রাগের মাথায় আফীফ দেয়ালের সঙ্গে ফোনটা আছাড় মারতেই বিকশ শব্দে কেঁপে সেহেরিশ।দু-চোখ খিঁচে ভয়ার্ত চোখে আফীফের দিকে তাকাতেই আবার তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে জানালার সামনে দাঁড়ায়।তখনি তার কানে আসে সেহেরিশের তীক্ষ্ম কন্ঠ,
– আমায় বেধে রেখেছেন কেন?জমিদারের নাতি বলে কী গ্রামটাকে কিনে রেখেছেন? আপনার কথায় মানুষ কী উঠবে আর বসবে ?
মেয়েটির তীক্ষ্ণ ধারালো কন্ঠের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আফীফ।
– পাখি যখন অন্যর বাস গৃহে এসে ডানা ঝাপটায় তখন তাকে বেঁধে রাখাই শ্রেয়!
আফীফের কথা শুনে শুকনো কয়েকটি ঢোক গিলে সেহেরিশ কিন্তু তবুও দমে যায় নি বরং আরো বেশি রাগ নিয়ে চেচিয়ে বলে,
– আমি এত শত জানতে চাই না আমাকে বেঁধে রাখার কারন টা কী?
আফীফ পিলপিল পায়ে এগিয়ে আসে সেহেরিশের দিকে।ডান হাতটা দিয়ে সেহেরিশের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে,
– মনে করে দেখো ফুলপরি আজ থেকে কয়েক বছর আগের কথা।অতীতের কথা,এই গ্রামে আসার কথা আমার কথা।আমি যানি তুমি ভুলে যাওনি সব মনে আছে।শুধু ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছো। ঠিক আমাদের মতো একই অঙ্গভঙ্গিতে।
আফীফের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো সেহেরিশ। তার বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ হচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস দিগুন বেড়ে গেছে।লোকটি আবারো তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মেয়েটি কয়েক বার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে তার চিরচেনা অতীত।যে অতীতে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আজ এতটা বছর…
___
– কী করেছো তুমি?হায় হায় কি করছো তুমি!এই গ্রামে কেন এলে তোমায় না পাশের গ্রামে।দেখেছিলাম তবে তবে…এই গ্রামে কি তোমার।আর এই গ্রামে যখন আসলেই তখন কেন বাঘের খাঁচায় এসে এই বাঘটাকে রাগিয়ে দিলে?
বৃদ্ধা লোকটির কথা শুনে অশ্রুসিক্ত নয়নে চমকে তাকায় সেহেরিশ।কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই আচমকা কয়েকজন মহিলা তার হাত পেছনে মুড়িয়ে বেধে নেয়।
– আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেনা আমায়?ছেড়ে দিন বলছি।বাড়াবাড়ি করবেন না।আমি কে আপনারা চিনতে পারেন নি আমার বাবা জানলে আপনাদের ছেড়ে কথা বলবেন না।
সেহেরিশের কথায় পাত্তা না দিয়ে মহিলা গুলো তাকে টানতে টানতে জিপের কাছে নিয়ে যায়।জিপের কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আফীফ দেওয়ান।তার কপাল কুচকে বেশ রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে সেহেরিশের দিকে।সেহেরিশ ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে আফীফের দিকে তাকাতেই আফীফ তার চুলের মুঠি চেপে ধরে।
– আমার সাথে বেয়াদবি করার আস্পর্ধা কেউ করেনি, কেউ না! আর তুমি আমার গায়ে কাঁদা ছুড়েছো? সাহস কম না মেয়ে তোমার!যার গ্রামে এসোছো তাকেই বয়কট করছো!বাহ,বাহ!আপনারা নিয়ে যান ওকে। ড্রাইভার চাচা বাড়িতে পৌছে দেবে আপনাদের।
সেহেরিশ কিছু বলার আগেই আফীফের নির্দেশে মহিলা গুলো হিড়হিড় করে টানতে টানতে সেহেরিশকে জিপে করে নিয়ে যায়।কিন্তু রাগে অগ্নিশর্মা সেহেরিশ এক বারের জন্যেও আফীফের দিক থেকে নজর সরায় নি বরং তাকিয়ে আছে ধারালো দৃষ্টিতে।তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে আফীফ তাকিয়ে আছে নিষ্পলক ভাবে তার দিকে, ঠিক ততক্ষণ যতক্ষন না জিপটি তার দৃষ্টির অগোচর হয়।
– ব..বলছিলাম কি বাবা মেয়েটা ছোট মাফ করে দাও। না বুঝে অন্যয় করেছে মেয়েটাকে শাস্তি দিও না।
বৃদ্ধার কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আফীফ।গায়ে থাকা কাদারছিটে গুলোর দিকে নাক কুচকে সহসা জবাব দেয়,
– অন্যায়!বুঝে হোক,না বুঝে হোক আমি কখনোই ক্ষমা করিনা।আর এই মেয়েকে তো কোন দিন ও না।সারাজীবন ওকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।শুধুমাত্র তার ধারালো চাহনীর জন্য!
আফীফ বাঁকা হেসে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।এদিকে বৃদ্ধা ঢোক গিলে আফীফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
– আল্লাহ! বাচিঁয়ে দাও মেয়েটাকে।আফীফ দেওয়ানের কবল থেকে কেউ রক্ষা পায়নি আর এই মেয়ে কী করে পাবে। আল্লাহ সহায় হোন।
বাড়ির আঙিনায় সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেননা আফীফ দেওয়ানের শিকারি আজ একটি ছোট্ট কিশোরী।আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আফীফ তাকিয়ে আছে অন্যমনা দৃষ্টিতে। কিন্তু কিশোরীটির চোখে আফীফের জন্য ঘৃণা ছাড়া কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা।আফীফের দাদা আহনাফ দেওয়ান দুজনকেই পরখ করছেন অনেক্ষণ যাবৎ।
আহনাফ দেওয়ান গুরুগম্ভীর কন্ঠে সেহেরিশকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
– তোমার নাম কি?
– তাকিয়া আনওয়ার সে…
সেহেরিশ সম্পূর্ণ কথা শেষ করার আগেই আফীফ ডাক দেয় সেই মহিলা গুলোর উদ্দেশ্য।
– এই মেয়ে, কি যেন নাম? ও হে তাকিয়াকে নিয়ে যাও আমার গোপন কক্ষে বন্ধী করো তাকে।আর সেই রুমে আমি ছাড়া সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ!
আফীফের কথায় বাড়ির সবাই চমকে তাকায়।আহনাফ ঢোক গিয়ে সেহেরিশের মলিন মুখের দিকে একবার তাকায়।মহিলা গুলো যখন সেহেরিশকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনি সেহেরিশ আফীফের দিকে থুথু ছুড়ে মারে।কিন্তু চতুর আফীফ সহসা ছিটকে দূরে সরে যায়। যার দরুনে বিন্দুমাত্র থুথু আফীফের গায়ে লাগেনি।সেহেরিশের এমন সাহসী কান্ডে বাড়ির সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে।
সেহেরিশ তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে, আফীফ সেই দৃষ্টিকে সায় দিয়ে বাঁকা হাসতে থাকে।
– আফীফ কি করছো দাদুভাই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটার সাথে এমন করা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। মেয়েটা যা করেছে ভুল করেছে বয়স কতই বা? তেরো কি চৌদ্দ, তুমি এমনটা করো না।
– দাদাজান নিয়ম মানে নিয়ম। আপনি ছোট থেকে আমাকে কঠোর করে তুলেছেন আমিও কঠোর হয়েছি।
আফীফ দ্রুত সামনের দিকে অগ্রসর হয়।তার দিকে তাকিয়ে আহনাফ দেওয়ান আড় চোখে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
– কিসের নিয়ম তোমার?তুমি তো কঠোর হওনি বরং উগ্র হয়েছো।
আহনাফ পেছনে ঘুরে তাকাতেই আফীফ তার সামনে এসে আবার দাড়ায়।দু ঠোঁটে প্রসস্ত হাসি রেখা ঝুলিয়ে বলে,
– আফীফ তার নিজস্ব সম্পদকে আগলে রাখে দাদাজান! তাকিয়ার উপর যাদের অধিকার আছে তারা যদি তাকে নিতে আসে আমি দেবো না।কোন দিন ও না।!এখন এই মূহুর্ত থেকে তাকিয়া আমার সম্পদ সে আমার কাছে থাকবে।
আমার কোন ইচ্ছা অপূর্ণ কর নি আর এটাও করবেনা। যদি হিতাহিত বিপরীত কিছু করো তবে এই গ্রামে যুদ্ধ লেগে যাবে,যুদ্ধ!
আফীফ আবারো দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায় এদিকে আহনাফ দেওয়ান স্তম্ভিত হয়ে আছেন।কি বলবেন তিনি? কি বা করবেন?এই ছেলে যে বড্ড এককাট্টা স্বভাবের।
–
সেহেরিশের সামনে বসে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে আফীফ।দুজনেই দুজনের মুখোমুখি।মেয়েটি মেঝেতে বসে মৃদ্যু শব্দে কেঁদেই যাচ্ছে তার দিকে ঘোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আফীফ দেওয়ান।
– আ..আমাকে.. এখানে বন্ধী করার মানে কী?আপনি অন্যয় করেছেন। আমার কাকাতুয়াকে আপনি মেরেছেন তবে আমায় কেন শাস্তি দিচ্ছেন?
– আমার গায়ে কাঁদা ছুড়েছো কেন তাকিয়া?
আফীফের উলটো প্রশ্নে চমকে যায় মেয়েটি।দু-হাত দিয়ে সামনে কপালে ছুঁয়ে থাকা চুল গুলো পেছনে ঠেলে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– আমার কাকাতুয়াকে কেন মেরেছেন?আমার কাকাতুয়া আপনার কি ক্ষতি করেছিল?তাই আমি কাঁদা ছুড়েছি আপনার গায়ে,যা করেছি বেশ করেছি। ইচ্ছে করছে এখন থু থু মারতে।
সেহেরিশ রাগ দেখিয়ে সত্যি সত্যি থু থু মারতে নিলেই আফীফ বেগবান তার ঠোঁট চেপে ধরে।আকস্মিক কান্ডে সেহেরিশ দেয়ালের সাথে লেপ্টে যায় আর তার উপর ঝুকে যায় আফীফ।আচমকা দেয়ালের সাথে ধাক্কা লাগায় পিঠে অসহ্য ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে নেয় মেয়েটি।আর সেদিকে তাকিয়ে নিজের দৃষ্টিকে আবারো অবরুদ্ধ করে আফীফ।
– তোমায় আমি চিনি!তুমি, তুমি, তুমি আমার খুব কাছের কেউ। না না তোমায় যেতে দেবো না। আমি আমার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে আটকে রাখবো।
আফীফের ফিসফিস কথায় দ্রুত চোখ খুলে সেহেরিশ।
– আমায় ছেড়ে দিন আপনি! এইসব পাগলামি করার মানে কী?আমি আপনাকে চিনিনা।আমি চলে যাবো, চলে যাবো আমি।ছেড়ে দিন আমায়।
সেহেরিশের কথা শেষ হওয়ার আগেই আফীফ তাকে টেনে ঝাপটে ধরে।এতটাই জোরে ধরে যে ছোট্ট সেহেরিশের দম আটকে আসার উপক্রম হয়েছে।ঘন ঘন কাশতে কাশতে একটা সময় নেতিয়ে পড়ে আফীফের বুকে।কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না আফীফ।বরং সমান তালে ফিসফিস করতে থাকে,
– তাকিয়া আমার! তাকিয়া আমার সম্পদ। আমি ছাড়া তাকিয়ার কেউ থাকবে না৷সে আমার হয়ে থাকবে।ছোট্ট তাকিয়া চিন্তা নেই, তোমায় আমি বড় করবো আমার মতো করে।
দরজায় কারো করাঘাত করার শব্দ পেলে।হুশ ফিরে আফীফের। দ্রুত সেহেরিশের নেতিয়ে যাওয়া মুখটি দু-হাতে অবরুদ্ধ করে কপালে গাঢ় করে চুমু খায়।আগলে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।কয়েক সেকেন্ড মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিযে যায়।তার মুখোমুখি সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন আহনাফ দেওয়ান।
– এইসব কী করছো তুমি?আর মেয়েটার সাথে তোমার কী শত্রুতা?
– দাদাজান আমি আজ সকালে শিকারে বের হলে গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি পায়রার দিকে তীর নিক্ষেপ করি কিন্তু তীরটি গিয়ে লাগে তাকিয়ার শখের পাখি কাকাতুয়ার গায়ে।সঙ্গে সঙ্গে পাখিটি মৃতবরণ করে। আর তাকিয়া আমার উপর রেগে ভেজা মাটি নিয়ে ছুড়ে মারে।ভরা গ্রাম বাসীর সামনে আমার সাদা পাঞ্জাবি কাদায় মাখামাখি।এতে কি আমার সম্মানে লাগেনি?তাকে তো ঘটা করে শাস্তি দিতেই হয়!
আফীফের কথা আহনাফ তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।তিনি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন দোষটা আফীফের কিন্তু এখন এই কথা বলতে গেলে কয়েক মিনিটে বিধস্ত হয়ে যাবে দেওয়ান মঞ্জিল।তাই তিনি সম্পূর্ণ কথাটা ঘুরিয়ে দিলেন,
– তা কি শাস্তি দিবে তুমি মেয়েটাকে?
– তাকিয়া আমার কাছেই থাকবে।একদিন দুইদিনের জন্য নয় বরং সারা জীবনের জন্য।তুমি ব্যবস্থা করে দাও সবকিছুর।
আহনাফ দেওয়ান চমকে যায়।মাত্র সতেরো বছর বয়সের একটি ছেলেকে তার বাবা-মা সহ গ্রামবাসী সবাই যেমন সম্মান করে ঠিক তেমন ভয় পায়।আর আফীফের কথার উলটো পিঠে কথা বলার সাহস আহনাফ দেওয়ানের নেই।তবুও সব সংকোচ উপেক্ষা করে গমগম সুরে আফীফকে বলেন,
– হবে না। এমনটা কোন দিন হবে না।আমি যতটুকু খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি মেয়েটি দেশের বাইরে থাকে।সে এখানে তার ফুফির সাথেই এসেছে আর তার ফুফি পাশের গ্রামে থাকে।জমিদারের নাতি যে মেয়েটিকে তুলে এনেছে সেই খবর পেয়ে গেছে মেয়েটির ফুফি। তিনি খুব শীঘ্রই এই বাড়ির দারপ্রান্তে পৌছে যাবে।তখন কী জবাব দিবে তুমি?এমন পাগলামো না করে মেয়েটিকে যেতে দাও।
আফীফ আরক্ত দৃষ্টিতে তার দাদাজানের দিকে তাকালে তিনি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ রাগ দেখিয়ে বড় বড় পা ফেলে সেখান থেকে চলে যায়।এবং ঘরের বাইরে গিয়ে দৌবারিকদের নির্দেশ দেয়।এই বাড়ির আঙিনায় কোন মহিলা কিংবা নতুন কোন অথিতির প্রবেশ নিষিদ্ধ।তাকিয়াকে নিজের কাছে রাখার সকল প্রস্তুতি সে নিজ হাতেই সম্পূর্ণ করছে।
#চলবে….
#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১
(