#প্রবঞ্চনা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩ [ অন্তিম পর্ব ]
.
ভয়াবহ সেই জঘন্য রাতটির পর নিস্তব্ধ রূপে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যায় শিরিন। শিরিনের এই চলে যাওয়াকে দুর্জয় স্বাভাবিক নেয় এবং ভাবে পরবর্তী’তে সে গিয়ে আবার নিয়ে আসবে। কিন্তু – মৃত মানুষ’কে কি কখনো জীবিত করা সম্ভব হয়? হয় না তাইনা… ঠিক তেমনি এ পৃথিবীতে কিছু সম্পর্ক থাকে,থাকে কিছু প্রগাঢ় অনুভূতি। যেগুলোর একবার সমাপ্তি ঘটলে দ্বিতীয় বার সূচনা ঘটানো সম্ভব হয় না। ক্ষমা করা মহৎ গুণ। কিন্তু গভীর এবং পবিত্র ভালোবাসা’কে নিকৃষ্ট ঘৃণায় পরিণতকারী ব্যক্তিদের কখনো ক্ষমা করতে নেই। মাসখানেক সময় চলে যাওয়ার পরও শিরিন’কে ফেরাতে পারেনা দুর্জয়। যে শিরিন মুখ দিয়ে কখনো কোনো কটুবাক্য উচ্চারণ করেনি সে শিরিন দুর্জয়ের ফোন পাওয়া মাত্রই বাজে ভাষায় গালি দিতে শুরু করে। না বিবেচনা করে স্থান,না বিবেচনা করে মানুষ। পরপর কিছুদিন শিরিনের থেকে এমন আচরণ পেয়ে রেগে গিয়ে আর ফোন করেনা দুর্জয়। এদিকে শিরিনের পুরো পরিবার ভীতিগ্রস্ত হয়ে দুর্জয়কে খবর পাঠায় শিরিন ঠিক নেই। শিরিন কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করে। কারো সঙ্গে কথা বলে না। কখনো কখনো ভুলে যায় তার আশেপাশের মানুষজন’কে। এমনও সময় যায় তার নিজের একটি সন্তান রয়েছে এটিও মনে থাকে না। কখনো কখনো অদ্ভুত স্বরে গুনগুনিয়ে কাঁদে। কখনো বা দুর্জয়ের নাম করে বিশ্রী ভাষায় গালি আওড়ায়। সমস্ত কথা শোনামাত্রই ছুটে আসে দুর্জয়। শিরিনের চোখ,মুখ দেখে মারাত্মক ভয় পেয়ে যায় সে। বুকের ভিতর হুহু করে ওঠে। নিজের কর্মের কথা স্মরণ করে মাথা নিচু হয়ে যায়। শিরিন’কে কাছে টেনে নিয়ে ক্ষমা চায়, বোঝায় এমন পাগলামো না করতে। কিন্তু অনুভূতিহীন শিরিন কিছুই বুঝতে পারেনা। দুর্জয়ের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে,
– তুই কে ? আমাকে ছুঁয়েছিস কেন কে তুই?
স্তব্ধ দুর্জয়ের বক্ষস্থল দুমড়েমুচড়ে যায়। রিমুকে সে প্রথম কোলে তুলে নেয় বলে,
– শিরিন আমি তোমার স্বামী, আমি তোমার দুর্জয় রিমুর বাবা আমি।
কথাটা বলামাত্রই দুর্জয়ের চুল খামচে ধরে শিরিন। পরোক্ষণেই রিমুকে কেড়ে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– ওর কোন বাবা নেই, ওর কোন বাবা নেই। আমার কোন স্বামী নেই,আমার কোন স্বামী নেই।
হঠাৎ শিরিনের এই ভয়াবহ পরিবর্তনে সকলের মাথায় বাজ পড়লেও নিশ্চুপ রইলো দুর্জয়। শিরিনের মা দুর্জয়’কে অনুরোধ করলো শিরিনকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু পাপীষ্ঠ দুর্জয় ভীতিগ্রস্ত হয়ে সে সাহসটুকু দেখালো না। পরিবর্তে ত্যাজ দেখিয়ে বললো,
– এজন্যই বলেছিলাম এখনি বাচ্চা নিতে হবে না। শিরিন আমার কোন কথা শুনেনি। এই বয়সে এটুকু শরীরে এমন ধকল গেলে কার মাথা ঠিক থাকে বলুন তো। কিছু হয়নি শিরিনের সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে একটু খেয়াল রাখবেন ওর এবং বাচ্চার সব খরচ আমি বহন করবো চিন্তা করবেন না আপনি শুধু ওর একটু যত্ন নেবেন বাচ্চাটাকে দেখবেন।
.
দেখতে দেখতে কেটে যায় অনেকগুলো মাস তবুও ঠিক হয় না শিরিন৷ মানসিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয় সে৷ তার মস্তিষ্কে সর্বক্ষণ পোকারা কিলবিল করতে থাকো। পুরো শরীর, মন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করে নিজেকে এবং নিজের চারপাশের মানুষ জন’কে। মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে কোলের বাচ্চাটিকে। বহুবার চেষ্টাও করেছে নিষ্পাপ, অবুঝ শিশুটির প্রাণনাশ করতে। কিন্তু যখনি মেয়েটা কেঁদে ওঠে বক্ষস্থলে টান পড়ে খুব। হুঁশ ফেরে ভাবে কি করতে যাচ্ছিল সে? কি দোষ এই নিষ্পাপ শিশুটার? যে আসল দোষী, যে আসল খুনি তাকেই তো শেষ করে দেওয়া উচিৎ। হ্যা খুনি দুর্জয়। তার নিষ্পাপ দেহ, মনের খুনি। তার অন্তর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে দুর্জয়। ক্ষমা নেই কোন ক্ষমা নেই দুর্জয়ের।
তারপর একদিন দুর্জয় আসে শিরিনের কাছে। একাকী ঘরে সেদিন শুধু শিরিন আর দুর্জয়ই ছিলো। দুর্জয় তার পাপে জর্জরিত দৃষ্টি দ্বারা শিরিনের শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছিলো। পাপে জর্জরিত হস্ত দ্বারা শিরিনের জ্বলন্ত শরীরের জ্বালা বাড়িয়ে দিয়েছিলো চারগুণ। উপায় না পেয়ে নিজের দু হস্তে দুর্জয়ের কন্ঠস্বর রোধ করে শিরিন। শ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে দুর্জয়ের। গায়ের সর্বচ্চ শক্তি দিয়ে শিরিনকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেদিন শিরিনের শক্তির সাথে পেরে ওঠছিলো না দুর্জয়। তবুও শেষ পর্যায়ে গিয়ে কোনক্রমে নিজেকে বাঁচায় সে। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রয় শিরিনের পানে। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শিরিনও। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে কোনপথে আগায় শিরিন তা সে নিজেও জানে না। দুর্জয় কিছু সময় থম মেরে বসে থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন ঘন চলতে থাকে তার। কিছু সময় পর হঠাৎই প্রচুর চিৎকার চেচামেচি শুনতে পায়। এদের ভীড়ে শিরিনের মায়ের গগনবিদারী চিৎকার কানে আসতেই শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় দুর্জয়ের। ঘর থেকে বের হতেই শিরিনের বোনের চিৎকারে স্তব্ধ হয়ে যায় সে।
– দুর্জয় ভাই শিরিনের এক্সিডেন্ট হইছে বড়ো বাসগাড়ির ধাক্কা লাইগা বোনটার শরীর খন্ড খন্ড হইয়া গেছে। তাড়াতাড়ি করো হাসপাতাল যাইতে হবো আমগো।
বেখেয়ালি ভাবে শিরিন বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলো সেদিন৷ বাড়ির সামনেই মেইন রাস্তা সে পথেই বেহুঁশের ন্যায় চলতে গিয়ে মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয় তার। প্রথমে গ্রামীণ হাসপাতাল পরে শহরের বড়ো হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় তাকে। দীর্ঘ ছয় মাস অচেতন অবস্থায় থাকে শিরিন। একটি হাত দুখন্ড হয়ে যায় তার। একটি পা’ও অকেজো হয়ে যায়৷ মাথায় চরম আঘাত পায় সে। তার চিকিৎসার জন্য দুর্জয় তার নিজ পৈত্রিক সম্পত্তির অর্ধেকাংশই বিক্রি করে দেয়। এর ফলে দুর্জয়ের প্রতি শিরিনের পরিবারের শ্রদ্ধার শেষ থাকে না। কিন্তু এতোকিছুর পরও কি দুর্জয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটেছিলো? না ঘটেনি শিরিন যখন কোমায় থাকে সকলেই ধরেই নেয় সে আর বাঁচবে না৷ সে সময় চিকিৎসা ব্যবস্থা তেমন উন্নত না থাকায় ডাক্তার রাও আশা ছেড়ে দেন। সে খবর দু’পরিবার সহ এলাকায়ও ছড়িয়ে যায়। সবাই রিমুর কথা ভেবে দুর্জয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দুর্জয়ের অন্যত্র বিবাহের ব্যবস্থা করে। দুর্জয় প্রথমে আপত্তি করলেও পরবর্তীতে রাজি হয়ে যায় এবং বলে, সে বিয়ে করলে রোজিনাকেই করবে। কারণ তার বউয়ের দরকার নেই তার শুধু রিমুর জন্য একজন মা দরকার। বউ তার একটিই আর সে হলো শিরিন। চতুর দুর্জয়ের নিখুঁত এই চাল কেউ ধরতে না পারলেও তার বড়ো ভাবি কিছুটা ধরতে পেরেছিলো৷ কারণ সে সন্তানহীন। রিমুর দায়িত্ব সেই নিতে পারতো এর জন্য অসুস্থ স্ত্রীকে হাসপাতালে কোমায়িত রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করার মানেই হয় না।
নিষ্ঠুর দুর্জয় বিয়ে করে নেয় রোজিনা’কে। ধীরে ধীরে শিরিনের খোঁজ নেওয়াও কমিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু শিরিনের মা, বোন এবং বোন জামাইদের সহায়তায় শিরিনের চিকিৎসা চলতেই থাকে। এক পর্যায়ে সুস্থও হয়ে ওঠে শিরিন। কিন্তু তার একটি হাত এবং একটি পা অচল হয়ে যায় সাথে অচল হয়ে যায় তার ব্রেইনও। ডাক্তারদের পরামর্শে শিরিনকে প্রথমে পঙ্গু হাসপাতাল এবং পরে মানসিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়৷ এর মধ্যে দুর্জয়কে এসব খবর জানালে সে টাকার ব্যবস্থা করে দেয় কিন্তু সশরীরে কখনোই আসে না। ইচ্ছে থাকলেও কখনো আসতে পারেনা কারণ রোজিনা তাকে আসতে দেয় না৷ একদিকে শিরিনের চিকিৎসা অপরদিকে দুর্জয়ের দ্বিতীয় সংসার বেশ ভালো ভাবেই চলতে থাকে। রিমুও মানুষ হতে থাকে রোজিনার কাছে! কেটে যায় পাঁচটি বছর৷ মৃত্যু’কে খুব কাছ থেকে দেখা শিরিন ফিরে আসে নিষ্ঠুর পৃথিবীতে। কিন্তু সত্যিই কি সে ফিরে এসেছে? কোথায় শিরিনতো নিজ স্বামী’কে একটিবারের জন্যও স্মরণ করে না। একটি বারের জন্যও মনে করেনা তার নাড়ি ছেঁড়া ধনটির কথা।
শিরিনের মা অনেকবার চেষ্টা করেছে শিরিনের স্মৃতি মনে করানোর জন্য৷ কিন্তু লাভ হয়নি। ডাক্তার বলেই দিয়েছিলো শিরিনের স্মৃতি লোপ পেয়েছে। এও বলেছে হঠাৎ হঠাৎ তার পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে পড়বে আবার ভুলেও যাবে আবার এমনও হতে পারে পরিবারের সঙ্গে স্বাভাবিক সময় কাটাতে পারলে পুরোপুরিও ঠিক হতে পারে কিন্তু চিকিৎসা বন্ধ করা যাবে না চালিয়েই যেতে হবে৷ এবং পুরোপুরি মেডিসিনের ওপরই চলবে তার দেহটি।
রিমুর বয়স ছয় বছর তখন। এই ছয়টি বছর বেশ যত্নতেই মানুষ হয়েছে রিমু৷ রোজিনা কখনোই সৎমায়ের আচরণ দেয়নি রিমুকে। বরং নিজেকে মহৎ প্রমাণ করে বরাবর সকলের চোখে সে ভালো সেজেছে। কিন্তু যখন সে জানতে পারে শিরিন অনেকটাই সুস্থ তখন তার মাথা খারাপ হয়ে যায়৷ কারণ এই ঘর সংসার,স্বামী, সন্তান সবটাই শিরিনের। শিরিন যদি চায় সবটাই তার থেকে কেড়ে নিতে পারবে। দুর্জয়ও শিরিনের এই চাওয়াকে অবমূল্যায়ন করতে পারবে না। শুধু দুর্জয় নয় এই পরিবার, সমাজ এবং আইন সবটাই শিরিনের পক্ষে থাকবে। সবচেয়ে বড়ো কথা রিমু। শিরিনের সন্তান রিমু। তাই শিরিনের জোরটাই আলাদা। রোজিনার শরীর ছাড়া আর কোন জোরই নেই আর এই শরীর দুর্জয় চাইলে বহুত পাবে। তাই দুর্জয়কে সম্পূর্ণ ভাবে হাতের মুঠোয় আনার জন্য নিজের অধিকার শক্তপোক্ত করার জন্য কনসিভ করে রোজিনা৷
দুর্জয় কখনোই সন্তানের প্রতি আগ্রহ দেখায় না। তাই দুর্জয়কে না জানিয়েই কনসিভ করে সে৷ এ খবর দুর্জয় জানার পর একটু রাগ করলেও পরবর্তীতে কিছু বলেনা। গর্ভে সন্তান আসার পর রিমুর প্রতিও অযত্ম করতে শুরু করে রোজিনা। দুর্জয়ের কাছে রিমুকে তেমন ঘেষতেও দেয় না। দুর্জয়ও কিছুই বলে না। এক প্রকার অবহেলাতেই মানুষ হতে থাকে রিমু। দীর্ঘ ন’মাস পর পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় রোজিনা।
এতোগুলো বছরে শিরিনের পরিবার শুধু এটুকুই চেয়েছে তাদের নাতনীটা ভালো থাকুক। শিরিনকে তার অধিকার দিতে হবেনা৷ শুধু রিমু তার অধিকার টুকু পেলেই হলো। কারণ রোজিনার সঙ্গে দুর্জয়ের বিয়েতে দুর্জয়ের কোন দোষ দেয়না শিরিনের পরিবার। তাদের মেয়েই সংসার করার অবস্থায় নেই সেখানে তারা কেন পরের ছেলের জীবন নষ্ট করবে?
কিন্তু যখন থেকে তারা জানতে পেরেছে রোজিনার ছেলে হওয়ার পর থেকে রিমুর বেশ অযত্ন হচ্ছে। বাবার ঘরে স্থান পাচ্ছে না সে। কখনো বড়ো চাচি কখনো বা দাদির ঘরে রাত কাটাতে হচ্ছে। অযত্নে,অবহেলায় মেয়েটার শরীরে হাড়গুলো চেয়ে চেয়ে থাকে। তখন আর নানী হয়ে শিরিনের মা চুপ থাকতে পারেনা৷ নানাভাবে শিরিনকে স্মরণ করাতে থাকে তার একটা মেয়ে রয়েছে। সে অনেক বড়ো হয়ে গেছে। ছোট্ট ছোট্ট হাত পা গুলো বড়ো হয়ে গেছে। সে হাঁটতে পারে কথা বলতে পারে। সে অন্য একটি মহিলাকে মা বলে ডাকে। তোর কি ইচ্ছা করেনা নিজের সন্তানের মুখে মা ডাকটি শুনতে?
মায়ের কথা শুনে চুপ করে থাকে শিরিন কখনো কখনো ফুঁপিয়ে কেঁদেও ওঠে।
কথিত আছে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। রোজিনা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকেই দুর্জয়ের সঙ্গে তার ঝামেলার সৃষ্টি হয়। পুত্র সন্তান হওয়ার পর তাদের ঝামেলা মিটে গেলেও স্বভাব একটুও পরিবর্তন হয়নি দুর্জয়ের। কিন্তু রোজিনাও কম নয়। সে দুর্জয়ের উল্টাপাল্টা আচরণ একটুও মেনে নেয় না। ছেলে হওয়ার পর থেকে তার জোর যেনো বেড়ে গেছে। গলার স্বর হয়েছে উঁচু চোখের ভণিতা হয়েছে দৃঢ়। দুর্জয়কে বেশ কড়া শাসনেই রাখে রোজিনা৷ না কোন নারী না কোন সুখ কোনটাই আজকাল ধরা দেয় না দুর্জয়ে জীবনে। সারাদিন ছেলেকে সামলাতে হয়। রাতের বেলায় রোজিনা পড়ে পড়ে ঘুমায় আর ছেলের সাথে পুরো রাত জাগতে হয় দুর্জয়কে। নিজের দৈহিক চাহিদাটুকু পূরণের জন্যও রোজিনা এক মূহুর্তের জন্য কাছে পায় না দুর্জয়। এ নিয়ে রাগে,ক্ষোপে একদিন বাড়ি ছাড়া হয় সে। নির্লজ্জের মতোন পা দেয় শিরিনের বাপের বাড়িতে। দুর্জয়কে দেখে শিরিনের মা কান্না করে দেয়। করুণ স্বরে বলে,
– বাবা তুমি আসছো রিমুরে নিয়ে আসোনাই বাবা?
– আরেকদিন নিয়ে আসবো। শিরিনের সাথে দেখা করা যাবে?
শিরিনের মা দুর্জয়’কে নিয়ে যায় শিরিনের কাছে। শিরিন তখন খাতায় কলম দিয়ে কাটিকুটি করছে। এমন সময় দুর্জয় ঘরে ঢুকে। অনেকটা সময় স্থির দৃষ্টিতে শিরিনকে দেখে। তারপর দু-হাত জোর করে ক্ষমা চায় শিরিনের কাছে। শিরিন কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে তারপর জিগ্যেস করে,
– ক্ষমা চাও কেন?
দুর্জয় তখন অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে তার পাপের কথা স্বীকার করে,রোজিনা কে বিয়ে করে কি মারাত্মক ভুলটাই না সে করেছে সবটা স্বীকার করে সে। তার এই স্বীকারক্তি ভয়ংকর হয়ে আক্রমণ করে তাকে৷ চরম ক্ষেপে গিয়ে শিরিন স্টিলের স্কেল দিয়ে পা থেকে মাথা অবদি একনাগাড়ে বাড়ি দিতে থাকে। আর চিৎকার করে বলে,
– তুই ঐ কালনাগিনী’কে বিয়ে করছিস? তুই আমার মেয়েটারে সৎমায়ের ভাত খাওয়াইছিস৷ তুই তোর নোংরা শরীরটা আবার আমার সামনে আনছিস।
কথাগুলো বলতে বলতে দুর্জয়কে স্কেল দ্বারা আঘাত করতে থাকলো শিরিন। না দুর্জয় এক চুল পরিমাণ সরলো আর না শিরিন একটু সময়ের জন্য থামলো৷ শিরিনের বাবা,মা, বোনরা ছুটে এসে শিরিনকে থামায়। পুরো দশজনের শক্তি যেনো শিরিনের শরীরে একাই ভর করেছে ঠিক এতোটাই শক্তি প্রয়োগ করে মারছিলো শিরিন স্কেল ভেঙে দু খন্ড হয়ে যাওয়ার পর পা তুলে বুক বরাবর লাথি দিয়ে মারতে থাকে। বহুকষ্টে সকলে মিলে শিরিনকে দূরে সরিয়ে নেয়। দুর্জয়ের দু’চোখ বেয়ে অঝর ধারায় অশ্রুপাত হতে থাকে। এ ‘ এক অদ্ভুত হৃদয়ের কান্না। এ এক ভয়ংকর পাপিষ্ঠের আর্তনাদ।
.
ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে রিমু বুঝতে পারে তার চারপাশের মানুষ জন’কে। বুঝতে পারে তার অদ্ভুত জীবনকে। অনুভব করতে পারে মায়ের শূণ্যতাকে। দূরে বসে মা’ও টের পায় তার মেয়ের অসহায়ত্বকে। তাই তো উপরওয়ালার অসীম কৃপায় মা ছুটে আসে মেয়ের কাছে। একদিন শিরিন বোরখা পরে ঘর থেকে বের হচ্ছিল। এমন সময় শিরিনের মা তাকে জিজ্ঞেস করে,
– কোথায় যাস তুই!
– আমার মেয়ে কাঁদছে আম্মা তুমি তো ওরে এনে দিতে পারলানা আমিই যাব ওরে নিতে।
শিরিন সেদিন রিমুর জন্য শ্বশুর বাড়িতে যায়। দুর্জয় তখন বাড়িতে ছিলোনা। রোজিনা শিরিনকে দেখা মাত্রই রিমুকে সেই যে ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে সারাদিনে আর দরজা খুলে না। শিরিন ঘরের সামনে গিয়ে সারাদিন বসে থাকে। বাড়ির প্রতিটি মানুষ নিশ্চুপ হয়ে থাকে। তারা না রোজিনাকে দরজা খুলতে বলে আর না শিরিনকে চলে যেতে বলে। অদ্ভুত এক টানাপোড়েনে সবাই নিশ্চুপ হয়ে থাকে। সারাদিন শিরিন দুচোখের অশ্রু বিসর্জন দেয়। কারো সাথে দু’টো ভালো মন্দ কথা বলতে ইচ্ছে হয় না তার। কিন্তু সে রোজিনা’কে দু’হাতে চরম শাস্তি দেওয়ার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েই বসে থাকে। কোনক্রমেই যখন রোজিনাকে এবং রিমুকে নাগালে পায় না তখন বাধ্য হয়ে আইনের সহায়তা নেয় শিরিন। সেদিন পুলিশ দিয়ে বেশ শাসিয়ে রিমুকে নিজের কাছে নিয়ে যায় শিরিন। কিন্তু আফসোস তার একটাই রোজিনাকে যোগ্য শাস্তি দিতে পারলো না। প্রথম প্রথম রিমু শিরিনের কাছে থাকতে চাইতো না৷ কিন্তু পরবর্তীতে সে থেকে যায়। মা যেমনই হোক না কেন মায়ের যে একটা আদর তার লোভ রিমুও ছাড়তে পারে না৷ শিরিন যেমনই করুক না কেন রিমুর প্রতি তার সমস্ত স্নেহ, সমস্ত জ্ঞান ছিলো নিখুঁত। রিমুকে কাছে পেয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক হয় শিরিন৷ কিন্তু মাঝে মাঝে ভুলে যাওয়া রোগ তার থেকেই গেছে। এই যেমন তার একটি মেয়ে আছে এটা মনে আছে কিন্তু তার নাম কি সেটা মনে নেই! আবার রিমুকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। রোজ স্কুলে নিয়ে যাবে কিন্তু কোন স্কুলে ভর্তি করিয়েছে সেটাই মনে নেই। কাল রিমুকে অ,আ শিখিয়েছে তো আজ সেটা পড়াতে গিয়েই আর খেয়াল নেই। মা যখন কিছুতেই অ,আ পারছে না রিমু তখন মা’কে মনে করিয়ে দেয়।শিরিন তখন মনে পড়েছে, মনে পড়েছে বলেই চেঁচিয়ে ওঠে। মা,মেয়ে এভাবেই নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেয় সুন্দর ভাবে।
শিরিন তার মেয়ে’কে নিয়ে একাকী জীবন বেশ ভালোই কাটাচ্ছিলো। দুর্জয় আর খোঁজ নেয়নি শিরিনের। আর না একটিবার দেখতে এসেছে মেয়েটিকে। শিরিন যখন গভীর রাতে মেয়ে’কে বুকে জড়িয়ে গভীর দীর্ঘশ্বাসে পুরো ঘর মুখরিত করে তুলে দুর্জয় তখন ভিন্ন ভিন্ন নারী’র শরীরে জঘন্য প্রমোদে মত্ত থাকে। ইতিমধ্যেই শিরিন খবর পেয়েছে রোজিনা আর দুর্জয়ের মধ্যে বেশ ঝামেলা চলছে। দু’একবার মারপিটও হয়েছে তাদের মধ্যে। তাই রাগ করে বাড়ি ছেড়ে অন্য একটি মেয়ে’কে নিয়ে কক্সবাজারে ঘুরতে গেছে দুর্জয়। যাওয়ার আগে রোজিনা’কে শাসিয়ে গেছে সেই মেয়ে’কে নাকি বিয়ে করবে! এসব ঘটনা শুনে শান্তি পায় না শিরিন আর না আসে তৃপ্তি। তার বক্ষস্থলে যে আগুন জ্বলছে সে আগুন ইহজনমে আর নিভানো সম্ভব না। কিন্তু মানুষ রূপী জানোয়ারের সঙ্গেও কোন বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে চায় না সে। মনের বন্ধন বহু আগেই ছিন্ন হয়ে গেছে। এবার নামমাত্র যে বন্ধনটুকু আছে সেটুকু ছিন্ন করার পালা। দুর্জয়কে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বেই তার সঙ্গে ঘটা যাবতীয় ঘটনাই নিজ পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করে শিরিন। প্রথমে তারা কেউই বিশ্বাস করতে চায় না। ভাবে শিরিন মানসিক রোগি। দুর্জয়ের দ্বিতীয় বিবাহ সে মন থেকে মেনে নিতে পারছেনা তাই সন্দেহের বশীভূত হয়ে আবোলতাবোল বকছে। কিন্তু তারপর যখন দুর্জয়ের কিছু কুকীর্তি লোকমুখেও শুনলো এবং রোজিনার সঙ্গে জেদ করে অন্য খারাপ মেয়েলোকদের সঙ্গে কক্সবাজার যাওয়ার ঘটনা শুনলো তখনি তারা শিরিন’কে পুরোপুরি বিশ্বাস করলো। এবং বড়ো বোন জামাইরা ডিভোর্সের সকল কাগজপত্রও রেডি করে দিলো। এই খবর দুর্জয় জানামাত্রই ছুটে আসে শিরিনের কাছে। নানাভাবে বুঝিয়েও যখন শিরিন’কে মানাতে পারলোনা তখন রিমুকে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখালো। কিন্তু শিরিন স্ত্রী হিসেবে কঠিন না হতে পারলেও মা হিসেবে প্রচুর কাঠিন্যতার প্রমাণ দিয়েছিলো। দুর্জয়কে আইনের ভয় দেখিয়ে রিমুকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করালো। দুর্জয় যখন সবদিক দিয়েই হেরে গেলো তখন শিরিন’কে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল শুরু করলো। বললো,
– জীবন দিয়ে দেবো তবু এই বিবাহ বিচ্ছেদ আমি করবো না শিরিন। আমি আমার স্ত্রী সন্তান কে একা পথে ছেড়ে দিতে পারবো না।
শিরিন বললো,
– আরে কাপুরষ তুই এখন আমাকে পুরুষত্ব দেখাতে আসছিস? তোর দম কতোটুকু তা বোঝা শেষ৷ আমি তোকে স্বামী হিসাবেই স্বীকার করিনা আর না তোকে আমার সন্তানের বাবা হিসেবে বিন্দু মূল্যায়ন করি। ডিভোর্স পেপারে সই করে দিছি তুই করবি কি করবি না তোর ব্যাপার৷ তবে এই শিরিন আর রিমুর জীবনে তুই দুর্জয় মৃত!
– শিরিন আমি পাপী, আমি অন্যায়কারী এতোকিছুর মাঝেও একটা কথা সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি। এ পৃথিবীতে আমি আমার স্ত্রী হিসেবে কেবল তোমাকেই জানি, তোমাকেই ভালোবাসি।
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দুর্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো শিরিন৷ দু-চোখ বেয়ে পড়লো দুফোঁটা অশ্রুকণারা। ওষ্ঠকোণে ফুটে ওঠলো তাচ্ছিল্যমাখা একটি হাসি। মুখ ফুটে বললো,
– তুমি বলছো তুমি আমাকে ভালোবাসো। অথচ তুমি আমি ব্যতিত অসংখ্য নারীর শরীরে মগ্ন থাকতে পারো। আমি বলছি আমি তোমাকে ঘৃণা করি। অথচ আমার সর্বাঙ্গে প্রথম এবং শেষ ছোঁয়া কেবল তোমারই ছিলো। তুমি বোঝাতে চাও ভালোবাসা মানে তোমার দুর্বৃত্ত দৃষ্টিজোড়ার মিথ্যা অশ্রুকণারা। আর আমি পুরো দুনিয়া’কে চিৎকার করে বলতে চাই ভালোবাসা মানে ধোঁকা, প্রবাঞ্চনা…।
একটু থেমে দুর্জয়ের দিকে পৃথিবী সমান ঘৃণা নিক্ষেপ করে বললো,
– আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় পুরুষ মানুষ বলতে তুমি কি বোঝ আমি বলবো, ঘৃণা। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় ভালোবাসা বলতে তুমি কি বোঝ আমি বলবো,ধোঁকা।
.
পুনশ্চঃ
সেদিন থেকেই একেবারে আলাদা হয়ে যায় শিরিন দুর্জয়। কেটে যায় বহুবছর। শিরিনের বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার যেটুকু সম্পদ নিজ ভাগে পেয়েছিলো শিরিন সে অল্প কিছু সম্পদ বিক্রি করে কয়েক লক্ষ টাকা ব্যাংকে রাখে। অল্পকিছু পড়াশোনা জানায় এবং বড়োবোনদের সহায়তায় এক মেয়ে নিয়েই তার জীবন বেশ চলে যায়। এ জীবনে আর দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধার প্রয়োজন বোধ করেনি। বাবার ভিটেতেই সম্পূর্ণ নিজের একটি ঠিকানা তৈরি করে নিয়েছে। মেয়ের পড়াশোনার জন্য পাড়ি দিয়েছে ঢাকা শহরে। এ শহরে বহু জীবনের গল্প পাওয়া যায়,পাওয়া যা নিত্য নতুন অনুভূতিদের সন্ধান। তেমনি এ শহরে শিরিন রিমুর করুণ জীবনের গল্পও পেয়েছিলাম আমি। মায়ের বয়সী একজন মহিলা শিরিন বোনের বয়সী একটি নিষ্পাপ, স্পষ্টভাষী,মিষ্টি মেয়ে রিমু। প্রথম আলাপে দুজনকেই পাগল ভেবেছিলাম। দ্বিতীয় আলাপে তো শিরিন আন্টি চিনতেই পারলো না আমায়৷ ঐ যে ভুলে যাওয়া রোগ। এ পৃথিবীর নিষ্ঠুর এক পুরুষের দেওয়া ক্ষত আজো বয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ টা। শিরিন আন্টি আর রিমুর সঙ্গে পরিচয় ঘটার পর থেকে প্রায়ই তাদের ফ্ল্যাটে যেতাম আমি। মায়ের বয়সী মানুষটার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। শিরিন আন্টি খুবই প্রাণখোলা মানুষ। আলাপে আলাপে বরাবরই সে তার জীবনী তুলে ধরতেন৷ মানুষ টা পুরোপুরি সুস্থ নয় এটা যখন তিনি কথা বলতেন তখনি বুঝতে পারতাম৷ স্বামী নামক বেইমান পুরুষটার ভালোবাসা গুলো ঠিক যতোটাই সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করতেন বেইমানিগুলো তোতোটাই ঘৃণার সঙ্গে উপস্থাপন করতেন৷ পুরুষ মানুষ নিয়ে তার মনোজগৎে যে বিতৃষ্ণার জন্ম হয়েছে সে বিতৃষ্ণার মৃত্যু ঘটানো ইহজনমে প্রায় অসম্ভব। রিমু পড়াশোনা করে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। মায়ের মতোনই পুরুষ মানুষের প্রতি অদ্ভুত এক বিতৃষ্ণার জন্ম হয়েছে তার মনোজগৎে। আমি শিরিন আন্টি’কে প্রশ্ন করেছিলাম,
– আন্টি ভালোবাসা মানে কি?
শিরিন আন্টি উত্তর দিয়েছিলো,
– ধোঁকা।
প্রশ্ন করেছিলাম,
– তিনি কি ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছিলো?
শিরিন আন্টি মাথা নাড়িয়ে বললেন,
– উহুম আজো করেনি।
– কেন করেনি?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিরিন আন্টি বললেন,
– জানিনা।
– তিনি ফোন করেন?
– হুম করেন।
– কী বলেন?
– ক্ষমা চায়, সান্নিধ্য চায় পবিত্র সান্নিধ্য কিন্তু সম্ভব না। আমি থাকাকালীন যে শরীর, যে মন অন্য শরীরের প্রয়োজন বোধ করেছিলো সে মনের সে শরীরের প্রয়োজন আমাকে দিয়ে আর মেটানো সম্ভব না।
– শুনেছিলাম প্রতিটি মানুষই তার পাপের শাস্তি ভোগ করে৷ মানুষ প্রতিশোধ না নিলেও প্রকৃতি ঠিক তার প্রতিশোধ নেয়। দুর্জয় আংকেল কি পেয়েছিলো তার পাপের শাস্তি?
তাচ্ছিল্য সহকারে শিরিন আন্টি উত্তর দিলো,
– পেয়েছিলো শব্দটা অতীত কিন্তু ওর শাস্তিতো অতীতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং বর্তমানেও চলছে ভবিষ্যৎেও চলবে। সুখী হতে পারেনি সে আফসোসের জর্জরিত তার হৃদয় পৃথিবীতে আফসোস ব্যতিত অন্য আর কোন শাস্তি বড়ো হতে পারে আমার জানা নেই। তবুও বলবো আমি সন্তুষ্ট নই।
❤সমাপ্ত