ঝরে যাওয়া বেলীফুল পর্ব -১৯

###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
পর্ব_১৯
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকালবেলা ঘুম ভেঙেই বেলীর মুখটা দেখতে পায় ইরফান । চুপটি করে গালে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছিল মেয়েটা । বেলীর মুখের মাঝে কিছু তো আছে যার মায়ায় বার বার পড়ে যাচ্ছে ইরফান । ইরফানের ভালো লাগা , মন্দ লাগা , ভালো থাকা , মন্দ থাকা সবটাই যেনো এখন বেলীকে ঘিরে । ঘড়িতে নজর দিয়ে দেখে সকাল সাড়ে ৮ টা বাজে । আজ লেট হয়ে গেছে তার । ডান হাত দিয়ে বেলীর কপাল ছুয়ে দেয় সে , নাহ এখনও জ্বর ছাড়ে নি তবে তেমনও জ্বর নেই । কাল রাতের মেডিসিনটা একটু হলেও কাজ করেছে । তারপর নিজের বুকের উপর থেকে বেলীর বাম হাতটা আস্তে করে সরিয়ে নেয় ইরফান । আস্তে করে বেলীর পাশ থেকে উঠে যায় সে । ফ্রেশ হতে হবে তাকে , অফিসেও যেতে হবে ।
আস্তে করে দরজা খুলে নিজের রুমে যায় ইরফান । গিয়ে অনেকটাই অবাক হয়ে যায় ইরফান । আজ রুবি সজাগ , যেই রুবি দিন ১০ টা বাজেও ঘুম থেকে উঠে না , সেই রুবি সকাল ৯ টা বাজতে উঠে গেল কিভাবে ? ইরফান ততটা পাত্তা দেয় নি । টাওয়াল নিয়ে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়াতে নিলে রুবি আটকায় তাকে ।

– গোসল করবা ?
– মানে কি ?
– সারা রাত তো তার সাথে কাটাইলা , তা এখন তো ফরজ গোসল করতেই হবে তাই না ?

রুবির মন মানসিকতা বার বার ওইদিকেই ইংগিত করে । যা ইরফানের মোটেই ভালো লাগে না । সে কিভাবে এইসব কথা বলতে পারে এইটাই ইরফানের মাথায় আসে না ।

– রুবি , তুমি কি শুধু এক সাথে থাকা মানে সেক্সই বুঝো ?
– সত্যি বললাম বলে জ্বালা ধরে গেছে তাই না ?
– এটা মোটেও সত্যি না , রুবি বেলী অসুস্থ , খুব অসুস্থ । তুমি ভাবলে কি করে এই অবস্থাতে আমি আর ও । রুবি মাঝে মাঝে একটু বেশিই ভেবে বসো তুমি ।
– যাক ভালো , সত্যিকে মিথ্যা বানিয়ে সত্যি বানাতে ভালোই পারো দেখছি ।
– তোমার সমস্যা কোথায় হচ্ছে রুবি ? তোমাকে সহ্য করে বেলী যদি এই ৭ মাস তেকই ছাদের নিচে থাকতে পারে তাহলে আমি একটা রাত শুধু ওর রুমে থেকেছি বলে তুমি এমন হুলস্থূল কান্ড বাধাচ্ছো ।
– কারণ আমি বেলী নই , আর তুমি ওই গাইয়া মেয়ের সাথে আমার কম্পেয়ার করবা না ।
– ও গাইয়া , ও মূর্খ কিন্তু তোমার মত এত আবাল না । ও গাইয়া , ও মূর্খ কিন্তু তোমার মত এত লেইম না রুবি ।
– ওহ রিয়েলি ?
– ইয়েস , রুবি এমন আচরণ করো না যাতে তোমার দিক থেকে আমাকে মুখ ফেরাতে হয় ।
– তাহলে বিয়ে কেন করেছো আমাকে ?
– লাইক সিরিয়াসলি রুবি ? আমি তোমাকে বিয়ে করেছি ? নাকি বিয়েটা দুজনের সম্মতিতে হয়েছিল , কোনটা ?
– যাই হোক , হয়েছিল তো ?
– আজ আর অফিস যাবো না আমি , তোমার সাথে কিছু কথা বলবো আজ আমি । আমি প্রশ্ন করবো , তুমি শুধু উত্তর দিয়ে যাবে ।
– আমার প্রয়োজন নেই ।
– কেন রুবি ? আমি ওয়াসরুমে যাবো ফ্রেশ হতে আর তুমি ফরজ গোসল নিয়ে আসছো । তুমি তো এই ৭ মাস আমার সাথে শুয়েছো , তুমি দেখো নি আমি কখন ফ্রেশ হই কখন গোসল করি ? ওহ সরি সরি , তুমি দেখবে কিভাবে তুমি তো দিন ১২ টা অবদি ঘুমে থাকো ।
– ইরফান বেশি বেশি হচ্ছে ।
– কোনটা বেশি বেশি , কি বেশি বেশি ? আমি যতদিন তোমার সাথে থেকেছি আমাদের মাঝে সেক্স কতবার হয়েছে বলো , সপ্তাহে দুইবার কি তিনবার আবার কোন সপ্তাহে একবারের জন্যেও না । যখন এইসব হতো না তখনও কি আমি ফ্রেশ হইনি ?
-………………
– লুক এট মি রুবি , এইসব নোংরা কথা কেন বলো , বলতে পারো । আমার অপরাধ একটাই আমি কেন দ্বিতীয় বিয়ে করলাম ।
– ওহ এখন অপরাধ হয়ে গেছে , সাধু পুরুষ তুমি ?
– মোটেও না , আমি নিজেকে সাধু কখনও ভাবি নি আর ভাববোও না । একটা কথার জবাব দাও তো রুবি , আমি যে বিবাহিত ছিলাম তুমি কি তা জানতে না ?
– জানতাম তো ?
– আমি কি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছিলাম , নাকি তোমাকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম ? তুমি সব জানতে , আমি বিবাহিত আমার বউ আছে সব সব । তবুও কেন পা বাড়ালে ।
– বাহ বাহ , এখন আমি অপরাধী হয়ে গেলাম । চাঞ্চ তুমি নেও নাই ?
– চাঞ্চ দিলে কে না নেয় রুবি ? বলো আমায় কে না নেয় । তুমি চাঞ্চ দিয়েছো , আমি অমানুষ চাঞ্চ নিয়েছি । আর এইসবের মাঝে থেকে ওই নিষ্পাপ মেয়েটা এতদিন কষ্ট পেয়ে গেছে । বিনিময়ে মুখ খুলে নি । কত মেরেছি , এক একবার মেরে অজ্ঞান করে রেখেছি , শরীরের ব্যাথায় মেয়েটা উঠে দাড়াতে পর্যন্ত পারে নি তখন আমি তোমার কাছে খুব ভালো ছিলাম । আর আজ আমি তার একটু সেবা করাতে আমি খুব খারাপ হয়ে গেলাম ।
-…………………
– তুমি মেয়ে সেও মেয়ে । তুমি আমার স্ত্রী এটা যেমন সত্যি , সেও আমার স্ত্রী এটা আরও বড় সত্যি । সব থেকে বড় কথা তুমি একজন মানুষ । কিন্তু তুমি মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের মৃত্যু কামনা করো । নিজে একজন মেয়ে হয়ে অন্য আরেকজন মেয়েকে গালিগালাজ করো , এইসব কি ঠিক করো ? তোমার ভাষণ অনুযায়ী তুমি শিক্ষিত আর বেলী মূর্খ । যেহেতু তুমি এত শিক্ষিত তাহলে মূর্খের মত কথা বলো কেন যে আমায় তাবিজ করা হয়েছে । তার মানে কি আমি বলতে পারি না তুমি এইসবে বিশ্বাস করো ?
– আমি একটা জিনিসই চাই , বেলী নামক কীটপতঙ্গ আমাদের জীবনে থাকবে না ।
– ও-কে কীটপতঙ্গ বলো না । মেয়েটা ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে , আল্লাহর কালাম পবিত্র কোরআন পড়ে , ওর সব চলাফেরা শরীয়তের দায়রার মাঝে পড়ে । আমি অধম হয়তো আগে কিছুই দেখিনি ওর । কারণ আমি তো পাগল ছিলাম তাই আসল হিরাকে কাঁচ ভেবেছি আর কাঁচকে হিরা ।
– বাহ বাহ , ও আমার বাল । বুঝলা তুমি ও আমার বাল । আই ডোন্ট কেয়ার এনি বেলী ফেলী ।
– ওকে , তুমি যে কেমন আমি হারে হারে বুঝে গেছি ।
– তাহলে আমায় বিয়ে করেছো কেন ?
– আবারও এক কথা বলে ? বিয়ে কি আমি একা করেছি নাকি তুমিও করেছো । তুমি তো জানতে আমি বিবাহিত , তুমি তো জানতে স্বামীর ভাগ তোমাকেও করতে হতে পারে , তুমি তো জানতে তোমাকে সতীন নিয়ে থাকতে হবে , তাহলে রাজি হলে কেন ? আর বিয়ের কথা আগে কে কাকে বলেছে ভেবে দেখো তো রুবি । তুমি তো চাইলেই পারতে আমায় ইগনোর করতে , তুমি তো চাইলেই পারতে আমায় ছাড়তে , কই তুমি তো ছাড়ার বদলে আরও চেপে ধরেছিলে । বেলী তো এইসব কিছুই জানতো না , তুমি তো জানতে , তাহলে ? তুমি মেয়ে হয়ে অন্যের স্বামীর দিকে হাত বাড়িয়েছো আর আমি শুধু হাতটা ধরেছি কেবল ।
– কি বলতে চাও তুমি ?
– কিছুই না , আমি চাই একটু শান্তি । যা আমি বেলীর কাছ থেকে পাই , আর তোমার কাছ থেকে পেইন পাই । তুমি অন্যের ঘর ভেঙে তার স্বামীকে নিয়ে সুখে থাকার স্বপ্ন যেমন দেখো তদ্রুপ সেই নারীও কখনো না কখনো তার নিজের স্বামীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে ।

রুবি আর ইরফানের কথোপকথনের মাঝে হঠাৎই ইরফানের ফোন বেজে ওঠে । রুবির দিক থেকে ধ্যান সরিয়ে মোবাইলের দিকে তাকায় ইরফান । মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে অফিস থেকে ফোন , ওইদিকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে ৯ টার উপরে বেজে গেছে । কথা বলতে বলতে সময় কোন দিক দিয়ে পার হয়ে গেছে বলতেও পারবে না সে ।

– আসসালামু আলাইকুম , কামাল ভাই বলুন !
– কোথায় আছেন ভাই ?
– এইতো ভাই বাসায় আছি ।
– অফিস আসবেন না , এত লেট কেন ?
– ভাই ওয়াইফ অসুস্থ ছিল , আর কিছুক্ষনের মাঝেই বের হবো ।
– ওকে ভাই , আসেন তাহলে ।
– জ্বি ভাই ।

ইরফানের কথা শুনে রুবি আরও জ্বলে উঠে যখন ইরফান তার কলিগকে বলেছে ওয়াইফ অসুস্থ । এটা রুবি ঠিক হজম করতে পারেনি । তাই সেও চুপ থাকে নি ,

– আমি তো অসুস্থ নই ।
– তো ?
– তাহলে ওনাকে কেন বললা যে ওয়াইফ অসুস্থ ?
– আরে আজব তো , বউ কি শুধু তুমি একা নাকি বউ তো আরও একজন আছে আমার , সে অসুস্থ । তার কথাই বলছি ।
– আর অন্যকিছু ছিল না ?
– কি ছিল , এত সহজ ভাবে কথা বললাম আর সে বলে আর অন্যকিছু ছিল না ? কি বলা উচিত ছিল আমার , যে ভাই আমার দ্বিতীয় স্ত্রী আমার আর আমার প্রথম স্ত্রীর মাঝে কাল রাতে সেক্স হয়েছে কিনা তার তদারকি করছে । এইটা বলা উচিত ছিল কি ?

ইরফানের এমন কথায় একদম চুপ হয়ে যায় রুবি । রুবি কোন দিক দিয়েই ইরফানকে জব্দ করতে পারছে না । রুবি বার বার ডাইরেক্টলি ইন্ডাইরেক্টলি বেলীকেই টার্গেট করছে । সে বার বার এত কিছু বলেও কোন কাজ করতে পারছে না । আপাতত চুপ হয়ে যায় সে ।
অন্যদিকে আজ মিনু-ই একা একা নাস্তা বানিয়ে রাখে টেবিলে । ইরফান রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে আসে । মিনু সব সামনে সাজিয়ে রেখেছে । তবুও কিছু একটা মিসিং । ইরফান টেবিলে ভালো মত চোখ বুলায় , কিছু তো মিসিং পাচ্ছে সে ।

– কিও ভাই খান না কা ?
– কিছু জিনিস মিসিং ।
– হেইডা কি ?
– মানে কিছু জিনিস দেস নাই তুই ।
– তা কি দেই নাই কন , সবই তো দিছি । খাইয়া লন দেহি ।
– খাচ্ছি , বেলী উঠছে ?
– হু ,
– কখন ?
– আপনে যখন রুমে গেছেন তার পরখানেই উঠছে ।
– মুখ ধুয়েছে ?
– হ ,
– নাস্তা দিছিস ?
– দিয়াইছি , খাইতো না কয় । আমি দিয়াইছি ।
– আচ্ছা ,

ইরফান আজ তেমন কিছু খায়নি । একটা ব্রেড খেয়েছে তাও শুকনো সাথে একটা ডিম । পানি খেয়ে সোজা বেলীর রুমে যায় সে ।
বেলী তখন বিছানায় বসে নাস্তার ট্রে টা দেখছিল । কেমন যেনো ঘিন ঘিন লাগছে তার কাছে এটা তার চোখে মুখেই বুঝা যাচ্ছে যা ইরফানের চোখে সহজেই ধরা পড়ে যায় । সে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় বেলীর । বেলী তখন নাস্তার ট্রে থেকে নজর সরিয়ে ইরফানের দিকে তাকায় ।
এক নজরে ইরফানের দিকে চেয়ে আছে সে । ইরফান আজ সাদা শার্ট পড়েছে তাও কালো জিন্স দিয়ে । ইন করা শার্টের আবার হাতা গুলোও ফোল্ড করা । একেবারে ক্লীন সেভও না আবার একেবারে দাড়িতেও ভরে নেই ইরফানের গাল জোড়া । এইভাবেই ভালো লাগছিল তার কাছে তার স্বামীকে । বেলী চেয়ে আছে তার স্বামীর দিকে । আর মনে মনে বলছে ,

– মাশা-আল্লাহ , একদম রাজপুত্র আমার স্বামী । কত সুন্দর দেখায় তাকে ।

বেলীর ভাবনায় ছেদ পড়ে ইরফানের ডাকে । ধ্যান ভেঙে সামনে তাকায় বেলী । ততক্ষণে ইরফান বেলীর পাশে এসে বসে গেছে । নাস্তার ট্রে টা সাইডে রেখে বেলীর কপালে হাত রাখে ইরফান । জ্বর মোটামুটি আছে শরীরে । তবে দেখে মনে হচ্ছে অনেক দুর্বল সে । ইরফান বেলীর গালে আলতো করে ছুয়ে দেয় । আর বলে ,

– কি ব্যাপার , খাচ্ছো না কেন ?
– এইগুলা খাবো না ।
– এইগুলা তো তুমিই রোজ বানাও , ডিম মামলেট , পরোটা , ভাজি , খাও তারপর সকালের মেডিসিনটাও তো খেতে হবে ।
– ডিম ডুম খাবো না , এইগুলাতে গন্ধ । সরান এইগুলা , মিনু কই ?
– কিসের গন্ধ , কি সব বলো তুমি বেলী ।
– ডিম খাবো না ,
– তাহলে শুধু পরোটা আর ভাজি খাও , তাড়াতাড়ি করো ।

বেলী তার নাক সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠিয়ে ফেলে ভাজি দেখে । কেন যেনো বেলী সব কিছুতেই ক্ষুত ধরছে ।

– ভাজি এমন ভর্তা ভর্তা কেন ?

এইবার ইরফানের মেজাজ খারাপ হচ্ছে । বেলী অহেতুক বাচ্চামো করতেছে । না খাওয়ার ধান্দা এইসব বেলীর । মোট কথা সে খাবে না , তাই এইসব করছে । এইদিকে ইরফানেরও অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে অফিসে । বেলীকে খাইয়ে দিয়ে মেডিসিন দিয়ে তারপর সে অফিসে যাবে । আর কোন কথা শুনেনি ইরফান । সোজা পরোটা ছিড়ে ভাজি নিয়ে বেলীর মুখের মধ্যে পুড়ে দেয় সে । তারপরও বেলী তা মুখের মধ্যে রেখেই চাবায় গিলে আর না । তারপর ইরফান পানি দিয়ে গিলতে বলে । বেলীও পানি দিয়ে গিলতে মাত্র একটা পরোটা খায় । ইরফান বেলীকে মেডিসিন দিয়ে মিনুকে ডাকে ।

– জ্বে ভাই ,
– আমি তো এখন অফিসে যাবো , ও-কে দেখে রাখিস ।
– আইচ্ছা ,
– দুপুরে যাতে ও ভাত খায় । কেমন ?
– আরে মাতারি এইডা খবিশ , পোলাপাইনের লাহান করে । খাইতে কইলেও খায় না ।
– আহহহহ , কিসব ভাষা ব্যবহার করিস তুই । যা বলছি তাই করিস ।
– আইচ্ছা , তা এই ডিম খানায় কি দোষ কচ্চিলো , খান নাই কিলিগা ভাবী ?
– তুই এইগুলা নিয়ে যা , ধর ।
– দেন ,

মিনু ট্রে নিয়ে চলে যায় । আর ইরফান বেলীর গালে আলতো করে ছুয়ে দিবে বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে ।

– আমি তোমার কাছে তো ২৪ ঘন্টা বসে থাকতে পারবো না তাই না ? অফিস আছে তো আমার । তুমি খেয়ে নিবে দুপুরে , কেমন ?
– হু ,
– আর হ্যাঁ ,
– কি ?
– কিছু না , ভালোবাসি,,,,,,

এই বলে বেলীর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে দেয় ইরফান । তারপর মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে ,

– একটা কথা বলি ?
– হু ,
– রুবি যদি এই রুমে আসে বা তোমাকে কিছু বলে , চুপ করে থাকার প্রয়োজন নেই । নিজের জন্যে স্ট্যান্ড নিতে শিখো আজ থেকে । আমি যেই ভুল করেছি তা হয়তো শুধরাতে টাইম লাগবে । তবে নিজের জন্যে ভাববে আজ থেকে । অন্যের জন্য নয় এমনকি আমার জন্যেও না । মনে যাতে থাকে , কেমন ?
-…………………
– চুপ করে থাকতে বলি নি তোমাকে , কিছু বলেছি তার উত্তর দেও ।
-………………….

বেলীর চুপ থাকা দেখে ইরফান আর বেশি কিছুই বলে নি । ইরফান জানে বেলীকে যদি রুবি মেরেও যায় তবুও সে কিছু বলবে না । কারণ বেলী এমন এক আল্লাহর বান্দা যে কিনা শত কষ্ট সহ্য করবে কিন্তু পালটা কাউকে কিছু বলবে না । ইরফান আল্লাহ হাফেজ বলে বিদায় নেয় বেলীর কাছ থেকে ।

ইরফান চলে যাওয়ার পর বেলী কেন জানি চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে । ইরফানকে ভেবে যাচ্ছে সে । বার বার ইরফানের মুখটা ভেসে আসছে তার সামনে । স্বামীর ভালোবাসা কি সে বিয়ের পর থেকে জানতো না । এই দুই দিনে সে বুঝেছে কেন মেয়েরা স্বামীর ভালোবাসার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে । ইরফান সত্যিই তাহলে বদলে গেছে , এইসব ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমের ঘোরে চলে যায় বেলী ।

অন্যদিকে , অফিসে বসে থেকেও কাজে মন বসছে না ইরফানের । কেমন আছে বেলী , দুপুরও হয়ে গেছে কি করছে সে এখন , খেয়েছে কিনা , মেডিসিন নিয়েছে কিনা , সব মিলিয়ে এখন এই মুহুর্তে তার মাইন্ড শুধুই বেলীকে ঘিরে চলছে । একটা খোঁজ নিতে পারলে ভালো হতো । অথচ নেয়ার উপায় নেই । বেলীর ফোনও নেই যে ফোন করবে । আবার রুবির ফোনে ফোন দিয়ে বেলীর খবর নেয়া মানে ৪র্থ বিশ্ব যুদ্ধকে যেচে আমন্ত্রণ করা । তাই আর এইসব ফোনের ব্যাপারে ভাবে নি ইরফান ।

বাসায় মিনু বেলীকে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ করিয়ে ভাত খেতে দেয় । বেলী যেই না ভাতে হাত দিয়েছে ওমনি রুবি হাজির সেখানে । বেলীর সামনে ভাত দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে রুবি ।

– জ্বর একটু হয়েছে , কত নাটক করলি তুই ?
-……………..
– এত অভিনয় কই থেকে শিখছিস ?
-……………..
– ভালো অভিনেত্রী হবি তো তুই ?
-……………..
– কিভাবে স্বামী কেড়ে নিতে হয় তুই ভালোই জানিস , নিজেকে আয়নায় দেখছিস ? কি যোগ্যতা আছে রে তোর ইরফানের সাথে থাকার ?
-……………….
– হ্যাঁ , গিল গিল ভাত গিল । গিলে গিলে হাতি হয়ে যা । তারপর মোটা শরীর দিয়ে ইরফানকে আরও বশ করতে পারবি ।

এইবার বেলীও মুখ খুলতে বাধ্য হয় । একে তো জ্বর দুয়ে শরীর ভালো নেই তার উপর এত কিছু বলছে রুবি । রুবির প্রতিটা কথাই নোংরা ইংগিত সম্পন্ন কথা । সব মিলিয়ে সেও বিরক্ত ।

– রুবি আপু আমি না করতেছি অভিনয় না করলাম নাটক । ওইটা আপনার কাছে মনে হচ্ছে আমার কিছু করার নাই । আর অন্যের স্বামী আমি কেড়ে নিচ্ছি না । আমি যদি বলি আপনি আমার স্বামী কেড়ে নিয়েছেন তখন কি হবে ? আর আমি ভাত এতটাও খাইনা যে হাতি হবো । যদি বলি শরীর দেখিয়ে আমার স্বামীকে আপনি বশ করেছেন , তখন কি হবে ? এতটাও খারাপ কথা বলবেন না যাতে পরবর্তীতে আপনার সাথে কথা বলতে গেলেও রুচিতে বাঁধে ।
– চুপ একদম , একদম চুপ ।
– আমার শরীর আসলেই ভালো নেই , আপনি আপনার রুমে যান ।
– ওহ আমি আসাতে এখন শরীর ভালো না তাই না ?
– দেখেন আপু আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না । আপনি আপনার স্বামীকে আপনার আঁচলের তলায় বেঁধে রাখুন । দেখুন আটকে রাখতে পারেন কিনা ? আমি তো আর তাকে বলি না যে আমার কাছে আসো এই সেই । সে আসে এতে আমার হাত নেই । আর হ্যাঁ স্বামীটা আমারও । আমি চুপ থাকি তার মানে এই না যে আমি বলতে পারি না । আমিও বলতে পারি আপু শুধু বলি না ।

বেলীর কথায় রুবির মুখ বন্ধ হয়ে যায় । বেলীর তাকে কথা বলা কথা গুলো জায়গা মত গিয়ে লাগে তার । এতটা বাড়াবাড়ি করে এই রুবি যে একে চুপ করানোর জন্যে অন্য কাউকেও এর মত ভাষা ব্যবহার করতে হয় । আদারওয়াইজ এই আল্লাহর বান্দি থামার পাত্রী না । রাগে ফুলতে ফুলতে বেলীর রুম থেকে বের হয়ে যায় রুবি । রুবি যাওয়ার পর পরই মিনু সেখানে হাজির । মিনুর মুখের ভঙ্গিমাই জানান দিচ্ছে যে সে সব শুনেছে । তাই বেলীও মিনুর হা করার আগেই বলে দিয়েছে ,

– মিনু এখন কিছু বলো না , খুব খারাপ লাগতেছে আমার কাছে । সো কিছু বলো না আর ।
– আমি কি কইতাম আর । সব আপনেই তো কইলেন । উফফফফ ভাবী যা কইলেন না , ওর থোতা মুখ আপনে ভোতা বানাইয়া দিছেন এক্কেরে ভালা করছেন ভাবী এক্কেরে ভালা করছেন । শয়তানি একটা , হেয় এহন পাগল হইয়া গেছে । শয়তানের হাফেজ । হেরফরে খুশি হমু ভাইয়ে এইডারে লাথি মাইরা ঘর থিকা বাইর কইরা দিলে ।
– আহহ মিনু , কি সব বলো । লাথি কেন মারবে তোমার ভাই । ও কি সংসার করতে আসে নাই ? ও কি আমার মত পাগল নাকি যে নিজের স্বামীকে অন্যের হাতে তুলে দিবে । পাগলেও আজকাল নিজের স্বামীর ভাগ দেয় না । সেই জায়গায় ও তো মানুষ ।
– তা আপনে কি ? মানুষ না ? আপনে দিছেন কেমতে ?
– আমার এই কপাল টা আছে না , এই কপালটার দোষ । আমার ভাগ্যে ছিল স্বামীর অবহেলা পাবো পাইতেছি । আমার ভাগ্যে ছিল সতীন নিয়ে ঘর করবো করতেছি । প্রতিনিয়ত এদের কথা শুনতে হবে শুনতেছি । আর কি লাগে ।
– হাত ধুইলেন যে ভাবী , খাইয়া লন ।
– নাহ এইসব নিয়ে যাও আমি আর খাবো না , পেট ভরে গেছে । আর খুব বেশি দরকার ছাড়া আমাকে জাগিও না ।

এই বলে বেলী হাত ধুয়ে ফেলে । এক লোকমা ভাতও পেটে যায়নি মেয়েটার । চুপ করে শুয়ে আছে , আর দুচোখ বেয়ে তার আপনা আপনি পানি পড়ে যাচ্ছে । আজ রুবির কথা গুলোয় আসলেই অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা । ইরফান বাসায় আসলে ইরফানকে কিছু কথা বলবে বেলী , এটা ভেবেই আস্ত্র আস্তে ঘুমিয়ে যায় সে ।

সারাদিন বেলী রুম থেকে বের হয় নি । রুবিও সোজা দুপুরের পর না খেয়েই বাপের বাড়ি চলে গেছে । সে এখানে এক মুহুর্তের জন্যও থাকবে না । তাই সে চলে যায় ।
রাত প্রায় ৮ টা নাগাদ ইরফান বাসায় আসে । মিনু দরজা খুলেই ইরফানকে সব বলে দেয় । রুবি বেলীকে কি কি বলেছে , বেলী রুবিকে কি কি বলেছে , রুবির চলে যাওয়া , বেলীর সারাদিন না খেয়ে থাকা সব সব বলে দিয়েছে মিনু ।

– মিনু আমার মাথাটা অনেক ধরে আছে , তুই আমার জন্যে কফি বানা । আমি আগে গোসল করবো তারপর বেলীর কাছে যাবো ।
– আইচ্ছা ।

ইরফান গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে মিনুও কফি নিয়ে হাজির হয় ইরফানের রুমে । কফিতে চুমুক দিতে দিতে ইরফান বেলীর রুমে যায় । গিয়ে দেখে বেলী ওপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে । ইরফান বেলীর পাশে গিয়ে বসে বেলীর কাঁধে হাত রাখে । তখনই বেলী চোখ খুলে একটা কথা-ই বলে দেয় ,

– আপনি চলে যান রুবি আপুর কাছে । আমার কপালে আপনার ভালোবাসা নেই আমি অভাগী এইভাবেই একদিন শেষ হয়ে যাবো । এভাবেই আমায় জীবনের শেষদিন অবদি কাতড়াতে হবে । কষ্ট পাইতেছি আর পাইতে হবে । তবুও পারবো না অন্য কোন নারীকে কষ্ট দিতে । আপনি রুবি আপুর কাছে চলে যান । আমি আপনাকে ভালোবাসি অনেক কিন্তু আপনাকে বেঁধে রাখতে পারবো না । মন জমিনে আপনার নাম আজীবন থাকবে তবুও অন্য কারো চোখের পানির কারণ হতে পারবো না ।

এই কথাগুলো বলে হু হু করে কেঁদে উঠে বেলী । তখন কেন জানি ইরফানের চোখ দিয়েও পানির স্রোত বয়ে যায় ।

.
.

চলবে…………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here