মন গহীনের গল্প পর্ব -৩৭+৩৮

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-৩৭
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞

ঘুমে ভাসা উন্মাদ বাতাস জেদে পড়েই যেন এলোমেলো করছে মেহউইশের চুল, শালের ভেতর লুকিয়ে থাকা ওড়নার কোণ আর তার ভেতরের চুপটি মেরে থাকা অনুভূতিকে। ছন্দপতন হয়ে গেছে রিশাদের বিষন্ন একাকীত্বে ভরপুর অনুভূতিরও। কি এক জাদুকরী মোহমায়া এই বালুচরে ফণা তোলা সাপের বিষের মত ছড়িয়ে পড়ছে শিরায় শিরায়, প্রতিটি রক্ত কণিকায়। আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে ধরছে নিজেকে কারো সান্নিধ্যে নিঃস্ব করতে। পায়ের গতি শ্লথ হয়েছে দুজনেরই সেই সাথে রাতও মোহনায় ঠেকেছে। রাত আর ভোরের মিলনমেলায় এসে হাওয়া উত্তেজিত করে তুলছে দুটি বিপরীতমুখী মানুষের ভেতর ছটফট করা আত্মাকে৷ প্রাণহীন এই তীরে প্রাণের স্পন্দন ঘোলাটে রাতকে আরও ঘোলা করে দিচ্ছে। মানুষের নিশ্চুপতা সমুদ্রের গর্জনকেও হার মানিয়েছিলো সেই নিঃশব্দতায় ইতি টেনে মেহউইশ কথা বলল।

-‘ অনেক তো হাঁটা হলো, একটু কি কোথাও বসা যায়?’ কথাটা বলেই তাকালো ঘাড় বাঁকিয়ে রিশাদের মুখের দিকে। আবছা অন্ধকার চোখ সয়ে গেছে আরও আগেই। এখন যেন স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে তার মুখাবয়ব।

-‘এখানে বসবে?’ বলেই চারপাশে তাকালো রিশাদ। বসার মত জায়গা খুঁজে একটু সামনেই চোখে পড়লো কলমিলতায় ভরা বালুচর৷

-ওদিকে চলো তবে ।

-নাহ।

ভ্রু জোড়া কুঁচকে জানতে চাইলো, ‘কেন?’

-‘ ওই লতায় ভর্তি বালুতে এই অন্ধকারে বসে সাপের কামড় খাবো নাকি!’ বাচ্চাসুলভ আচরণ পরিলক্ষিত হলো মেহউইশের এ কথায়। রিশাদের বুঝি একটু হাসিও পেল। ঠোঁট টেনে নিঃশব্দে একটু হেসে বলল, ‘ঠিক আছে তবে এখানেই বসি! কাঁকড়ার গর্তের ওপর আবার বসে পড়ো না যেন, নইলে কাঁকড়া আবার আদর করে কামড়ে ধরবে। ‘ হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রিশাদ। তার কথার ধরন যে একটু বাঁকা ছিলো আবার নেগেটিভও তা বুঝতে পেরে লজ্জা পেল । যাচ্ছেতাই লোক তো! রিশাদ বসে পড়েছে বালুর ওপর যেখানে দাঁড়িয়েছিলো সেখানেই । মেহউইশ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই তা দেখে রিশাদ আচমকা মেহউইশের বা হাতটা টেনে তাকেও বসিয়ে দিলো নিজের পাশে। অপ্রত্যাশিত এই টেনে বসানোতে মেহউইশ ভীষণ অবাক হলো এবং অবাকের রেশ কাটতেই ভালো লাগার হাওয়া লাগলো। কিছু সময় আবারও কাটলো নীরবে। এবার নীরবতার রাশ টেনে রিশাদ কথা শুরু করলো। তার দৃষ্টি সামনে ভাটার টানে পিছিয়ে সরে যাওয়া পানির দিকে৷ চোখ জোড়া উজ্জ্বল আর জলে চিকচিক করছে।

– ‘মেবিশ তুমি কি জানো, মা হারা মানুষগুলো খুব অসহায় হয়।’ নিঃশব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো মেহউইশ৷ পাশে বসা মানুষটার এই একটা বাক্য তীরের মত বিঁধলো তার বুকে৷ রিশাদ কি কাঁদছে!

-‘আমার মা মারা গেছেন আমার বোনের জন্মের সময়৷ আমার ঠিকঠাক মনে নেই মায়ের সাথে কাটানো সময় গুলো। বোনের জন্মের সময় হয়ে এসেছিলো আর সেসময়ই একটা দূর্ঘটনা ঘটলো। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়েই অসাবধনতায় পড়ে গেল মা। বোনটা নাকি মায়ের গর্ভেই মারা গিয়েছিলো এবং প্রচুর ব্লিডিংয়ের কারণে মাও বাঁচতে পারেনি। বাবা তখন বিদেশে ছিলেন বাড়িতে ফুপি ছাড়া কেউ ছিলো না। কাজের লোকের সাহায্য নিয়ে ফুপি মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যান । কিন্তু সময় হয়তো আল্লাহ্ ততটুকুই রেখেছিলেন তাই রক্ত দিয়ে, দেশের বেস্ট ডক্টরদের দেখিয়েও লাভ হয়নি৷ চলে গেছে আমায় ছেড়ে মা,বোন দুজনই। আমার জীবনের হাত বদলের শুরু সেই থেকে। কখনও ফুপি,কখনও খালা মানে রাইমার মা, কখনও কাজের লোক কাছে বড় হতে থাকলাম। তারপর যখন বয়স হলো বোঝার মত, পড়াশোনায় যখন হাই স্কুলে তখন থেকে বন্ধু বান্ধব হলো প্রচুর পরিমাণে। বাবার বিয়ে,ফুপির বিধবা হওয়া আর এসবে বাড়ির পরিস্থিতি এতোটাই বাজে হয়েছিলো যে আমি বোঝার বয়সে এসে আর কাউকেই কাছে পাইনি৷ বন্ধু বান্ধবের সঙ্গ আর বাবার টাকায় আমার জীবন চলতে লাগলো। বছরে দুটো দিনও ঠিকঠাক বাবার সাথে কাটানো হতো না আমার। ততদিনে আবার রাইমারও জন্ম হয়ে গেল। বাবা আমারই চোখের সামনে রাইমাকে সময় দিতে সব কাজ ফেলেই তার জন্মদিনে ছুটে আসতেন দেশে। প্রথম প্রথম হিংসে হলো ছোট বোনটির প্রতি তারপর একসময় বুঝতে পারলাম রাইমাও দুঃখী। ঠিক আমারই মতন৷’ থেমে গেল রিশাদ এতটুকু বলতেই কিন্তু মেহউইশ এখনও অপলক দেখছে তাকে। সে শুনতে চায় আরও কিছু, অনেক কিছু, এমনকি সবটাই৷ মেহউইশের এভাবে তাকিয়ে থাকা বুঝতে পেরেই রিশাদ বলল, ‘ সামনে তাকাও মেবিশ। মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে বলতে পারবো না কিছুই।’ টনক নড়লো মেহউইশের সে সত্যিই মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকালো।

-‘ রাইমা বাবার আদর দুই কি তিন দিন পেত বছরে৷ ওই যে তার জন্মদিনের সময় বাবা আসতো সেইটুকুই তার প্রাপ্তি বাকিটা সময় সে আমার মতোই জীবন কাটাতো৷ তার কারণ, খালা কখনও তাকে আদর করে কাছে ডাকতো না, একবেলা নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দিতো না। সে যখন জোর করে তার মায়ের হাতে খাওয়ার বায়না করতো তখন খালা তাকে দূর দূর করতেন। আমার চোখ এড়াতো না এগুলো৷ কষ্ট লাগতো তখন তার জন্য আর সুযোগ পেলে আমি নিজে তাকে ডেকে নিয়ে খাইয়ে দিতাম। সুযোগ পেলে তার মাথায় ঝুঁটি বেঁধে দিতাম আবার আমার কোন কথা না শুনলে প্রচুর মাির দিতাম। আর লক্ষ্য করতাম আমি তাকে অনেক মারলেও তার মা কখনও আমাকে কিছু বলতো না। তবে আমার লালন পালন নিয়ে অনেক কটুকথা বলতেন বাবাকে। ফোন করলেই আমার কিংবা রাইমার নাম নিয়ে কালসাপের বাচ্চা বলে গালি দিতেন৷ তখনও আমার অজানা ছিলো বাবার প্রতি খালার ক্ষোভের কারণ তাই আমিও অপছন্দ করতাম খালাকে৷ আর একমাত্র ফুপি সেও প্রায় আঠারো বছর বিদেশে ছিলেন৷ বাড়িতে আপন কেউ ছিলো না আমার, রাইমার। আমি যখন এস এস সি পরীক্ষা দেবো তখন বাবা দেশে এলেন। থাকলেন কয়েকমাস কিন্তু বাবার সাথে খালার কোন বনিবনা হলো না। বাবা আবার চলে গেলেন বিদেশে সেখানেই ব্যবসায় মজে গেলেন। তখন আবার খালা প্রেগন্যান্ট। রিহানের জন্ম হলো। মালা দাদাী আমাদের বৃদ্ধা কাজের লোক তিনি বললেন এবার সংসারে পরিবর্তন হবেই। সব ঠিক হবে কিন্তু না হলো না কিছুই। সময় গেল আপন স্রোতে কিন্তু পরিবর্তন শব্দটা আমাদের জীবনে অপরিচিতই রয়ে গেল।’

পূব আকাশ রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। ফজরের আযান হচ্ছে রিশাদের হোটেলের পাশের মসজিদটাতে৷ আযান শুনেই হয়তো রিশাদ কথা বন্ধ করলো মেহউইশও ওড়না টেনে এলেমেলো চুলগুলোকে আড়াল করে ঘোমটা টানলো। এত ভোরে হোটেলে সবাই গভীর ঘুমে আছে নিশ্চয়ই। হোটেলে ফিরলেও বসইরে বসে থাকতে হবে আর হোটেলের চেয়ে এখানে বসাটাই ভালো লাগছে মেহউইশের। সেই সাথে এই গম্ভীর, একরোখা, বদমেজাজী লোকটার মনের গহীনে লুকানো কথাগুলো শুনতেও ইচ্ছে করছে খুব। দুজনের বসার মাঝে কিছুটা জায়গা ফাঁকা ছিলো। অন্যদিকে মুখ করেই মেহউইশ সেই ফাঁকা জায়গাটুকুর দূরত্ব ঘুচিয়ে গা ঘেঁষে বসলো। রিশাদ অন্যমনস্ক সে হয়তো বুঝতেই পারলো না এই ঘুচানো দূরত্বটুকু। তবে উষ্ণতা একটু গায়ে লাগলো তার।

-আপনার খালা তো আপনাকে ভালোবাসে। আপনি কি তা জানেন?

-‘ হুম, জেনেছি অনেক পরে৷ তোমাকে বাড়িতে আনার ঠিক দুদিনের মাথায় আমার জানা হলো সৎ মা নামক খালাটা আমাকে খুব ভালোবাসে৷ সেই সাথে আমার ছেলেটাকেও।’ রিশাদ শেষের কথাগুলো বলার সময় মেহউইশের দিকে তাকিয়ে রইলো।

‘আমার ছেলেটাকেও’ আমার! কথাটা কানে বাজলো খুব মেহউইশের । ঠিক নয় মাস আগে মেহউইশকে জোর করে আনা হয়েছিলো রিশাদের জীবনে। শুধু মাত্র নির্জনের মা হতেই তো তার এ জবরদস্তির জীবনে থেকে যাওয়া তবুও শুনতে হলো নির্জন শুধু রিশাদের ছেলে। কেন? আমাদের ছেলে কি বলা যেত না! আবেগী হয়ে উঠলো মেহউইশ । চোখ ছলছল,কান্নার একটা ঢোক গলায় আটকে রইলো৷

-‘হোটেলে ফিরবে?’

-‘ এখন হোটেলে গিয়ে কি করবো?’

-হুম, করার কিছুই নেই। হয় গ্রাউন্ড ফ্লোর অথবা লনে বসে থাকতে হবে। তবে কি এখানেই বসে থাকবে?

-থাকি।

-আচ্ছা। কিছু খাবে?

-নাহ

-আশ্চর্যজনক তাই না!

-কি?

-আস্ত এক হোটেলের মালিক শেষরাতে বালুচরে এসে ঠাঁই নিয়েছে। ঘুমানোর মত জায়গা নেই তার আর তার স্ত্রীর৷

‘কে বলেছে নেই? তার না থাকলেও তার স্ত্রীর তো আছে৷ এই যে আপনার লম্বা চওড়া কাঁধটা এটাকে একটু নামিয়ে নিলেই তো হয়। আপনার স্ত্রী এই কাঁধে মাথা রেখে স্নিগ্ধ ভোরের আলোমাখায় হাওয়ায় দারুণ একটা ঘুম দিতে পারবে৷’ মনে মনে কথাটা ভেবেই লজ্জায় লাল হলো মেহউইশ। যতোই সে মনে মনে এসব ভাবুক না কেন মুখে বলার সাহস একটুও নেই৷ লালচে ভোরের লালিমাসিক্ত গাল দুটোকে দেখে কোমল ভোরটাকে উফভোগ করা থেকে বঞ্চিত হলো রিশাদ শুধুমাত্র দৃষ্টি সামনে থাকায়।

-‘ঘুম ঘুম লাগলে একটু চোখ বুঁজে বসতে পারো কাঁধে মাথা রেখে।’

এই এক ভোরেই এত পাওয়া কি করে সহ্য করবে মেহউইশ! মনে মনে যা সে ভাবছে তাই পেয়ে যাচ্ছে। ইশ, এখনই মাথাটা রাখবে কাঁধে! নাকি একটু ভাব দেখিয়ে নেবে? লোকটা আবার ছ্যাচড়া ভেবে বসবে নাতো! সেকি ছ্যাঁচড়া নাকি, গত নয় মাসে কত কিই তো করলো লোকটার ইচ্ছেতে এখন একটু না হয় সেও নিলো নিজের ইচ্ছে পূরণ করে৷ আর আজই কেন এমন ইচ্ছে হলো?

-নাহ, কাঁধে ব্যথা পাবেন।

-‘মাথা রাখো সমস্যা নেই৷ এখন চাইলেও হোটেলে ফিরে ঘুমানোর জায়গা পাবে না।’
কথা বাড়ালো না মেহউইশ। আরো একটু ঘেঁষে মাথাটা রিশাদের কাঁধে রাখলো। মেহউইশের কাঁধ নাগাল পেতে একটু কষ্ট হচ্ছে ভেবে পা ছড়িয়ে হাত পেছনে বালুতে ফেলে বসলো৷ মেহউইশের চোখে সত্যিই ঘুম ছিলো । শিরশিরে হাওয়ায় ঘুমটা আরো জেঁকে বসেছিলো চোখের পাতায়। সুযোগ পেয়ে ঘুমটা খুব গভীর হয়ে নেমে এলো চোখে৷ রিশাদ তাকিয়ে রইলো যতদূর দৃষ্টি যায়। অসীম সাগরে থেকে থেকে জাহাজ , ভেসে বেড়ানো নাম না জানা কিছু পাখির আনাগোনা। পর্যটকরাও বেরিয়ে পড়েছে ভোরবিলাসে। অনেকেই চলতে চলতে ফিরে চাইছে তাদের দিকে৷ অনেকটা সময় কেটে গেছে এভাবেই দুজনের৷ মেহউইশ ঘুমে আচ্ছন্ন রিশাদের কাঁধে । শরীরের উত্তপ্ততা রিশাদকে নাকাল করছে। ঘাড় ফিরিয়ে ঘুমন্ত মেহউইশের দিকে চেয়ে নিজেকে সাবধান করছে৷ অনুভূতির পোকারা কিলবিল করে কামড়ে ধরছে মনকে একটু পরশ নিতে ঘুমন্ত অধরের। ভয়ংকর যাতনায় নিজেকে সামলানো দায় হলো তার৷ ভাবনাদের ঠেলে দূরে সরানোর চরম চেষ্টা বিফলে গেল৷ ডান হাতে ঘুমন্ত মেহউইশের কাঁধ জড়িয়ে নিলো রিশাদ। আলতো করে বা হাতে মেহউইশের চিবুক ধরে মুখটাকে উঁচু করলো। এত গভীর ঘুম কি করে ঘুমায় মেয়েটা! কয়েক মুহূর্তে নিষ্পলক চেয়ে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো সে। নিজের দু’ঠোঁটের ভাঁজে মেহউইশের অধর চেপে চুমু খেল৷ খুব ধীরে, চুপিসারে খাওয়া চুমুটাতে স্বাক্ষী হতেই বুঝি জেগে উঠলো মেহউইশ তাকিয়ে রইলো তার আঁখিযুগল৷ কল্পনা না সত্যি! ভালোলাগা নাকি মোহ!
#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব -৩৮
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
ঘোর কাটেনি ঘুমের, উষ্ণ চুমুর আর অপার্থিব সৌন্দর্য মিশ্রিত ভোরের। নিষ্পাপ চাহনি মেলে রিশাদের দিকে তাকিয়ে থেকেই ডান হাতের মধ্যমা আর তর্জনী তুলে তার অধর ছুঁলো। সত্যিই কি রিশাদ এই মাত্র তাকে চুমু খেল! মুখ ফিরিয়ে অন্যদের আসা যাওয়া মনযোগে দেখতে লাগলো রিশাদ। সংকোচোর সমুদ্রের আকন্ঠ ডুবে গেছে তার। প্রথম, এই প্রথম সে সংকোচে কারও সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়েছে। আজই প্রথম তার ভেতরে জড়তার আকাশ নেমেছে মাথার উপর।মেহউইশ যখন একটু সরলো তখনি রিশাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।

-‘ফেরা দরকার।’

ঘোর কাটলো রিশাদের কথায়। উঠতে ইচ্ছে করছে না তার তবুও বলল, ‘ হুম।’

মেহউইশও উঠলো বসা থেকে ; কেউ কারো দিকে দেখছে না। কারো মুখের ছায়ায় কতোটা সংকোচ একটিবার মুখোমুখি দাঁড়ালেই দেখতে পেত। ভালোবাসা নাই’বা হলো ভালোলাগাটা তো হয়েই গেছে। একটা মানুষের খোলসের আবরণে যে রূপটা ঢাকা আছে সেটাই হয়তো আসল রূপ। মেহউইশ দেখছে খুব কাছ থেকে খোলসবিহীন রিশাদকে৷ যতটুকু দেখেছে ততটুকুতে আবর্জনার ছিঁটেফোটাও নেই। খোলসটাই যা ময়লা হয়েছে,নষ্ট হয়ে গেছে, ভেতরকার মানুষটা পরিষ্কার । চেষ্টা করলে আবরণটাকেও হয়তো ধুয়েমুছে নেওয়া যেত তবে তা করার জন্যও যোগ্য একজন মানুষ দরকার। সূর্যের লালচে আলো ঘন হয়ে রঙ বদল করছে। মেহউইশের ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই তারা হোটেলে পৌঁছে গেছে৷ রিশাদ সত্যিই তাকায়নি তার দিকে একটিবারও। বসার মত জায়গা কোথায় ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো সুইমিংপুলের পাশে কচি ঘাস আছে। শরতের এই শুরুটাতে ওই ঘাসগুলোকে খুব সতেজ লাগে। এই ভোরে শুধু সেখানটাতেই বসতে আরাম লাগবে।

-‘ তুমি সুইমিংপুলের পাশে লনে গিয়ে বসো আমি দেখছি কফির ব্যবস্থা হয় কিনা।’ কথাটা বলেই রিশাদ দোতলার দিকে এগোচ্ছিলো।

-‘কফি না চা।’

– ‘আমি চা বানাতে পারি না৷ রেস্টুরেন্টের কুকরা এখনও কেউ উঠেছে বলে মনে হয় না।’

মেহউইশ লনের দিকেই এগোচ্ছিলো, রিশাদের কথা শুনে উল্টো ঘুরলো।

-‘আমি কি সেখানের কিচেনে ঢোকার অনুমতি পাবো?’

রিশাদ না করতে গিয়েও করলো না। ইচ্ছেই হলো না বাঁধা দেওয়ার৷

-‘এসো’

দুজন মিলে আবার পায়ে পা মিলিয়ে চলল। দোতলায় রেস্টুরেন্ট খালি পড়ে আছে৷ কোথাও কোন শব্দ নেই, এমনকি তাদের পায়ের আওয়াজটাও নেই। রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরের স্লাইড দরজাটা সরিয়ে দুজন চুপিসারে ভেতরে ঢুকলো। মেহউইশ স্তব্ধ হয়ে গেল ভেতরে প্রবেশ করতেই। সুবিশাল কিচেন, বড় বড় ক্যাবিনেট,ড্রয়ার, ইলেকট্রিক ওভেন,হিটার,প্রেসার কুকার আবার একপাশে ক্রোকারিজ সেট। মেহউইশ হা করে চেয়ে রইলো সেদিকে। এত এত জিনিসপত্র তাও আবার রান্নাঘরের সে একসাথে কখনোই দেখেনি৷ রিশাদ মশলার কাঁচের কৌটো গুলো একে একে সবগুলো নামিয়ে দেখছে। কোথাও চা পাতা খুঁজে পেলো না। সে ভাবছে চা করতে চা পাতা লাগবে, দুধ লাগবে, চিনিও এগুলো কোথায় খুঁজবে।মেহউইশ মেয়ে মানুষ হয়তো সে তাড়াতাড়িই খুঁজতে পারবে তাই ডাকলো, মেবিশ,,,

মেহউইশ এ জগতেই যেন নেই। সে শুনতে পায়নি রিশাদের ডাক৷ তার চোখ জ্বলজ্বল করছে এতসব দামী, অত্যাধুনিক জিনিসপত্র দেখে। ফ্রিজটার সাইজও এত বড় যা সে কখনোই দেখেনি।

-মেবিশ চা পাতার কৌটো পাচ্ছি না।

-হু!

-বলছি চা পাতা ছাড়া চা সম্ভব নয়। কফিও পেলাম না তবে নিচের ক্যাবিনেটে নুডলস আছে খাবে?

এবারে সম্বিৎ ফিরলো মেহউইশের৷ লজ্জিত হলো নিজের এমন হা মুখো আচরণে। ছিহ, রিশাদ কি তাকে ছ্যাঁচড়া ভাবছে? জীবনেও দেখেনি এসব তা নিশ্চয়ই বুঝে গেছে! মুখটা কাচুমাচু করে রিশাদের দিকে তাকাতেই সে ইশারা করলো নুডুলসের প্যাকেটের দিকে।

মেহউইশ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই রিশাদ একটা প্যানে পানি বসালো। গ্যাস চালু করে ফ্রিজ খুলে দেখলো কি কি আছে তাতে। কাঁচা মরিচ, ক্যাপসিকাম আর সস বের করল। কপাল কুঁচকে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে মনে করার চেষ্টা করলো নুডুলসে আর কি দেয়? সে ভার্সিটি থেকে বন্ধুদের সাথে যেবার ট্র্যাকিংয় করতে পাহাড়ে গেল সেবারই ছিলো তার শেষবার নিজে হাতে নুডুলস রান্না করা৷ সেটাতো খুব সিম্পল ছিলো ফুটন্ত পানিতে নুডুলস ছেড়ে মশলা ঢেলে নেড়েচেড়ে নামিয়ে নিয়েছিলে। এখন কিভাবে রাঁধবে!

মেহউইশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল তবুও এগিয়ে এসে বলতে চাইলে না, ‘দিন আমি রাঁধছি।’

পানি ফুটে উঠেছে। নুডলসের প্যাকেট ছিঁড়ে তাতে নুডলস দিতে গিয়ে অসাবধানতাবশত চুলোর পাশে থাকা আরেকটা প্যান নিচে পড়লো। নিশ্ছিদ্র নীরবতায় ছেদ ঘটিয়ে জোর আওয়াজ হলো, চমকে উঠলো মেহউইশ । ধড়মড় করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রেস্টুরেন্টের শেফ আলাউদ্দিনও এসে ঢুকলো। এতভোরে তার রান্নাঘরে কিছু পড়ার শব্দ শুনেই সে দিকদিশা ভুলে দৌড়ে এসেছিলো বেচারা৷ তার সুরতহাল দেখে মেহউইশ চোখ বন্ধ করে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়ালো তৎক্ষনাৎ ।

-স্যার আপনি রান্নাঘরে! বেশ আশ্চর্যজনক মুখভঙ্গি করেই প্রশ্ন করলো আলাউদ্দিন। রিশাদ খেয়াল করেছে মেহউইশ মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

-আলাউদ্দিন সাহেব আপনি দয়া করে কাপড় পরে আসুন।

‘ওহ, স্যরি স্যার ‘ বলে লজ্জায় লাল হয়ে আবার দৌঁড়ে বের হলো আলাউদ্দিন৷ এই রান্নাঘরে কখনো কোন মেয়ে কাজের লোক ছিলো না। বলা যায় কিচেন শেফ আলাউদ্দিন এর আর্জি ছিলো তার রান্নাঘরে যেন কোন নারী না আসে৷ সে চুয়াল্লিশের ঘরে পা রাখা অবিবাহিত পুরুষ। হয়তো জীবনে নারীঘটিত কোন দূর্ঘটনা ছিলো অথবা অন্যকোন কারণ যার দরুণ সে মেয়ে জাতিকে তেমন একটা পছন্দ করে না। আর যেখানে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ সেখানে সে এত ভোরে তার পোশাকের দিকে খেয়াল দেওয়ার চিন্তা মাথায় ভুল করেও আনেনি৷ রাতে ঘুমানোর সময় পরা প্যান্ট, যার লম্বা তার হাঁটু পর্যন্তও নয় সেটা পরেই এখন এসেছিলো সে। তা দেখেই মেহউইশ অপ্রস্তুত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আবার এলো আলাউদ্দিন কাপড়চোপড় পরে বাবু সেজে। লজ্জায় তার মুখ এখনও রক্তিম তা দেখে রিশাদের হাসি পাচ্ছে।

-‘ মেয়েদের মত গাল গোলাপি করার আর দরকার নেই আলাউদ্দিন সাহেব৷ আমি নুডুলস বানাচ্ছিলাম ভুল করে এই কড়াইটা পড়ে গেছে।’

-স্যার আমাকে ডাকলেন না কেন? আমি করে দিচ্ছি এক্ষুনি৷

– ‘আপনার করতে হবে না আপনি শুধু বলে দিন চা পাত্তি,চিনি কোথায় আমি চা করবো।’ মুখ খুলল এবার মেহউইশ। আলাউদ্দিন এগিয়ে গিয়ে সব কিছু এগিয়ে দিতেই রিশাদ তাকে চলে যেতে বলল। মেহউইশ নিজেই নুডুলস আর চা করে একটা ট্রে তে সাজিয়ে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছিলো। রিশাদকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন না চা খাবেন?’

‘কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এসব।’

-‘লনে বসে খাবো৷ এখনও সাতটা বাজেনি। আর যাইহোক লোকজনের ভীড় হবে না।’

-‘চা ঠান্ডা হয়ে যাবে নিচে যেতে যেতে।’

-‘হোপফুলি আমি অতোটা বোকা আর গর্দভ নই।’

-‘মানেহ!’ রিশাদ ভ্রু কুঁচকালো আবারও তা দেখে মেহউইশ যেন সুযোগ পেল টিপ্পনী কাটার মত।

-‘ কথায় কথায় ভ্রু দুটোকে ওরকম কষ্ট না দিয়ে মাথাটা একটু খাটালেই বেশি উপকৃত হবেন, আমার ধারণা।’ মেহউইশ আর দাঁড়ায়নি । সত্যিই চলে গেল সিঁড়ি বেয়ে নিচ তলায়। লনে ছোট গোল একটা টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে চেয়ার টেনে বসলো৷ রিশাদও পেছন পেছন এসে আরেকটা চেয়ার টেনে বসলো। এবার খেয়াল করলো চা ছোট্ট একটা ফ্লাক্সে করে এনেছে সে সাথে দুটো কাপও৷ নুডুলসের বাটি টেনে নিয়ে রিশাদ খাওয়া শুরু করলো, মেহউইশও তাই করলো। তারপরের সময়টা দুজনে টুকটাক গল্প করেই কাটিয়ে দিলো। কল্পনার চেয়েও সুন্দর অনেক বেশি সুন্দর ছিলো আজকের সকাল মেহউইশের জীবনে। রিশাদের জীবনেও তাই নয় কি! কৈশোরের প্রেম ভ্রমণ যৌবনের শুরুতে একটা মেয়ের প্রেমে পড়লেও প্রেম করা তার হয়নি। সময়মত বিয়ে হলো ভুল মানুষের সাথে যে কিনা সময়ের সাথেই আবার হারিয়ে গেল। প্রেম না হলেও নীলিমার জন্য মায়া জন্মেছিলো৷ সেই মায়াকে সম্বল করে আজীবন পার করতে চাওয়ার সাধে ঘুন ধরলো। নীলিমা পালালো আর সন্তানকে করে গেল মা হারা। এরই মাঝে নিজেরই এক ভুল ধারণার জন্যই ইভানের কাছ থেকে মেহউইশকে আলাদা করলো। সে চেয়েছিলো এক ঢিলে দুই পাখি মারতে কিন্তু ভাগ্য তো তার বরাবরই সংকুচিত রইলো। যতদূর খবর নিয়ে জানা গেল রাইমা ইভান নয় অন্যকাউকে ভালোবাসে। সেই এক ভুল তার জীবনে মেহউইশকে বেঁধে দিলো। বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করেই সে চলল। বাবা যা করলো খালার সাথে সেও কি তাই করেনি মেহউইশ এর সাথে! তাই তো করলো পার্থক্য শুধু তার কাজ বৈধতাযুক্ত৷ এক ভোরেই যে আজ সকল ভুলত্রুটি, অন্যায় – পাপ তাকে এমন গাঢ়ভাবে নাড়া দিবে কে জানতো৷ আজই উপলব্ধি হলো মেহউইশকে সে সম্মানের সাথে নিজের কাছে বেঁধে রাখতে পারে আর আজই মনে হলো মেহউইশের একটা সুন্দর জীবন সে ধ্বংস করেছে৷ তার প্রায়শ্চিত্ত করা দরকার। মেহউইশ কি চায়!

সারাটা দিন খুব হৈ চৈ এর সাথে কাটলো রাইমাদের। তানভীর নিজের পরিচয় হিসেবে রাইমা যে কলেজে পড়ে সেখানেই ইউনিভার্সিটি লেভেলের সিনিয়র বলেছে রিশাদকে। মেহউইশের সাথে আলাদাভাবে বেশ ক’বার কথা বলার চেষ্টা করেছে তানভীর । মেহউইশ এড়িয়ে গেছে তাকে বিভিন্ন ব্যস্ততার অজুহাতে। ইভান সম্পর্কিত কোন কথাই আলোচনা করতে আগ্রহী নয় সে এখন। ইভানকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব কিন্তু রিশাদের সংসারে ভালো একজন বউ আর মা হওয়া অসম্ভব নয়৷ তাই সে এ বিষয়েই সততার পরিচয় দিতে চায়। সুযোগ পেলে অবশ্যই তানভীরের কৌতূহলও মিটিয়ে দেওয়া যাবে৷ দুপুরের পর রিশাদকে আর দেখা যায়নি। মেহউইশ নির্জন আর তার মায়ের সাথেই বেশি ব্যস্ত ছিলো। রেহনুমাও খুব উৎসাহ নিয়ে লনের ডেকোরেশন দেখছিলো ঘুরে ঘুরে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা তেমন বড় করে না হলেও মোটামুটি নিজেরাই আছে প্রায় বিশ,বাইশজন। আজকের জন্য লনের সাইডে ট্যুরিস্টদের জন্য ঢোকা বারণ৷ তিশমা এসে রাইমাদের সাথে যোগ দিলো সোৎসাহে। ম্যানেজার বেচারা এখানেও ছাড় পেলো না৷ মি.হাংকি পাংকি নামেই তাকে সকলের সামনেই খুব জ্বালিয়ে মারলো।

দিনের আলো যখন নিভু নিভু , রাত যখন আসি আসি করছে সন্ধ্যের শেষ আলোটুকু গায়ে মেখে রিশাদ এলো। দু হাত ভর্তি তার শপিং ব্যাগ। সব নিয়ে সে প্রথমে নিজের ঘরেই ঢুকলো। রাইমারা দুপুরেই নিজেদের রুম পেয়ে গেছে তাই সে রুমেই শিফট হয়েছে। মেহউইশ রুমেই ছিলো নিজের৷ দু দিনের জন্য হোটেলে আসা তাদের তাই বেশি কিছু না নিয়েই এসেছিলো। রিশাদ হাতের ব্যাগগুলো ড্রেসিংটেবিল এর পাশেই ডিভানের উপর রাখলো।

‘ফুপি আর আন্টি কোথায়?’ রিশাদ জানতে চাইলো।

-‘ নিচেই মনে হয় লনের পাশে ডেকোরেশন দেখছে।’ কানে দুলজোড়া পরতে পরতে কথাটা বলল মেহউইশ।

– এখানে দুটো শাড়ি আছে একই রঙের। আমার ফুপি কখনও রঙচঙে কাপড় পরেননা আর আন্টিকেও আমি যে কদিন দেখেছি তিনিও সাদামাটা পরেন৷ এ দুটো শাড়ি একই রকম তাদের দিয়ে দিও৷ আর এখানে তিনটে ব্যাগ মিহাদের ‘ বলতে বলতে ব্যাগ তিনটা আলাদা করে দেখালো মেহউইশকে৷ শার্ট,প্যান্ট আর একরাতে মোবাইল ফোন এগুলো মিহাদের জন্য কেনা।

-এতকিছু কেন আনতে গেলেন৷ মিহাদের মোবাইল দরকার নেই।

-‘ভয় পেয়ো না আমাদের মত বিগড়াবো না তাকে৷ শুধু ফোনটাই দিচ্ছি সে খুব খুশি হবে৷ আর এদিকে একটা শাড়ি আর একটা গাউন আছে। গাউনটা রাইমা নিজেই পছন্দ করে ছবি পাঠিয়েছিলো। তাকে ডেকে দিয়ে দিও৷’ কথা শেষ করে রিশাদ বাথরুমে ঢুকলো। মেহউইশ ভাবছে শাড়িটা কার! সবগুলো ব্যাগের কথাই বলেছে কার কোনটা শুধু নির্জন আর তার জন্যই কিছু এনেছে কিনা বলল না। মন খারাপ করে শাড়িটা শপিং ব্যাগ থেকে বের করতেই ছোট্ট একটা চিরকুট বেরুলো, নির্জনের মায়ের জন্য এই উপহারটা ।’

চলবে
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here