###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
পর্ব_১৩
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
নামটা শুনেই ধপ করে পুকুর ঘাটেই বসে পড়ে বেলী । আজ প্রায় ১০ মাস পর রাজুর কথা আবার মনে পড়লো বেলীর । নিঃশব্দ মুখে শান্ত চোখ জোড় বেয়ে ক্রমাগত পানি গড়িয়ে যায় গাল বেয়ে বেলীর । সারাদিনের পর ক্লান্ত শরীরটা তার এই কথাটার জন্য প্রস্তুত ছিল না । এমন সময় ময়না আবার বলে উঠে ,
– আমি তো পুরাই অবাক হইছিলাম ফোন পাইয়া ।
– কি কইলো সে ?
– তোর কথা জিগাইছে ,
– কি ,,,,,?
– শুনলাম বেলীর বিয়ে হইছে , বেলী কি এখন ঢাকা থাকে ? – এই সব বললো ,
– কি বললি তুই ?
– আমি বলেছি আমি সঠিক জানি না ।
– ভালো করছিস , কখনো বলিসও না ।
– তার কাছে হয়তো ভালোই থাকতি তুই , জানিস চাকরি করে একটা , অনেক ভালো টাকা বেতন পায় ।
– আমি এখন অন্যের বউ রে , এইসব শুনাও গুনাহ । জেনে শুনে গুনাহ কিভাবে করি ।
– ১০ মিনিট কথা বলছিল ৭ মিনিটই তোর কথা বললো ।
– আমার কথা কখনো বলিস না , তার সামনে কখনো হয়তো যাইতে পারবো না ।
– এটা রাখ ,
– কি এটা ?
– রাজু ভাইয়ের নাম্বার ,
– এটা আমার কোন কাজেই লাগবে না , বাদ দে ।
– রেখে দে বেলী , যদি কখনো ভালো লাগে কথা বলে নিস ।
এই বলে ময়না কাগজের টুকরো টা বেলীর হাতে দিয়ে দেয় । তারপর বেলীর সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ময়না বিদায় নেয় । বেলী তখনও ঘাটে বসা । আসর আজান পড়ে যায়৷ কানে আজানের আওয়াজ পেতেই লাফিয়ে উঠে সে । তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে যায় । আজ সন্ধ্যার পর হয়তো তাকে শ্বশুরবাড়িও যেতে হবে কারণ রহমান আলী চান এক রাত তার কাছেও থাকবে তার ছেলে আর ছেলের বউ । বাড়ি এসে নিজের রুমে যায় বেলী । ইরফান তখন ওইদিক ফিরে শুয়ে আছে । আজ সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে মানুষটা । তাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে । এইটা ভেবে বেলীও চুপচাপ কোন শব্দ ছাড়া কাজ করে । আস্তে করে নিজের পার্সের মধ্যে ময়নার দেয়া কাগজের টুকরোটা রেখে দেয় । তারপর অযুর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় রুম থেকে । কল পার থেকে অযু করে ঘরে এসে নামাজ আদায় করে নেয় বেলী ।
সন্ধ্যা হতে আর বেশিক্ষণ সময় নেই । বেলী সব গুছিয়ে নিয়েছে । কালকেই আবার ঢাকা ফিরতে হবে তাদের । আবার সেই বন্দী জীবন । নিজের স্বামী আর সতীনের সংসারে ফিরতে হবে তাকে । অপরদিকে রাজুর কথা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে । এদিকে ইরফানও খেয়াল করছে বেলী কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেছে । কিন্তু সে কিছু বলেনি বেলীকে ।
মায়ের থেকে একেবারে বিদায় নিয়ে বেলী আর ইরফান বেরিয়ে পড়ে । একটা রিক্সা ধরে উঠে যায় বেলী আর ইরফান । ১০ মিনিটের রাস্তা , তাই বেশি একটা ঝামেলাও হয়নি পৌঁছাতে তাদের । বেলী পুরো রাস্তা চুপচাপ ছিল । ইরফান প্রথমে ভেবেছে তার মায়ের জন্যে মন খারাপ তাই সে আর তেমন কিছু বলে নি ।
বাড়ি পৌঁছে শ্বশুরকে সালাম করে নেয় বেলী । ঘরের ভেতরে গিয়ে বেলী একটু অবাক হয়ে যায় । পুরো ঘরটাই এলোমেলো হয়ে আছে । অথচ ইরফান একজন কাজের মহিলা ঠিক করে দিয়েছিল । সেই মহিলা থাকা স্বত্ত্বেও ঘরবাড়ির এই অবস্থা । তাই ইরফান রাগারাগি করে । অন্যদিকে বউয়ের হাতে রান্না খাবেন বলে রহমান আলী বাজার করে এনেছেন বিকালেই । তা দেখেও ইরফান ফোপাতে থাকে । এখন এই সন্ধ্যার পরে বেলীকে আবার চুলার কাছে যেতে হবে । গ্যাস হলে সমস্যা ছিল না কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মাটির চুলা বলে । কিন্তু বেলী একবারের জন্যেও বলেনি যে তার রান্না করতে সমস্যা হবে । তাই বুদ্ধি করে আগে আগে ইরফানের রুমের বিছানার চাদর পালটে নতুন চাদর বিছিয়ে পুরো রুম পরিষ্কার করে দেয় বেলী । নয়তো দেখা যাবে ইরফান রাতে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবে কিন্তু রুমে আসবে না । এক ঘন্টার মত সময় নিয়ে সব পরিষ্কার করে দেয় বেলী । আর কাল সকাল সকাল উঠে পুরো বাড়ি পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে । কারণ তারা দুপুরের বাসে যাবে । এরই মাঝে রহমান আলী ডাক দেয় বেলীকে ।
– বউমা ,,,,,,,, ও বউমা ,,,,,,,,,?
– জ্বি বাবা ,
– এখন কি রান্না করবা ? নাকি কালকে করবা ।
– বাবা এখনি যাইতেছি আমি পাকেরঘরে । আপনার ছেলের রুমটা পরিষ্কার করলাম একটু বাবা ।
– ওহ ,
– বাবা , খালা কি কাজ করে , সব কিছু এমন এলোমেলো কেন বাবা ?
– কি জানি মহিলায় কি ছতরবতর কাজ করে , বুঝি না আমি ।
– আচ্ছা কাল সব বুঝিয়ে দিয়ে যাবো আমি ।
– আচ্ছা ,
শ্বশুরের সাথে কথা বলে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেলী রান্না ঘরে যায় । রান্নাঘরে সব কিছুই রাখা আছে তাদের । এইদিকে ইরফান ওদের বাড়ির ঘাটে বসে আছে । এরই মাঝে রুবির ফোন আসে । আশেপাশে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে ইরফান ।
– হ্যাঁ ,
– কবে আসবা ?
– কাল ,
– তাহলে আমায় এসে নিয়ে যাবা ।
– অসম্ভব , নিজে যেমন গেছো ঠিক তেমন আসবা ।
– মানে কি ?
– মানে আমি যা বললাম তাই । নিজে গেছো আর নিজেই আসবা ।
– আর যদি না আসি ?
– তাহলে আলহামদুলিল্লাহ আমি বেঁচে যাবো ।
– এত সোজা ?
– রাখছি ,
লাইন কেটে দেয় ইরফান । ইদানীং রুবিকে তার অসহ্য লাগে । ইচ্ছে করেই কথা বলে না সে রুবির সাথে । কেন জানি বেলীর আশেপাশে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ইরফান । ইরফানের মনের ঘরে তারই অজান্তে এখন বেলীর বিচরণ । তার মনে এক এক সময়ে এক এক ভাবনা , কখনো মন চায় বেলীকে নিয়ে হারাতে ওই দূর অজানাতে আবার কখনো মন চায় নিজেই হারাতে বেলীর মাঝে । বেলীর মাঝে কিছু তো একটা আছে যা ইরফানকে খুব করে টানে ।
মোবাইল টা অফ করে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই দেখে উঠানের এক সাইডে রান্নাঘরে আলো জ্বলছে । ইরফান পা বাড়াতেই দেখে বেলী রান্না করে । একা হাতে এই রাতের বেলা রান্না করছে মেয়েটা । ঢাকাতে তো মিনু সাহায্য করতো কিন্তু এখানে তো একদম একা । বেলী এতইটাই শান্ত যে বেলীর হাতে ঘটি বাটিও শব্দ করতে পারে না । ইরফান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের ভেতর চলে যায় । নিজের রুমে ঢুকে সে রীতিমত অবাক হয়ে যায় । সব কিছু পরিষ্কার , বিছানার চাদর থেকে শুরু করে রুমে যা যা ফার্নিচার ছিল সব পরিষ্কার করা । এমনকি রুমের পাপসটা পর্যন্ত পরিষ্কার করা । ইরফানও বুঝে যায় এটা বেলী ছাড়া অন্য কারো কাজ না । ইরফান বুঝে উঠতে পারে না , বেলী এত কাজ করে কিভাবে । বেলীর জায়গায় রুবির কাছে যদি তার বাবা আজকে রান্নার আবদার করতো হয়তো এই জীবনেও তার বাবার সেই আবদার পূরণ হতো না । আর সে জায়গায় বেলী বিনা কথায় সব করে ।
এইসব ভাবতে ভাবতেই বেলীর ডাক পড়ে ,
– শুনছেন ,,,,,,,?
-………..
– শুনছেন , ঘুমিয়ে গেছেন ?
– ওহ তুমি , চোখটা লেগে আসছিলো ।
– খাবার বাড়ছি , খেতে আসেন ।
– হু ,
ইরফান বেলীর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তার নিজেরই খেয়াল নেই । হয়তো এরই মাঝে বেলীর সব রান্না হয়ে গেছে । ইরফান আর দেরি না করে খেতে চলে যায় সেখানে ইরফানের বাবা ৷ রহমান আলী তার জন্যে অপেক্ষা করছে ৷
ইরফান ও রহমান আলী খাবার খাবে এমন সময় রহমান আলী বেলীকে তাদের সাথে খেতে বলে ,
– বউমা ,,,,,,,?
– জ্বি বাবা ,
– আমাগো সাথে খেয়ে নেও ,
– আপনারা খান বাবা , পরে আমি খেয়ে নিবো ।
– পরে তুমি কি একা একা খাবা নাকি মা , এখনই বসে পড়ো ।
– বাবা আপনারা খান ,
– বাবা বলতেছে তো বসার জন্যে , বসে খেয়ে নিলে কি হবে তোমার ?
ইরফানের এমন কথায় ভয় পেয়ে যায় বেলী । কারণ কথাটা একটু জোরেই বলেছে ইরফান । তাই রহমান আলীও ইরফানকে ডাক দেয় এই ব্যাপার নিয়ে ।
– ইরফান , বউমাকে ধমকাস কেন তুই ?
-…………….
– আমি তো বলতেই আছি , মাতাব্বরি করবি না একদম , এটা আমার মা ।
মা তুমি বসো , আমার সাথে কয়টা খেয়ে নেও ।
শ্বশুরের কথায় বেলীও খেতে বসে যায় । রহমান আলীর অনেকদিনের শখ ছিলেন লাউ চিংরি খাবেন তা আজ বেলী পূরণ করে দিয়েছে । ইরফানের জন্যে আলাদা করে মাছ ভুনা আর চিকেন ঝোল করেছে , আর তার বাবার জন্যে লাউ চিংরি , পুটি মাছ ভাজা , চিংরি ভর্তা করেছে বেলী । বেলী শুধু একটু ভর্তা দিয়ে অল্পকয়টা ভাত খেয়েছে । ইদানীং খাওয়ার প্রতিও তার অরুচি ধরে গেছে । কিছুই খেতে ভালো লাগে না তার ।
– কিরে মা , এই কয়েকটা ভাত নিলি ?
– বাবা এই কয়টাই বেশি ।
– হায় হায় বলে কি ? এমনে খেলে তো অসুস্থ হয়ে যাবি ।
– নাহ বাবা আমি ভালোই আছি ।
ইরফান আড় চোখে নজর দিয়ে বেলীকে দেখে । কিছু তো একটা হয়েছে বেলীর । কেমন জানি লাগছে তাকে , বেলী তো এইভাবে থাকে না । শান্ত থাকে কিন্তু এমন ভাবে থাকে না এটাই ইরফানের খটকা লাগছিল । ইরফান আর কিছু না বলে চুপ করে খেয়ে উঠে যায় । এইদিকে বেলীও সব গুছিয়ে রেখে রুমে যায় । ইরফান তো খাটে শুয়ে মোবাইল টিপছে । ইরফানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে বেলী । এই সেই রুম আর এই সেই খাট যেখান থেকে ইরফান বাসর রাতেই তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় আর বলেছিল ” তুই যদি এক বাপের জন্মের হয়ে থাকিস আমার আশেপাশেও ঘেষবি না ” । কথাটা আজও মনে আছে তার । আর তারপর একদিন ভুলবশত দুধ পড়ে যাওয়ায় জুতা মেরেছিল । নিয়তি বড্ড বেশি খেলা করে গেছে বেলীর সাথে । নিয়তি বেলীর কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেলো বিনিময়ে কিছু দিয়ে গেলো না । এইসব কিছুক্ষন ভেবে তারপর ফ্লোরেই মাদুর পাততে থাকে বেলী । বেলীর মাদুর পাতা দেখে ইরফান তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । তারপর অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় নিচু স্বরে বেলীকে ডাক দেয় ইরফান ,
– বেলী,,,,,,,,?
– জ্বি ,
– মাদুর কেন পাতো ?
– এখানেই শুবো ,
– বিছানায় কি হয়েছে ?
– আমি এক বাপের জন্মের ।
কথা শুনেই ইরফান কিছু উপলব্ধি করতে পারে । আর তখনই খাট থেকে নেমে বেলীর কাছে যায় সে । বেলীর বাম হাত টা ধরে আর বলে ,
– কোন রকম তামাশা চাই না , খাটেই শুবে তুমি , যাও ।
– আমি এখানেই ঠিক আছি ।
– এমন আছাড় দিবো , যাও খাটে ।
তবুও বেলী দাঁড়িয়ে আছে সেখানে । ইরফানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায় । টানতে টানতে বিছানার কাছে নিয়ে যায় সে বেলীকে । তারপর জোর করে শুইয়ে দেয় বেলীকে ।
– যদি উঠেছো তো , আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না ।
– এভাবে জোর করলে কি মুখের কথাটুকু ফেরত নিতে পারবেন । কথায় আছে , বন্দুকের গুলি , ধনুকের তীর , ফেলে দেয়া থুতু আর মুখের কথা কিছুই ফেরত যায় না , শুভ রাত্রি ।
এইটুকু বলে বেলী চোখ বন্ধ করে ফেলে । ইরফান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । তারপর নিজেও এপাশে এসে শুয়ে যায় । একটা সময় সেও ঘুমিয়ে যায় ।
গভীর রাতে ইরফানের ঘুম ভাঙে কারো কান্নার শব্দে । ইরফান ঘুম থেকে উঠে দেখে বেলী পাশে কাঁদছে । এত রাতে কি জন্যে এইভাবে কাঁদছে সে , প্রশ্নটা মাথাতে এলেও তাৎক্ষনিত সে কি করবে বুঝতে পারছিল না । অন্যদিকে বেলীও ঢুকরে কাঁদছে । ইরফানের আর সহ্য হয় নি ইরফান বেলীর কাধে হাত দিয়ে বেলীকে এক পাশ থেকে সোজা করে শুইয়ে দেয় ,
– কি হয়েছে ?
-……….
– এত রাতে কাঁদতেছো কেন ?
-………..
– বেলী কি হয়েছে বলো ?
– একটা দাড়িপাল্লা , তার দুটো পাল্লার এক পাশে সুখ আর অন্যপাশে দুঃখ । মাপলে কেন দুঃখের পাল্লাটাই ভারী হয় , বলতে পারেন ?
বেলীর এমন কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় ইরফান , ড্রীম লাইটের আলোতে ইরফান বেলীকে দেখছে নিবিড় ভাবে । বেলীর চোখের পানিগুলো চিক চিক করতেছে ।
– বলুন না , কেন সুখের চাইতে দুঃখের পাল্লাটা ভারী হয় ?
– বেলী কেঁদো না
– আমার সুখ চাই ,
– বেলী !!
– হ্যাঁ , আমার সুখ চাই । আজকে আপনার কাছে আমি আমার অধিকার টুকু চাই । দেবেন ?
-…………..
– এই বলেন না , দিবেন ?
-……………
– আমি সহ্য করতে পারি না , এইভাবে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয় । আমি মরে যাবো এইভাবে থাকতে থাকতে ।
– বেলী কি সব বলছো ?
– শুনেন না , আজ আমায় একটু ভালোবাসবেন ?
-………….
– এই আমার দিকে দেখেন , আমার আপনাকে চাই , আপনার এই শরীরটা আমার চাই , আপনার অংশ চাই আমি ।
-……………
– শুনতে পাচ্ছেন আপনি , আমার আপনাকে চাই । এতদিন পর আজ চাইছি আপনাকে , দিবেন না আমায় আপনাকে ?
-…………
– ইরফান এইদিকে দেখেন , এক রাতের জন্যে চাই আপনাকে । এই শরীরটা আপনার শরীরকে চায় ইরফান । আমার দিকে তাকান ।
-………….
– ইরফান চুপ করেই থাকবেন ? কিছু বলবেন না ? ইরফান এমন যেন না হয় , আপনি আসলেন আমার কাছে কিন্তু আপনাকে পাওয়ার জন্য আমিই রইলাম না ।
ইরফান আর কথা না বলে থাকতে পারেনি , ওই অবস্থাতেই বেলীকে জড়িয়ে নেয় ইরফান । বেলীও ইরফানকে জড়িয়ে নেয় । আজ বেলী ধরা দিয়েই দেয় তার ভালোবাসার কাছে । ইরফানের স্পর্শ পেয়ে বেলী আরও আঁকড়ে ধরে ইরফানকে । আজ বেলী কাঁদছে , ঢুকরে কাঁদছে আর ইরফানকে বলছে ,
– ইরফান আজ কোন কথা না বলি , আজ শুধু ভালোবাসুন । কোন শর্ত ছাড়া ভালোবাসুন আমায় ।
বেলীর কথায় ইরফান বেলীকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । নিজের গায়ের কাথাটা সরিয়ে বেলীর কাথার নিচে ঢোকে ইরফান । বেলীর গায়ের ওড়নাটা সরিয়ে নেয় সে । বেলীর কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একে দেয় ইরফান । বেলীর নিঃশ্বাস যেন সেখানেই বন্ধ হয়ে যায় । বেলীর হাতের বন্ধনে নিজের হাত আবদ্ধ করে নেয় ইরফান । শরীরের নিচে দু জোড়া পা একে অপরকে জড়িয়ে নেয় । ইরফানের ডান হাতটা বেলীর গাল গলা কাধ স্পর্শ করে যায় । এক সময় হাতটা বেলীর পিঠে চলে যায় । বেলীর বাম কাধ থেকে ইরফান জামাটা টেনে নিচে নামিয়ে নেয় । বেলী যত শক্ত করে পারে আঁকড়ে ধরে ইরফানকে ।
বাহিরে ডাহুক পাখি ডেকে উঠে , সাথে ঝিঝি পোঁকার শব্দ । আজ আকাশে পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে । সেই আলোয় দুটো শরীর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে । ভালোবাসা গুলো জানান দিচ্ছে । পুরো ঘর জুড়ে চাপা আর্তনাদ । আজ কারো মুখেই কথা নেই শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া । মিলনের মাঝে ক্লান্ত শরীরে ইরফান যখন বেলীকে জড়িয়ে নেয় ঠিক তখনই বেলীর নিঃশ্বাস জোরে জোরে পড়া শুরু করে । একটা সময় বেলীর পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় । বেলী দুই হাত দিয়ে ইরফানের বুকে চেপে ধরে রাখে আর শ্বাস ফেলে । মনে হচ্ছিল তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে । ইরফান বেলীর গালে হাত দিয়ে বেলীকে সেন্সে ফেরানোর চেষ্টা করে । বেলী কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে । চোখে দিয়ে স্রোত বইছে পানির । ইরফান বুঝতে পারে বেলীর হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে । ইরফান উঠে বেলীর হাতে পায়ে মালিশ করছে । কিন্তু বেলীর শ্বাস আরও বেড়ে যায় । গলা কাটা মুরগির মত তরপাচ্ছে বেলী । কিন্তু কিছুই করতে পারছে না ইরফান । বাবা বাবা বলে কয়েকবার নিজের বাবাকে ডাকে ইরফান কিন্তু তার বাবারও খবর নেই । ইরফান বেলীর হাত পা টিপে দেয় , ডোলে দেয় , বেলীর মুখে শ্বাস দেয় । হঠাৎ বেলী কেশে উঠে । ইরফান বেলীর দুই গাল তার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে নেয় । ইরফান বুঝতে পারছে যে বেলীর খুব কষ্ট হচ্ছে । মুহুর্তের মাঝে শরীরের সব উত্তেজনা শেষ হয়ে যায় । বেলী বহুত কষ্টে কিছু কথা বের করে মুখ থেকে তবে শ্বাসকষ্টের জন্য সব টা আসে না কথা তবুও চেষ্টা করে সে ।
– বলেছিলাম না , সময় হয়তো না ও থাকতে পারে । আপন করে নিতে আমায় , কত মেরেছেন আমায় , কত আঘাত দিয়েছেন , এখন আপনি মুক্ত , আমি আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে চলে গেলাম ।
ইরফান অশ্রু চোখে বেলীকে বার বার ডাকছে । আর বেলীর শ্বাস আরও বেড়ে গেছে , ইরফান বেলীকে বার বার ঝাকড়াচ্ছে কিন্তু এক সময় বেলী নিস্তেজ হয়ে যায় । হাত জোড়া ইরফানের বুক থেকে সরে খাটের মধ্যে পড়ে যায় । ইরফান কয়েকবার বেলী বেলী বলে চিৎকার করে কিন্তু বেলী আর সাড়া দেয় না । নাকের কাছে হাত নিতেই দেখে বেলীর আর নিঃশ্বাস পড়ছে না । বেলী মারা গেছে । হ্যাঁ বেলী মারা গেছে । বেলীর চোখে দিয়ে দম গেছে । শান্ত চোখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে আছে সে । এই অন্ধকারেই বেলী তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ।
..
ঘামার্ত শরীর নিয়ে ইরফান লাফিয়ে উঠে । বেলী বলে চিৎকার করে উঠে সে । তবে সেই চিৎকারের কোন শব্দ হয় নাই । সব কথা যেন আজ ভেতরে রয়ে গেছে । ইরফান এদিক সেদিক তাকায় । নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে সে । পুরো শরীর কাঁপছে তার । কপালে ঘাম জমে গেছে । তাড়াতাড়ি উঠে লাইট জ্বালায় ইরফান । বেলী তখন ওইদিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে আছে । ইরফান দৌড়ে গিয়ে বেলীর পাশে দিয়ে নিচে ফ্লোরে বসে পড়ে । ভালোভাবে বেলীকে দেখছে সে । তারপর বেলীর নাকের কাছে নিজের হাত নিয়ে দেখে । নাহ বেলীর নিঃশ্বাস তো ঠিকই আছে । বেলীর গায়ের কাথাটা হালকা সরিয়ে বেলীর শরীরের দিকে তাকায় সে । শরীরে জামাকাপড় তো ঠিকই আছে । তাহলে তখন এইটা কি ছিল । ইরফানের শরীর তখনও কাঁপছে ।
কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর ইরফান অনুভব করতে পারে যে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল । হ্যাঁ , ইরফান স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষন ধরে । এক ভয়ার্ত স্বপ্ন , যা কল্পনাতেও আনতে পারেনি সে । এটা কেমন স্বপ্ন দেখলো সে যেখানে তারই সামনে তারই বাহুতে বেলীর মৃত্যু ঘটে গেলো । সে খাটের পাশে টেবিলের উপর পানি দেখতে পায় । গলাটা তার শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে তাই সে দ্রুত জগ দিয়েই পানি গুলো খেয়ে নেয় । খুব ভয় করছে তার , এটা কেমন স্বপ্ন দেখলো সে ।
– এটা কি দেখলাম আমি , এমন তো আগে কখনো হয় নি আমার সাথে । স্বপ্নে কারো মৃত্যু দেখলাম তাও বেলীর মৃত্যু । এমন লাগছে কেন ?
মনে মনে বলতে থেকে আবারও বেলীর দিকে যায় সে । মাঝে একবার ঘড়িতেও চোখ বুলায় সে । রাতের শেষ ভাগ চলছে এখন । কিছুক্ষণ পরেই হয়তো মোরগ গুলো ডাকাডাকি করবে । প্রায় ভোরের দিকেই স্বপ্নটা দেখেছে সে । অনেকের কাছে শুনা ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় যে কোন দিন । যদি এটাও সত্যি হয়ে যায় ? এইসব ভাবা বন্ধ করে আবারও বেলীর পাশে এসে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে ইরফান । বেলীকে ভালো করে দেখে নেয় সে । আবার চেক করে নাকে হাত দিয়ে । শ্বাস পড়ছে কিনা । তবে সব কিছুই ঠিক আছে । বেলী ঘুমাচ্ছে , শান্ত হয়েই ঘুমাচ্ছে সে ।
ইরফান উঠে লাইট অফ করে দেয় । তারপর আবার শুয়ে পড়ে । কিন্তু তার শরীর এখনও কাঁপছে । বুকটা ধুক ধুক করছে তার । ইরফানও হালকা পাতলা দোয়া দুরূদ পারে । তাই ঘুমানোর আগের দোয়া ” আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়াহিয়া ” পড়তে থাকে । তারপর কোন ফাঁকে যে ঘুমিয়ে পড়ে সে নিজেও জানে না ।
.
.
চলবে…………………