সুঁই সুতোর আসক্তি পর্ব -৩১

#সুঁই_সুতোর_আসক্তি
#পর্বঃ৩১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

১ মাস পর,

আদ্রিক এখন বাড়িতে নেই।এই কয়েকদিনে আদ্রিক আর কায়াসার মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়েছে।কায়াসা আর আদ্রিক এখন এক ঘরেই থাকে তবে কায়াসা বিছানায় আর আদ্রিক সোফায়।

কায়াসা আজ ঠিক করেছে সে বাড়ির বন্ধ রুমগুলো পরিষ্কার করবে।তাই সুমি নিচে আর কায়াসা উপরের রুমগুলো পরিষ্কার করা শুরু করে দিলো।দুটো রুম পরিষ্কার করার পর কায়াসা একদম শেষের দিকের রুমটার কাছে এসে পৌঁছায়।আগে যখন কায়াসা এদিকে এসেছিল তখন রুমটা বন্ধ ছিল,আজও বন্ধ ভেবে কায়াসা চলে যেতে নিলে পরেই সে খেয়াল করে না রুমটাতো খোলাই আছে।কায়াসাও খোলা দেখে পানির বালতি আর মোছার কাপড়টা নিয়ে দরজা টেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে।ভেতরে পুরো অন্ধকার,কায়াসা বাতলি আর কাপড়টা সাইডে রেখে অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে সুইচটা খুঁজে পাই।লাইট জ্বালিয়ে কায়াসা যখন পেছনে ফেরে তখন তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।পুরো রুম জুরে কায়াসা ছবি।দেয়ালে,টেবিলে এমনকি দড়ি ঝুলিয়ে তার মধ্যেই ক্লিপ দিয়ে কায়াসা ছবি আটকানো।নিজের এতো ছবি তাও আবার আদ্রিকের বাড়িতে এটা দেখে কায়াসা অনেকটাই অবাক।ছবিগুলো দেখতে দেখতে কায়াসা দেখে দেয়ালে অনেকগুলো টিভি লাগানো।কায়াসা এদিক-ওদিক হাতড়ে একটা সুইচ পাই,সুইচটা টিপ দেওয়ার পরেই সবগুলো টিভির চালু হয়ে যায় কিন্তু স্ক্রিনে তাকিয়ে তো কায়াসার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে।কারণ প্রতিটা স্ক্রিনে তার বাড়ির এক একেকটা জায়গার দৃশ্য ফুটে উঠছে।

এতোকিছু দেখার পর কায়াসা এবার বুঝতে পারে আদ্রিকই তাহলে সুতো।এবার কায়াসা বুঝতে পেরেছে এই ২ মাসে সুতোর কোন খবর নেই কেন।আদ্রিকের সাথে তার বিয়ে হয়েছে এটা নিশ্চয়ই সে জানে তাহলে কেন কিছু করলোনা।এতোদিনে কায়াসা বুঝতে পেরেছে সুতো কিছু করবে কেন তার সাথেই তো কায়াসার বিয়েটা হয়েছে।কায়াসার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।সে ভাবতেই পারছেনা আদ্রিক তার সাথে এতোদিন এতোটা নিখুঁত অভিনয় করে গিয়েছে।কায়াসা নিজেকে শান্ত করে এদিক-ওদিক খুঁজতে শুরু যদি আদ্রিকের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পেয়ে যায় এই আশায়।

কার্বাডে খুঁজতে খুঁজতে কায়াসা একটা ফাইল দেখতে পাই।কায়াসা তাড়াতাড়ি ফাইলটা খুলে চেক করতে থাকে।কিন্তু ফাইলটা পুরোটা দেখে কায়াসা আরো বড় ঝটকা খায়।এই ফাইলে কারো ডেথ সার্টিফিটেক সহ তার সম্পর্কে আরো অনেক কিছু লেখা আছে।কায়াসা ডেথ সার্টিফিকেটটা ভালো করে দেখতে শুরু করে।নামের জায়গায় লেখা আছে “নবনী ইসলাম”।মৃত্যু ২৯/০৩/২০০৫।কায়াসা এবার মৃত্যুর কারণ দেখা।সিঁড়ি থেকে পা পিচলে পড়ে গিয়েছে যার ফলে মাথায় আঘাত লাগার কারণে নাকি মৃত্যু হয়েছে।কিন্তু কায়াসা আরেকটু নিচে নেমে যা সেটা দেখে তার পায়ের তলার মাটি সরে যায়।

বিছানায় চুপচাপ বসে আছে কায়াসা,সে আদ্রিকের আসার অপেক্ষা করছে।অবশেষে কায়াসার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আদ্রিক বাড়িতে আসে।আদ্রিক কায়াসাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু-কুচকে তার দিকে তাকাই তবে এখন কিছু বলেনা,সে ফ্রেশ হতে চলে যায়।আদ্রিক ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে কায়াসা এখনো ওভাবেই বসে আসে।মাথা মুছতে মুছতে আদ্রিক কায়াসাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে।কায়াসা একদম শান্তদৃষ্টিতে আদ্রিকের দিকে তাকাই।কায়াসাকে এভাবে তাকাতে দেখে আদ্রিকের ভয় হতে লাগে।

” কায়াসা কিছু কি হয়েছে?”

কায়াসা বিছানা থেকে উঠে টেবিল থেকে ফাইলটা নিয়ে আসে।

” এটা কি মিস্টার আদ্রিক?”

” কি?”

” আর কত নাটক করবেন আপনি আমার সাথে?”

” কি..স..ব ব..ল..ছো.. তু..মি..?”

” কিসব বলছি আমি?এটা ডেথ ফাইল যেটা আমি আপনার ওই রুম থেকে পেয়েছি।”

কায়াসার কথা শুনে আদ্রিক ভীত দৃষ্টিকে কায়াসার দিকে তাকাই।

” আমার আম্মু ডেথ সার্টিফিকেট আপনার কাছে কি করে এলো?” চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে কায়াসা।

” কায়াসা তুমি প্লিজ একটু শান্ত হও।আমার কথাটা আগে শোন তারপর না হয়….”

” ওকে ঠিক আছে।শান্ত হলাম আমি।আপনি আপনার কথা শুরু করুন।আমিও দেখি আপনি আর কত নাটক করতে পারেন আর কত মিথ্যা কথা বলতে পারেন।”

” প্রথমতো এটা বলো তুমি কি করে জানলে এটা তোমার আম্মুর ডেথ সার্টিফিকেট?আমি যতটুকু জানি তুমি তোমার আম্মুর আসল নাম জানোনা।তোমার আব্বু কোনদিনও ওনার সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলেনি।”

আদ্রীকের কথা শুনে কায়াসা হাসে।

” হ্যাঁ আমি হয়তো আমার আম্মুর পুরো নাম জানিনা কিন্তু আব্বুর নামতো জানি।ছোট থেকে আব্বুর নামেই নিজেকে চিনেছি,আশেপাশের সবাই আমাকে চিনেছে তাহলে আব্বুর নাম কি করে আমি ভুলতে পারি।আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন ডেথ সার্টিফিকেটে স্বামীর নামও লেখা থাকে।এবার বলুন আমার আম্মু ডেথ সার্টিফিকেট আপনার কাছে কি করে এলো?আর আপনি যদি আমার আম্মুকে আগে থেকেই চিনে থাকেন তাহলে আমাকে বললেন না কেন?”

” তুমি যখন সত্যিটা জেনেই গিয়েছো তখন আর আমি কিছু লুকাবোনা।হ্যাঁ আমি তোমার আম্মুকে আগে থেকে চিনতাম তবে তা বেশি না ৩/৪ বছর আগে থেকে আর হ্যাঁ আমিই সুতো,আমিই এশান আর আমিই আদ্রিক।মনে আছে তুমি একদিন আমাকে আমার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলে?আজ আমি তোমাকে আমার জীবনের সব না বলা কথাগুলো বলবো।”

কিছুক্ষণ থেমে আদ্রিক আবারো বলতে শুরু করে।

” আমার আপন বলতে শুধু আমার বাবা-মাই ছিল।আমার বাবা-মায়ের লাভ ম্যারেজ ছিল।তারা দুজন পালিয়ে বিয়ে করেছিল বিধায় তাদের সাথে আমার নানুবাড়ি বা দাদুবাড়ির কারো যোগাযোগ ছিলনা।আমার মা তার বিয়ের দিনই আমার বাবার সাথে পালিয়ে এই ঢাকা শহরে চলে এসেছিল আর তাকে সাহায্য করেছে আমার মায়ের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী।ভালোই চলছিল আমার বাবা-মায়ের জীবন।সময় ঘনিয়ে যেতে লাগলো,আমার বাবার উন্নতিও হতে লাগলো তাদের বিয়ের ২ বছর পর আমার জন্ম।আমার জন্মের ৩ বছর পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল কিন্তু আস্তে আস্তে আমার বাবা পাল্টে যে শুরু করে।আমাদের আর আগের মতো সময় দেয়না,কথাও ঠিকমতো বলতোনা।এরকম করে কেটে যায় আরো দেড় বছর।একদিন আমার মা জানতে পারে আমার বাবার নাকি অন্য এক নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে।সেদিন আমার মা তার সেই বান্ধবীকে ফোন করে প্রচুর কান্না করেছিল।বলে রাখা ভালো মায়ের সেই বান্ধবীর সাথে মায়ের প্রায় ৪ বছর পর কথা হয়েছে।আমি জন্ম হওয়ার পর তাদের মাঝে কথা আস্তে আস্তে কম হতে শুরু করে,একসময় বন্ধ হয়ে যায়।আমার যখন ৫ বছর বয়স তখন আমার বাবা-মায়ের ডির্ভোস হয়ে যায়।মা আমাকে নিয়ে থাকতো।যেহেতু মা পড়াশোনা শেষ করেছিল তাই উনার চাকরি পেতে অসুবিধা হয়নি।”

এতটুকু বলে আদ্রিক থাকে কিন্তু কায়াসা এরপরের কথাগুলো শোনার জন্য আদ্রিকের দিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কায়াসার উৎসাহ দেখে আদ্রিক মুচকি হাসে।তারপর আবারো বলতে শুরু করে।

” তখন আমার সাড়ে আট বছর বয়স।একদিন মাকে তার সেই বান্ধবী ফোন করে।সেদিন মা অনেক খুশি হয়েছিল।তারা সেদিন অনেক কথা বলে কিন্তু মা জানতোনা যে এটাই তাদের শেষ কথা হতে যাচ্ছে।এরপর কেটে যায় আরো ১০ বছর।তখন আমার ১৯ বছর বয়স,আমি মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম।তখন মা হঠাৎ জানতে পারে তার সেই প্রিয় বান্ধবী নাকি আরো ১০ বছর আগেই মারা গিয়েছে,তাও তার সাথে কথা বলার ১ সপ্তাহ পরেই।এটা শোনার পর সেদিন আমার মা প্রচুর কান্না করেছিল।অনেক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে মায়ের সেই বান্ধবীর নাকি একটা মেয়ে আছে আর মায়ের সেই বান্ধবীর সাথে যার বিয়ে হয়ে সে আর কেউ না আমার মায়ের সাথে যার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার সাথেই নাকি ওনার বিয়ে হয়েছে।”

এতটুকু বলে আবারো থামে আদ্রিক।কায়াসা আবারো উৎসুক দৃষ্টিতে আদ্রিকে মুখপানে তাকিয়ে আছে।আদ্রিক কায়াসার দিকে তাকাই।

” তুমি জানো আমার মায়ের সেই বান্ধবীটা কে ছিল?”

” আমার আম্মু?” দ্বিধা নিয়ে বলে কায়াসা।

” তুমি আসলেই অনেক বুদ্ধিমতী।হ্যাঁ তোমার আম্মুই ছিল আমার মায়ের সেই প্রিয় বান্ধবী।১ বছর অনেক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে তোমার আম্মু মৃত্যু কোন সাধারণ মৃত্যু ছিলনা।”

” মানে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে কায়াসা।

চলবে…..

(সন্ধ্যার দিকে আরো একটা পর্ব পোস্ট করা হবে,আশা করি পড়বেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here