মন গহীনের গল্প পর্ব -৪১+৪২

#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব -৪১
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
বিকেলের নরম আলোয় গা ধুয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে শঙ্খচিলের দল। কোথায় যাচ্ছে তারা, কোথায় তাদের ঘর মেহউইশের খুব জানতে ইচ্ছে হলো! রিশাদের কাছে জেনে নিবে এক্ষুনি আগে সে ঘরে আসুক। বেলকোনির সব ক’টা পর্দা সরানো,কাঁচ খোলা । ঝড়ের বেগে সমুদ্রের হাওয়া পশ্চিম থেকে ঠেলে বাঁক নিয়েছে, আর সেই বাঁকেই মেহউইশদের এই বেলকোনিটাতে ঝপাট মেরে জায়গা নিচ্ছে সানন্দে । মেহউইশের সর্বাঙ্গ মরা রোদের আলো আলতো করে মাখিয়ে দিচ্ছে সুযোগ পেয়ে। সন্ধ্যে নাগাদ ফিরবে আজ মেহউইশেরা তাদের পাহাড়ি বাড়িতে। অনেক বলেও মিহাদ,মাইমুনা কাউকেই সঙ্গে নিতে পারছে না তারা। ব্যবসাটা নতুন এখনই এমন বন্ধ ফেলে রাখলে গ্রাহক পাবে কি করে, মিহাদের পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে এই সেই আরো কত যুক্তি দেখিয়ে তবেই রাজী করেছে সবাইকে । মেহউইশ সকালে মজা করেই বলেছিলো যেতে হয় যাও আটকাবো না। সে কি জানতো তার মা আজ সত্যিই চলে যাবে! এতগুলো দিন পর মা’কে তার আনন্দের সীমা ছিলো না। এখন আবার সেই আনন্দ মিলে যাচ্ছে দিনের দ্যুতি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই। রিশাদ গেছে প্রাইভেট গাড়ির জন্য লোক পাঠাতে স্ট্যান্ডে। মাইমুনা বাসেই যেতে চেয়েছিলো । রিশাদ কিছু বলবে তার আগেই রেহনুমা বলল, ‘ অত কথা বলবেন না। দুদিন তো মেয়ের কাছে থাকলেন না এখন আবার যাওয়ার ব্যবস্থা নিয়েও আপনার কথা শুনতে চাই না। রিশাদ যা কাউকে পাঠা গাড়ির ব্যবস্থা করতে।’ মাইমুনা খুশি হয়েছে রেহনুমা আর রিশাদের আচরণে। বদলেছে রিশাদ সবটাই আর এই বদল তার মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক এমনটাই আল্লাহর কাছে তার চাওয়া। মেহউইশ মায়ের সাথে অভিমান করেই নিজের ঘরের বেলকোনিতে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। তখনই চোখে পড়ল অদূর সাগরের উপর ভাসতে থাকা শঙ্খচিলের ঝাক। মন খারাপের পর্দা সরে একটুখানি মন ভালো করা এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই ভাবুক মেহউইশ টের পেল তার পেছনে কেউ একজন চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সময় একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে গলা খাঁকাড়ি দিলো তানভীর।অপরিচিত কন্ঠের খাঁকড়ি নিজের ঘরে শুনতে পেয়ে চকিতে ফিরে তাকালো মেহউইশ৷ ঘরে রিশাদ নেই,নেই ফুপু,রাইমা, মা কিংবা মিহাদ। তানভীর একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দেখেই ভড়কে গেছে সে, প্রচণ্ড রেগেও গেছে।

-তুমি এ ঘরে কি করছে তানভীর? বিনা অনুমতিতে প্রবেশই কেন করেছো? এ কেমন অসভ্যতা!

-‘ প্রথমেই বলছি আমি দুঃখিত এভাবে ঘরে প্রবেশ করার জন্য । এভাবে আসা ভালো ম্যানার্সে পড়ে না আমি জানি কিন্তু সময় কম বলেই এভাবে এসেছি। রিশাদ ভাইয়ার মুখে শুনলাম আপনারা চলে যাচ্ছেন কোথাও৷ তাই কৌতূহল মেটানোর তাড়ায়,,,,

– ‘অনুমতি ছাড়াই কোন মেয়ের ঘরে ঢুকে যাবে তাই না তানভীর!’ তানভীরকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল মেহউইশ ।

-‘ সত্যিই দুঃখিত মেহউইশ আপু৷ কিন্তু আপনি ইভান ভাইয়াকে কেন ছেড়ে দিলেন?’

-‘দিস ইজ নান অফ ইউর বিজনেস তানভীর৷ ‘

-‘ ডোন্ট বি রুড মেহউইশ আপু, আই জাস্ট সে দ্যাট,,,’

-‘ মেবিশ, তুমি কি তৈরি?’ দরজার সামনে এসেই রিশাদ ডাকলো। মিহাদ আর মাইমুনার সাথেই তারাও রওয়ানা দিবে নিজের গন্তব্যে ভেবেই এসেছিলো মেহউইশকে ডাকতে। রিশাদের রাগ বরাবরই চট করে আসে তানভীরকে দেখেও রাগের উদ্রেক হচ্ছিলো৷ কিন্তু সেই রাগে বর্ষণ হলো মেহউইশের মুখ দেখে। চোখ দুটো ছোট ছোট, নাকের পাটা ফুলে আছে সেই সাথে তার কপাল কুঁচকে যে রেখার উৎপত্তি তা বিরক্তির নয় রাগেরই আভাস। কষ্ট হলেও নিজের রাগকে আয়ত্তে আনা অনেকটাই শিখেছে রিশাদ। এখন তাই শিখে যাওয়াটাকে কাজে লাগিয়েই রাগ সংবরণ করেছে৷ নইলে তানভীরের এভাবে মেহউইশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জনমের মত শেষ করে দিতো।

-‘ আমি তৈরি দু মিনিটেই আসছি ওর প্রশ্নের জবাব দিয়ে।’ কঠিন চাহনি তানভীরের দিকে তাক করে রেখেই মেহউইশ বলল রিশাদকে। রিশাদ একবার এগিয়ে আসতে গিয়েও আবার ভাবলো না আগানোটাই উচিত। তারা দুজন যে দুজনকে চেনে এ ব্যপারে রিশাদের কোন সন্দেহই নেই বরং সে আজকে জেনেই গেছে পরিচয়ের যোগসূত্র কোথায়। ‘ইভান’ হলো তাদের পরিচয়ের শিকড়। রিশাদ নেমে গেছে দোতলা থেকে নিচ তলায়। সম্পর্কের গোড়া মজবুত করতে যতোটা করা লাগে ঠিক ততোটাই সে করবে বাকিটা জীবন। সবাই তো আর নীলিমা নয় যে, পুরনো প্রেমিকের কাছে ফিরে যেতে সুযোগ সন্ধানী হবে। তানভীর তো ইভানের আপন ভাই নয় তবুও আত্মীয়।ইভান কি কখনো কিছু করবে তানভীর -রাইমার জীবনে! গাড়ির কাছে যেতে যেতে এলোমেলো কত ভাবনাই তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করলো৷ কিছুটা বোনের ভবিষ্যত নিয়ে আর কিছুটা মেহউইশের মনের অবস্থা পরিবর্তনের ভয়ে।

‘ তানভীর, আমি এখন একজনের বিবাহিতা স্ত্রী । ইভান এখন শুধুই অতীত আমার জীবনে। যেভাবেই হোক আমরা আলাদা হয়েছি এবং দুজনেই নতুন দুজন মানুষের জীবনের অংশ এখন । তুমি যাকে ভালোবাসো আমি তারই ভাইয়ের বউ। তুমি আমার অতীত নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নিজেদের সম্পর্কের সুষ্ঠুতা নষ্ট করো না৷ ঝগড়া বা অন্যকোন কারণ ছাড়াই আমরা আলাদা হয়েছি কিন্তু আমরা অন্য আর দশজন প্রেমিক প্রেমিকার মত বিয়ের সম্পর্ক ভেঙে পালাবো না৷ ভাগ্যের হাতে না চাইতেও কিছু জিনিস ছেড়ে দিতেই হয় এছাড়া করার কিছু নেই। বিয়েটাও তেমনই একটা অংশ আমাদের জীবনে যা উপরওয়ালা আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। যাইহোক, তুমি আমার চেয়ে ছোট না হলেও আমি তোমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখতাম ইভানের কারণে। আজও তোমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই ভাবছি রিশাদ সাহেবের ছোট বোনের হবু বর হিসেবে।’ শেষ বাক্যটা বলার সময় মেহউইশ মুচকি হাসলো৷ তানভীর বেশ উত্তেজনা বোধ করলো, ‘রাইমার হবু বর!’ তারমানে কি প্রিয় মানুষটিকে পাওয়া সহজ হলো তার জন্য ? সকালে রাইমার ভাইয়ের কথাবার্তাতেও পজেটিভ সাইন ছিলো তাদের সম্পর্কের প্রতি । এখন আরও সহজ লাগছে মেহউইশ আপুর কথায়। তানভীরের মুখে, চোখে আনন্দের ঝিলিক ছিলো যা মেহউইশের চোখে ধরা পড়েছে৷ ভালো লাগে তার যে যাকে চায় তাকে পেতে দেখলে। একটা সময় নিজেরও তো সাধ ছিলো প্রিয় মানুষটার সাথে সারাজীবন থাকার। রিশাদকে সে ভালোবাসে না, হয়তো কখনও বাসতেও পারবে না কিন্তু রিশাদের জীবনের বিষাক্ত অতীত আর অভ্যাসে বাঁধা পড়ে সারাজীবন একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা সে নিজ মনে করে নিয়েছে। দায় নয় বরং দ্বায়িত্ব হিসেবেই পালন করবে সম্পর্কটাকে।

‘ আমাদের দেরি হচ্ছে তানভীর চললাম৷ ভালো থেকো আর সৎ থেকো মেয়েটার প্রতি। কেন জানি ভরসা হয় তোমার ওপর তুমি কখনো কষ্ট দেবে না রাইমাকে। তবুও অনুরোধ রইলো ভাই সম্পর্কটাকে সৎভাবে এগিয়ে নিয়ে যেও। রাইমা সত্যিই খুব ভালো মেয়ে।’

-‘দোয়া করবেন যেন আমরা উপসংহারেও একসাথে, একই বন্ধনে জুড়ে থাকতে পারি৷’ কথা শেষ করে তানভীরই আগে বের হলো ঘর থেকে তারপরই মেহউইশ বেলকোনির পর্দা,কাঁচ সব লাগিয়ে ঘর লক করেই বের হলো৷ নির্জন আগে থেকেই বাইরে ছিলো। সে নিচতলায় গুটি গুটি পায়ে ছুটোছুটি করছিলো সেই সাথে তার আধখানি বুলিতে মাতিয়ে দিচ্ছিলো সবাইকে। মেহউইশ নিচে আসতেই মাইমুনা ডাকলো তাকে। মন খারাপ হলো মা, মেয়ে দুজনেরই তবুও নিয়মের পথে বাঁধ তৈরি সম্ভব নয় বলেই আলাদা হয়ে দু পথে রওয়ানা দিলো৷ মিহাদ আর মাইমুনা ঢাকার পথে আর মেহউইশরা চট্টগ্রামেই তাদের সেই পাহাড়ের বুকে। পাহাড়ি জনপদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা মেহউইশের নজরে পাহাড়ি হাটবাজার। কত রকম আদিবাসী একসাথে হয় তখন। আজও হাট বসেছে আর নিজেদেরই বাড়ির কাছাকাছিই এক বাজার। মেহউইশ জেদ করলো সে ওই বাজারে ঘুরবে। আজ সাথে নির্জন আর ফুপিও আছে তাই জেদ আরও জোড়ালো হলো তার। সন্ধ্যে ঘন হয়ে রাত নামছে ধরণীতে এ সময় পাহাড়ি পথে চলতে বড্ড ভয় রিশাদের যখন তার সাথে নির্জন থাকে। কিন্তু মেহউইশকে বোঝানো হলো না তার ভয়টা। বাধ্য হয়েই গাড়ি থামাতে হয়েছে তার। বাজার বসেছে দুপুরের পরই কিন্তু সন্ধ্যের পর তা জমেছে খুব। খাদ্যসামগ্রী থেকে কাপড়, বাঁশ,মাচার তৈরি জিনিস, নারীদের প্রসাধনী , ছাগল,হাঁস মুরগি কিছুই বাদ নেই এতে। শীত আসি আসও করছে হালকা হিম গায়ে থেকে থেকে কাঁপুনি দিচ্ছে। শীতের আগমনী এই হাওয়া মনের কোণ জমে থাকা বিষন্নতাকে জমিয়ে দেয় আশ্লেষে। রিশাদ গাড়ি থেকে নামার আগে তার ওয়ালেট চেক করলো। খুঁচরো কিছু পয়সা আছে কিনা তার জানা নেই। এখন বাজারে ঢোকা মানে ফুপি কিছু বেতের তৈরি জিনিস কিনবে, মেহউইশ নিশ্চয়ই একটা কাজল আর একটা ছোট্ট খেলনা কিনবে৷ প্রতিবার তারা তাই করে আর বিপদে ফেলে রিশাদকে। তারা এমনসব জিনিস কেনে যার দাম পাঁচশো’ও হয় না৷ আর রিশাদের পকেটে বরাবরই টাকা বলতে কয়েকটা পাচশো টাকার নোট অথবা তার কার্ডগুলোই থাকে। আগেরবার মেহউইশ ইঙ্গিতে তাকে অপমান করেছিলো। সেই অপমানের ঝাল সে মিটিয়েছিলো তার বোকাসোকা ম্যানেজারের উপর। কিন্তু আজও যদি অপমানিত হতে হয় সে ঝাল মেটানোর জন্য তো আজ ম্যানেজারও নেই।

‘শালা এই কপালটাই খারাপ নইলে কি আর বোকাসোকা ম্যানেজারটার প্রেম হয় তিশমার মতো মেয়ের সাথে। ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেল আমার সকল সুখের চাবি ম্যানেজারকে।আগেই বোঝা উচিত ছিলো তিশমা এমন ঘন ঘন কক্সবাজারে আসা আর আমার বলদা ম্যানেজারকে হাংকি পাংকি ডাকার কারণ ,,,! ‘ স্বগোতক্তির মতোই বলল রিশাদ সিটে বসে থেকেই। তার এই বেখেয়ালি ভাবনা চলার মাঝেই রেহনুমা আর মেহউইশ বেরিয়ে পড়েছিলো গাড়ি থেকে। রিশাদও এবার বেরিয়ে গিয়ে খুঁজতে লাগলো ভীড়ে। অন্ধকারে বড় বড় কুপি আর চার্জার লাইটের আলোতে চেনা মুখের খোঁজ মিলছে না। এত দ্রুত কোথায় মিলিয়ে গেল তারা! যেদিকে চোখ যায় চাকমা,মারমা,মুরুং। এত লোকের ভীড়ে তার বাঙালি বউ আর ফুপুটাকে চোখে পড়ছে না। মিনিট দশেক ঘুরতে ঘুরতে পাগল প্রায় রিশাদের চোখ থমকে গেল সামনেই এক কুপির সামনে। হলদে আলোয় ফর্সা মুখটা কাঠবর্ণ হয়ে আছে৷ ঘন পাপড়ির চোখ ঘন কালো মেঘের মতন। ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক বিজলির মত চমকিত করছে যেন ভুবনমোহিনী গোলাপর গুচ্ছ কেউ তুলে ধরেছে চোখের সামনে। সঙ্গাহীন হয়ে থমকে আছে মেহউইশের অমন আলোয় জ্বলজ্বল মুখটা দেখে৷ এ মুখের প্রেমে সে বহুবার নিজেকে হারাতে চায়। নতুন করে মন বুঝি তার আবারও নিজেকে রক্তাক্ত করতে চায় প্রেম নামক কাঁটায় ঘেরা রক্ত গোলাপে!

মাটির একটা ছোট পুতুল হাতে নিয়ে খুব মন দিয়ে দেখছিলো মেহউইশ। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো রিশাদ দেখছে তাকে, নিষ্পলক সে চাহনি।#মন_গহীনের_গল্প
পর্ব ৪২
#রূবাইবা_মেহউইশ
💞
‘এখন আমি এত টাকা কোথায় পাবো মেবিশ? ফুপি তুমিও কেন এমন অবুঝপনা করো বলো তো! অন্তত সকালের আগে তো কিছুই করা সম্ভব নয় ।’ বিড়বিড় করতে করতে ঘরের ভেতর পায়চারী করছে রিশাদ। কিছুক্ষণ আগেই তারা বাড়ি ফিরেছে সেই সাথে ফিরছে মেহউইশ আর রেহনুমার কেনার ঝুড়ি ঝুড়ি জিনিসপত্র, দোষ এখানে রিশাদেরই বৈকি । মাটির তৈরি জিনিসপত্রাদির সামনে মেহউইশের অমন জ্বলে উঠা রূপ দেখে বিবশ হয়েছিলো কিছু সময়ের জন্য । আদুরে গলায় বলেছিলো, ‘এগুলো কি কিনছো রেখে দাও আমি তোমার জন্য ঢাকা থেকে আরও ভালো দেখে আনিয়ে দেবো।’

ঘুটঘুটে অন্ধকারে কুপির আলোয় মেহউইশের দৃষ্টি কেড়েছিলো রিশাদের সেই নিষ্পলক দৃষ্টি, হঠাৎ করে কোমল হওয়া মুখটা। সে ভাবলো এই তো সুযোগ নাকউঁচু লোকটার অর্থ সঠিক জায়গায় ব্যয় করার। ‘এই জিনিসগুলো যারা বিক্রি করছেন তারা দরিদ্র আর শহরে যারা নিয়ে গিয়ে বিক্রি করবে তারা মধ্যবিত্ত৷ আমাদের কি উচিত নয় চোখের সামনে থাকা এই দরিদ্র মানুষগুলোর কষ্ট দূর করা?’ কথাটা বলে মেহউইশ তাকিয়ে রইলো রিশাদের দিকে জবাবের আশায়। রিশাদ মানলো না কথাটা শীত বাড়ছে বলেই মেহউইশকে গাড়িতে উঠতে বলল। মেহউইশ ছাড়বার পাত্রী নয় আর এখন রিশাদের সাথে জেদ,রাগ কোনটাতে জড়তাও কাজ করে না তার। সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো আগের জায়গায় তখনি আবার রেহনুমা কোথা থেকে এগিয়ে এসে যুক্ত হলো৷ তার কোলে নির্জন আর নির্জনের পরনে ক্যাটক্যাটে লাল রঙের উলের সুয়েটার। রেহনুমার মুখেও একই কাহিনী শুনে রাগ হলো খুব তবুও তা প্রকাশ না করে বলল, ‘ নিয়ে এসো যা যা কেনার’ বলেই সে তার ওয়ালেট বাড়িয়ে দিলো। অবাক করা ব্যপার হলো দুজনের কেউই সে ওয়ালেট নিলো না৷

‘ টাকা ছাড়া কিনবে কি করে?’ প্রশ্ন করলো রিশাদ।

– ‘টাকা বাসায় গিয়ে দিবো৷ তারা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে সবই৷’ মেহউইশ বেশ উজ্জ্বল মুখ করে বলল।

‘কি এমন কিনেছো যে তারা একদম বাড়িতেই দিয়ে আসবে?’রিশাদের কিছুটা বিভ্রান্তি হলো৷ তখনি পেছন থেকে একজন কাপড়ের দোকানি জিজ্ঞেস করলো কোন বাড়িতে যেতে হবে। লোকটা উপজাতি তার ভাষা মেহউইশ একটু আধটু বোঝে সে রেহনুমাকে বলল, ‘ফুপি ঠিকানা কিভাবে দেব?’

রেহনুমা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরেকজন বলল, জমিদার বাড়িতে।

রিশাদ অবাক হয়ে চাইলো, জমিদার বাড়ি!

রেহনুমা বলল, হ্যাঁ ওই বাড়িতেই নিয়ে চলো।

-‘ কোন জমিদার বাড়ি ফুপু?’ রিশাদ জানতে চাইলো।

‘ এখানে থাকিস বছর তো প্রায় হয়েই এলো। অথচ এখনো জানিস না এই এলাকায় তোর বাড়িটার একটা নাম আছে।’ হাসছে রেহনুমা কিন্তু মেহউইশও ভীষণ অবাক সেও তো জানতো না।

‘কি আশ্চর্য ব্যাপার আমার বাড়িরও একটা নিকনেম আছে আর আমি তা জানি না।’ রিশাদ বলল স্বগোতক্তির মত করে।

বাড়ি ফিরে কাপড় বদলে ঘর ছেড়ে বের হতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। বারন্দার বাইরে এক এক করে চার পাঁচ ঝুপড়িওয়ালা ঝুপড়ি নিয়ে হাজির৷ চিৎকার করে ডাকলো সে তার ফুপুকে। রেহনুমা গা ছাড়া ভাব নিয়ে ধমক দিলো, ‘চিৎকার করছিস কেন অমন করে বাড়িতে কি চোর ঢুকেছে, সিধ কেটেছে!’

‘ফুপি এসব কি! এত এত জিনিস কিনেছো কি করতে আর এসব তো তোমাদের ব্যবহার করার মতও না৷’

রেহনুমা বলল, ‘সেই কৈফিয়ত আমি তোকে দেবো না৷ যা গিয়ে টাকা পরিশোধ কর।’ বলতে বলতে মুচকি মুচকি হাসছিলো। রিশাদ বোকার মত পকেটে হাত রেখে ভাবনায় পড়লো। তার পকেটে হাতে গুণে তিনটে পাঁচশো টাকার নোট ছাড়া কার্ডগুলো আছে। কার্ড দিয়ে তো আর ঝুপড়ি মালের দাম পরিশোধ সম্ভব নয়। সে কারণেই বারবার বলছে, ‘এখন আমি এত টাকা কোথায় পাবো মেবিশ!’ তার ধারণা একটাই মেহউইশই ষড়যন্ত্র চালিয়ে ফুপিকে উৎসাহী করেছে এতসব জিনিস কেনার। তার এই পায়চারী চলাকালীনই রেহনুমা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন হাতে চকচকে অনেকগুলো নোট নিয়ে। করিডোরের বাতির হলদে আলোয় রিশাদ সেই টাকা দেখে এগিয়ে আসতেই রেহনুমা জানালো ঘরে কিছু জমানো টাকা আছে। কিছু বলতে অনেকই আছে যা রিশাদ সবসময় খরচের জন্য দিতো তা প্রয়েজনের চেয়ে বেশিই ছিলো। মনে মনে স্বস্তি পেল সে ভাবলো কাল কার্ড থেকে ক্যাশ করেই ফুপিকে ফিরিয়ে দেবে। রাতে ঘুমানোর সময় সুযোগ বুঝে মেহউইশকে আক্রমণ করলো সে।না শীত না গরম এমন ছ্যাতছ্যাতে ঋতু বড্ড যন্ত্রণাদায়ক। মেহউইশের মনে হলো শীত শীত লাগছে সে কম্বল পেঁচিয়ে নিলো গায়ে। রিশাদ তার কম্বল পেঁচানো দেখে ইচ্ছে করেই সিলিং ফ্যান চালু করলো। তাতে মনে হলো মেহউইশের ভালোই লাগছে তাই আবার ঘরে থাকা বড় স্ট্যান্ড ফ্যানটাও চালু করে ঠিক পায়ের সামনে রাখলো৷ কম্বলে গা ঢাকা থাকলেও মাথার চুল আর নাকে মুখে হাওয়ার তোড় এমনই লাগলো যার দরুণ মেহউইশের নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম ।

–‘ কি শুরু করলেন রাত বিরাতে!’ রিশাদ নিঃশ্চুপ চোখ বুঁজে পড়ে আছে বিছানায়৷যেন সে শুতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বিছানা থেকে নেমে ফ্যান দুটোই অফ করলো। মনে মনে বলল ভাগ্যিস আজ নির্জন ফুপুর ঘরে নইলে এ বাতাসে তার তো নিঃশ্বাস আটকাতো। মেহউইশ আবার বিছানায় গেল। মিনিট দশেক পর আবারও রিশাদ আগের মত ফ্যান ছাড়লো। আবারও মেহউইশ বন্ধ করে ঘুমোতে গেলে কয়েক মিনিট পর আবারও রিশাদ আগের মতোই ফ্যান ছাড়লো। রাত তখন কত হবে, একটা কি দেড়টা! দূর পাহাড় থেকে হঠাৎ হঠাৎ অচেনা এক পাখির ডাক ভেসে আসছে এই মাঝরাত্তিরে। বড্ড ভয়ংকর শোনালো সে ডাক অনেকটা বিপদে পড়া জন্তুর আর্তচিৎকারের মত। কি নাম হবে পাখিটার! মেহউইশ আগেও শুনেছে এই ডাক বড় করুণ লাগে। এবারে সত্যিই রিশাদ ঘুমিয়ে পড়েছে । ফ্যান বন্ধ করে মেহউইশও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। দেরি করে হলেও তার চোখে ঘুম নামলো।

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির শুরু ভোর রাতেই হয়েছে। কম্বল মুড়ে একে অপরের গায়ে গা লাগিয়ে বড় আরামের ঘুম হচ্ছে দুজনের। কম্বলের উম সাথে দেহের উষ্ণতা ভারী শীতকেও কাবু করেছে। সময় গড়ালো অনেক তবুও বিছানা ছাড়তে কারোই ইচ্ছে করছিলো না৷ কিন্তু নির্জন যদি যায় ফুপি কতক্ষণ সামলাবে? আজকের এই অসময়ে বৃষ্টি আবহাওয়াকে খুব বেশিই শীতল আর ক্রমশ হাওয়াও বেড়ে ঝড়ের আভাস দিচ্ছে৷ রিশাদকে ঠেলে সরিয়ে বিছানা থেকে নামলো মেহউইশ। খাটের পাশে কর্ণার টেবিলে থাকা ঘড়িটাতে চোখ বুলিয়ে আৎকে উঠলো সে। এগারোটা বেজে গেছে অথচ সে বা রিশাদ আজ কারো একটিবারের জন্যও ঘুম ভাঙলো না! আশ্চর্যান্বিত মেহউইশ ঝাকালো কয়েকবার উঠার জন্য কিন্তু রিশাদের ঘুম কিছুতেই ভাঙলো না। দুয়েকবার সাড়া দিয়ে আবারও ঘুমালো সে।

মুখ হাত ধুয়ে মেহউইশ গেল রেহনুমার ঘরে। রেহনুমাও কি আজ ঘুমিয়েছে খুব! আবহাওয়া আচমকা এতোটাই আগ্রাসী হয়ে প্রকৃতি এমন করে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে কেন? মেহউইশ রেহনুমার দরজায় কয়েকবার ধাক্কানোর পরও যখন খুলল না সে আবার ফিরে গেল নিজের ঘরে। ঘরে পা দিতেই কানে কানে এলো ফোন বাজছে রিশাদের৷ লোকটা এত ঘুম কি করে ঘুমাচ্ছে ভেবে পায় না সে৷ যে লোক রাতভর জেগে থেকেও পার করতে পারে কিংবা রাতে দু ঘন্টা ঘুমালেও কাকডাকা ভোরে সজাগ হয় সে এমন কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাচ্ছে! মেহউইশ ভাবলো মা সবসময় বলে মানুষ খুব খারাপ সময়ের আগে এমন করে ঘুমায় যাকে বলে মরার মত ঘুম। মেহউইশ আর মিহাদ যদি একদিনও ভুল করে সকালে দেরি করে উঠে তখন মা খুব রেগে বলে এ কথা৷ না না, কিসব উল্টাপাল্টা কথা ভাবছি! স্বগোতক্তির মতো বলেই ফোন রিসিভ করলো মেহউইশ স্ক্রীণে রাইমার নাম্বার দেখে৷ ফোন রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে রাইমার হিঁচকি তোলা কান্নামাখা কন্ঠস্বর। কান্নার দমকে সে দুয়েকটা কথা যাই বলল কিছুই বোঝা গেল না৷ মেহউইশ অস্থির হয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে কথা বলল। কিন্তু দূর্ভাগ্য এখানে এমনিতেই নেটওয়ার্ক থাকে না তারওপর আজকের আবহাওয়া এতোটা খারাপ। এক কানে আঙ্গুল চেপে অন্যকানে ফোন ধরে বোঝার চেষ্টা করলো মেহউইশ যা বলছে রাইমা৷ কাটা কাটা কন্ঠস্বরে যা শুনলো তাতে পায়ের তলায় শীতল এক রক্তস্রোতে টের পেল, ভয়ও হচ্ছে খুব। তাড়াতাড়ি ফোন রেখে রিশাদকে টেনে, ঝাকিয়ে ডাকাডাকি করলো সে৷ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে রিশাদ উঠে বাথরুমে গেল। তারপর রেহনুমাকে ডাকতে গেলে দেখলো রক্তিম চোখ,মুখ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো রেহনুমা৷ মেহউইশ বুঝে গেল রেহনুমারও জানা হয়ে গেছে খবর তবুও সে মুখ খুলতে যাচ্ছিলো অমনি রেহনুমা বলল, ‘ মেহউইশ আমার ভাই হাসপাতালে মৃত্যু পথে লড়ছে, মেহউইশ আমি ঢাকায় যাবো। রিশাদকে বলো আমার ভাইয়ের কাছে নিয়ে যেতে।’ বলতে বলতে রেহনুমা বসে পড়লো সেই অবস্থায়৷ কান্নায় তার গলার স্বর অস্পষ্ট । বাইরে ঝড় ঠিক কাল বৈশাখীর মত৷ এ কেমন বৃষ্টি শুরু হলো আজ? এমন দুঃসংবাদ আসবে বলেই কি আজ তাদের চোখে এত ঘুমের টান ছিলো! মেহউইশ ঝুঁকে রেহনুমাকে তুলতে তুলতে ভাবছিলো ফুপিকে মিথ্যে বলা হয়েছে তবে কি রিশাদকেও মিথ্যেই বলবে! যা ফুপি জানে তা রিশাদকেও জানানো হোক। রিশাদ বাথরুম থেকে বেরিয়ে করিডোর দিয়েই আসতে হয় বলে সবটাই শুনেছে রেহনুমার কথা। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, চোখের কোণে জল চিকচিক করছে কিন্তু মুখে তেমন কোন অস্বাভাবিকতা নেই তার৷ মেহউইশ কি করবে কাকে সান্ত্বনা দেবে আর কাকে সামলাবে বুঝে পেল না।

ঝড় বাদল উপেক্ষা করেই পাহাড়ি রাস্তায় খুব সাবধানে গাড়ি চালিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছুলো রিশাদরা। তাৎক্ষণিক টিকেট পাওয়া অসম্ভব হলো না পরিচিত লোক থাকায় কিন্তু সমস্যা হলো ফ্লাইট টাইম পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে আবহাওয়ার কারণে৷ মেহউইশ একবার রিশাদ একবার ফুপির মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হলো। দুজনের মুখে বিমর্ষতা নেই তবুও মনে হলো মানুষ দুটোর ভেতরে তুফান চলছে। তারা কি বুঝে গেছে সত্যিটা! রিশাদ চুপচাপ বসে রইলো দু হাতে মুখ ঢেকে। মেহউইশের মনে হলো আর দেরি করা ঠিক হবে না। রিশাদ তার গাড়ি হোটেলে পাঠাবে বলে একজনকে ফোন করছিলো মেহউইশ বলল আমরা না হয় গাড়িতেই যাই এখানে বসে থেকে দেরি হবে। রিশাদ মনে মনে কি ভাবলো কে জানে সেও বলল ঠিক আছে চলো। রেহনুমা শুনতেই সে আর কোন দিকে চাইলো না। এলোমেলো পা ফেলে আগে আগে গাড়িতে গিয়ে বসলো।মেহউইশও এগোলো যতোটা দ্রুত সম্ভব নির্জনকে কোলে নিয়ে। রিশাদ স্থির হয়ে নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, ‘ মেবিশ৷ আব্বু নেই তাই না!’ থেমে গেল মেহউইশের পা দুটি থেমে গেল । সে বলতে চাইলো কিছু কিন্তু তার কন্ঠস্বর ছাপিয়ে কোন আওয়াজই বের হলো না রিশাদের মুখের দিকে তাকিয়ে৷ তারও চোখ ঝাপসা হতেই রিশাদ হাঁটু মুড়ে সেখানেই দপ করে বসে পড়লো।

চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here