সঞ্চারিণী
আফনান লারা
৩৩.
-‘আপনি ঘুমান।আমিও দেখি ঘুম আসে কিনা।নাকি রশ্নি আপু চলে আসে আবার।আপনার পাশে দাঁড়াতেও মাঝে মাঝে ভয় হয়।কে জানে আপনার ঘাঁড়ের ভূত এসে আমার ঘাঁড়ে না চেপে বসে।’
শাওন শুয়ে পড়েছে।তার মাথায় ঘুরছে অন্য কথা।রশ্নির হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে যাওয়া মানে কি দাঁড়ায়??সে কি জেলাস?কিন্তু মেধা আর তার মধ্যে তো এমন কিছুই নেই
যাই হোক।হয়ত সে উল্টো ভাবছে।এসব পরে দেখা যাবে।তাকে পরে সব কিছু বুঝিয়ে দেওয়া যাবে।রশ্নি সহজে সব বুঝে যাওয়ার মতন একটা মেয়ে’
—-
-‘বুঝলে ফেরদৌস!শাওনকে নিয়ে চিন্তায় আছি।কয়েকবছর আগের একটা দূর্ঘটনা তার জীবনে এমন আঘাত হেনেছে সে আর কোনো নারীতে আশক্ত হতে পারেনা।’
-“আসক্ত হতে পারেনা নাকি চায়না??পুরুষ যদি চায় সে আশক্ত হবে।আর যদি না চায় তাহলে জীবনেও তার মন গলানো সহজ না।এখন তোমার ছেলের কি সমস্যা সেটা ঠিক করে বলো।আমি তো দেখি বেশ ভালোই চলাফেরা করে।তার সমস্যা আছে বোঝাই গেলোনা।যদি তুমি না বলতে আমি এখন পর্যন্ত তাকে স্বাভাবিক মনে করে এসেছি’
-‘নাহ।সমস্যা আছে।তবে সে বিয়ে করতে নারাজ।যদি জোর করে বিয়ে করিয়ে দিতে পারতাম তাহলে ল্যাটা চুকে যেতো।একটা মেয়ে তার জীবনে বৈধ ভাবে আসলে তার জীবন আরও সুন্দর হবে।সে তার মনের যে নারী আছে তাকে একটু হলেও ভোলার সাহস পাবে,শক্তি পাবে।এখন আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না তাকে জোর করার।আমি পছন্দ করে দিলে সে কড়া কথা বলে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়।বোকাসোকা মেয়ে পেয়ে ভয় দেখায়।আমার মনে হচ্ছে, শাওনের জন্য ওর মতনই একজন দরকার।যে ইটের উত্তর পাটকেল দিয়ে দেবে’
.
-‘তুমি কি আমার মেয়ে মেধাকে ইশারা করছো?তাহলে ভুল করছো।
আমি যদি রাজি হয়েও যাই,সবাই যদি রাজি হয়েও যায় মেধা তোমার ছেলের মাথা চুরমার করে ওর জীবন সুন্দরের বদলে ওলটপালট করে দেবে।মেধা জেদি মেয়ে।আর ওর মাথায় সারাদিন ঘুরে কোথায় খারাপ কি ঘটলো,গিয়ে সেটা সলভ্ করতে বসবে।সে এসব বাদ দিয়ে শাওনের মাথা ঠিক করার দায়িত্ব জীবনেও নেবে না।আমি মত দিয়ে দিলাম, এবার তুমি ভাবো।’
সেই মূহুর্তে গিয়াস স্যার তার ওয়াইফকে নিয়ে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আসলেন।দাওয়াতটা শাওন দিয়েছিল।এসে বসলেন শাওনের বাবার সঙ্গে।এরপর মনটা খারাপ করে বললেন,”ভাল করেছেন অনুষ্ঠান বন্ধ করেননি।শাওন কালকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।ও অনেক স্ট্রং ছেলে।’
গিয়াস স্যারের কথা শুনে সবাই হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।এই খবর তারা মাত্র শুনলো।শাওনের বাবা বসা থেকে উঠে বললেন,’কি হয়েছে ওর?’
-‘গুলি লেগেছে ওর।কেন জানেন না?’
শাওনের বাবা চমকে গেলেন।শুধু প্রশ্ন করলেন কোন হসপিটালে আছে এখন।
—–
মেধার ফোনে আননউন নাম্বার থেকে কল এসেছিল।কানে ধরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনতে পেলো রকির কণ্ঠ।
সে হাসছে।ক্লিপটা নাকি সে পেয়ে গেছে।এটা শুনে মেধার হাত থেকে ফোন গেলো নিচে পড়ে। আওয়াজ পেয়ে শাওন উঠে পড়ে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে।মেধা ভীতি স্বরে জবাব দিলো ক্লিপটা রকি পেয়ে গেছে।
রকির উপর প্রচণ্ড রাগ নিয়ে ছুটতে যেতেই শাওন ওকে আটকালো।শান্ত করতে সোফায় বসিয়ে বললো,’ক্লিপ কোথায় রেখেছিলে?’
-‘আমার গলার একটা চেইনের সঙ্গে রেখেছিলাম ব্যাংকে।একাউন্টটা সম্পর্কে আমি ছাড়া আর কেউ জানেনা,জানতোনা ‘
-‘তাহলে পেলো কি করে?তোমার চোখ এমন পানিতে ভরে এসেছে কেন?চোখ মুছো।’
শাওন হাত দিয়ে মেধার চোখ মুছতে গিয়ে টের পেলো রুমে অন্য কারোর উপস্থিতি।বাবা মা,তৃনা সবাই এসেছে এখানে।শাওন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইলো।খবরটা লিক হলো কি করে তাই ভাবছে সে।এদিকে মেধার বাবা হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে বললেন,’মেধা তুমি এত রাতে এখানে কি করছো?তোমার না অফিসে কাজ?’
-‘না আসলে..’
-‘চলো আমার সাথে’
জনাব ফেরদৌস মেধার হাত ধরে নিয়ে গেলেন।শাওন মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে আছে।শাওনের বাবা, মা সোফায় এসে বসে ওকে রাগান্বিত চোখে দেখছেন আপাতত।কোনোমতে কেঁপে কেঁপে বিছানার কিণারায় এসে বসলো সে।বাবা হাত কপাল থেকে সরিয়ে বললেন,’তোমার গায়ে গুলি লেগেছে তা আমাদের জানালে না।জানালে কলিগকে।তাকে সঙ্গ দিতেও রেখে দিলে।আমি জানতে চাই সে কি আদৌ তোমার কলিগ নাকি আরও কিছু আছে?’
শাওন চোখ বড় করে বললো,’আরও কি থাকবে?এসব কেমন কথা।আমি তোমাদের চিন্তায় ফেলতে চাইনি।তৃনা আপুর বিয়েতে কোনো সমস্যা হোক আমি সেটা চাইনা।আর মেধাকে যেতে বলেছিলাম তাও সে থাকতে চাইলো জোর করে’
-‘কেন জোর করেছে?সে কি তোমায় পছন্দ করে?নাকি তোমরা দুজনই দুজনকে পছন্দ করো।আজকের ইন্সিডেন্টটার মতন এই বিষয়টাও কি আমাদের অজানা?’
-‘বাবা এসব কি শুরু করছো??আমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করি মানে?এই টপিক কেন আসছে?’
-‘তাহলে বলো কাকে পছন্দ করো।তোমার ঐ মনের ভূতটার নাম বলোনা প্লিজ’
শাওন কাত হয়ো শুয়ে চুপ করে থাকলো।এত প্যাঁচ ভালো লাগেনা তার।বাবা চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন,’যদি তুমি তোমার মত না দাও তো আমি আমার মন মত মেয়ে ঠিক করে তোমার পাশে বসিয়ে দিতে সময় নেবোনা’
শাওন তাও চুপ করে আছে, বাবা চলে গেছেন বাহিরে করিডোরের দিকে।মা এসে শাওনের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ওর শরীর কেমন আছে। পায়ে বেশি ব্যাথা করছে কিনা।দূরে এক কোণায় তৃনা নিরবে কেঁদে চলেছে।তার বিয়েতে যাতে কোনো সমস্যা না হয় তার জন্য তার ভাই এতবড় ইন্সিডেন্সের কথা চেপে গেলো।কতটা ভালোবাসে সে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ছুটে এসে শাওনের বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেললো সে।শাওন বোনের মাথায় হাত রেখে হেসে বললো,’এখন কাঁদলে মেক আপ নষ্ট হয়ে যাবে কন্যা।পরে ঐ মেক আপ দিয়ে বিয়েতে যাবেন কি করে?বিয়ে পর্যন্ত চালাতে হবে না?’
তৃনা শাওনের গায়ে কিল বসিয়ে হেসে ফেললো।
শাওনের বাবা আর মেধার বাবার মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে।তারা ওদের দুজনকে রাগিয়ে তুলে এক প্রকার জোর করে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করতে চান।
মেধাকে বাসায় আনার পর তার বাবা আহামরি কিছুই বলেননি।মেধা ভেবেছিল রাগটা বাকি সবার সামনে অবধি প্রচলিত হয়ত।
কিন্তু নাহ!
মেধা একটু ফ্রেশ হয়ে বসতেই বাবা ওর সামনে এসে হাজির।সে জানেও না বাবা কি বলে বসবে।বাবা ওর সামনে বসে স্বাভাবিক ভাবেই কথা শুরু করেছেন কিছু অতি জরুরি কথা।
তার কথার মেইন টপিক ছিলো “বিয়ে”
মেধার আর শাওনের বিয়ে।এটা শুনে মেধা দাঁড়িয়ে পড়েছে।একই হাল হয়েছে শাওনেরও।চোট পাওয়া পা নিয়েও সে দাঁড়িয়ে পড়েছে।দুজনের বাবাই শক্ত হয়ে বসে আছেন ওদের দুজনের দিকে চেয়ে।মেধা পুনরায় বিছানায় বসে বললো,’এটা অসম্ভব।কি বলছো বাবা??’
শাওন বললো,’রশ্নিকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করে শুধু শুধু কষ্টে ফেলতে চাইনা আমি’
তাদের দুজনের দুরকম মত দেখে তাদের বাবারা কোনো রিয়েকশানই দেখালেন না।চুপচাপ রুম থেকে গেলেন।আপাতত তাদের সময় দিতে চান বলেই এমনটা করার।তারা একসাথে ফোন নিলো বিষয়টা নিয়ে আলাপ করবে বলে।একসাথে কল করায় কেউ কারোর সাথে ১০মিনিট ধরে কথা বলতে পারলোনা।শেষে মেধা দম ফেলার সময় নিলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য।তখনই শাওনের কলটা ওর ফোনে ঢুকেছে।রিসিভ করে দুজনে হ্যালো বলে ফেললো।এরপর আবার দুজনে চুপ।
শেষে শাওন বললো,’ জানি না তোমার বাবা তোমায় কি বলেছে।আই গেস তোমার সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছে এতক্ষণে।বলতে চাই আমাকেও একই কথা আমার পরিবার বলেছে।তুমি কি করে মানা করেছো বলে দাও।আমিও সেই ট্রিক ফলো করবো।’
মেধা দরজা লক করে বিছানায় এসে বললো,’আমি কিছু বলার আগেই বাবা চলে গেছেন।আমার হাতে সময় দিয়েছেন হয়ত।’
-‘তাহলে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলো যে তারা দুজনে সব ঠিক করেছে।নাহলে একসাথে দুজনের একই ভাব প্রকাশ হতোনা।’
কি করা যায় তা নিয়ে কাল আলাপ হবে বলে শাওন কল কেটেছে।
রাত যত গভীর হচ্ছে দুজনের মনে মনে ভয় জাগছিল তাদের বাবার মেজাজ নিয়ে।দুজনেই তাদের বাবাকে ভয় পায়।মানা করলে না জানি সত্যি সত্যি জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় তা নিয়ে মনে সংশয় জাগছে।এই সংশয় মেটাতে হবে নিরুদ্দেশ হয়ে। সঞ্চারিণী
আফনান লারা
৩৪.
যেমন কথা ছিল ঠিক তেমনটাই কাজে পরিণত হয়েছে।তারা দুজনে খুব ভোরে যখন পাখি সবেমাত্র উঠেছে ঘুম থেকে ঠিক তখন বাসা থেকে উধাও হয়ে গেলো।তবে তারা ঢাকাতেই আছে এখনও।
তৃনা আপুর বিয়েতে ভাইকে না দেখলে তিনি মন খারাপ যেন করতে না পারেন তাই শাওন ছদ্দবেশে নিজের বোনের বিয়েতে গিয়ে তাকে সময় দিয়ে আবার পালাবে ভেবে রেখেছে।
শাওন আর মেধা আপাতত ঢাকার এমন জায়গায় আছে যেখানে তাদের দুজনের পরিবার আসার কথা কল্পনাও করবেনা।
একটা কফি শপে কফি খেতে খেতে চোখের মোটা ফ্রেমের চশমা হটিয়ে মেধা বললো,’আজকে কি এমন জোকার সেজে আপনার বোনের বিয়েতে যেতে হবে আমায়??
একটা সময়ে সবাই চিনে ফেলবে আমায়।আমি না গেলে হয় না?’
শাওন তার ঠোঁটের উপর ইয়া বড় গোঁফ টেনে বললো,’না হয়না।আমি আর তুমি হাসবেন্ড ওয়াইফ সেজে যাব।আমি একা গেলে সবাই প্রশ্ন করবে।কই থাকি,কার ছেলে ইত্যাদি ইত্যাদি।’
মেধা কফিতে চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে শাওনের দিকে তাকালো হঠাৎ।
শাওন ও হাসছে।হাসি থামিয়ে বললো,’আমার এখনও বিশ্বাস হয় না তোমার ঐদিনের কথাটা।’
-‘কেন?আপনার কি মনে হয় আমার সাহস নেই?’
-‘প্রচুর সাহস আপনার।আর সাহস দেখতে চাইনা।আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
-‘কি?’
——
[মালদ্বীপের সেই দুইদিন]
-‘আমি রেদোয়ান আর আশার পরিবারকে এই কেসটা দ্বারা চিনি না।
আমি তাদের চিনি গত এক বছর ধরে।আমার ট্রেনিং শেষ হবার পর গিয়াস স্যার আমাকে অফিসের কাজ অফিসে বসে প্রেক্টিস করতে ময়মনসিংহ যেতে বলেছিলেন আমাদের অন্য একটা শাখাতে।আমি তৈরি হচ্ছিলাম।সব ঠিকঠাক ছিল।দুপুরবেলা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম বাস স্টেশনে।
বাস আসার কয়েক মিনিট আগে আমার সামনে একটা বিরাট কার এসে থামলো।যেহেতু দেখতে অনেক সুন্দর ছিল,আমার চোখ গেলো বরাবর কারটার দিকে।নীল রঙের ছিল।এত সুন্দর!!
দেখলাম তার থেকে জ্যাকেট পরা একজন লোক বের হলেন।ওপাশে কারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে লাগলেন তিনি।তার দু মিনিট পরেই কার থেকে একটা মেয়ে বের হলো।গায়ে বেগুনী রঙের শাড়ী।হাতে পায়ে হাজারটা চোটের নিশান।সে কেঁপে কেঁপে বের হয়ে ঐ লোকটার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে কিসব বলছিল।লোকটা সেদিকে তোয়াক্কা না করে ফোনে কথা বলছে।যেন কোনো ভিখারী ভিক্ষা চাচ্ছে আর সে ভিক্ষা দেবেনা বলে ঠিক করে রেখেছে।মেয়েটা অনেকক্ষণ আকুতি মিনতি করে পেছনে তাকাতেই আমাকে দেখলো।আমি চোখ নামিয়ে বাসের অপেক্ষায় অন্যদিকে মুখ করে থাকলাম।ভেবেছিলাম বিষয়টা এখানেই শেষ।কিন্তু নাহ।
মেয়েটা আমার কাছে এসে দাঁড়ালো হঠাৎ।এসেই বললো,’আপনার ফোন নাম্বার দিবেন??’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’আপনার কি কোনো সমস্যা হয়েছে??
আমি সাহায্য করবো?আমি একজন ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিসার’
মেয়েটা আমার কোটে লেগে থাকা কলমটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে বললো,’আমার হাতে আপনার নাম্বারটা লিখে দিবেন?’
আমি বুঝলাম সে আসলেই বিপদে আছে।এখন বলতে পারছেনা।
যদি তার কোনো সাহায্য করতে পারি।তাই নাম্বারটা লিখে দিলাম।মেয়েটা ছুটে আবারও কারের কাছাকাছি চলে আসলো
লোকটা পেছনে তাকিয়ে মেয়েটার দিকে ইশারা করে কিসব বলতেই সে দেরি না করে কারে ঢুকে গেছে। লোকটার মুখ আমি এইবার স্পষ্ট দেখলাম।চিনতে পারলাম লোকটা আসলে কে।ওটা ছিল রেদোয়ান।রেদোয়ানকে সবাই চেনে।আমিও চিনে ফেললাম।কিন্তু তার ওয়াইফের চোখ মুখের এমন বেহাল দশাতে আমি তাকে চিনতে পারিনি এতক্ষণ।অথচ বহুবার তাকে টিভিতে দেখেছি।বড় বড় শো তে দেখেছি রেদোয়ানের পাশে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে থাকতে।
রেদোয়ান সহ কারে উঠে চলে গেলো সেবার।আমি অপেক্ষা করলাম মেয়েটার কল আসার।সেদিন আর কল আসলোনা।আমি ময়মনসিংহ চলে এসেছি। ময়মনসিংহ থাকার দুইদিন পর বিকেল বেলা আমার ফোনে একটা কল আসলো।সেই কলটা রেদোয়ানের স্ত্রীর ছিল।কল রিসিভ করায় সে শুরুতেই বললো তার নাম আশা।সে রেদোয়ানের স্ত্রী। সে সাহায্য চায়।বাঁচতে চায়,স্বাধীন ভাব শ্বাস নিতে চায়’
আমি বুঝলাম রেদোয়ান তাকে অত্যাচার করে।কিন্তু তার মুখ থেকে অত্যাচারের ধরণ শুনে বুঝলাম রেদোয়ান আসলে মানুষ না,একটা জানোয়ার।কোনো মানুষ এরকম অত্যাচার করতে পারেনা।আশা আমায় বলেছিল এই অত্যাচারের কারণ হলো রেদোয়ান বাড়িতে একবার একজনকে আনবে বেড শেয়ার করতে কিন্তু আশা মুখ বন্ধ রেখে সব সইবে।
সব শোনার পর আমি বললাম তাহলে কেস করো।সে হাসলো।বললো কেস করলে তাকেই জেলে যেতে হবে।রেদোয়ান যাবেনা।
আমি বললাম তাহলে ডিভোর্স দাও।সে বললো ডিভোর্স দিলে তাকে আর তার বাবাকে পথে বসতে হবে,রেদোয়ানের টাকায় তারা বেঁচে আছে।
শেষে জিজ্ঞেস করলাম কি করলে আশা শান্তি পাবে।সে আমায় বললো শুধু যে রেদোয়ান টর্চার করে তা নয়,রকিও তাকে টর্চার করে।শারীরিক এবং মানসিক দুটোই।
আমাকে বললো প্রমাণ জোগাড় করতে।এই প্রমাণ কোর্টে গেলে রেদোয়ানের আর রকির জেল কেউ ঠেকাতে পারবেনা।
আমি রাজি হলাম।ময়মনসিংহে কাজ সেরে অফিসারের লুক পাল্টে হয়ে গেলাম রেদোয়ানের পি.এ।অবশ্য তার আরেকজন পুরুষ পি.এ ও ছিল।কিন্তু সে লন্ডনে গিয়েছিল রেদোয়ানের একটা কাজে।যার কারণে জরুরি ভিত্তিতে পি.এ প্রয়োজন ছিল।
অবশ্য এটার জন্য অনেক কাঠকড় পোড়াতে হয়েছিল আমায়।
আমার মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছিল রকি।সে শুরুতেই আমাকে অফার করে বসে তার সাথে রাত কাটাতে।আমি রাজি হয়ে যাই।
মদের সঙ্গে অজ্ঞান হবার ট্যাবলেট সচরাচর ছেলেরা খাওয়ায়।কিন্তু সেই রাতে আমি ওরে খাইয়ে দিয়েছিলাম।পরেরদিন সকালে সে চোখ খুলে আমার গায়ের সেই জামা দেখে অনেক হেসেছিল।বলদকে বলদ বানাতে অনেক ভালো লাগে তাই না??
আমিও হাসলাম অনেক।গায়ের জামাটা খুলে ওর মুখে ছুঁড়ে চলে এসেছিলাম আর সে বলদ ভেবেছিল আমি বুঝি তার সঙ্গে সারা রাত ছিলাম।
তো সে আমাকে আরেকটা রাত থাকতে বলে।আমার শরীরের কোন অংশ সে ছুঁয়েছে তার নাকি মনে পড়ছেনা।
ভেবেছিলাম সে বলদ,এখন মনে হলো শেয়ানা বলদ।যাই হোক এবারও রাজি হলাম।তার সাথে রুমে ঢুকে শুরুতেই চেয়ারে বসে একটা ভিডিও প্লে করলাম পাশের টিভিতে।রকির সঙ্গে একটা মেয়ের ভিডিও।এটা আমাকে একটা ছেলে জোগাড় করে দিয়েছিল।তার নাম আনিসুল।
যে মেয়েটা ছিল ভিডিওতে সেই মেয়েটা ঐ ছেলের প্রাক্তন ছিল।রকি ভিডিওটা দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো -‘হু আর ইউ??’
আমি উত্তরে বললাম’আই এম ইউর মিসফরচুন’
সে পাগলামি করলো অনেক সময় ধরে তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বললো ভিডিও ডিলেট করার বদলে আমাকে টাকা দেবে।আমি বললাম টাকা লাগবেনা।চাকরি লাগবে।সে রাজি হয়ে গেলো।তার সামনে ভিডিও ডিলেট করলাম।সুযোগ পেয়ে সে আমাকে টাচ করার জন্য এগোতেই বলে দিলাম একটা কথা।আর সেটা হলো,’ভিডিওটা যার থেকে নিয়েছিলাম তার বাসার ফোন,ল্যাপটপ,পিসিতে সেভ করা আছে’
ব্যস তার পর থেকে রকি আমাকে পারে না সালাম করে।যাই হোক চাকরিটা পেতে কম কষ্ট করিনি।এত কষ্ট আমি আমার এই চাকরি পেতেও করিনি।চাকরি পেয়ে রেদোয়ানের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে গেলাম।আশা আমাকে দেখেই চিনে ফেলেছিল।আমি সিসি ক্যামেরা লাগানোর জন্য তৈরি হচ্ছিলাম।বাসায় একটা গার্ড সবসময় থাকতো।তারা কুক আর আমার উপর নজর রাখতো।
আশা আমাকে বলেছিল আমি যেন তাদের বেডরুমে ক্যামেরা না লাগাই।লজ্জা পেয়ে বলেছিল এটা।তাই আমি সেই রুমে ক্যামেরা লাগাইনি।
কিন্তু সমস্যা হলো রেদোয়ান ওর গায়ে হাত তুলতো বেডরুমেই।একদিন আশা সব লজ্জা দূরে কাটিয়ে বললো আমি যেন বেড রুমেই ক্যামেরা লাগাই।
ঐ দৃশ্য আপনি নিজে চোখে দেখলে বিশ্বাস করতেন।ক্লিপটা আমি এক জায়গায় রেখেছি।আপনাকে দেখাবো।
প্রমাণ হাতে আসতেই আমি শেষ বারের মতন পি.এ হিসেবে গিয়েছিলাম রেদোয়ানের বাসায়।শেষ বার বললাম কারণ ঐদিনই আশা মারা গেছে।আমি থাকলে আমি ওকে মরতে দিতাম না।,বাঁচাতে পারলাম না ওকে।নিজেকে দোষী মনে হয়।
আমি তাকে মরে যেতে দেখেছি।আমার চোখের সামনে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে ছটফটাতে দেখেছি।সবার চোখ এড়িয়ে ছুটে এসে তার হাত ধরে বুঝতে পারলাম সে মারা গেছে।রেদোয়ান হাসছিল পাশে সোফায় বসে বসে।তার পাশেই সিঁড়ি ছিল।
যেই ফুলদানি মিসিং ছিল ওটা সিঁড়ির উপরে রাখা ছিল।কেন জানিনা।
লোক ধরিয়ে সেটাকে উপরে এনে রেখেছিলো রেদোয়ান।আশাকে মারা যেতে দেখে সিঁড়ির কাছে এসে অট্টহাসিতে মেতে ছিল সে।
আমিই তাকে মেরেছি সেদিন।হ্যাঁ আমি!!!
ধাক্কাটা আমি দিয়েছিলাম।তবে এত উঁচু লম্বা সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়েও সে মরেনি।আমার মাথার সেই রাগ আরও কড়া হয়ে দাঁড়ালো।আপনারা এতগুলো পুরুষ মিলেও ফুলদানিটাকে নাড়াতে পারলেন না,আর আমি একজন নারী হয়ে সেটাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিলাম।সেটার চাপা পড়েই রেদোয়ান মরেছে।তবে সেটা ওর মাথায় লাগেনি।বুকে লেগেছিল।মাথায় লাগলে তে মাথা থ্যাঁতলে যেতো।
ফুলদানি ফেলতে আমার জন্য সহজ হয়েছিল কারণ ফুলদানিটা সিঁড়ির কিণারায় ছিল।লোক ধরিয়ে সেটাকে এখানে রাখতে বলা হয়নি।ভেতরে রাখতে বলা হয়েছিল কিন্তু তারা ভুল করে কিণারায় রেখে চলে গিয়েছিল।আমি সব বাদ দিয়ে নিচে এসে ফুলদানির ভাঙ্গা টুকরো আর মাটি সরিয়ে ফেলেছি।সব একটা বস্তাতে।
গার্ডরা আসার আগেই ঐ বস্তার ভাঙ্গা সব অংশ একটু একটু করে আমি সরিয়েছি রেদোয়ানের বাসার কোণায় কোণায়।
মাটিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছি।আর ভাঙ্গা টুকরো গুলোকে টেনে হিঁচড়ে শহরের বাহিরে নিয়ে এসেছি।
রেদোয়ানের বাসার কুক,সেই গার্ড, রকি,এ্যামিলি ছাড়া আমাকে আর একটা মানুষ ও চিনে না।কেন জানেন??শুনলে হাসবেন।আমি এরকম মোটা ফ্রেমের চশমা আর কালো রঙের মেক আপ করে আসতাম প্রতিদিন।মুখে থাকতো মাস্ক।শুধু চোখ দেখে তারা দ্বিতীয়বার দেখে আমাকে চিনলেও খুনি বলে দোষারোপ করতে পারতো না,মনে সংশয় রয়ে যেতো।একটা ফর্সা মেধা,আর আরেকটা কালো মেধা।
তাদের ভাবনার বাহিরে ছিল রেদোয়ানের পি.এ হিসেবে আসা নতুন মেয়েটাই খুনি।আসলে আমাকে কদিন ধরে খুব কম লোকই দেখেছে।যারা দেখেছিল তাদের কজনকে আমি নিরুদ্দেশ করে দিয়েছিলাম।মারিনি।শহর ছাড়া করেছি।এবার বলুন আমায় কি শাস্তি দেবেন?’
চলবে♥