুমি বাধ্য’
-‘একদিনে আপনি থেকে তুমিতে চলে এলেন?’
শাওন না শোনার ভান করে চলে গেলো বাড়ির ভেতর।মেধা বাড়িটা একবার দেখে নিয়ে ওর পিছু পিছু চললো।
শাওন এবার দোতলায় এসেছে।সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একবারও মনে হয়নি যে এই সিঁড়ি পিচ্ছিল।খসখসে ডিজাইনের টাইলস লাগানো।হোচট খেলেও পড়ে যাবার সম্ভাবনা ২%।এত বড় বাড়ি অথচ কোনো সিসি ক্যামেরা নেই।দারোয়ান যারা ছিল তারা হসপিটালে ভর্তি।তাদের হুস আসা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছেনা।
নুহাশ নিচে থেকে শাওনকে ডাক দিলো।শাওন ওর আওয়াজ শুনতে পেয়ে রেলিংয়ে হাত রেখে তাকালো ওর দিকে।
-‘শাওন! আমার মনে হয় মিসেস রেদোয়ানের বোন খুন করেছে মিঃরেদোয়ানকে।সিনেমাতে দেখায় না?? নায়িকা তার বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে ভালোবাসার একটিং করে ভিলেনকে ফাঁদে ফেলে খুন করে???’
-‘শোনো!!মিসেস রেদোয়ানের বাবা ছাড়া আর কেউ ছিলনা।বার্ধক্যের শেষ সিঁড়িতে পা রেখেছেন তিনি।তাকে আনতে গেছে রেদোয়ানের অফিসের লোক।আর রেদোয়ানের বাবা মা আমেরিকাতে থাকেন
তার ভাই বোন যারা আছে তারা একেক জনে একেক দেশে থাকে।ঢাকায় তার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই একটা থাকে।ব্যাচলর।বাসা সাভারে।
সেই ছাগলের নাকি মোক্ষম সময়ে ডায়রিয়া হয়েছে।তোমাকে পাঠাতে হবে।সন্দেহ হচ্ছে ওরে’
মেধা শাওনের কাছে এসে বললো,’আমি তো বললামই রেদোয়ান আত্নহত্যা করেছে’
মেধার কথা শুনে শাওন অগ্নি দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,’নুহাশ,নিতুর কাছে গিয়ে এসব ভুলভাল ইনফরমেশন দাও।আমাকে দিতে আসবা না।আমাকে আমার কাজ করতে দাও’
শাওনের ধমকে মেধা মুখ বাঁকিয়ে চলে যাচ্ছে এখন।
হঠাৎ ওর হাতে থাকা ফুল দেখে শাওন হাত ধরে আটকে ফেললো ওকে।
-‘কি?’
-‘তোমার হাতের এই ফুলটা কোথায় পেয়েছো?’
-‘কেন বলবো আপনাকে?’
শাওন মেধার হাত থেকে ফুলটা কেড়ে নিয়ে বললো,’এটা তো হোয়াট এগরেট ফ্লাওয়ার।জাপানের বিখ্যাত ফুল এটা’
মেধা শাওনের হাত থেকে পুনরায় কেড়ে নিয়ে বললো,’তো?’
-‘তো এটা তুমি পেলে কই?আমাকে দাও’
-‘দিব না’
মেধা ছুটলো।একবার তাকিয়ে শাওনকে ভেংচি কেটে সিঁড়িতে পা রাখতেই বেসামাল হয়ে পড়ে গেলো নিচে।
চার সিঁড়ি অতিক্রম করার পর পরই শাওন ওকে ধরে ফেললো।মেধা এবার মাথায় চোট পেয়েছে।শাওন ওকে ঠিক করে সিঁড়িতে বসিয়ে বললো,’আমার সাথে প্রতিযোগিতা চলছে তোমার?মেজাজ গরম করো কেন?ফুলটা আমায় দিলে তোমার কি ক্ষতি হবে?আর এটা পেলে কই তুমি?’
-‘কোথায় পাবো আর।রেদোয়ানের বাগানে পেয়েছি।হাজার হাজার বিদেশী ফুল পড়ে আছে ওখানে’
হঠাৎ করে মেধার পেছনে কাউকে দেখতে পেয়ে শাওন ওর হাত ছেড়ে দিলো।একটু পিছিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নুহাশকে ডাক দিলো সে।
-“নুহাশ!মিস অতিরিক্তর মাথায় মলম পট্টি করো।আমি বাগান বিলাস করে আসছি’
শাওন যাওয়ার সময় মেধার হাত থেকে ছোঁ মেরে ফুলগুলো নিয়ে গেলো।
মেধা কপালে হাত দিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছে।নুহাশ ভ্রু কুঁচকে বললো,’এসেছো খুনি খুঁজতে আর বেসামাল হয়ে নিজেই খুন হয়ে যাচ্ছিলে’
-‘সব উনার দোষ।আমাকে দৌড়ানি দিয়েছিল এই সামান্য ফুলের জন্য’
——
চলবে
Afnan Lara