#তুমি_যে_আমার
#Writer_Nondini_Nila
#Part_14
মায়ের অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকে বর্ষা কাদছে। একদিকে পেটের ভেতর খিদে যন্ত্রণা আর একদিকে মায়ের অসুস্থ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে কষ্টে। মায়ের এই অবস্থা দেখে কিভাবে নিজেকে শান্ত রাখবো বর্ষা।মায়ের হাসি মুখটা ভেসে উঠছে বর্ষার। বর্ষা একটু কিছু হলেই মা রাত দিনে করে বর্ষার সেবা যত্ন করেছে। আর আজ মায়ের এই অবস্থা ও তার পাশে থাকতে পারছেনা। আর সে কিনা তারই চিন্তায় এখন হসপিটালের বেডে পড়ে আছে। একটা সন্তানের কাছে এর থেকে কষ্টের আর কি হতে পারে? কি পাষাণ? কি নির্দয় লোকটা! এতটা পাষাণ লোক জীবনে দুটো দেখেনি বর্ষা। মায়ের এই অবস্থা জানার পরও কিভাবে তিনি এভাবে ওকে আটকে রাখতে পারল।
তার নিজের কি মা-বাবা নাই?উনি কি তার মা-বাবা কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারে না। ওর পরিবারের সাথে তার যত দ্বন্দ্ব লেগে থাকুক তার জন্য কেন এভাবে মায়ের থেকে সন্তানকে আলাদা করতে পারছে। আজ যদি মায়ের কিছু হয়ে যায় তাহলে ওই লোকটাকে আমি খুন করে ফেলবো। বর্ষা উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে দরজার কাছে এসে আবার লোকটাকে ডাকবে ও।
বিছানা থেকে দাঁড়াতেই খট দরজাটা খুলে গেল চমকে চোখ মেলে তাকাল বর্ষা খোলা দরজার দিকে।লোকটা গম্ভীর মুখ রুমে প্রবেশ করলো, আর সাথে সাথে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। তূর্য বর্ষার দিকে তাকিয়ে দেখলো বর্ষা খাটের পাশে
অশ্রু নয়ন চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। বর্ষা চোখ লাল টকটকে হয়ে ফুলে আছে। গালে এখনো পানি লেগে আছে। ওর দিকে খুব মায়া ভড়া চোখে তাকিয়ে আছে। বর্ষার এমন চোখ মুখ দেখে তূর্য এর বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
তূর্য পা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। কিছু একটা ভেবে পা বাড়াতে যাবে তার আগেই বর্ষা ঝড়ের গতিতে ছুটে তূর্য এর পায়ের কাছে বসে পরলো। আর তূর্যের পা দুহাতে জাপ্টে ধরল।
বর্ষার আচমকা কান্ডে তূর্য থমকে গেলো। বর্ষা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘ আমাকে মাম্মার কাছে নিয়ে চলুন প্লিজ। আমি আপনার পায়ে পড়ছি। আমাকে একটা বার মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিন।’
বর্ষার কথায় প্রেক্ষিতে তুর্য কিছু বলল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বর্ষা কাঁদতে কাঁদতে অনেক কাকুতি-মিনতি করতে লাগবে। বর্ষার কান্নার কাকুতি মিনতি তে তূর্যের ওপর কতটা প্রভাব ফেলল বোঝা গেল না। বর্ষা হেঁচকি দিয়ে কাঁদছে। সামনে দাঁড়ানো এই পাথরের মত শক্ত মানুষটার দিক থেকে কোন আশার আলো পেলো না। পা ধরে থাকা অবস্থায় অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা তুলে পাষাণ হৃদয়ের লোকটার দিকে তাকালো।
বর্ষা নিজে থেকে পা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এই লোকটার সামনে শত চোখের জল ফেলে কাকুতি-মিনতি করলেও তার কিছু আসবে যাবে না। বর্ষার চোখের জল কষ্ট এসব এই লোকটার জন্য সুখ ছাড়া আর কিছুই না। অর কষ্টে লোক আরো আনন্দিত হয়। বর্ষা উঠে দাঁড়িয়ে এই পাষাণ লোকটার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে একাধারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
তূর্য বর্ষার হাতের কব্জি ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিলো। বর্ষা হাত ছাড়ানোর জন্য ছটফট করে বললো,
‘ ছারুন আমাকে।’
বিছানায় বসিয়ে বর্ষার হাত ছাড়লো আর একদম বর্ষার মুখোমুখি হয়ে বসলো তূর্য।
‘ মায়ের সাথে কথা বলতে চাও! তাকে দেখতে চাও! তার কাছে যেতে চাও!’
বর্ষা তূর্যের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ হ্যা চাই। আপনি কি আমার চাওয়া পূরণ করবেন?’
তূর্য বর্ষার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘অবশ্যই করবো। করবো না কেন? আমি অতটাও খারাপ না।’
বর্ষায় স্তম্ভিত হয়ে বললো, ‘; আপনি খারাপ না?’
‘খারাপ হলেও তো নিজে নিজেকে খারাপ বলতে পারিনা। তাইনা।’
‘ভালো ও বলতে পারেন না। আপনার মত খারাপ আমি জীবনে আর একটাও দেখি নাই। আমার দেখা সব থেকে খারাপ লোক আপনি।’
‘ জানি। তো তুমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাও। আমি তোমার এই ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারি। কিন্তু তার জন্য আমার ইচ্ছাটা ও তোমায় পূরণ করতে হবে। দশ মিনিট এ জানাও রাজি কিনা। তুমি রাজি হলে আজ তোমার মা বেঁচে যাবে। আর তুমি রাজি না হলে হয়তো আর কখনো মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ পাবে না।’
‘ মানে? কি বলতে চাইছেন?’
‘এত কথার উত্তর দিতে পারব না রাজি কিনা তাই বলো। দুই মিনিট চলে গেছে অলরেডি।তোমার মা তোমার জন্য পাগলামি করছে। সে তোমার সাথে কথা বলতে চায়। না পারলে হয়ত আর বাচবেনা তাই সিদ্ধান্ত তাড়াতাড়ি নাও। ‘
বর্ষা ফোন নেওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘ফোনটা দিন প্লিজ আমি মাম্মার সাথে কথা বলবো।’
‘নো আগে বলো রাজি কিনা!’
‘এমন একটা কাজে আমি কি করে রাজি হব আপনি বলেন?’
‘আই ডোন্ট নো! তোমার কাছে কি নিজের জীবন বড় নাকি মায়ের?’
‘অফকোর্স মাম্মার।’
‘তাহলে এত কি ভাবছো রাজি হয়ে যাও।’
বর্ষা চোখ বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো বুকের ভেতর টা ওর যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে মাম্মার জন্য। এদিকে তূর্য তাকিয়ে আছে বর্ষার বিধ্বস্ত মুখটার দিকে।
ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,’ আর এক মিনিট আছে।’
বর্ষা চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় নিজের পাতলা শুকনো কাঁপা ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
‘আমি রাজি।’
রাজি কথাটা শুনে তূর্য ঠোঁটের কোনে হাসি চলে এলো। সেই নজরকাড়া সুন্দর হাসিটা হাসল তূর্য। বর্ষা চোখ মেলে সেই হাসিটা দেখলো। এই হাসিটা দেখলে ওর মন ভালো হয়ে যায়। এই সুন্দর হাসিটা হাসলে মনে হয় না এই লোকটা এত খারাপ। তার মনে দয়া মায়া কিছুই নাই। এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। কিন্তু লোকটা সেই সবি।
তূর্য এগিয়ে এসে বর্ষার গা ঘেঁষে বসলো। আর বললো,
‘ আমি জানতাম তুমি আজকে রাজি হবে। গুড গার্ল।’ বলেই মাথা হেলিয়ে বর্ষার ঠোঁটের উপর হালকা চুমু খেলো।
বর্ষা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলো। তূর্য সরে আসতেই বললো,
‘ মাম্মার কাছে নিয়ে চলেন।’
তূর্য নিজের ফোন বের করে কাউকে কল করলো। ফোনে কানে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ফোনের লোকটাকে কিছু বলে কল কেটে দিলো। আবার এগিয়ে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসলো। বর্ষা বুঝতে পারছে না কি করছে তূর্য ওকে নিয়ে যাচ্ছে না কেন মাম্মার কাছে। তূর্য ল্যাপটপে কি যেন করলো তারপর বর্ষার সামনে ল্যাপটপ রেখে বললো,
‘এখন তোমার মায়ের সাথে কথা বলো কলে। আরেকটা কথা আলতু ফালতু কথা বললে কিন্তু কল কেটে দেওয়া হবে আধা ঘন্টা টাইম দিলাম। যত ইচ্ছা কথা বলো।’
বলেই তূর্য বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
বর্ষার কথা বলল না। মায়ের সাথে এতো দিন পর কথা বলতে পারবে সেটা ভেবে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। 2 সেকেন্ডের মধ্যে মায়ের মুখটা ল্যাপটপে ভেসে উঠলো। বর্ষা মায়া ভরা চোখে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের চোখ বন্ধ তিনি ঘুমিয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে বর্ষার মায়াবী মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তূর্য। বর্ষার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। বর্ষা কাঁপা গলায় মাম্মা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। বর্ষার মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
বর্ষা একাধারে ডেকে চলেছে। মেয়ের ডাকে মায়ের ঘুম তাড়াতাড়ি ছুটে গেলো। বর্ষার মায়ের কাছে তূর্য এর দুই লোক আছে । একজন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে আরেকজন ফোন হাতে বর্ষার মায়ের বেডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষার মা চোখ মেলে ফোনের স্ক্রিনে নিজের মেয়েকে দেখতে পায়। মেয়েকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,
‘ আমার বর্ষা মা।’
মায়ের কন্ঠ শুনে বর্ষার চোখ জলে ভড়ে উঠে। কান্না চলে আসে ওর ও কাঁদতে যাবে তখন তূর্য এর দিকে চোখ যায় কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। ও তাকাতেই ইশারায় কান্না করতে মানা করে,
বর্ষা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নেয়।
‘ মাম্মা তুমি এত অসুস্থ হলে কিভাবে? আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করছো কেন? আমি একদম সুস্থ আছি আর খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে চলে আসবো। তুমি আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করো না আমার কষ্ট হয়।’
‘ তুই আমার কাছে আয়। কোথায় তুই? কোথায় থেকে ফোন দিছিস?’
‘এখন বলা যাবে না। আমি এসে সব তোমাকে বলব। তুমি আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।’
দুজনের মাঝে কথা চলতে লাগলো। আধা ঘন্টার বেশি চলে গেছে। বর্ষা আর ওর মা কথা বলেই যাচ্ছে। চল্লিশ মিনিট হতেই কল কেটে গেলো। বর্ষা রাগ নিয়ে তাকালো তূর্য এর দিকে,
‘ আধা ঘন্টা কথা বলার কথা বলেছিলেন কেটে দিলেন কেন?’
‘ চল্লিশ মিনিট বলেছো!’ গম্ভীর গলায় বলল তূর্য।
#তুমি_যে_আমার🥀
#Writer_Nondini_Nila
#Part_15
বর্ষার মায়ের জ্ঞান ফিরতেই তিনি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। তার বর্ষার সাথে কথা হয়েছে।বর্ষা তার সাথে কথা বলেছে, বর্ষা সুস্থ আছে, আর খুব তাড়াতাড়ি তার কাছে চলে আসবে। এই একটা কথা বলে তার চোখমুখ উজ্বল হয়ে উঠছে। এজন্য তিনি লাইফ রিক্স থেকে ও বেরিয়ে এসেছে। ডাক্তাররা এতে আনন্দিত কারণ তিনি খুব তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।কিন্তু তার এই উল্টাপাল্টা কথা শুনে তারা ধারণা করছে বর্ষার মায়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে মেয়ের চিন্তায়। তাই তিনি উল্টাপাল্টা কথা বলছেন।নিবিড় চৌধুরী চিন্তিত মুখে হসপিটাল কডিটড়ে বসে আছে। স্ত্রীর এমন অবস্থায় তিনি খুবই আশাহত হয়েছে। একদিকে মেয়ে নিখোঁজ আরেকদিকে স্ত্রীর এসব পাগলামো। ওনার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
উঠে দাঁড়ালো ডাক্তারকে দেখে। ডাক্তার চিন্তিত মুখে এগিয়ে এলো নিবিড় চৌধুরীর সামনে। তারপর তার সাথে করে নিবিড় চোধুরীকে নিজের কেবিনে নিয়ে এলো।
‘কি অবস্থা দেখলেন ডক্টর?’
‘শরীরের কন্ডিশন তো এখন ভালো কোন রিক্স নাই আল্লাহর রহমতে। কিন্তু ওনার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে উনার মাথায় প্রবলেম হচ্ছে। কিন্তু এমন তো হবার কথা ছিল না। কিন্তু অনেক সময় এমন অনেক ঘটনাই ঘটে যা আমরা বুঝতে পারি না।’
‘এখন কি হবে?’
‘মিস্টার চৌধুরী আপনি চিন্তা করবেন না। উনি মেয়েকে নিয়ে বেশি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। এজন্য উনি ভাবছেন উনার মেয়ে এখন উনার সাথে আছে। যেটাই ভাবে ভাবতে দিন উনি এখন সুস্থ আছে। এভাবে থাকতে দিন আপনাদের মেয়ে ফিরে আসলে এই সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।’
নিবিড় চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ডাক্তারের সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে নিজের স্ত্রীর পাশে এসে বসলো। বর্ষার মা নিজের স্বামীকে দেখে হাত বাড়িয়ে স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
‘তুমি জানো বর্ষা আমার সাথে কথা বলেছে। আমার মেয়ে সুস্থ আছে আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। ও বাড়ি আছে।’
ডাক্তার বলেছে উনি যা বলে তাতে সায় দেওয়ার জন্য এজন্য নিবিড় চৌধুরী মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
‘তাহলে চলো কতদিন মেয়েকে দেখি, না ছুঁয়ে দেখি না। ওকে আজ নিজের হাতে খাইয়ে দেবে।
‘আমি শান্ত হও! রেস্ট নাও! এখন যাওয়া যাবে না। তুমি অসুস্থ।’
‘আমি ঠিক হয়ে গেছি। এখন আমি বাড়ি যেতে পারব! আমি আমার মেয়ের কাছে যাব।’
‘ জেদ করো না। দুইদিনের তো ব্যাপার তাই একটু সহ্য করো। না হলে বর্ষা নিজে তোমাকে বকে আবার হসপিটালে পাঠাবে কিন্তু। বর্ষা তোমাকে হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে যেতে বলেছে বাড়িতে। না হলে খুব রেগে যাবে। আর তুমি তো বর্ষার জেদ সম্পর্কে অবগত আছ।’
মেয়ের কথা শুনে আর বর্ষার মা আর কিছু বলল না। মেয়ের জেদ সে জানে। মেয়ে যদি এ কথা বলে থাকে তাহলে বাড়ি ফেরা মানে ঘোর বিপদ। থাক দুদিন পরে বাড়ি ফিরবো। মেয়ে তো সুস্থ আছে এইটাই তার জন্য অনেক।
স্ত্রীকে বুঝিয়ে নিবিড় চৌধুরী কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
.
নিদ্রা কে কোন কাজই করতে হয় না। শাশুড়ি মা এবং পরিবারের সবাই ওকে মেয়ের মত ভালবাসে। পরিবারের ভালোবাসা ও পায়নি। তাই একটা পরিবার পেয়ে ও খুবই খুশি। এতো ভালোবাসা দেখে বারবারই ওর চোখে জল চলে আসে। এই পরিবারটা ও কখনো হারাতে চায় না। সব সময় এই পরিবারে ভালো বউমা হয়ে থাকতে চাই। সবার খেয়াল রাখতে চাই। সবার ভালোবাসা চায় তার সাথে অভ্রের ভালবাসাও চাই। আল্লাহ কি ওর এই আশা পূরণ করবে কখনো? উপর থেকে হসপিটালে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েই নিচে এসে। সোজাও রান্না করে চলে গেল শাশুড়ি মার সাথে খাবার টেবিলে এনে রাখল। শাশুড়ি মা এসব করতেন না করল কিন্তু ও শুনল না। কোন কাজ তো করে না সারাদিন হসপিটালে থাকে। এসেও ক্লান্ত থাকায় গোসল সেরে শুয়ে পড়ে। এর মাঝে যেটুকু সুযোগ পায় ও করতে চায়।
খাবার টেবিলে রাখা সময় অভ্রের দাদি এল নিচে। আর এসেই সোফায় বসে পান চিবোতে চিবোতে বলল,
‘ওরে মাগো নাতবৌ দেহি রান্নাঘরে পা রাখছে।’ টিটকারি মালা গলায় বলল।
এই বাসায় একজন মানুষই নিদ্রাকে সহ্য করতে পারে না তার কারণ হচ্ছে নিদ্রা কেন জব করে। বিয়ের পরে এত চাকরি-বাকরি করতে হবে কেন? আগে যা করছে করেছে বিয়ের পর এসব ছেড়ে দেয়া উচিত। স্বামীর দেখভাল করবে সংসারে কাজ করবে। বউ কেন চাকরি করতে বাইরে যাবে। এসব তিনি একদম পছন্দ করেন না।বিয়ের পর প্রথম যেদিন হসপিটালে যাচ্ছিলো সেইদিন তিনি এসব বলেছে।নিদ্রা পরিবার চায়, এই ঘর চায়, স্বামী চায় কিন্তু ওর নিজের স্বপ্ন রেখে না। ওর বাবার স্বপ্ন ছিল যে ও যেন ডাক্তার হয়। মানুষের সেবা করবে।সেই কথাটা মাথায় রেখেও ডাক্তার হওয়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছে। যত কঠিন মুহূর্তে এসেছে ও নিজের লেখাপড়া ব্যাঘাত ঘটায় নি। ক্যারিয়ার নিয়ে সব সময় সিরিয়াস ছিল। অনেক যুদ্ধের পর ও নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করেছে। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজের স্বপ্ন ছাড়তে পারবে না কিছুতেই।অভ্র আমাকে সত্যি বউ হিসেবে মেনে নিলে কি বলতো আমি জানিনা। কিন্তু সেই দিন আমার পাশে থেকে সবাই কে বলেছিল,
‘আমার ব্যক্তিগত জীবনে যেন কেউ হস্তক্ষেপ না করে।’
পরিবারের সবার সামনে ও আমার পাশে দাঁড়ানোতে। আমি সত্যিই এতটা আনন্দিত হয়েছিলাম ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আচ্ছা ও যদি আমাকে ভালোবাসতো, বউ হিসেবে গ্রহণ করতো, তাহলে কি এইভাবে আমার পাশে থাকতো?
সেই দিন রাস্তায় গিয়ে আমাকে বলেছিল,
‘কিছু মনে করিস না নিদ্রা তুইতো আমার বাড়ির বউ না আমার জন্য তোর নিজের জব ছাড়ার কোন প্রশ্নই আসে না! কয়দিনই বা তুই এখানে থাকবি ওদের কথা কানে নিস না।’
আমি মাথা নেড়ে দিয়েছি শুধু আমার মনে মনে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল আচ্ছা আমি যদি তোর বউ হয়ে সারা জীবনের জন্য এখানেই থাকি তাহলে কি তুই আমার জবটা মেনে নিবি না। তখন কি তুই আমাকে জবটা ছেড়ে দিতে বলবি?
কিন্তু পারিনি জিজ্ঞেস করতে। আজকে আবারো উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছে।
‘মাইয়া মানুষের বিয়া হইবো স্বামী, সংসার, সন্তান নিয়ে থাকবো তাদের এত চাকরি করান লাগবো ক্যান। এখনকার বউগুলা বাড়িতে থাকব না তাদের স্বামীর লাগান বাইরে কাজ করন লাগবো। কি দিন আইলো!’ বলে মুখ বাকালো।
অভ্র কে দেখে তিনি কথা বন্ধ করে দিল। অভ্র আসার পর বাসার সবাই খাবার টেবিলে খেতে বসে পরলো। আমি ও বসে পড়লাম হসপিটালের সময় হয়ে আসছে। এক লোকমা খাবার মুখে দিতেই কলিং বেল বেজে উঠল, এই সময় আবার কি আসলো? ব্রু কুঁচকে আমি সে দিকে তাকালাম ওঠতে যাব তখন শাশুড়ি মা আমাকে থামিয়ে দিলো আর নিজে চলে গেল দরজা খুলতে।
খাবার খাচ্ছি আর একটু পর পর ওই দিকে তাকাচ্ছি কে এসেছে দেখার জন্য! দুবার তাকানোর পরও কাউকে দেখলাম না কি যেন কথা হচ্ছে কন্ঠটা আমার কেমন চেনা চেনা লাগছে। চেনা লাগছে বিধায় আরো বেশি করে তাকাচ্ছি। হুট করেই তিনজন মানুষকে দেখতে পেলাম। যাদের দেখে দেখে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। আমি হাতে খাবার তুলে ছিলাম আমার হাত থেকে খাবার পড়ে গেছে আমি ওইভাবে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। এরা এখানে কি করছে? তারা চেচামেচি করতে করতে ভেতরে চলে এলো। আর আমাকে দেখে তো চিৎকার করে উঠলো পাশে থাকা আরিয়ান ভাই।
আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে ভয়ে।
.
‘ আমার মাম্মা এখন কেমন আছে?’ বর্ষা তূর্য এর দিকে তাকিয়ে বলল।
তূর্য ফোনের কিছু করছিলো বর্ষার কথা শুনে ও মাথা উঁচু করলোনা। ফোনের দিকে নিজের দৃষ্টি রেখেই বলল,
‘ বেঁচে আছে।’
‘এটা কেমন উওর? আমার মাম্মা সুস্থ হবে তো তার কোন রিক্স নাইতো আর? বলেন।’
‘আমি ডাক্তার না ওকে! আর বললাম তো বেঁচে আছে। বেঁচে আছে মানে সে সুস্থ আছে। মরবে না চিন্তা করো না। ‘
শান্ত গলায় বললো।
বর্ষা রেগে উঠে দাড়ালো আর তূর্য এর সামনে এসে দাড়িয়ে বললো,
‘এত ত্যারা ব্যাকা কথা বলেন কেন? আর মরবে কেন আর একবার আমার মাম্মার মৃত্যুর কথা বললে আপনাকে আমি খুন করে ফেলবো।’
তেজী গলায় বলল বর্ষা।
তূর্য এবার ফোন থেকে মাথা তুলে বর্ষার মুখের দিকে তাকালো। তেজী মুখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্য বিরক্তিকর মুখে বললো, ‘তুমি আমাকে খুন করবে?’
‘হ্যাঁ করব!’ সাহসী গলায় বলল বর্ষা।
তুর্য উপহাস গলায় বলল, ‘তোমার মত ভীতুর ডিম একটা মেয়ে তূর্য কে খুন করবে। রিয়েলি! খুব মজা পেয়েছি তোমার কথা শুনে।’
বলেই তূর্য হা হা করে হাসতে লাগলো। বর্ষা তূর্য এর হাসির দিকে তাকিয়ে আছে রাগে ওর গা জ্বলে যাচ্ছে। এ হাসি দেখলে প্রতিবার ও ঘায়েল হয় আজকে ঘায়েল হলো না। ওর রাগ আরো বেড়ে গেল। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ঝাঁপিয়ে পড়ল তূর্য এর উপর। তূর্য বর্ষার রুমের সোফাতে বসে ছিল। বর্ষা তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তূর্য এর হাতে ফোন ছিল। বর্ষা ফট করে একদম তূর্যের কাছে চলে গেল আর দুই হাতে তূর্যের গলা চেপে ধরলো। রাগে ওর চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।
‘আমার বাবা মাকে নিয়ে বাজে কথা বললে। তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করলে। আপনাকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলবো।’
বর্ষা নিজের নরম তুলতুলে হাতে তূর্যের গলা চেপে ধরেছে। তূর্য তাতে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে না। বরংচ মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বর্ষার রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে গলা টিপে ধরেছে বর্ষা। তবুও লোকটা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে পাগল নাকি লোকটা? রাগ কমে এলো বর্ষার। বিশ্মিত হয়ে তূর্য এর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি লোকটাকে খুন করতে চাইছি আর লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে কি কান্ড! ও বোকা চোখে তাকিয়ে আছে। ওর হাতের বাধন আগলা হয়ে এলো। তূর্য তা দেখে বললো,
‘কি হলো বর্ষা মনি? তোমার শক্তি সব ফিনিশ হয়ে গেল নাকি?’ হাসিমুখে বলল তূর্য।
বর্ষা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে। ও কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।ওর হাত-পা ছোঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে এই লোকটাকে কোনভাবে শায়েস্তা করা যায় না। সবকিছু বানচাল হয়ে যায় কেন? বর্ষা হাত নামিয়ে ফেলল তূর্য এর গলা থেকে। রাগের মাথায় ও একদম তূর্য কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি। তূর্য এর মাথা ওর শরীরের সাথে মিশে আছে। ও ফট করে সরে আসতে চায়। কিন্তু তূর্য তা দেখে ফোন পাশে রেখে হাত দিয়ে বর্ষাকে উল্টা করে নিজের সাথে চেপে কোলের উপর বসিয়ে দেয়। বর্ষার পিঠ তূর্য এর বুকের সাথে মিশে আছে। তূর্য দুইহাতে বর্ষাকে জাপ্টে ধরে আছে। বর্ষার পেটে দুইহাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে তূর্য। তূর্য নিজের থুতনি বর্ষার কাধের উপর রেখে বলে,
‘কি বর্ষা মনি খুন করতে পারলে না। সো স্যাড!’
আফসোস গলায় বলল তূর্য।
বর্ষা ছটফট করছে ছাড়া পাওয়ার জন্য তূর্য তাতে আরো শক্ত করে চেপে যাচ্ছে ওর দু হাত।
‘আমি কিন্তু এখন তোমাকে টেনে আমার কাছে আনিনি বর্ষামনি। তুমি নিজে এসেছ স্বেচ্ছায়।তাই এখন ছটফট করে লাভ নাই। আমি না চাইলে তুমি আমার থেকে মুক্ত হতে পারব না। আমার গলা টিপে ধরার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে বর্ষা মনি।’
তূর্য বর্ষার কাধের কাছে মুখ রেখেই ফিসফিস করে বলে কথা গুলো। তূর্যের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে কাঁধে। বর্ষার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে। ছটফট করে ও লাভ হচ্ছে না। এই খাম্বার মত শক্ত লোকটার থেকে ও নিজেকে ছাড়াতে পারবে না। লোকটা যদি নিজে থেকে না ছাড়ে। আচমকা নিজের ঘাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো বর্ষা। ব্যথায় ও মৃদু চিৎকার করে উঠলো। ব্যাথায় ওর চোখের কোনায় জল চলে এলো। ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে আছে বর্ষা। তূর্য বর্ষার কাঁধে কামড়ে ধরেছে শাস্তি স্বরূপ।
#চলবে……
( আজ অনেক বড় পর্ব দিলাম সবাই বড় বড় কমেন্ট করবেন না হলে আর বড় পর্ব দিমু না হু। গল্পের অনেককিছুই আপনারা বুঝতে পারছেন না তা খুব শিগ্রই জানতে পারবেন। ইনশাল্লাহ।)
#চলবে