বেলাশেষে পর্ব -১০

#বেলা_শেষে। [১০]

-আপনি এখানে কি করছেন?? তড়িৎগতিতে ভূমিকার ছুঁড়ে দেওয়ার প্রশ্নের কোন জবাবই দিলো না আরাভ। মাথা দুলিয়ে স্মিত হাসলো সে। ভূমিকা ভ্রু কুচকিয়ে সেই হাসির দিকে তাকালো। দু-দু বার প্রশ্ন করার পরেও কোন জবাব দিলো না আরাভ। বিনিময়ে মৃদু হাসলো। ভূমিকা ভেবে পায়না এখানে হাসির কথা কি বলল সে।

-আপনি এখানে কি করছেন?? আরাভের প্রশ্নের জবাব তড়িৎগতিতে দিলো ভূমিকা।

-অপেক্ষা করছি।

আরাভ ভ্রু কুচকিয়ে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলল। ওর মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। ভূমি এখানে কার জন্যে অপেক্ষা করছে। ভূমিকা হয়তো আরাভের চাওনিটা বুঝতে পারলো। তাই সে বলে ফেলল,

-রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছি। বাসায় ফিরবো তো তাই।
ভূমিকার কথা শুনে বড় করে শ্বাস ছাড়লো আরাভ। এতক্ষণ মনে হয় তার দমটা গলায় আটকে ছিলো। ঠোঁটের কোনে কিন্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো। অধরে হাসি ফুটিয়ে বলল,

-আমি ড্রপ করে দিবো। না, যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

-আমি কেন আপনার গাড়িতে যাব হুম। একটু পর দেখবেন এদিকে রিক্সার লাইন লেগে যাবে। আপনি যান না যেখানে যাচ্ছিলেন যান।মাথা চুলকালো আরাভ। আর মনে মনে বলল,

-জানতাম মেডাম কিছুতেই আমার গাড়িতে যাবেন না। তাতে মেডামের ইগো হার্ট হবে কি-না। অতঃপর আরাভ ভূমিকার জন্যে একটা রিক্সা ডেকে আনে। ভূমিকা সে রিক্সাতেই উঠে বসে। রিক্সাওয়ালা তার রিক্সা চালিয়ে ছুটছে। পিছনে থেকে আরাভ তাকিয়ে আছে সেই রিক্সার দিকে। যতক্ষণ না চোখের আড়াল হলো আরাভ তার দৃষ্টি নামালো না। রিক্সাটি আরাভের দৃষ্টির অগোচর হতেই স্মিত হেসে বুকের বা পাশটাতে হাত রাখলো। উপর দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলে উঠলো,

-অপেক্ষার শেষটা একদিন সুন্দর হবে, ক্লান্ত হৃদয়টাও একদিন প্রশান্ত হবে, প্রার্থনার আওয়াজ গুলোও একদিন কবুল হবে । দু-ঠোঁট প্রসারিত করে ভূবন ভুলানো হাসি হাসলো আরাভ। তারপর নিজের গাড়িতে করে চলল তার গন্তব্যে।

রিক্সাটি এসে এগারোতলা একটা বিল্ডিং এর সামনে থামালো। ভূমিকা রিক্সা থেকে নেমে তার বাসার দিকে চলে গেলো। এদিকে কেও ওকে ফলো করতে করতে ওর বাসা পর্যন্ত এসেছে সেটা বুঝতেই পারলো না ভূমিকা। ভূমিকা চলে যাওয়ার পর অঞ্জাত ব্যক্তি মাথা থেকে হেলমেড খুলে পৈশাচিক হাসি হাসলো। হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে নিচের ঠোঁটের কোর্নারে স্লাইড করে নিলো।

আজ রাতে দিগন্ত একটু লেট করে বাসায় ফিরে। একে একটু লেট বলে না। রাতের বারোটা বাজে।তবে শহরের মানুষের কাছে এইটুকু সময় লেট করে বাসায় ফেরাটা কোন ফ্যাক্টই না।
গ্রামের সাধারণ মানুষরা যখন সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় তখন শহরের আধুনিক মানুষেরা ছুটে যায় ডিক্সে, নাইট ক্লাবে। সেখানে নাচে গান গায় ড্রিংক করে তারপর মাতাল হয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে। এটাই এখন শহরের উচ্চবিত্তদের পরিবারে কালচার। পরিবারের কোন সদস্য এই নিয়মের বাইরে গেলে তাকে গাইয়্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। দিগন্ত আজ গভীর রাতে বাসায় ফিরে। এই নিয়ে মাশহুদ তালুকদার দিগন্তের সাথে অনেক রাগারাগি করে। তার ধারনা রাতে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি না করে সঠিক সময়ে ঘুমিয়ে যাওয়া ভালো। এটা স্বাস্থের জন্যে অনেক ভালো।
সব চেয়ে বড় বিষয় হল, শরীর ও মস্তিষ্ক দু’টিকে সতেজ রাখতে পর্যাপ্ত ঘুমের কোনও বিকল্প নেই। এটি মানসিক শান্তি ও সুস্থতা বজায় রাখার পাশাপাশি শারীরিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। যথাযথ ঘুম না হলে অস্বস্তি, বিরক্তিভাব এমনকি ঘন ঘন রাগ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। অর্থাৎ অনিদ্রা মানুষের আচরণগত দিককেও প্রভাবিত করে।

মাশহুদের যুক্তিতে কোন ভুলনেই। তাই বাধ্য ছেলের মতো মাথা নতকরে বাবার সব কথা হজম করে নেয় দিগন্ত। ভূমিকা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মাশহুদের কথা শুনছিলো। দিগন্তের এমন অসহায় মুখ দেখে খুব হাসি পাচ্ছিলো ভূমিকার। মুখে যতই ফটফট করুক না কেন বাবার সামনে সে ভেজা বেড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর বাহিয়ে নিজেকে শের মনে করে। ভূমিকার এখন বলতে ইচ্ছে করছে বাঁশ বাগানের শেয়াল রাজা দিগন্ত তালুকদার।

ফ্রেশ হয়ে সোজা টেবিলে বসে দিগন্ত। কিন্তুু পড়াতে মন বসে না তার। পেটে ক্ষুধা থাকলে কোন কাজে মন বসে নাকি। আজ রাতে আর খাওয়া হলো না তার। মাশহুদের দেওয়া ঞ্জান শুনেই পেট ভরে গেছে তার। এখন খাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। এদিকে ক্ষুধায় পেটের ভিতরে ইদুর লাফাচ্ছে। উহঃ এক কাপ কফি হলেও মন্দ হতো না। চোখমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে দিগন্ত এমনি সময় কেও তার সামনে চায়ের কাপ ধরলো। দিগন্ত সেই হাত লক্ষ করে সামনে তাকালো, ভূমিকা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠোঁটের কোনে দুষ্ট হাসি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে দিগন্ত। দিগন্ত ভ্রু কুচকিয়ে প্রশ্নের দৃষ্টিতে ভূমিকার দিকে তাকালো। ভূমিকা ভ্রু নাড়িয়ে বলল,

-পেটে কিছু পরে নি তাইনা। দিগন্ত ভূমিকার কথার কোন জবাব দিলো না। চায়ের কাপ নিয়ে সেটাতে ওষ্ঠদ্বয় ছোয়ালো।তারপর বলল,

-বিস্কুট থাকলে নিয়ে এসো খুব ক্ষিদে পেয়েছে।

-বাবা এতো দেখি বসতে দিলে থাকতে চায়। শুনুন চা করে দিয়েছি এটাই অনেক। আর তাছাড়া আপনার কাজ করে দিলে তাতে আমার লাভ কি?? ভূমিকার কথা শুনে ভ্রু কুচকিয়ে কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলল দিগন্ত। ভূমিকার কথা কেমন জানি রহস্যে ঘেরা। লাভ ক্ষতির হিসাব করছে, তবে কি ভূমিকার কিছু লাগবে।

-কি চাই তোমার। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল দিগন্ত।

-আমি যা চাইবো তা দিবেন বলুন। উৎসাহ নিয়ে বলল ভূমিকা। দিগন্ত কিছুক্ষণ মৌনতা অবলম্বন করলো।অতঃপর মৌনতা ভেঙে সে বলল,

-ওকে, বলো কি চাই তোমার।

-আমাকে কয়েকটা টিউশন যোগাড় করে দিবেন। মৃদু হেসে বলল ভূমিকা।

-মানে, চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে বলল দিগন্ত। তোমাকে টিউশন যোগাড় করে দিবো আমি। কেন তুমি কি টিউশনি করবে নাকি।

-না আপনার জন্যে খুঁজতেছি। যত্তসব। হ্যাঁ আমি টিউশনি করবো। ভূমিকার কথায় কিছুটা রেগে গেলো দিগন্ত।

-তুমি টিউশানি করবে মানে। তোমার টাকার দরকার সেটা আমাকে বলতে প্রবলেম কি হ্যাঁ। কত টাকা লাগবে তোমার আমাকে বলো। কোন টিউশানি করবে না তুমি।
বলো কত টাকা লাগবে তোমার।

-আমার কোন টাকা লাগবে না মিস্টার দিগন্ত। দু-হাত উঠিয়ে দিগন্ত থামানোর চেষ্টা করে বলল ভূমিকা। আমার কোন টাকা লাগবে না বুঝছেন আপনি। এমনিতেই দিনের পর দিন আপনাদের কাছে ঋনি হয়ে যাচ্ছি। অস্বীকার করতে পারবো না আপনার জন্যেই আজ আমি এই এত বড় কলেজে পড়তে পারছি। এই ঋন কি করে শোধাবো আমি। আমি এই ঋনের বোঝা আর বাড়াতে চাই না। তাই বলছিকি আপনি আমাকে কয়েকটা টিউশানি যোগাড়করে দিন।

-আমি তোমাকে কোন টিউশানি যোগাড় করে দিবো না। আর না তোমাকে টিউশানি করতে দিবো। আমার দায়িত্বে তুমি ঢাকা এসেছো। আমি আমার সব দায়িত্ব পালন করবো। এই শহর সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নেই ভূমি। তুমি কোন টিউশানি করবে না ব্যস্। দিগন্ত আর কিছু বলল না। উঠে চলে গেলো বারান্দায়। ভূমিকা সেখানেই বসে তাকিয়ে রইলো দিগন্তের চলে যাওয়ার দিকে। তারপর সেও চলে গেলো বারান্দায়।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে এই ঘুমান্ত শহর দেখছে দিগন্ত। সারাদিনের কোলাহল পূর্ণ শহর যেন পৃথীবির বুকে রাত নামার সাথে সাথে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। চারিদিকে নিবিড় স্তব্ধ, কোথাও কোন মানুষ জনের ছায়াও নেই। চাঁদের জ্যোৎস্নায় জ্বলমল করছে শহরের বড় বড় রং বেরঙের দালানগুলো। বাহিরে দিকে তাকিয়ে ভাবছে দিগন্ত। ভূমিকা হঠাৎ কেন এতটা ইমোশনাল হয়ে গেলো। তখনি নিজের পাশে কারো উপস্থিত ফিল করলো দিগন্ত। দিগন্ত ঘুরে তাকালো না কারন সে জানে তার পাশে এখন ভূমিকা ছাড়া আর কেওই আসবে না।

-আপনি কি আমার সাথে রাগ করেছেন??

-তোমার কি মনে হয়না তুমি রাগ করানোর মতো কথা বলছো।

-আপনি আমার দিকটা বুঝতে পারছেন না।

-হয়তো না। কিন্ত তবুও আমি তোমাকে টিউশানি করতে দিবো না। এখন এসব চিন্তা মাথা তেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজের মনকে পড়াশুনায় ফোকাস করো।

-আচ্ছা ঠিক আছে। আর টিউশনি করার কথা বলবো না। এবার খুশি। ভূমিকা গভীর চোখে তাকালো দিগন্তের দিকে। যেটা দিগন্ত দেখতে পেলো না। দিগন্ত দেখবে কি করে সে তো তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ভূমিকার দৃষ্টি স্থির দিগন্তের মুখের দিকে। আর মাত্র কয়েকটা মাস তার পর থেকেই এই মানুষটাকে আর দেখতে পাবে না সে। দিগন্ত সেটেল হয়ে গেলেই ওদের সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটবে। ভাবতেই বুকের পা পাশটা চিনচিন করে ব্যথা করে উঠলো দিগন্তের। বাঙালি মেয়েরা আর যাই হোক স্বামীকে কারো সাথে ভাগ করতে পারে না। ভূমিকা সিদ্ধান্ত নিলো পরে যা হবে ভাবা যাবে। সে এখান থেকে কোথাও যাবে না। আর মন মরা হয়ে থাকবে না। আগের মতো নরমালি আচরন করবে সে দিগন্তের সাথে। ওকে জ্বালাবে হাসাবে আরো কত কি? দিগন্ত যখন থাকবে না এই স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরেই বাকিটা জিবন কাটিয়ে দিবে সে। কারন বাঙালি মেয়ের বিয়ে তো একটাই তাইনা।

-আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। যদি আপনার মনে আমার জন্যে একটু দয়া হয়। তাহলে খেতে দিবে কিছু?

-আমাকে কি কাজের লোক মনে হয় আপনার। কথাটা বলে সামনে তাকাতেই দেখে দিগন্ত ওর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। ভূমিকা তুতলিয়ে বলল,

-আ-আপনার ক্ষিদে পেয়েছে তো। আমি খাবার নিয়ে আসছি ওকে। তারপর তড়িৎগতিতে সেখান থেকে চলে আসে। দিগন্ত স্মিত হেসে বলে,

-আমি সিউর মেয়েটার মাথায় কোন গণ্ডগোল আছে। কে বলবে এতক্ষণ এই মেয়েটা ইমোশনালি কথা বলছিলো। যাই হোক মাথা থেকে টিউশানির ভুত নেমেছে এটাই অনেক।

রান্নাঘরে এসে প্লেটে খাবার সাজিয়ে নেয় ভূমিকা। তখনি ওর মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি আসে। সে তরকারিতে মরিচ আর ভাতে লবন মিশিয়ে নেয়। তারপর ঠোট কামড়ে বলে, আমাকে কাজের লোক বলা তাইনা এবার থেকে বুঝবে মজা। এই ভূমিকার সাথে পাঙ্গা নিয়ে এখনো কেও শান্তিতে বাঁচতে পারে নি। আর মিস্টার বাঁশ বাগানের শিয়াল রাজা আপনাকে তো কখনো শান্তিতে থাকতে দিবো না। ফুঁ দিয়ে কাপলের চুলগুলো উঁড়িয়ে দিয়ে খাবারের প্লেট হাতে চলে আসলো রুমে।

চলবে,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here