###__ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল__###
#পর্ব_২৯
লেখিকা : আফরোজা আক্তার
নারী পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক । একজন পুরুষের যেমন একজন নারীকে প্রয়োজন পড়ে , তেমনি একজন নারীরও একজন পুরুষকে প্রয়োজন পড়ে । কেউ কখনো একা থাকতে পারে না । জীবনে চলার পথটা বড় কঠিন । এই কঠিন রাস্তায় চলাটা বড্ড কঠিন । এখানে একজন সাথীর খুব প্রয়োজন । তবে প্রয়োজন নয় প্রিয়জন হয়ে প্রিয় মানুষের হাতটা ধরাই উত্তম । তাই এইখানে একটা ভরসার হাতের খুব দরকার । আর সেই ভরসার হাতটা অত্যন্ত আপন কারো হওয়ার-ই উচিত । এটাই হয়তো হয়েছে বেলী আর ইরফানের সাথে । দুজন ভালোবাসার মানুষ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একত্রিত হতে পেরেছে । যাদের ভেতরের মান অভিমান সব কিছু ধুয়ে মুছে গেছে ।
এভাবেই কেটে যায় একটি সপ্তাহ । ভালোবাসার মুহুর্ত গুলো অনায়াসেই অতিবাহিত হয়ে যায় । এই একটা সপ্তাহে বেলী তার না পাওয়া সুখ গুলোকে নিজের করে নিয়েছে । ভালোবাসা নামক সোনার হরিণ আজ বেলীর হাতের মুঠোয় । ইরফান যেন তার ভালোবাসার সব টুকু খনি ঢেলে দিয়েছে বেলীর আঁচলে । আজ বেলীর আঁচল সম্পূর্ণ কাণায় কাণায় ভর্তি ভালোবাসায় ।
রাতের খাবার খেয়ে ইরফান তখন বিছানায় শুয়ে আছে । বেলী তখন রুম গোছাচ্ছে । এরই মাঝে ইরফানের ফোনে ফোন আসে । রুবির নামটা দেখে একটু ভড়কে যায় ইরফান । সামনে বেলী আছে , যদিও বেলীর এইসবের দিকে খেয়াল নেই বললেই চলে যেখানে তার নিজের মোবাইল কোথায় থাকে তাই সে জানে না , ফোন আসলে শুধু রিসিভ করে এর বেশী আর কিছুই জানে না সে । এইসব জিনিসে তার আগ্রহ নেই বললেই চলে । বেলীর সামনে ফোনটা রিসিভ করা ঠিক হবে না বলেই ইরফান ফোন নিয়ে উঠে অন্য রুমে চলে যায় ।
– হ্যালো ,
– হ্যালো মিষ্টার ইরফান , কেমন আছেন আপনি ?
– ভালো আছি , তুমি ?
– আমি ভিষণ ভালো আছি , আপনি তো ভালো থাকবেনই , নতুন শরীরের গন্ধ গেছে নাকে তাই খুব ভালো আছেন তাই না ?
– মানে ?
– তা রাতে কয়বার হয় ?
রুবির কুরুচিপূর্ণ নোংরা কথা গুলো ইরফানের মেজাজ সহজেই খারাপ করে দেয় । ইরফানকে ইদানীং রাগতে দেখা যায় না খুব একটা । বাঘ যখন শান্ত থাকার পরে হিংস্র হয়ে ওঠে তখন সে আরও ভয়ংকর হয়ে যায় । তখন ইরফানেরও সেই অবস্থা হয়েছে । ইরফান দেয়ালে নিজের হাতটা দিয়ে সজোরে একটা ঘুষি মারে ।
– ওই তুমি কি বলতে চাও ?
– বলতে চাচ্ছি যে , এক বউ তো সরে গেছে এখন অন্য মেয়ে মানুষের শরীর কেমন লাগে আর কয়বার হয় রাতে নাকি রাত দিন বিকাল সব সময় লাগে ।
– shut up you bus,,,,,,,,,,,,,,,
– হা হা হা , আমাকে এখন গালিগালাজও করা হয় ।
– ওই তুই কি বলতে চাস ? হ্যাঁ , কি বলতে চাস । আমি কি পাড়ার মেয়ে নিয়ে রঙ তামাশা করি ? নাকি পাড়ার মেয়ে মানুষ নিয়ে শুয়ে থাকি ? নাকি আমার শরীরে এনার্জি ভরা থাকে যে সকাল বিকাল রাত শুয়ে থাকবো । তোকে নিয়েও কি শুয়ে থাকতাম নাকি ?
– খবরদার আমায় ওর সাথে কম্পেয়ার করবা না ।
– তুই কোথাকার প্রাইম মিনিষ্টার । শুন আমার কাছে ওর দাম যতটা আছে তোর দাম ওর থেকে এক আনাও নাই । হায়রে মেয়ে মানুষ , ওই মেয়ে আরও আমায় প্রতিদিন বলে তোকে ফিরিয়ে আনতে , আর তুই রাতের বেলা ফোন দিয়ে এত নোংরা ভাষায় ওর সম্পর্কেই কথা বলছিস , ছিহ ! তুই কি আসলেই মানুষ ?
– নাহ আমি অমানুষ , হয়েছে ? যাই হোক আমার প্রয়োজনে ফোন দিছিলাম আমি ।
– নাহ , কই তুই প্রয়োজনে ফোন দিছিস , তুই ফোন দিছিস জানতে আমি রাতে কয়বার করি , নিজেকে পরিষ্কার কর আগে । আমার তো নিজের কপালকে জুতা দিয়ে মারতে ইচ্ছা করে কোন কু-ক্ষনে তোর সাথে আমার জীবন আমি জড়িয়েছি ।
– খবরদার তুই তুকারী করবা না একদম !
– ভালো কথা কয়টা বলছিস তুই , রিসিভ করার পর নোংরা ভাষায় কথা বলছিস ।
– আমি ডির্ভোস ফাইল করে দিছি , এখন যখন আমার উকিল তোমাকে ফোন দিবে কোর্টে চলে আসবা ।
– বাহ চমৎকার , অসাধারণ ।
– অবশ্যই , আমি বলেছিলাম না হয় ও নয় আমি , ও-কে না ছাড়লে আমি তোমাকেই ছেড়ে দিবো । তুমি থাকো একটা থার্ড ক্লাস গাইয়া মেয়েকে নিয়ে ,
– ভালো থাক ,
ইরফান ফোন টা কেটে দিয়ে ফোন একদম বন্ধ করে দেয় । মেজাজ তার অনেক খারাপ হয়ে যায় । রুবি এত বাজে ভাবে কথা বলবে পারে আদৌ বুঝতে পারে নি সে । সে ভেবেছিল হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফোন দিয়েছে এখন দেখছে এইসবের সম্পূর্ণ উলটা । এক দিক থেকে ভালো হয়েছে । ডির্ভোস হয়ে যাওয়াটাই উত্তম । রোজ রোজ অশান্তির থেকে ডির্ভোসই উত্তম । যে নারী নিজের স্বামীকে হোক সে বিবাহিত হোক তার আরেক স্ত্রী আছে তাকে এত নোংরা কথা বলতে পারে সে নারী যে সেই স্বামীকে ঘুমের মধ্যে জবাই করে দিবে না তার কি গ্যারান্টি আছে ? ইরফান মেজাজ কন্ট্রোল করে রুমে যায় । বেলী তখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে । দরজা লাগানোর শব্দটা বেশ জোরেই হওয়ায় একটু ঘাবড়ে যায় বেলী । ইরফানের মেজাজ যে ভালো নেই তা বেলীর বুঝতে বাকি নেই । ইরফান বেলীর সাথে কথাও বলছে না তাই অনেক ভেবে নিয়ে ইরফানের সাথে নিজেই কথা বলে ,
– ঘুমাবেন এখন ?
– হ্যাঁ ,
– ওহ ,,,,,,,,,
-,,,,,,,,,,,,,,,,
– কে ফোন দিছিলো , ওই রুমে গেলেন দেখলাম ?
– রুবি ফোন দিছে ,
রুবির নামটা শুনে কলিজায় এক কামড় পড়ে বেলীর । বেলীর মন তখন সাথে সাথে এটাই বলে যে হয়তো এইজন্যই সে তার সাথে কথা বলতেছে না । বেলী আবারও জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় ,
– তাহলে কি সে আবারও আমার থেকে দূরে সরে যাবে ? আমায় আর ভালোবাসবে না , আমায় আর তার বুকে নিবে না ? রুবি আপুকি তবে আবার ফিরে আসবে ? আমার কপালে কি তার থেকে পাওনা সুখ এইটুকুই ছিল ?
এইসব কথা গুলো ভাবতে গিয়ে বেলীর গলা ধরে যায় । বুক ফেটে কান্না আসে তার । নিজেকে শক্ত করে নিয়ে সাহস করে আবার ইরফানকে জিজ্ঞেস করে ,
– কি বললেন তিনি ?
– ডির্ভোস ফাইল করছে , যেতে হবে ।
ডির্ভোসের কথা শুনে অনেকটাই অবাক সে । এত সহজেই কি ডির্ভোস দিয়ে দেয়া যায় ।
– আপনি যাবেন ?
– যেতে তো হবেই ,
– এইসবের কি খুব প্রয়োজন ?
– কোন সবের ?
– এইযে ডির্ভোস , আপনারা তো একে অপরকে ভালোবাসতেন , তাহলে এইসব কেন ?
– ভালোবাসাটাই যেখানে নেই সেখানে সম্পর্ক থেকে লাভ কি ?
– আমি বলি কি ? আপনি রুবি আপুর সাথে বসে কথা বলে নিন , তাহলে সব ঠিক হয়ে যেতেও পারে ।
বেলীর কথা শুনে এইবার ইরফান আরও রেগে যায় । চেঁচিয়ে এক ধমক দেয় সে বেলীকে ।
– টেনে এক থাপ্পড় মারবো তোমাকে আমি , চিনো তুমি আমাকে ? অতীত ভুলে গেছো নাকি তুমি , নাকি আবারও মনে করিয়ে দিতে হবে ?
ইরফানের এমন ধমকে বেলীর আত্মাটা কেঁপে ওঠে ।
– জনদরদি হয়েছো নাকি , সতীন বিদায় হলে অন্যরা খুশি হয় তোমার দেখি কলিজা পুড়ে যাচ্ছে । কার সাথে বসে কথা বলবো আমি , হ্যাঁ , কার সাথে ? যার জন্যে তোমার কলিজা পুড়ে সে তোমাকে নিচে নামানোর কোন সুযোগই হাত ছাড়া করে না , এটা কি জানো তুমি ?
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– কি , মায়া বেড়ে গেছে নাকি তোমার ? বলো তো বিয়ে আরেকটা করি । আরেক সতীন এনে দেই তোমার সংসারে । তার কলিজা ফেটে যায় একেবারে ।
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
– এই , নিচে কি দেখো ? আমার দিকে তাকাও , তুমি জানো রুবি ফোন দিয়ে কি নোংরা কথা গুলো বলেছে আমাকে আর তোমাকে নিয়ে ? ওর কথা অনুযায়ী তুমি পাড়ার মেয়ে আর আমি সেই পুরুষ যে পাড়ার মেয়ে নিয়ে শুয়ে আছি , আমি রাতে তোমার সাথে কয়বার করি , দিনে করি নাকি দুপুরে করি এইসব জানতে চায় সে ,
– থামুন ,,,,,,,,
– কেন এখন কেন থামুন বলো , আরেকটু শুনো । তোমার তো কলিজা ফেটে যায় । শুনো তার নোংরা ভাষা যা তোমায় নিয়ে করে সে । শুনো বেলী , ভালো হওয়া ভালো এতটা ভালো হওয়া ভালো না যে ভালো তোমার সর্বনাশ হয়ে দাঁড়ায় । কথাটা মনে রাখবা ।
– শুনেন না ?
– নাহ , আর কিছু শুনতে চাই না । আমার মাথা গরম আছে এখন , কিছু শুনলেই মাথা নষ্ট হবে , হয়তো হাত উঠে যাবে । ঘুমাও তুমি আর না পারলে সতীন বিদায়ের জন্যে কেঁদে কেটে বুক ভাসাও আমার দেখার প্রয়োজন নেই । তবে যা করবা রুমের বাহিরে গিয়ে । রুমে যদি কিছু শুনি , খোদার কসম লাথাতে লাথাতে নিচে ফেলবো । আমার ভালো এবং খারাপ দুই রুপ-ই তোমার জানা । এখন আর কোন কথাই বলবা না তুমি ।
এই বলে ইরফান শুয়ে যায় লাইট অফ করে । বেলী জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলে ,
– সময় জিনিসটা বড্ড বেশি স্বার্থপর । নিজের মন মতই ঘুরছে সে । কাল অবদি যেই আমি রুবির জায়গায় ছিলাম আর আজ আমার জায়গায় রুবি দাঁড়িয়ে আছে । আল্লাহ পাকের লীলাখেলা কেউ বুঝে আবার কেউ বুঝে না । ভালোবেসে কি লাভ হলো রুবি যখন মানুষটাকেই আর নিজের করে রাখতে পারলেন না ।
.
.
চলবে,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,